মহিউদ্দিন খান মোহন
কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর ‘দেশে বিদেশে’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, ‘কুইনাইন জ্বর সারাবে, কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে?’ ওই সময়ে কুইনাইন ছিল ম্যালেরিয়া জ্বরের মহৌষধ। তবে তা এতই তেতো যে মুখে দেওয়াই ছিল মুশকিল। সৈয়দ মুজতবা আলী বলতে চেয়েছেন, কুইনাইন খেলে তো জ্বর সেরে যাবে। কিন্তু কুইনাইনের তীব্র তেতো স্বাদ থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে কীভাবে?
মানুষের জীবনে নানা ধরনের সমস্যা আসে। সেই সব সমস্যার সমাধানে মানুষ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। তাতে সমস্যার আপাতসমাধান হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা নতুন সমস্যার উদ্ভব ঘটায়। কখনো কখনো নতুন সমস্যা এমনই প্রকট আকার ধারণ করে যে, এর সমাধান দুরূহ হয়ে পড়ে।
সমস্যা সব ক্ষেত্রেই উদ্ভব হতে পারে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রীয় কিংবা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেওয়া বিচিত্র নয়; বরং অত্যন্ত স্বাভাবিক। সারা পৃথিবীতে রাজনৈতিক সমস্যা বিদ্যমান। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও রাজনৈতিক সমস্যা রয়েছে; বরং বলা যায় তা একটু বেশি মাত্রায়ই আছে। বিশেষত নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে দেশের দুই প্রধান দলের ‘সুমেরু-কুমেরু’ অবস্থান মানুষের ‘উচ্চ রক্তচাপজনিত’ রোগের রূপ ধারণ করেছে; যা নির্দিষ্ট মাত্রায় ওষুধ সেবনে নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলেও সম্পূর্ণ নিরাময় হয় না কখনোই।
একবার এ-দল নির্বাচন বয়কট করে তো আরেকবার সে-দল বর্জন করে। এর ফলে দুই দশক ধরে দেশের জনসাধারণ ভোট-উৎসবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নানা ইস্যুতে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানালেও নির্বাচন পদ্ধতির প্রশ্নে তাঁরা নিজেরাই ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারছেন না। ফলে সমস্যার অন্ধকার কাটছে না। এ এক নিদারুণ হতাশার ব্যাপার!
এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও তাই ঘটে গেল। দেশের রাজনীতির বড় দুই অংশী দল ঐকমত্যে উপনীত না হতে পারায় একই দৃশ্যের অবতারণা হলো। ভোটযুদ্ধের ময়দানে অনুপস্থিত থাকল বিএনপি। ফলে আশঙ্কা সৃষ্টি হলো ভোটের লড়াইটা একতরফা হবে এবং তা জমবে না। এই আশঙ্কা অমূলক ছিল না। কেননা সরকারের পরম সুহৃদ ভগ্নস্বাস্থ্যের জাতীয় পার্টিকে নিয়ে যে জমজমাট লড়াই সম্ভব নয়, সরকার সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিল।
তাই উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে আপাৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে সরকারি দল আওয়ামী লীগ গ্রহণ করে এক অভিনব পন্থা। তারা নিজ দলের মনোনয়নের বাইরে দলের আগ্রহী নেতাদের ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এটা ছিল নির্বাচনের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। কোনো নির্বাচনে একই দলের নেতারা কেউ ‘দল মনোনীত’ আবার কেউ দলের ‘অনুমতিপ্রাপ্ত স্বতন্ত্র’ প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতান্ত্রিক বিধান মতে, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে তাঁর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
অতীতে আওয়ামী লীগও তাই করেছে। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ঘটায় দলটি। দলের কেন্দ্রীয় কিংবা স্থানীয় পর্যায়ের সাংগঠনিক পদে বহাল থেকেই বিপুলসংখ্যক নেতা দল মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। কিন্তু দল তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি; বরং সহযোগিতা করেছে। বিএনপির বর্জনের মুখে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও উৎসবমুখর করতে এর কোনো বিকল্পও ছিল না।
দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জিতিয়ে এনে আওয়ামী লীগ উদ্ভূত সমস্যার আপাতসমাধান করতে সক্ষম হলেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। এর মাধ্যমে দলের স্থানীয় পর্যায়ে যে দ্বন্দ্ব-কোন্দল এবং রেষারেষি সৃষ্টি হলো, তা স্থায়ী রূপ নিতে পারে। এমনিতেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ লেগেই ছিল।
বিগত দিনে সেই সব খবর গণমাধ্যমেও এসেছে। দ্বন্দ্ব-কোন্দলের কারণে কিংবা আধিপত্য বিস্তার নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এবার মনোনয়নপ্রাপ্ত ও বঞ্চিত নেতাদের মধ্যে সেই দ্বন্দ্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যেসব এলাকায় মনোনয়নবঞ্চিতরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন, একই দলের হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যে শত্রুতার সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন চলাকালীন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে, যাঁরা সবাই আওয়ামী লীগেরই নেতা, সংঘাত-সংঘর্ষ ও হানাহানির ঘটনা ঘটেছে।
নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে আওয়ামী লীগ যখন দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ উন্মুক্ত করে দেয়, অনেকেই তখন মন্তব্য করেছিলেন, এই সিদ্ধান্ত দলটির জন্য বুমেরাং হতে পারে। নির্বাচন চলাকালে এবং পরবর্তী সময়ের ঘটনায় সে আশঙ্কা অনেকাংশেই সত্যে পরিণত হয়েছে। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, দেশের ৩৯টি জেলায় নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় চার শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৬০ জন হয়েছেন গুলিবিদ্ধ।
৬ জন নিহত এবং তিন শতাধিক বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা-অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী নেতাদের কর্মী-সমর্থকদের সহিংসতা দলটির অভ্যন্তরে নতুন সংকট সৃষ্টি করবে নিঃসন্দেহে।
নির্বাচনকেন্দ্রিক সাময়িক উত্তেজনার এই সংঘাত-সংঘর্ষ যদি স্থায়ী রূপ নেয়, তাহলে সেটা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। অপরদিকে যাঁরা ‘দলীয় স্বতন্ত্র’ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন, সংসদে তাঁদের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। তাঁরা কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন, তা নিয়ে ছিল ধোঁয়াশা। তবে গত ২৮ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে স্বতন্ত্র এমপিদের বৈঠকের পর সে ধোঁয়াশা অনেকটাই কেটে গেছে। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র এমপিদের তাঁর ডান-বাম দুই হাত হিসেবে উল্লেখ করে তাঁদের সবাইকে নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। বৈঠকে স্বতন্ত্রদের ভাগের ১০ জন নারী এমপির বিষয়েও কথা হয়েছে।
সিদ্ধান্ত হয়েছে, ওই ১০ আসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাঁদের মনোনয়ন দেবেন, স্বতন্ত্র এমপিরা তাঁদেরই সমর্থন দেবেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে স্বতন্ত্র এমপিদের বৈঠকের পর এ বিষয়ে সৃষ্ট জটিলতা অনেকটাই কেটে গেছে। বৈঠকের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুসারে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা সরকারি দলে সরাসরি যোগ না দিয়েও সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করবেন। ফলে উভয় কূল রক্ষা করে সংসদীয় রাজনীতিতে নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো বলা যায়।
অপরদিকে জাতীয় পার্টির ‘ওরা ১১ জন’ প্রধান বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃত হওয়ায় আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দিয়ে ‘দলীয় বিরোধী দলের’ ভূমিকা পালন করানোরও আর দরকার পড়ল না। ফলে এটা বলা যায়, নির্বাচনকে উৎসবমুখর না হওয়ার জ্বর সারানোর জন্য আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্রের যে কুইনাইন সেবন করেছিল, তার তেতো স্বাদও তারা বেশ ভালোভাবেই সামাল দিল। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বলিষ্ঠতা এবং দলীয় নেতাদের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না।
রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, বিপুলসংখ্যক ‘দলীয় স্বতন্ত্র সদস্য’ নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা আরেক দিকে দিয়ে আওয়ামী লীগের জন্য শাপেবর হয়েছে। দলের যে ৫৮ জন নেতা স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন, নিঃসন্দেহে তাঁরা এলাকায় গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয়।
এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ বেশ কিছুসংখ্যক যোগ্য ও জনপ্রিয় নেতারও সন্ধান পেল। আগামী দিনে তাঁদের কাজে লাগিয়ে দলকে শক্তিশালী এবং পরবর্তী নির্বাচনে অধিকতর যোগ্য প্রার্থী বাছাই করে মনোনয়ন দিতে পারবে। সুতরাং এটা বলা যায়, স্বতন্ত্র তেতো কুইনাইনও আওয়ামী লীগ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেই গলাধঃকরণ করে ফেলতে পারল।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর ‘দেশে বিদেশে’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, ‘কুইনাইন জ্বর সারাবে, কিন্তু কুইনাইন সারাবে কে?’ ওই সময়ে কুইনাইন ছিল ম্যালেরিয়া জ্বরের মহৌষধ। তবে তা এতই তেতো যে মুখে দেওয়াই ছিল মুশকিল। সৈয়দ মুজতবা আলী বলতে চেয়েছেন, কুইনাইন খেলে তো জ্বর সেরে যাবে। কিন্তু কুইনাইনের তীব্র তেতো স্বাদ থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে কীভাবে?
মানুষের জীবনে নানা ধরনের সমস্যা আসে। সেই সব সমস্যার সমাধানে মানুষ তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। তাতে সমস্যার আপাতসমাধান হলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা নতুন সমস্যার উদ্ভব ঘটায়। কখনো কখনো নতুন সমস্যা এমনই প্রকট আকার ধারণ করে যে, এর সমাধান দুরূহ হয়ে পড়ে।
সমস্যা সব ক্ষেত্রেই উদ্ভব হতে পারে। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রীয় কিংবা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমস্যা দেখা দেওয়া বিচিত্র নয়; বরং অত্যন্ত স্বাভাবিক। সারা পৃথিবীতে রাজনৈতিক সমস্যা বিদ্যমান। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও রাজনৈতিক সমস্যা রয়েছে; বরং বলা যায় তা একটু বেশি মাত্রায়ই আছে। বিশেষত নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে দেশের দুই প্রধান দলের ‘সুমেরু-কুমেরু’ অবস্থান মানুষের ‘উচ্চ রক্তচাপজনিত’ রোগের রূপ ধারণ করেছে; যা নির্দিষ্ট মাত্রায় ওষুধ সেবনে নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলেও সম্পূর্ণ নিরাময় হয় না কখনোই।
একবার এ-দল নির্বাচন বয়কট করে তো আরেকবার সে-দল বর্জন করে। এর ফলে দুই দশক ধরে দেশের জনসাধারণ ভোট-উৎসবের আনন্দ থেকে বঞ্চিত। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নানা ইস্যুতে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানালেও নির্বাচন পদ্ধতির প্রশ্নে তাঁরা নিজেরাই ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারছেন না। ফলে সমস্যার অন্ধকার কাটছে না। এ এক নিদারুণ হতাশার ব্যাপার!
এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়েও তাই ঘটে গেল। দেশের রাজনীতির বড় দুই অংশী দল ঐকমত্যে উপনীত না হতে পারায় একই দৃশ্যের অবতারণা হলো। ভোটযুদ্ধের ময়দানে অনুপস্থিত থাকল বিএনপি। ফলে আশঙ্কা সৃষ্টি হলো ভোটের লড়াইটা একতরফা হবে এবং তা জমবে না। এই আশঙ্কা অমূলক ছিল না। কেননা সরকারের পরম সুহৃদ ভগ্নস্বাস্থ্যের জাতীয় পার্টিকে নিয়ে যে জমজমাট লড়াই সম্ভব নয়, সরকার সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিল।
তাই উদ্ভূত সমস্যার সমাধানে আপাৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে সরকারি দল আওয়ামী লীগ গ্রহণ করে এক অভিনব পন্থা। তারা নিজ দলের মনোনয়নের বাইরে দলের আগ্রহী নেতাদের ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এটা ছিল নির্বাচনের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন ঘটনা। কোনো নির্বাচনে একই দলের নেতারা কেউ ‘দল মনোনীত’ আবার কেউ দলের ‘অনুমতিপ্রাপ্ত স্বতন্ত্র’ প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর গঠনতান্ত্রিক বিধান মতে, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে তাঁর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
অতীতে আওয়ামী লীগও তাই করেছে। কিন্তু এবার ব্যতিক্রম ঘটায় দলটি। দলের কেন্দ্রীয় কিংবা স্থানীয় পর্যায়ের সাংগঠনিক পদে বহাল থেকেই বিপুলসংখ্যক নেতা দল মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। কিন্তু দল তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি; বরং সহযোগিতা করেছে। বিএনপির বর্জনের মুখে নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও উৎসবমুখর করতে এর কোনো বিকল্পও ছিল না।
দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জিতিয়ে এনে আওয়ামী লীগ উদ্ভূত সমস্যার আপাতসমাধান করতে সক্ষম হলেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী হওয়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। এর মাধ্যমে দলের স্থানীয় পর্যায়ে যে দ্বন্দ্ব-কোন্দল এবং রেষারেষি সৃষ্টি হলো, তা স্থায়ী রূপ নিতে পারে। এমনিতেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে বিবাদ-বিসংবাদ লেগেই ছিল।
বিগত দিনে সেই সব খবর গণমাধ্যমেও এসেছে। দ্বন্দ্ব-কোন্দলের কারণে কিংবা আধিপত্য বিস্তার নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটেছে। এবার মনোনয়নপ্রাপ্ত ও বঞ্চিত নেতাদের মধ্যে সেই দ্বন্দ্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যেসব এলাকায় মনোনয়নবঞ্চিতরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন, একই দলের হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যে শত্রুতার সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচন চলাকালীন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে, যাঁরা সবাই আওয়ামী লীগেরই নেতা, সংঘাত-সংঘর্ষ ও হানাহানির ঘটনা ঘটেছে।
নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করতে আওয়ামী লীগ যখন দলের নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ উন্মুক্ত করে দেয়, অনেকেই তখন মন্তব্য করেছিলেন, এই সিদ্ধান্ত দলটির জন্য বুমেরাং হতে পারে। নির্বাচন চলাকালে এবং পরবর্তী সময়ের ঘটনায় সে আশঙ্কা অনেকাংশেই সত্যে পরিণত হয়েছে। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, দেশের ৩৯টি জেলায় নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় চার শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৬০ জন হয়েছেন গুলিবিদ্ধ।
৬ জন নিহত এবং তিন শতাধিক বাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলা-অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী নেতাদের কর্মী-সমর্থকদের সহিংসতা দলটির অভ্যন্তরে নতুন সংকট সৃষ্টি করবে নিঃসন্দেহে।
নির্বাচনকেন্দ্রিক সাময়িক উত্তেজনার এই সংঘাত-সংঘর্ষ যদি স্থায়ী রূপ নেয়, তাহলে সেটা আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। অপরদিকে যাঁরা ‘দলীয় স্বতন্ত্র’ হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন, সংসদে তাঁদের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছিল। তাঁরা কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন, তা নিয়ে ছিল ধোঁয়াশা। তবে গত ২৮ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে স্বতন্ত্র এমপিদের বৈঠকের পর সে ধোঁয়াশা অনেকটাই কেটে গেছে। প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগ ও স্বতন্ত্র এমপিদের তাঁর ডান-বাম দুই হাত হিসেবে উল্লেখ করে তাঁদের সবাইকে নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। বৈঠকে স্বতন্ত্রদের ভাগের ১০ জন নারী এমপির বিষয়েও কথা হয়েছে।
সিদ্ধান্ত হয়েছে, ওই ১০ আসনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাঁদের মনোনয়ন দেবেন, স্বতন্ত্র এমপিরা তাঁদেরই সমর্থন দেবেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে স্বতন্ত্র এমপিদের বৈঠকের পর এ বিষয়ে সৃষ্ট জটিলতা অনেকটাই কেটে গেছে। বৈঠকের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত অনুসারে স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা সরকারি দলে সরাসরি যোগ না দিয়েও সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করবেন। ফলে উভয় কূল রক্ষা করে সংসদীয় রাজনীতিতে নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো বলা যায়।
অপরদিকে জাতীয় পার্টির ‘ওরা ১১ জন’ প্রধান বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃত হওয়ায় আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দিয়ে ‘দলীয় বিরোধী দলের’ ভূমিকা পালন করানোরও আর দরকার পড়ল না। ফলে এটা বলা যায়, নির্বাচনকে উৎসবমুখর না হওয়ার জ্বর সারানোর জন্য আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্রের যে কুইনাইন সেবন করেছিল, তার তেতো স্বাদও তারা বেশ ভালোভাবেই সামাল দিল। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের বলিষ্ঠতা এবং দলীয় নেতাদের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না।
রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, বিপুলসংখ্যক ‘দলীয় স্বতন্ত্র সদস্য’ নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা আরেক দিকে দিয়ে আওয়ামী লীগের জন্য শাপেবর হয়েছে। দলের যে ৫৮ জন নেতা স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন, নিঃসন্দেহে তাঁরা এলাকায় গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয়।
এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ বেশ কিছুসংখ্যক যোগ্য ও জনপ্রিয় নেতারও সন্ধান পেল। আগামী দিনে তাঁদের কাজে লাগিয়ে দলকে শক্তিশালী এবং পরবর্তী নির্বাচনে অধিকতর যোগ্য প্রার্থী বাছাই করে মনোনয়ন দিতে পারবে। সুতরাং এটা বলা যায়, স্বতন্ত্র তেতো কুইনাইনও আওয়ামী লীগ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গেই গলাধঃকরণ করে ফেলতে পারল।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৮ দিন আগে