মাসুদ রানা
আজকের পত্রিকা: জুলাই অভ্যুত্থানকে কীভাবে দেখেন?
আনু মুহাম্মদ: জুলাই অভ্যুত্থান আপাতদৃষ্টিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের একটা ধারাবাহিকতা। তবে এটা শুধু তা না। সমাজের মধ্যে দীর্ঘদিনের যে ক্ষোভ, সেই ক্ষোভ যখন আরও বৃদ্ধি পায় সরকারের সহিংস আগ্রাসী ভূমিকার কারণে, তখনই একটা অপ্রতিরোধ্য পরিস্থিতির তৈরি হয়। সেভাবেই জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান ঘটে।
আমরা জানি, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ওই সময় এই আন্দোলনে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার ছবি সামনে রেখেই আন্দোলন করছিলেন। তারপরও তাঁদের ওপর অত্যাচার হয়েছে। সে সময় যেভাবে কোটা বাতিল করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সেটার মধ্যে একটা চাতুর্য ছিল। সেটা বাতিল হওয়ারই কথা, সেটাই হয়েছে এ বছরের জুনে। এ ঘটনা শিক্ষার্থীদের মধ্যে অবিশ্বাস ও ক্ষোভ আরও বৃদ্ধি করে। শুধু কোটা নিয়ে কেন বিশাল বিশাল জমায়েত হলো, সেটা সরকারের উপলব্ধি করার ব্যাপার ছিল। কারণ, দেশের বড় সমস্যা হলো বেকার সমস্যা। আর জনসংখ্যার যে বিন্যাস, সেখানে তরুণদের অনুপাত সবচেয়ে বেশি। তরুণ তাঁর ভবিষ্যৎ কী দেখছেন? দেশে অনেক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধি কোনো কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারেনি; বরং এমন সব কাজের মধ্য দিয়ে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, যেগুলো কর্মসংস্থান নষ্ট করে।
আবার পাবলিক সেক্টর, যেমন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতালসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে প্রায় চার লাখ পদ খালি ছিল। সরকার সেগুলো পূরণ করেনি। কারণ, সরকার শিক্ষা, চিকিৎসা বেসরকারি খাতেই বাড়তে দিতে চায়। আর কর্মসংস্থান যতটা হচ্ছিল তা নিয়োগ-বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস ইত্যাদি কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠের আওতার বাইরেই থেকে যায়। এর বাইরে বিসিএসের মাধ্যমে নিয়মিত কর্মসংস্থান হওয়ার সুযোগ থাকলেও, কোটার কারণে সেটা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। এই তিন কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে হতাশা, অনিশ্চয়তা এর কারণেই ব্যাপকসংখ্যক শিক্ষার্থী এই আন্দোলনে যুক্ত হন।
এ ছাড়া জিনিসপত্রের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা, লুণ্ঠন, দুর্নীতি এবং সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের জুলুমের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ছিল। শিক্ষার্থীরা তাঁদেরই সন্তান, তাঁদের কাজ পাওয়ার আন্দোলনে তাই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থন প্রথম থেকেই ছিল।
এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল। কিন্তু ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার কথার কারণে ক্ষোভ-ক্রোধ আরও বাড়ে, পরিস্থিতি অস্বাভাবিকতার দিকে চলে যায়। এরপর ছাত্রলীগ, পুলিশ, বিজিবি দিয়ে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড শুরু হলো। সবকিছু মানুষের সহ্যসীমার বাইরে চলে গেল। এই সহ্যসীমা পার হওয়ার কারণেই জনগণ আন্দোলনে ব্যাপকভাবে যুক্ত হলেন। এককথায় সরকারের ঔদ্ধত্য, অহমিকা, জনগণকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, সমস্যা উপলব্ধি না করার প্রবণতা এবং সর্বোপরি ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডের ফলাফল হলো এই গণ-অভ্যুত্থান।
আজকের পত্রিকা: অনেকেই এই অভ্যুত্থানকে বিপ্লব বা দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলছেন। আপনার কাছে কী মনে হয়?
আনু মুহাম্মদ: এ রকম চিন্তার একটা বড় কারণ হলো, ১৫ বছর ধরে মানুষ নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারেনি। গুম, অপহরণ, ক্রসফায়ার, ধরপাকড়, নির্যাতন ব্যাপক আকার লাভ করেছিল। সরকার দলীয় লোক দিয়ে সব জায়গা দখল করে রেখেছিল। মানুষ আতঙ্কের মধ্যে বাস করতে বাধ্য হয়েছিল। মানুষের মধ্যে একটা পরাধীনতার বোধ তৈরি হয়েছিল। এ রকম একটা দমবন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার কারণে মানুষের কাছে স্বাধীনতা মনে হচ্ছে। তবে এটা যেভাবে সংঘটিত হয়েছে, তাকে অবশ্যই গণ-অভ্যুত্থান বলতে হবে। বিপ্লব আরও অনেক বড় ব্যাপার।
বিপ্লবের মধ্যে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালিত একটা সাংগঠনিক প্রক্রিয়া থাকতে হয়। বিপ্লব মানে মৌলিক একটা পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে যখন রাষ্ট্র বা সরকারব্যবস্থার পরিবর্তন করা হয়। এখানে কিন্তু সেই ব্যাপারটা ছিল না। এটা কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল, রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্য থাকলে প্রস্তুতি অন্য রকম থাকত। তবে এই অভ্যুত্থানের মধ্যে বিপ্লবের উপাদান আছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে নেতৃত্বের ভূমিকা দেখা গেছে, সেটা অসাধারণ ব্যাপার ছিল। এর সঙ্গে শিক্ষক, শ্রমজীবী মানুষ ও নারীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। যেখানে আগে অভিভাবকেরা সন্তানদের ছেড়ে দিতেন না, সেখানে তাঁরা এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন।
রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ঠুর ও ভয়ংকর আক্রমণ মোকাবিলা করে যেভাবে পুরো সমাজ দাঁড়িয়েছিল, সেটাই গণ-অভ্যুত্থান তৈরি করেছে। মূল দাবি এসেছে—এ অবস্থা এভাবে চলতে পারে না। সবার মধ্যে যখন প্রত্যাশা তৈরি হয় আগের অবস্থায় আর ফেরত যাওয়া যাবে না, বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগের শাসনে আর ফিরে যাওয়া যাবে না, সেই আকাঙ্ক্ষাটাই হলো বিপ্লবের উপাদান। এখন গণ-অভ্যুত্থানকে কত দূর পর্যন্ত নেওয়া যাবে, সেটা সামনের দিনে আরও স্পষ্ট হবে।
আজকের পত্রিকা: এই অভ্যুত্থানকে যাঁরা গ্রহণ করছেন না। তাঁরা বলছেন, এটা বিদেশি চক্রান্তের ফল। আপনার কাছে কী মনে হয়?
আনু মুহাম্মদ: বাংলাদেশ নিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং রাজনৈতিক আধিপত্যের ব্যাপার আছে। এখানে ভারতের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। চীনের প্রভাব ক্রমাগত বাড়ছে। রাশিয়ার স্বার্থ আছে আর যুক্তরাষ্ট্রের বড় কৌশলগত স্বার্থ আছে। সুতরাং যখনই একটা পরিবর্তন ঘটছে, সেই সময় সবারই কিছু না কিছু ভূমিকা থাকার কথা। এই গণ-অভ্যুত্থানে সেই সুযোগটা নেওয়ারই কথা। কিন্তু ঘটনাটা যে বিদেশি শক্তির কারণে হয়েছে, এ রকম বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়।
আন্দোলনের পরম্পরা দেখলেই বোঝা যায়, ব্যাপারটা মোটেই সে রকম নয়। প্রধানত শেখ হাসিনার জেদ ও অহমিকার কারণে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ধরা যাক, পুলিশ যে নিষ্ঠুর কায়দায় গুলি করে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত প্রকাশ্যে ও অপ্রয়োজনে সরাসরি গুলি করে হত্যা করেছে এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগ সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়েছে, বাহিনী হেলিকপ্টার দিয়ে নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি করেছে, এগুলো কি বিদেশিরা করেছে? এটা বাংলাদেশের সাবেক সরকার করেছে। বিদেশিরা এই পরিস্থিতির সুবিধা তো নিতেই পারে। এ রকম কথা আমরা ১৯৭১ সালেও শুনেছি। যেমন মুক্তিযুদ্ধটা ভারত করেছে। এগুলো বললে হবে না। দেশের ভেতরে কীভাবে আন্দোলনটা গড়ে উঠেছে, জনগণের ভূমিকা ও আকাঙ্ক্ষা কী ছিল, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তারপর বিদেশি শক্তি সুবিধা নিতে পারে, সেটা অন্য প্রসঙ্গ।
গণ-অভ্যুত্থানের পরে পরিবর্তনটা যাতে জনগণের পক্ষে থাকে এবং জনগণের স্বার্থে একটা টেকসই বা মৌলিক পরিবর্তনের দিকে যায়, সেটা অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের একটা বড় দায়িত্ব।
আজকের পত্রিকা: এই অভ্যুত্থানের পরে একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। শিক্ষার্থীসহ সবার প্রত্যাশা এখন রাষ্ট্র সংস্কার করা। আপনি কি মনে করেন এ সরকার সেই কাঙ্ক্ষিত সংস্কার করতে পারবে?
আনু মুহাম্মদ: অন্তর্বর্তী সরকার তো একটা বড় দায়িত্ব নিয়েছে। এখন এ সরকার সেই দায়িত্ব পালন করে কি না, সেটা আমরা দেখব। তারা যদি অবহেলা করে, উদাসীনতা দেখায়, তাহলে তো তাদের জনগণ দায়মুক্তি দেবে না। আগের আওয়ামী লীগ সরকার অনেক ধরনের দায়মুক্তি আইন করেছিল। কিন্তু এই সরকারকে আমরা দায়মুক্তি দেব না।
এই সরকারের প্রথম কাজ হচ্ছে, আগের সরকারের অর্থনৈতিক লুণ্ঠন ও রাজনৈতিক নিপীড়ন নিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। জুলাই হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য নিপীড়নের জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচারের সম্মুখীন করা তাদের দায়িত্ব। তাদের আরও দায়িত্ব হলো, ব্যাংকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা দখল ও লুণ্ঠন করেছে, তাদের কাছ থেকে সম্পদগুলো উদ্ধার করা। আর মানুষের জন্য মহা ক্ষতিকর মেগা প্রকল্প রামপাল কয়লা ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করা। এসব বাতিলের জন্য মানুষের একটা ঐকমত্য আছে। যেগুলো নিয়ে দীর্ঘ আন্দোলন হয়েছিল।
এরপর অর্থ ও সম্পদ পাচারের প্রক্রিয়া বন্ধ করা। আর জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করাতে হবে। কারণ আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সব প্রতিষ্ঠানে একটা ধস নেমেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক, মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশন, আদালত, বিশ্ববিদ্যালয়—এ ধরনের সব প্রতিষ্ঠান দলীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়েছিল। সে জন্য এগুলোকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করাতে হবে। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে সুযোগ দেওয়া এবং জবাবদিহির আওতায় আনা এ সরকারের অন্যতম দায়িত্ব।
আজকের পত্রিকা: রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য কি করণীয়?
আনু মুহাম্মদ: অন্তর্বর্তী সরকারের সীমাবদ্ধতা হলো,
তারা সবকিছু করতে পারবে না। কিন্তু অনেক কিছুর ভিত্তি তৈরি করে দিতে পারবে। যেমন আমাদের যে সংবিধান আছে, সেটাই যদি বলবৎ থাকে, তাহলে যে সরকার এটার অধীনে থাকবে, তারাই স্বৈরতান্ত্রিক হবে। কারণ এটা ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অধিকতর স্বৈরতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক, জাতিবিদ্বেষী এবং বৈষম্যমূলক দলিলে পরিণত হয়েছে। এই সরকার সংবিধানসহ আইনকাঠামো পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো, যেমন কী পরিবর্তন করতে হবে, সে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কমিশন গঠন করতে পারে। এ ছাড়া ব্যাংক খাতসহ অন্যান্য খাতে পরিবর্তনের ভিত্তি তৈরি করতে পারে। আর জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আইনকানুনের পরিবর্তন নিশ্চিত করতে পারে।
আগের সরকারগুলোর ঘাড়টা ঘোরানো ছিল কিছু দেশি-বিদেশি লুটেরা শক্তির দিকে। তাদের স্বার্থ দেখার জন্যই রাষ্ট্রের শক্তি ব্যবহার হতো। সে কারণে শিক্ষা, চিকিৎসা, জ্বালানি, নিরাপত্তা, পরিবহন, পরিবেশ—সব ক্ষেত্রে জনগণের জীবন বিপন্ন করে কিছু গোষ্ঠী ফুলেফেঁপে উঠেছে। এখন সরকারের ঘাড়টা ঘুরিয়ে দিতে হবে জনগণের দিকে। জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, সেটা সরকার তখনই শুরু করতে পারবে।
আজকের পত্রিকা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আনু মুহাম্মদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
আজকের পত্রিকা: জুলাই অভ্যুত্থানকে কীভাবে দেখেন?
আনু মুহাম্মদ: জুলাই অভ্যুত্থান আপাতদৃষ্টিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনের একটা ধারাবাহিকতা। তবে এটা শুধু তা না। সমাজের মধ্যে দীর্ঘদিনের যে ক্ষোভ, সেই ক্ষোভ যখন আরও বৃদ্ধি পায় সরকারের সহিংস আগ্রাসী ভূমিকার কারণে, তখনই একটা অপ্রতিরোধ্য পরিস্থিতির তৈরি হয়। সেভাবেই জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থান ঘটে।
আমরা জানি, ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছিল। ওই সময় এই আন্দোলনে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার ছবি সামনে রেখেই আন্দোলন করছিলেন। তারপরও তাঁদের ওপর অত্যাচার হয়েছে। সে সময় যেভাবে কোটা বাতিল করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সেটার মধ্যে একটা চাতুর্য ছিল। সেটা বাতিল হওয়ারই কথা, সেটাই হয়েছে এ বছরের জুনে। এ ঘটনা শিক্ষার্থীদের মধ্যে অবিশ্বাস ও ক্ষোভ আরও বৃদ্ধি করে। শুধু কোটা নিয়ে কেন বিশাল বিশাল জমায়েত হলো, সেটা সরকারের উপলব্ধি করার ব্যাপার ছিল। কারণ, দেশের বড় সমস্যা হলো বেকার সমস্যা। আর জনসংখ্যার যে বিন্যাস, সেখানে তরুণদের অনুপাত সবচেয়ে বেশি। তরুণ তাঁর ভবিষ্যৎ কী দেখছেন? দেশে অনেক প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধি কোনো কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারেনি; বরং এমন সব কাজের মধ্য দিয়ে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, যেগুলো কর্মসংস্থান নষ্ট করে।
আবার পাবলিক সেক্টর, যেমন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতালসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে প্রায় চার লাখ পদ খালি ছিল। সরকার সেগুলো পূরণ করেনি। কারণ, সরকার শিক্ষা, চিকিৎসা বেসরকারি খাতেই বাড়তে দিতে চায়। আর কর্মসংস্থান যতটা হচ্ছিল তা নিয়োগ-বাণিজ্য, প্রশ্নপত্র ফাঁস ইত্যাদি কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠের আওতার বাইরেই থেকে যায়। এর বাইরে বিসিএসের মাধ্যমে নিয়মিত কর্মসংস্থান হওয়ার সুযোগ থাকলেও, কোটার কারণে সেটা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। এই তিন কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে হতাশা, অনিশ্চয়তা এর কারণেই ব্যাপকসংখ্যক শিক্ষার্থী এই আন্দোলনে যুক্ত হন।
এ ছাড়া জিনিসপত্রের মূল্যের ঊর্ধ্বগতি, স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতা, লুণ্ঠন, দুর্নীতি এবং সরকারি দলের নেতা-কর্মীদের জুলুমের কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ ছিল। শিক্ষার্থীরা তাঁদেরই সন্তান, তাঁদের কাজ পাওয়ার আন্দোলনে তাই বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থন প্রথম থেকেই ছিল।
এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল। কিন্তু ১৪ জুলাই শেখ হাসিনার কথার কারণে ক্ষোভ-ক্রোধ আরও বাড়ে, পরিস্থিতি অস্বাভাবিকতার দিকে চলে যায়। এরপর ছাত্রলীগ, পুলিশ, বিজিবি দিয়ে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড শুরু হলো। সবকিছু মানুষের সহ্যসীমার বাইরে চলে গেল। এই সহ্যসীমা পার হওয়ার কারণেই জনগণ আন্দোলনে ব্যাপকভাবে যুক্ত হলেন। এককথায় সরকারের ঔদ্ধত্য, অহমিকা, জনগণকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, সমস্যা উপলব্ধি না করার প্রবণতা এবং সর্বোপরি ভয়ংকর হত্যাকাণ্ডের ফলাফল হলো এই গণ-অভ্যুত্থান।
আজকের পত্রিকা: অনেকেই এই অভ্যুত্থানকে বিপ্লব বা দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলছেন। আপনার কাছে কী মনে হয়?
আনু মুহাম্মদ: এ রকম চিন্তার একটা বড় কারণ হলো, ১৫ বছর ধরে মানুষ নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারেনি। গুম, অপহরণ, ক্রসফায়ার, ধরপাকড়, নির্যাতন ব্যাপক আকার লাভ করেছিল। সরকার দলীয় লোক দিয়ে সব জায়গা দখল করে রেখেছিল। মানুষ আতঙ্কের মধ্যে বাস করতে বাধ্য হয়েছিল। মানুষের মধ্যে একটা পরাধীনতার বোধ তৈরি হয়েছিল। এ রকম একটা দমবন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পাওয়ার কারণে মানুষের কাছে স্বাধীনতা মনে হচ্ছে। তবে এটা যেভাবে সংঘটিত হয়েছে, তাকে অবশ্যই গণ-অভ্যুত্থান বলতে হবে। বিপ্লব আরও অনেক বড় ব্যাপার।
বিপ্লবের মধ্যে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য, উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালিত একটা সাংগঠনিক প্রক্রিয়া থাকতে হয়। বিপ্লব মানে মৌলিক একটা পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে যখন রাষ্ট্র বা সরকারব্যবস্থার পরিবর্তন করা হয়। এখানে কিন্তু সেই ব্যাপারটা ছিল না। এটা কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল, রাষ্ট্রব্যবস্থা পরিবর্তনের লক্ষ্য থাকলে প্রস্তুতি অন্য রকম থাকত। তবে এই অভ্যুত্থানের মধ্যে বিপ্লবের উপাদান আছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে নেতৃত্বের ভূমিকা দেখা গেছে, সেটা অসাধারণ ব্যাপার ছিল। এর সঙ্গে শিক্ষক, শ্রমজীবী মানুষ ও নারীদের অংশগ্রহণ ছিল উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। যেখানে আগে অভিভাবকেরা সন্তানদের ছেড়ে দিতেন না, সেখানে তাঁরা এই আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন।
রাষ্ট্রযন্ত্রের নিষ্ঠুর ও ভয়ংকর আক্রমণ মোকাবিলা করে যেভাবে পুরো সমাজ দাঁড়িয়েছিল, সেটাই গণ-অভ্যুত্থান তৈরি করেছে। মূল দাবি এসেছে—এ অবস্থা এভাবে চলতে পারে না। সবার মধ্যে যখন প্রত্যাশা তৈরি হয় আগের অবস্থায় আর ফেরত যাওয়া যাবে না, বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামী লীগের শাসনে আর ফিরে যাওয়া যাবে না, সেই আকাঙ্ক্ষাটাই হলো বিপ্লবের উপাদান। এখন গণ-অভ্যুত্থানকে কত দূর পর্যন্ত নেওয়া যাবে, সেটা সামনের দিনে আরও স্পষ্ট হবে।
আজকের পত্রিকা: এই অভ্যুত্থানকে যাঁরা গ্রহণ করছেন না। তাঁরা বলছেন, এটা বিদেশি চক্রান্তের ফল। আপনার কাছে কী মনে হয়?
আনু মুহাম্মদ: বাংলাদেশ নিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং রাজনৈতিক আধিপত্যের ব্যাপার আছে। এখানে ভারতের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। চীনের প্রভাব ক্রমাগত বাড়ছে। রাশিয়ার স্বার্থ আছে আর যুক্তরাষ্ট্রের বড় কৌশলগত স্বার্থ আছে। সুতরাং যখনই একটা পরিবর্তন ঘটছে, সেই সময় সবারই কিছু না কিছু ভূমিকা থাকার কথা। এই গণ-অভ্যুত্থানে সেই সুযোগটা নেওয়ারই কথা। কিন্তু ঘটনাটা যে বিদেশি শক্তির কারণে হয়েছে, এ রকম বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়।
আন্দোলনের পরম্পরা দেখলেই বোঝা যায়, ব্যাপারটা মোটেই সে রকম নয়। প্রধানত শেখ হাসিনার জেদ ও অহমিকার কারণে ভয়ংকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ধরা যাক, পুলিশ যে নিষ্ঠুর কায়দায় গুলি করে শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত প্রকাশ্যে ও অপ্রয়োজনে সরাসরি গুলি করে হত্যা করেছে এবং ছাত্রলীগ-যুবলীগ সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়েছে, বাহিনী হেলিকপ্টার দিয়ে নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি করেছে, এগুলো কি বিদেশিরা করেছে? এটা বাংলাদেশের সাবেক সরকার করেছে। বিদেশিরা এই পরিস্থিতির সুবিধা তো নিতেই পারে। এ রকম কথা আমরা ১৯৭১ সালেও শুনেছি। যেমন মুক্তিযুদ্ধটা ভারত করেছে। এগুলো বললে হবে না। দেশের ভেতরে কীভাবে আন্দোলনটা গড়ে উঠেছে, জনগণের ভূমিকা ও আকাঙ্ক্ষা কী ছিল, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তারপর বিদেশি শক্তি সুবিধা নিতে পারে, সেটা অন্য প্রসঙ্গ।
গণ-অভ্যুত্থানের পরে পরিবর্তনটা যাতে জনগণের পক্ষে থাকে এবং জনগণের স্বার্থে একটা টেকসই বা মৌলিক পরিবর্তনের দিকে যায়, সেটা অভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের একটা বড় দায়িত্ব।
আজকের পত্রিকা: এই অভ্যুত্থানের পরে একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। শিক্ষার্থীসহ সবার প্রত্যাশা এখন রাষ্ট্র সংস্কার করা। আপনি কি মনে করেন এ সরকার সেই কাঙ্ক্ষিত সংস্কার করতে পারবে?
আনু মুহাম্মদ: অন্তর্বর্তী সরকার তো একটা বড় দায়িত্ব নিয়েছে। এখন এ সরকার সেই দায়িত্ব পালন করে কি না, সেটা আমরা দেখব। তারা যদি অবহেলা করে, উদাসীনতা দেখায়, তাহলে তো তাদের জনগণ দায়মুক্তি দেবে না। আগের আওয়ামী লীগ সরকার অনেক ধরনের দায়মুক্তি আইন করেছিল। কিন্তু এই সরকারকে আমরা দায়মুক্তি দেব না।
এই সরকারের প্রথম কাজ হচ্ছে, আগের সরকারের অর্থনৈতিক লুণ্ঠন ও রাজনৈতিক নিপীড়ন নিয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। জুলাই হত্যাকাণ্ডসহ অন্যান্য নিপীড়নের জন্য যারা দায়ী, তাদের বিচারের সম্মুখীন করা তাদের দায়িত্ব। তাদের আরও দায়িত্ব হলো, ব্যাংকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা দখল ও লুণ্ঠন করেছে, তাদের কাছ থেকে সম্পদগুলো উদ্ধার করা। আর মানুষের জন্য মহা ক্ষতিকর মেগা প্রকল্প রামপাল কয়লা ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বাতিলের প্রক্রিয়া শুরু করা। এসব বাতিলের জন্য মানুষের একটা ঐকমত্য আছে। যেগুলো নিয়ে দীর্ঘ আন্দোলন হয়েছিল।
এরপর অর্থ ও সম্পদ পাচারের প্রক্রিয়া বন্ধ করা। আর জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করাতে হবে। কারণ আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সব প্রতিষ্ঠানে একটা ধস নেমেছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক, মানবাধিকার কমিশন, নির্বাচন কমিশন, আদালত, বিশ্ববিদ্যালয়—এ ধরনের সব প্রতিষ্ঠান দলীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়িয়েছিল। সে জন্য এগুলোকে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড় করাতে হবে। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে সুযোগ দেওয়া এবং জবাবদিহির আওতায় আনা এ সরকারের অন্যতম দায়িত্ব।
আজকের পত্রিকা: রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য কি করণীয়?
আনু মুহাম্মদ: অন্তর্বর্তী সরকারের সীমাবদ্ধতা হলো,
তারা সবকিছু করতে পারবে না। কিন্তু অনেক কিছুর ভিত্তি তৈরি করে দিতে পারবে। যেমন আমাদের যে সংবিধান আছে, সেটাই যদি বলবৎ থাকে, তাহলে যে সরকার এটার অধীনে থাকবে, তারাই স্বৈরতান্ত্রিক হবে। কারণ এটা ক্রমাগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে অধিকতর স্বৈরতান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক, জাতিবিদ্বেষী এবং বৈষম্যমূলক দলিলে পরিণত হয়েছে। এই সরকার সংবিধানসহ আইনকাঠামো পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো, যেমন কী পরিবর্তন করতে হবে, সে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের কমিশন গঠন করতে পারে। এ ছাড়া ব্যাংক খাতসহ অন্যান্য খাতে পরিবর্তনের ভিত্তি তৈরি করতে পারে। আর জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আইনকানুনের পরিবর্তন নিশ্চিত করতে পারে।
আগের সরকারগুলোর ঘাড়টা ঘোরানো ছিল কিছু দেশি-বিদেশি লুটেরা শক্তির দিকে। তাদের স্বার্থ দেখার জন্যই রাষ্ট্রের শক্তি ব্যবহার হতো। সে কারণে শিক্ষা, চিকিৎসা, জ্বালানি, নিরাপত্তা, পরিবহন, পরিবেশ—সব ক্ষেত্রে জনগণের জীবন বিপন্ন করে কিছু গোষ্ঠী ফুলেফেঁপে উঠেছে। এখন সরকারের ঘাড়টা ঘুরিয়ে দিতে হবে জনগণের দিকে। জনগণের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, সেটা সরকার তখনই শুরু করতে পারবে।
আজকের পত্রিকা: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আনু মুহাম্মদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে