প্রসঙ্গ: সংস্কার

সম্পাদকীয়
প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৮: ০৮

রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে ছয়টি কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানকে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়, এরশাদ সরকারের সময় কমিশন গঠন করে সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু হয়নি। এবার কি এমন হবে? উত্তরে রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘এ সরকার হলো গণ-অভ্যুত্থানের ফসল। সেখানে দুটি মূল শব্দ ছিল, একটি হচ্ছে বৈষম্যবিরোধী, আরেকটি হচ্ছে সংস্কার। এটির উদ্দেশ্য হচ্ছে, একটি প্রকৃত গণতন্ত্রের দিকে দেশকে নিয়ে যাওয়া। যেহেতু এরশাদ সরকারের সঙ্গে আমাদের ফাউন্ডেশনেরই অনেক পার্থক্য আছে, তাই তার সঙ্গে আমাদের কর্মপদ্ধতি, কর্মপরিকল্পনাকে কোনোভাবে মিলিয়ে ফেলব না।’

‘সুনির্দিষ্ট সংস্কার ও সংশোধনীর পরই ভোট’ শিরোনামে আজকের পত্রিকায় ১৩ সেপ্টেম্বর এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। 
আমরা মনে করি, যেকোনো কর্মপদ্ধতি ও কর্মপরিকল্পনার আগে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া উচিত। একসময় আমাদের সমাজের মূল শক্তি ছিল যূথবদ্ধতা, এখন লক্ষ করা যায় মানুষের ক্রমবর্ধমান আত্মকেন্দ্রিকতা। আজ আমরা ভুলে গেছি যে আমাদের প্রত্যেকের অগ্রগতি ও নিরাপত্তা একার ওপর নির্ভর করে না, তা নির্ভর করে যে বৃহত্তর কাঠামোর আমরা অংশ, তার ওপরে। আজকাল আর্থিক সাফল্যকেই আমরা একজন সফল মানুষের নির্ণায়ক বলে মেনে নিয়েছি। বিত্তের মাপকাঠিতেই আজ আমরা মানুষের মূল্যায়ন করছি।

শিক্ষা, মানবিকতা, সংস্কৃতিমনস্কতা, ভদ্রতা-শোভনতা—এগুলোকে আমরা আর মনুষ্য বিচারের মাপকাঠি বলে ভাবি না। ফলে মানুষের বহু সুকুমারবৃত্তিকে আমরা বিসর্জন দিয়েছি, তাদের অপ্রাসঙ্গিক ও মূল্যহীন করে ফেলেছি। 

সমাজে সন্ত্রাস ও সহিংসতার বিস্তৃতি ঘটেছে। আমাদের সহনশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কমেছে। মানুষের ন্যূনতম মানবিক মর্যাদা দিতেও আমরা ভুলে যাই। যেকোনো মতভেদ, মতানৈক্য ও বিরোধ নিষ্পত্তিতে আমরা আজ কথাবার্তার পরিবর্তে শক্তিকেই ব্যবহার করি—পেশিশক্তি, বিত্তশক্তি, ক্ষমতার শক্তি। তার পথ ধরেই এসেছে অস্ত্রায়ণ, সহিংসতা আর সন্ত্রাস। যেকোনো মতবিরোধ, মতানৈক্য আর মতভেদে আমরা আশ্রয় নিই সহিংসতা ও সন্ত্রাসের। 

সময়, ইতিহাস এবং প্রেক্ষাপটের পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের এই বদলে যাওয়া মনমানসিকতা উদ্বেগজনক। সবচেয়ে বড় কথা, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ তার প্রতিষ্ঠাকালীন মূলনীতিগুলো থেকে সরে এসেছে। 

তাই সংস্কারের আগে মনে রাখতে হবে, জাতীয়তাবাদ আমাদের বাঙালি আত্মসত্তার জন্য আবশ্যিক শর্ত। আত্মসত্তার বোধ একটি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য দরকার। আবার গণতন্ত্র ছাড়া স্বাধীনতা বা মুক্তিকে একটি টেকসই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা যায় না। একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা বা ধর্মীয় উদারতা, মানবিক অধিকার, সামাজিক ন্যায্যতাও সমতার জন্য অত্যাবশ্যকীয়। 

সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মকেন্দ্রিক উগ্রবাদী অপশক্তিকে আশকারা দিয়ে উদারপন্থী বাঙালিত্বকে বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। সামাজিক ন্যায্যতা আজ মুখে মুখেই আমরা বলি, আমাদের কাজে তার প্রতিফলন দেখা যায় না। চিন্তায়, দৃষ্টিভঙ্গিতে ও কাজে আমরা

ধর্মনিরপেক্ষতা বিসর্জন দিয়েছি বলেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা হচ্ছে, তাঁদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। এই বিষয়গুলো বিবেচনায় থাকলে সংস্কার কার্যক্রম ফলপ্রসূ হতে পারে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত