চিররঞ্জন সরকার
ক্রমেই দেখা যাচ্ছে, জনসমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যেই রাজনীতিকদের একাংশ দুর্বিনীত, অসংযত, হিংস্র আচরণে মত্ত হচ্ছেন। আর সেই হিংস্রতার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সেখানে ‘প্রতিপক্ষ’ ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস ও ক্ষতিকর কর্মসূচি থেকে বিএনপি সরে আসছে না। এতে শঙ্কা জাগছে, আবারও কি বিএনপি ২০১৪-১৫ সালের মতো লাগাতার অবরোধের পথে পা বাড়াবে? বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট সেই সময় টানা ২৮০ দিন অবরোধ পালন করেছিল। তখন অবরোধের মধ্যে নির্দিষ্ট মেয়াদে হরতালেরও ডাক দেওয়া হতো। সরকার পতন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ ও হরতালের ডাক দেয় বিএনপি জোট। বাস্তবে এই হরতাল ও অবরোধের কার্যকারিতা দেখা না গেলেও সেই অবরোধের ২৮০ দিন অতিক্রম করলেও বিএনপি জোট আনুষ্ঠানিকভাবে অবরোধ প্রত্যাহার করেনি। সহিংস আন্দোলন করেও সেই সময় কোনো দাবি আদায় করা সম্ভব হয়নি। উল্টো বিএনপি রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়ার পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
আন্দোলন-সংগ্রাম, প্রতিবাদ, সমালোচনা, বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন ইত্যাদি যেকোনো রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য। সাংবিধানিক অধিকার। দলের নীতি-আদর্শ বাস্তবায়ন করতে এবং ক্ষমতাসীন দলের গণবিরোধী কাজ ঠেকাতে রাজনৈতিক দলগুলোকে নানা রকম তৎপরতা চালাতে হয়। কখনো তারা অসহযোগের মতো ‘চরম’ কর্মসূচিও গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু বিএনপি এখন যা করছে, এর কোনো তল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
দলটির পক্ষ থেকে প্রতিদিন কর্মসূচি পালনের নানা রকম ভিডিও পাঠানো হয় গণমাধ্যমে। এর মধ্যে রয়েছে সীমিতসংখ্যক নেতা-কর্মীর ঝটিকা মিছিল। যদিও বাস্তবে নেতা-কর্মীদের এসব ক্ষণস্থায়ী ঝটিকা মিছিল রাজপথে তেমন একটা প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। হরতাল-অবরোধের প্রভাব যেমন ক্রমেই কমে আসছে, তেমনি নির্বাচনের দিকেও বীর বিক্রমে এগিয়ে চলেছে আওয়ামী লীগ।
প্রশ্ন হলো, এবারও যদি ক্ষমতাসীনেরা বিএনপির দাবি-দাওয়া না মেনে নির্ধারিত সময়ে সংসদ নির্বাচন করে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসে, তখন বিএনপি কী করবে? তখনো কী বিএনপি সরকার পতনের আন্দোলন চালিয়ে যাবে? সেই আন্দোলনের পরেও পদত্যাগ না করে ক্ষমতাসীনেরা যদি নানা কৌশলে ক্ষমতায় টিকে থাকে, তাহলেও কী এভাবে অনন্তকাল আন্দোলন চলবে? বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অবরোধ ও হরতালের ডাক দিয়েই যাবেন?
রুহুল কবির রিজভী অবশ্য বলছেন, নির্বাচন ‘হতে দেওয়া হবে না।’ ‘হতে দেওয়া হবে না’ বললেই কি নির্বাচন ঠেকানো যাবে? বিএনপি এবং তাদের মিত্রদের দাবি উপেক্ষা করে নির্বাচন হলে (নির্বাচন যে হবেই, তার আলামত স্পষ্ট) তাঁরা কী করবেন? আওয়ামী লীগারদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেবেন? পেট্রলবোমা ছুড়বেন? রিজভী সাহেবরা ২০১৫ সালেও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।
আওয়ামী লীগ প্রশাসনকে ব্যবহার করে তাদের কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ঠিকই নির্বাচন করেছে। সেই নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় তারা এখনো ক্ষমতায় আছে। বিএনপি নেতারা যতই হুংকার ছাড়ুন না কেন, নির্বাচন এবারও হবে। এটা একই সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের নির্ঝঞ্ঝাটে ক্ষমতায় থাকার মওকা এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। তা ছাড়া, নির্বাচনের পক্ষে আওয়ামী লীগ ছাড়া আরও অন্তত দুই ডজন দল রয়েছে। দলগুলো ইতিমধ্যে এমপি হওয়ার জন্য মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এই ‘রেসের ঘোড়া’দের স্তব্ধ করার মতো শক্তি বিএনপির কোথায়?
আমরা পনেরো বছর ধরে একই রকম দৃশ্য দেখছি। নির্বাচন এলেই বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানায়। কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা তা মানে না। ক্ষমতাসীনেরা তাদের মিত্রদের নিয়ে নির্বাচন করে। জয়ী হয়। সরকার গঠন করে। এরপর বিএনপিকে দাবড়ানি দেয়। দাবড়ানি খেয়ে তারা ছত্রভঙ্গ হয়। কিছুদিন চুপচাপ থাকে। দম নেয়। এরপর আবার একটু একটু করে আন্দোলন শুরু করে। হুমকি দেয়। হরতাল-অবরোধ করে। কিন্তু তাতে শক্তিক্ষয় ছাড়া কোথাও কোনো পরিবর্তন হয় না।
এবারও কয়েক মাস ধরে বিএনপি যখন তার মিত্রদের নিয়ে সরকার পতনের আন্দোলনে নানা কর্মসূচি পালন করছে, তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বেশ ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নির্বাচনের দিকে। বিএনপিসহ বিরোধী কয়েকটি দলের আন্দোলন কিংবা নির্বাচন বর্জন—কোনো কিছুই ক্ষমতাসীনদের ন্যূনতম চাপে ফেলতে পারেনি। উল্টো মামলা, গ্রেপ্তার, দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় যেতে না পারার হতাশা, কিছু কিছু নেতা-কর্মীর দলত্যাগ করে নির্বাচনী মিছিলে যোগদানসহ নানামুখী চাপে বিপর্যস্ত বিএনপি। দলের সিদ্ধান্তে অনেক নেতা-কর্মীই সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। আবার দল থেকে বোরোতেও পারছেন না। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া কিংবা নির্বাচনের পক্ষে কাজ করায় দেড় মাসে ৩০ জনের বেশি কেন্দ্রীয় এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
দলটি সরকার পতনের আন্দোলনে সফল হতে পারছে না, আবার নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে না। এতে ক্ষতি যা হওয়ার হচ্ছে দেশের এবং দেশের সাধারণ মানুষের। কিন্তু সেই বোধ বিএনপিসহ আন্দোলনরত দলগুলোর আছে বলে মনে হয় না।
এমনিতে বিএনপির আন্দোলন নিয়ে বলার কিছু নেই। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি হরতাল-অবরোধ-ঘেরাও, সমাবেশ, মহাসমাবেশ, বিক্ষোভ অনেক কিছুই করতে পারে। সমস্যা হচ্ছে বিএনপির এই আন্দোলনের কারণে নিরীহ মানুষদের সীমাহীন সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ বিএনপির হরতাল-অবরোধ শেষ পর্যন্ত নিরীহ থাকে না। এটা সহিংস কর্মসূচিতে পরিণত হয়। আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা না থাকলেও এক মাসে প্রায় ২৩০টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। বাদ যায়নি ট্রেনও। এ সময় ১১টি স্থাপনায়ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগ অফিস, বিএনপি অফিস, পুলিশ বক্স, কাউন্সিলর অফিস, বিদ্যুৎ অফিস, বাস কাউন্টার, শোরুম ইত্যাদি। এসব অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছেন বেশ কয়েকজন। আহত হয়েছেন অনেকে।
বিএনপি আন্দোলনের নামে একধরনের ভীতির সৃষ্টি করছে। রুটি-রুজি নিয়ে ব্যস্ত মানুষের এসব আন্দোলন নিয়ে তেমন একটা মাথাব্যথা নেই। তাই তো বিএনপির চলমান আন্দোলনে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আর জনসম্পৃক্ততাহীন বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচির কোনো প্রভাব নেই। পোড়ার আশঙ্কাকে উপেক্ষা করে মানুষ গাড়িও বের করছে। অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবকিছুই সচল থাকছে। বিএনপির একমাত্র মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী ‘অজ্ঞাত’ স্থান থেকে ভিডিও বার্তায় দুদিন পর পর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করছেন। হুমকি দিচ্ছেন, আন্দোলন আরও জোরদার করবেন। সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। সরকারের পতন হলো বলে! কিন্তু তাঁর কথায় সাধারণ মানুষ পথে নামে না। নেতা-কর্মীরাও না। কেউ ভরসাও পায় না।
সাধারণ মানুষের প্রতি আমাদের দেশে কোনো রাজনৈতিক দলেরই কোনো দায় আছে বলে মনে হয় না। অথচ সাধারণ মানুষের প্রতি সবচেয়ে বেশি দায়িত্বশীল হওয়ার কথা রাজনৈতিক দলগুলোরই। সরকার যেমন জনসাধারণের প্রতি দায়বদ্ধ হওয়ার কথা, রাজনৈতিক দলেরও সেই দায় থাকা দরকার। এমনকি সেই দায়বদ্ধতাকে সংবিধানে নির্দিষ্ট করে দেওয়ারও যুক্তি আছে। রাজনৈতিক দলগুলো আর পাঁচটা বেসরকারি সংগঠনের মতো নয়, তারা একটি ‘পাবলিক বডি’, অর্থাৎ জনপরিসরের প্রতিষ্ঠান, জনসমর্থন পাওয়ার জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, সুতরাং প্রতিটি কাজের জন্য জনসাধারণের কাছে তাদের জবাবদিহির দায় থাকা উচিত। দলীয় রাজনীতির মূর্তি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে রাজনৈতিক দলের আচরণের ঔচিত্য-অনৌচিত্য বিষয়ে নীতিগত আলোচনা করে আদৌ আর কোনো লাভ আছে কি না, সেই প্রশ্ন নিতান্ত স্বাভাবিক।
কিন্তু সকাল থেকে রাত্রি অবধি অনন্ত কুনাট্যের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্তব্যের কথা স্পষ্টভাবে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। দলনেতা ও নেত্রীরা তাতে হয়তো কর্ণপাতও করবেন না, কিন্তু তাঁদের অনেকের অনেক আচরণ যে যথার্থ রাজনীতি নয়, রাজনীতির কলঙ্ক, সেই সত্যটি অন্তত সমাজের নিজের মনে রাখা জরুরি।
প্রকৃত গণতন্ত্রের শর্ত পূর্ণ হলে এই দায়িত্বের কথা আলাদা করে বলার দরকার হতো না। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলকে জনসাধারণের সমর্থন নিয়ে চলতে হয়—সুতরাং তাদের কাছে দায়বদ্ধ না থাকলে জনসমর্থন হারাতে হবে, এই আশঙ্কার তাড়নাতেই দলের নেতা ও কর্মীদের আচরণ যথাযথ হওয়ার কথা, ভুল করলে দ্রুত আত্মসংশোধন করার কথা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দলের সঙ্গে জনতার সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে দাতা এবং গ্রহীতার। আর গণতন্ত্র পরিণত হয়েছে দলতন্ত্রে। দলতন্ত্রের অভিধানে নৈতিক দায়দায়িত্বের কোনো স্থান নেই।
ক্রমেই দেখা যাচ্ছে, জনসমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যেই রাজনীতিকদের একাংশ দুর্বিনীত, অসংযত, হিংস্র আচরণে মত্ত হচ্ছেন। আর সেই হিংস্রতার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সেখানে ‘প্রতিপক্ষ’ ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। বস্তুত যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া আর সবকিছুর বিনিময়ে ক্ষমতা ধরে রাখার উদগ্র বাসনা-তাড়িত রাজনীতির কারবারিরা এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং সমাজের পক্ষে হানিকর আচরণকেই নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চলেছেন। এই পরিস্থিতিতে সবাই মিলে আদিগন্ত বিস্তৃত অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া ছাড়া বুঝি আমাদের অন্য কোনো যৌতুক নেই!
ক্রমেই দেখা যাচ্ছে, জনসমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যেই রাজনীতিকদের একাংশ দুর্বিনীত, অসংযত, হিংস্র আচরণে মত্ত হচ্ছেন। আর সেই হিংস্রতার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সেখানে ‘প্রতিপক্ষ’ ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।
হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস ও ক্ষতিকর কর্মসূচি থেকে বিএনপি সরে আসছে না। এতে শঙ্কা জাগছে, আবারও কি বিএনপি ২০১৪-১৫ সালের মতো লাগাতার অবরোধের পথে পা বাড়াবে? বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোট সেই সময় টানা ২৮০ দিন অবরোধ পালন করেছিল। তখন অবরোধের মধ্যে নির্দিষ্ট মেয়াদে হরতালেরও ডাক দেওয়া হতো। সরকার পতন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে টানা অবরোধ ও হরতালের ডাক দেয় বিএনপি জোট। বাস্তবে এই হরতাল ও অবরোধের কার্যকারিতা দেখা না গেলেও সেই অবরোধের ২৮০ দিন অতিক্রম করলেও বিএনপি জোট আনুষ্ঠানিকভাবে অবরোধ প্রত্যাহার করেনি। সহিংস আন্দোলন করেও সেই সময় কোনো দাবি আদায় করা সম্ভব হয়নি। উল্টো বিএনপি রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়ার পথে অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
আন্দোলন-সংগ্রাম, প্রতিবাদ, সমালোচনা, বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন ইত্যাদি যেকোনো রাজনৈতিক দলের বৈশিষ্ট্য। সাংবিধানিক অধিকার। দলের নীতি-আদর্শ বাস্তবায়ন করতে এবং ক্ষমতাসীন দলের গণবিরোধী কাজ ঠেকাতে রাজনৈতিক দলগুলোকে নানা রকম তৎপরতা চালাতে হয়। কখনো তারা অসহযোগের মতো ‘চরম’ কর্মসূচিও গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু বিএনপি এখন যা করছে, এর কোনো তল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
দলটির পক্ষ থেকে প্রতিদিন কর্মসূচি পালনের নানা রকম ভিডিও পাঠানো হয় গণমাধ্যমে। এর মধ্যে রয়েছে সীমিতসংখ্যক নেতা-কর্মীর ঝটিকা মিছিল। যদিও বাস্তবে নেতা-কর্মীদের এসব ক্ষণস্থায়ী ঝটিকা মিছিল রাজপথে তেমন একটা প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। হরতাল-অবরোধের প্রভাব যেমন ক্রমেই কমে আসছে, তেমনি নির্বাচনের দিকেও বীর বিক্রমে এগিয়ে চলেছে আওয়ামী লীগ।
প্রশ্ন হলো, এবারও যদি ক্ষমতাসীনেরা বিএনপির দাবি-দাওয়া না মেনে নির্ধারিত সময়ে সংসদ নির্বাচন করে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসে, তখন বিএনপি কী করবে? তখনো কী বিএনপি সরকার পতনের আন্দোলন চালিয়ে যাবে? সেই আন্দোলনের পরেও পদত্যাগ না করে ক্ষমতাসীনেরা যদি নানা কৌশলে ক্ষমতায় টিকে থাকে, তাহলেও কী এভাবে অনন্তকাল আন্দোলন চলবে? বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী অবরোধ ও হরতালের ডাক দিয়েই যাবেন?
রুহুল কবির রিজভী অবশ্য বলছেন, নির্বাচন ‘হতে দেওয়া হবে না।’ ‘হতে দেওয়া হবে না’ বললেই কি নির্বাচন ঠেকানো যাবে? বিএনপি এবং তাদের মিত্রদের দাবি উপেক্ষা করে নির্বাচন হলে (নির্বাচন যে হবেই, তার আলামত স্পষ্ট) তাঁরা কী করবেন? আওয়ামী লীগারদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেবেন? পেট্রলবোমা ছুড়বেন? রিজভী সাহেবরা ২০১৫ সালেও চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।
আওয়ামী লীগ প্রশাসনকে ব্যবহার করে তাদের কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে ঠিকই নির্বাচন করেছে। সেই নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় তারা এখনো ক্ষমতায় আছে। বিএনপি নেতারা যতই হুংকার ছাড়ুন না কেন, নির্বাচন এবারও হবে। এটা একই সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের নির্ঝঞ্ঝাটে ক্ষমতায় থাকার মওকা এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা। তা ছাড়া, নির্বাচনের পক্ষে আওয়ামী লীগ ছাড়া আরও অন্তত দুই ডজন দল রয়েছে। দলগুলো ইতিমধ্যে এমপি হওয়ার জন্য মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এই ‘রেসের ঘোড়া’দের স্তব্ধ করার মতো শক্তি বিএনপির কোথায়?
আমরা পনেরো বছর ধরে একই রকম দৃশ্য দেখছি। নির্বাচন এলেই বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি জানায়। কিন্তু ক্ষমতাসীনেরা তা মানে না। ক্ষমতাসীনেরা তাদের মিত্রদের নিয়ে নির্বাচন করে। জয়ী হয়। সরকার গঠন করে। এরপর বিএনপিকে দাবড়ানি দেয়। দাবড়ানি খেয়ে তারা ছত্রভঙ্গ হয়। কিছুদিন চুপচাপ থাকে। দম নেয়। এরপর আবার একটু একটু করে আন্দোলন শুরু করে। হুমকি দেয়। হরতাল-অবরোধ করে। কিন্তু তাতে শক্তিক্ষয় ছাড়া কোথাও কোনো পরিবর্তন হয় না।
এবারও কয়েক মাস ধরে বিএনপি যখন তার মিত্রদের নিয়ে সরকার পতনের আন্দোলনে নানা কর্মসূচি পালন করছে, তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বেশ ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নির্বাচনের দিকে। বিএনপিসহ বিরোধী কয়েকটি দলের আন্দোলন কিংবা নির্বাচন বর্জন—কোনো কিছুই ক্ষমতাসীনদের ন্যূনতম চাপে ফেলতে পারেনি। উল্টো মামলা, গ্রেপ্তার, দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতায় যেতে না পারার হতাশা, কিছু কিছু নেতা-কর্মীর দলত্যাগ করে নির্বাচনী মিছিলে যোগদানসহ নানামুখী চাপে বিপর্যস্ত বিএনপি। দলের সিদ্ধান্তে অনেক নেতা-কর্মীই সন্তুষ্ট হতে পারছেন না। আবার দল থেকে বোরোতেও পারছেন না। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া কিংবা নির্বাচনের পক্ষে কাজ করায় দেড় মাসে ৩০ জনের বেশি কেন্দ্রীয় এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
দলটি সরকার পতনের আন্দোলনে সফল হতে পারছে না, আবার নির্বাচনেও অংশ নিচ্ছে না। এতে ক্ষতি যা হওয়ার হচ্ছে দেশের এবং দেশের সাধারণ মানুষের। কিন্তু সেই বোধ বিএনপিসহ আন্দোলনরত দলগুলোর আছে বলে মনে হয় না।
এমনিতে বিএনপির আন্দোলন নিয়ে বলার কিছু নেই। রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি হরতাল-অবরোধ-ঘেরাও, সমাবেশ, মহাসমাবেশ, বিক্ষোভ অনেক কিছুই করতে পারে। সমস্যা হচ্ছে বিএনপির এই আন্দোলনের কারণে নিরীহ মানুষদের সীমাহীন সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ বিএনপির হরতাল-অবরোধ শেষ পর্যন্ত নিরীহ থাকে না। এটা সহিংস কর্মসূচিতে পরিণত হয়। আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততা না থাকলেও এক মাসে প্রায় ২৩০টি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। বাদ যায়নি ট্রেনও। এ সময় ১১টি স্থাপনায়ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগ অফিস, বিএনপি অফিস, পুলিশ বক্স, কাউন্সিলর অফিস, বিদ্যুৎ অফিস, বাস কাউন্টার, শোরুম ইত্যাদি। এসব অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছেন বেশ কয়েকজন। আহত হয়েছেন অনেকে।
বিএনপি আন্দোলনের নামে একধরনের ভীতির সৃষ্টি করছে। রুটি-রুজি নিয়ে ব্যস্ত মানুষের এসব আন্দোলন নিয়ে তেমন একটা মাথাব্যথা নেই। তাই তো বিএনপির চলমান আন্দোলনে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আর জনসম্পৃক্ততাহীন বিএনপির আন্দোলন কর্মসূচির কোনো প্রভাব নেই। পোড়ার আশঙ্কাকে উপেক্ষা করে মানুষ গাড়িও বের করছে। অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবকিছুই সচল থাকছে। বিএনপির একমাত্র মুখপাত্র রুহুল কবির রিজভী ‘অজ্ঞাত’ স্থান থেকে ভিডিও বার্তায় দুদিন পর পর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করছেন। হুমকি দিচ্ছেন, আন্দোলন আরও জোরদার করবেন। সরকার পতন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। সরকারের পতন হলো বলে! কিন্তু তাঁর কথায় সাধারণ মানুষ পথে নামে না। নেতা-কর্মীরাও না। কেউ ভরসাও পায় না।
সাধারণ মানুষের প্রতি আমাদের দেশে কোনো রাজনৈতিক দলেরই কোনো দায় আছে বলে মনে হয় না। অথচ সাধারণ মানুষের প্রতি সবচেয়ে বেশি দায়িত্বশীল হওয়ার কথা রাজনৈতিক দলগুলোরই। সরকার যেমন জনসাধারণের প্রতি দায়বদ্ধ হওয়ার কথা, রাজনৈতিক দলেরও সেই দায় থাকা দরকার। এমনকি সেই দায়বদ্ধতাকে সংবিধানে নির্দিষ্ট করে দেওয়ারও যুক্তি আছে। রাজনৈতিক দলগুলো আর পাঁচটা বেসরকারি সংগঠনের মতো নয়, তারা একটি ‘পাবলিক বডি’, অর্থাৎ জনপরিসরের প্রতিষ্ঠান, জনসমর্থন পাওয়ার জন্য নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, সুতরাং প্রতিটি কাজের জন্য জনসাধারণের কাছে তাদের জবাবদিহির দায় থাকা উচিত। দলীয় রাজনীতির মূর্তি যা দাঁড়িয়েছে, তাতে রাজনৈতিক দলের আচরণের ঔচিত্য-অনৌচিত্য বিষয়ে নীতিগত আলোচনা করে আদৌ আর কোনো লাভ আছে কি না, সেই প্রশ্ন নিতান্ত স্বাভাবিক।
কিন্তু সকাল থেকে রাত্রি অবধি অনন্ত কুনাট্যের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্তব্যের কথা স্পষ্টভাবে মনে করিয়ে দেওয়া দরকার। দলনেতা ও নেত্রীরা তাতে হয়তো কর্ণপাতও করবেন না, কিন্তু তাঁদের অনেকের অনেক আচরণ যে যথার্থ রাজনীতি নয়, রাজনীতির কলঙ্ক, সেই সত্যটি অন্তত সমাজের নিজের মনে রাখা জরুরি।
প্রকৃত গণতন্ত্রের শর্ত পূর্ণ হলে এই দায়িত্বের কথা আলাদা করে বলার দরকার হতো না। গণতন্ত্রে রাজনৈতিক দলকে জনসাধারণের সমর্থন নিয়ে চলতে হয়—সুতরাং তাদের কাছে দায়বদ্ধ না থাকলে জনসমর্থন হারাতে হবে, এই আশঙ্কার তাড়নাতেই দলের নেতা ও কর্মীদের আচরণ যথাযথ হওয়ার কথা, ভুল করলে দ্রুত আত্মসংশোধন করার কথা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দলের সঙ্গে জনতার সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে দাতা এবং গ্রহীতার। আর গণতন্ত্র পরিণত হয়েছে দলতন্ত্রে। দলতন্ত্রের অভিধানে নৈতিক দায়দায়িত্বের কোনো স্থান নেই।
ক্রমেই দেখা যাচ্ছে, জনসমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্যেই রাজনীতিকদের একাংশ দুর্বিনীত, অসংযত, হিংস্র আচরণে মত্ত হচ্ছেন। আর সেই হিংস্রতার শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। সেখানে ‘প্রতিপক্ষ’ ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। বস্তুত যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় যাওয়া আর সবকিছুর বিনিময়ে ক্ষমতা ধরে রাখার উদগ্র বাসনা-তাড়িত রাজনীতির কারবারিরা এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং সমাজের পক্ষে হানিকর আচরণকেই নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে চলেছেন। এই পরিস্থিতিতে সবাই মিলে আদিগন্ত বিস্তৃত অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া ছাড়া বুঝি আমাদের অন্য কোনো যৌতুক নেই!
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
২ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
২ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৬ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে