হাসান মামুন
ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটার পর পাকিস্তানে কেমন নির্বাচন হবে, সে ব্যাপারে রাজনীতিসচেতন সবার মধ্যেই মোটামুটি স্পষ্ট ধারণা ছিল। দেশটির বিধান অনুযায়ী, একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের আয়োজন হলেও তারা যে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ প্রতিষ্ঠা করতে পারছিলেন না, সেটাও ছিল স্পষ্ট।
কিছু বিতর্কিত মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরানকে কারাগারে পাঠানোর পর তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নেতা-কর্মীর ওপর ‘ক্র্যাকডাউন’ও হতে দেখেছে সবাই। সেটা প্রায় অব্যাহতভাবে চলেছে। নির্বাচনে তাঁদের অংশ নিতে হয় চাপের মুখে ও সুকৌশলে।
পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনও তাঁদের প্রতি সুবিচার করেনি বলে অভিযোগ ওঠে জোরালোভাবে। কেননা, পিটিআই সমর্থিতদের নির্বাচনে যেতে হয় ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হিসেবে এবং দলের পরিচিত প্রতীক ছাড়া। প্রচারণা চালাতে গিয়েও পড়তে হয় বাধাবিপত্তির মুখে।
এ সময়টায় ইমরান ছিলেন কারাগারে এবং একাধিক মামলায় কারাদণ্ড হয়ে যাওয়ায় নির্বাচনেও লড়তে পারছিলেন না। এ অবস্থায় মনে করা হচ্ছিল, জনপ্রিয়তা থাকলেও এবং রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ার পর সহানুভূতি বাড়লেও ভোটের বাক্সে তাঁর দল এর প্রতিফলন ঘটাতে পারবে না। তাই ক্ষমতায় আসবে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন)। তাদের জিতিয়ে আনার জন্যই এ নির্বাচন, এমনটাই মনে করা হচ্ছিল দেশ-বিদেশে।
এমন একটা ‘নীলনকশা’ থাকলেও এর বাস্তবায়ন অবশ্য দেখা গেল না পাকিস্তানের নির্বাচনে। সব প্রতিকূলতার মুখেও দেখা গেল, ইমরান-সমর্থিত প্রার্থী, নেতা-কর্মী ও ভোটাররা মাঠ ছাড়লেন না। নজিরবিহীন ঐক্য আর নাছোড় মনোভাবের পরিচয় দিলেন তাঁরা এবং বিজয় ছিনিয়ে আনলেন।
এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত প্রাপ্ত খবরে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সব আসনের ফল ঘোষণা না হলেও পিটিআই সমর্থিতরা এগিয়ে আছেন স্পষ্টভাবে। অফিশিয়ালি কোনো দল না হলেও ইমরান খানের নেতৃত্বে তাঁরা যে আস্থাশীল, তাতে এখন পর্যন্ত কোনো সন্দেহ নেই। ‘এখন পর্যন্ত’ কথাটি বলা ভালো; কেননা কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় সরকার গঠনে শেষতক কী হয়, তা দেখার জন্য কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে।
ইমরান-সমর্থিতরা বেশির ভাগ আসনে জয়ী হয়ে এলেও দেশটির ক্ষমতার সবচেয়ে শক্তিশালী ও স্থায়ী অংশীদার সেনাবাহিনীর এবারের আস্থাভাজন ব্যক্তি নওয়াজ শরিফ ইতিমধ্যে তৎপর হয়ে উঠেছেন সরকার গঠনে। আলোচনা শুরু করা হয়েছে নির্বাচনে তৃতীয় স্থান অর্জনকারী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে।
জোট সরকার গঠনে এ দুই পক্ষ একমত হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে তাদের অন্যান্য দলের বিজয়ীদের সমর্থন দেখাতে হবে। সে ক্ষেত্রে পিটিআইয়ের বাইরে থেকে বিজয়ী কজন স্বতন্ত্রকে পক্ষে টানার চেষ্টা হতে পারে। ইমরানের নেতৃত্বাধীন কিছু স্বতন্ত্রকেও ‘ভাগিয়ে আনা’র চেষ্টা চালানো হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইমরান সরকারের পতন ঘটানোর সময় তাঁর দলের একাংশ কিন্তু বিরোধীদের কাতারে এসে অনাস্থা জানিয়েছিল। এতে সরকারের প্রতি রুষ্ট হয়ে ওঠা সেনাবাহিনী শুধু নয়; পাকিস্তানে বরাবরই সক্রিয় যুক্তরাষ্ট্রও কলকাঠি নাড়ে বলে খোলাখুলি অভিযোগ করেছিলেন ইমরান খান। তিনি নিজেও একসময় সেনাবাহিনীর আস্থাভাজন ছিলেন এবং তাদের সমর্থনেই রাজনীতিতে তাঁর দ্রুত উত্থান বলে মনে করা হয়।পাকিস্তানে এটি প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেখা যাচ্ছে, আগেকার মতো বাঁধা ছক ধরে সবকিছু এগোচ্ছে না। সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনের ‘চমকপ্রদ ফল’ তার একটি প্রমাণ বলা যেতে পারে।
অবশ্য এমনটাও মনে করা হচ্ছে, প্রধান তিন দলের কোনোটিই যেন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়—এর ব্যবস্থা করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সেটাই ছিল ছক! বলা হয়ে থাকে, ‘সব দেশেরই সেনাবাহিনী রয়েছে; তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আছে একটি দেশ’।
পাকিস্তান তাই দীর্ঘদিন থেকেছে সেনাশাসনে এবং বেসামরিক শাসনামলেও রাজনীতিতে ছিল তার কমবেশি অপ্রতিরোধ্য প্রভাব। নির্বাচনের মাধ্যমে এলেও তাদের অসম্মতিতে কোনো দল সরকার গড়তে পারেনি এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে সুসম্পর্ক ছাড়া কোনো সরকার টিকে থাকতেও পারেনি। ইমরানসহ কোনো বেসামরিক সরকার এ পর্যন্ত দেশটিতে পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেনি।
এই বাস্তবতায় এবারের নির্বাচন যে বিশেষ প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হলো, তাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ‘প্ল্যান-বি’ও থাকতে পারে নাকি? পছন্দের দল পিএমএল-এনকে এককভাবে জেতানো না গেলে নির্বাচনী ফলে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হতেই পারে, যাতে ইমরান অনুগতরা ক্ষমতায় ফিরতে ব্যর্থ হন। সে অবস্থায় একটা ‘ঝুলন্ত পার্লামেন্ট’ তৈরি হয়ে ভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ যেন অন্তত থাকে।
তেমন অবস্থায় পাকিস্তানে সরাসরি সেনা হস্তক্ষেপ ঘটার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যেভাবে অস্বাভাবিক দীর্ঘ সময় নিয়ে, থেমে থেমে ফল ঘোষণা হয়েছে এবং এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত সব আসনের ফল ঘোষণাও করা হয়নি, তাতে পিটিআইয়ের পক্ষ থেকে ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু হলেও ফলে কারচুপি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে জোরালোভাবে। পাকিস্তানের মিডিয়াও এ বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপনে কুণ্ঠিত হয়নি।
এ অবস্থায় সেনাবাহিনীর পাশাপাশি নির্বাচন অনুষ্ঠানে নিয়োজিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচন যেহেতু একটি প্রক্রিয়ার ব্যাপার, তাই এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের ভূমিকা স্বচ্ছ থাকাটা নিশ্চয় জরুরি। পাকিস্তানের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচন ঘিরে এ অবস্থায় নতুন কিছু প্রশ্নও উঠবে, যার নিষ্পত্তি করেই এগোতে হবে তাদের। এগোতে চাইলে!
নির্বাচনটি পাকিস্তানে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে—সেখান থেকে কী ধরনের সরকার আসবে এবং কে হবেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী, তা এখনো অনিশ্চিত। পিপিপির সঙ্গে পিএমএল-এনের ঐক্য হলে এবং তারা শেষতক সরকার গড়তে পারলে বিলাওয়াল তাঁর ‘দর–কষাকষির ক্ষমতা’ ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রীর পদ চাইতে পারেন। তবে সেনাবাহিনী মনে হয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নওয়াজকেই এগিয়ে রেখেছিল। তিনিও পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর মতো আচরণ শুরু করেছিলেন।
কিন্তু ইমরান ও তাঁর নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীর ঐক্য আর জনসমর্থনকে তাঁরা বোধ হয় হিসাবে নেয়নি। ইমরান সরকার তার অঙ্গীকার অনুযায়ী, দুর্নীতি দমন ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সফল হয়েছিল, তা কিন্তু বলা যাবে না। তাঁর সরকারের কিছু ‘ভুল নীতি’র কারণেও পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সংকট বরং তীব্রতর হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এ অবস্থায় দেশটির সিংহভাগ মানুষকে অশেষ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এখনো।
তা সত্ত্বেও ইমরান খান ও পিটিআই সেভাবে জনপ্রিয়তা হারায়নি। ক্ষমতা হারানোর পর তাঁর ও দলটির প্রতি যা যা করা হয়েছে, তাতে বরং নতুন করে জনপ্রিয় হন ইমরান। ক্ষমতার বাইরে থেকে অংশ নেওয়া সিংহভাগ উপনির্বাচনে তাঁর দলের প্রার্থীদের জয়ী হওয়া সেটারই প্রমাণ দেয়। এটা আবার পাকিস্তানের নির্বাচন-প্রক্রিয়ার তুলনামূলক স্বচ্ছতার ব্যাপারে বিশ্বাস জাগিয়ে তোলে বিরোধীদের মনে।
তীব্র বাধাবিপত্তির মুখেও ইমরান অনুগতরা যে মাঠ ছাড়েননি, সেটা এ বিশ্বাসের কারণেও। ভোটার, বিশেষ করে বিপুলসংখ্যক তরুণ ভোটারের ওপরও তাঁদের আস্থা ছিল। এমনটিও মনে করা হচ্ছে, স্বাভাবিকভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারলে পিটিআই এবার এককভাবেই জিতে ক্ষমতায় ফিরে আসত। ২০১৮ সালে কিন্তু অন্যদের সমর্থন নিয়ে তবেই তাদের সরকার গড়তে হয়েছিল।
যা-ই হোক, সরকার গড়তে না পারলেও ইমরান-সমর্থিতরা একটি প্রায় একতরফা নির্বাচনে দেশটির অত্যন্ত ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেভাবে লড়লেন, তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ইমরান খান তাঁকে ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্য যাদের বিষয়ে অভিযোগ করে আসছিলেন–যুক্তরাষ্ট্রসহ সেই পশ্চিমারাও কিন্তু দেরি না করে নির্বাচনটির মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তদন্ত চেয়েছে নির্বাচনে হস্তক্ষেপসহ উত্থাপিত অভিযোগগুলোর। এর পেছনে তাদের কী স্বার্থ বা উদ্দেশ্য রয়েছে, কে জানে। এমন অবস্থান ‘মূল্যবোধভিত্তিক’, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। তাদের অবস্থানে তো পরিবর্তনও ঘটে থাকে। একই সময়ে একেক দেশে একেক অবস্থানও নিতে দেখা যায়।
এখন সামনে দেখতে হবে, পশ্চিমা প্রভাবেও কোন দিকে মোড় নেয় পাকিস্তানের রাজনীতি। সেনাবাহিনীও বা নতুন কোনো অবস্থান নেয় কি না। এ অবস্থায় সংকট থেকে অধিকতর সংকটের দিকে যাত্রা করলে দেশটির অর্থনীতিও আরও বিপদগ্রস্ত হবে বলে ধারণা। শুধু বিদেশি ঋণদাতা, বিনিয়োগকারী আর বাণিজ্যিক অংশীদার নয়; দল-মতনির্বিশেষে জনগণেরও আস্থা কমবে দেশটির ওপর। সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনকেন্দ্রিক ঘটনাবলিতে পাকিস্তানের শেয়ারবাজার এরই মধ্যে নিম্নমুখী হয়ে পড়েছে বলে খবর মিলল। পড়ে গেছে সার্বভৌম বন্ডের দামও!
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটার পর পাকিস্তানে কেমন নির্বাচন হবে, সে ব্যাপারে রাজনীতিসচেতন সবার মধ্যেই মোটামুটি স্পষ্ট ধারণা ছিল। দেশটির বিধান অনুযায়ী, একটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের আয়োজন হলেও তারা যে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ প্রতিষ্ঠা করতে পারছিলেন না, সেটাও ছিল স্পষ্ট।
কিছু বিতর্কিত মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরানকে কারাগারে পাঠানোর পর তাঁর দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নেতা-কর্মীর ওপর ‘ক্র্যাকডাউন’ও হতে দেখেছে সবাই। সেটা প্রায় অব্যাহতভাবে চলেছে। নির্বাচনে তাঁদের অংশ নিতে হয় চাপের মুখে ও সুকৌশলে।
পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনও তাঁদের প্রতি সুবিচার করেনি বলে অভিযোগ ওঠে জোরালোভাবে। কেননা, পিটিআই সমর্থিতদের নির্বাচনে যেতে হয় ‘স্বতন্ত্র প্রার্থী’ হিসেবে এবং দলের পরিচিত প্রতীক ছাড়া। প্রচারণা চালাতে গিয়েও পড়তে হয় বাধাবিপত্তির মুখে।
এ সময়টায় ইমরান ছিলেন কারাগারে এবং একাধিক মামলায় কারাদণ্ড হয়ে যাওয়ায় নির্বাচনেও লড়তে পারছিলেন না। এ অবস্থায় মনে করা হচ্ছিল, জনপ্রিয়তা থাকলেও এবং রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়ার পর সহানুভূতি বাড়লেও ভোটের বাক্সে তাঁর দল এর প্রতিফলন ঘটাতে পারবে না। তাই ক্ষমতায় আসবে তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন)। তাদের জিতিয়ে আনার জন্যই এ নির্বাচন, এমনটাই মনে করা হচ্ছিল দেশ-বিদেশে।
এমন একটা ‘নীলনকশা’ থাকলেও এর বাস্তবায়ন অবশ্য দেখা গেল না পাকিস্তানের নির্বাচনে। সব প্রতিকূলতার মুখেও দেখা গেল, ইমরান-সমর্থিত প্রার্থী, নেতা-কর্মী ও ভোটাররা মাঠ ছাড়লেন না। নজিরবিহীন ঐক্য আর নাছোড় মনোভাবের পরিচয় দিলেন তাঁরা এবং বিজয় ছিনিয়ে আনলেন।
এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত প্রাপ্ত খবরে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সব আসনের ফল ঘোষণা না হলেও পিটিআই সমর্থিতরা এগিয়ে আছেন স্পষ্টভাবে। অফিশিয়ালি কোনো দল না হলেও ইমরান খানের নেতৃত্বে তাঁরা যে আস্থাশীল, তাতে এখন পর্যন্ত কোনো সন্দেহ নেই। ‘এখন পর্যন্ত’ কথাটি বলা ভালো; কেননা কোনো দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায় সরকার গঠনে শেষতক কী হয়, তা দেখার জন্য কিছুটা অপেক্ষা করতে হবে।
ইমরান-সমর্থিতরা বেশির ভাগ আসনে জয়ী হয়ে এলেও দেশটির ক্ষমতার সবচেয়ে শক্তিশালী ও স্থায়ী অংশীদার সেনাবাহিনীর এবারের আস্থাভাজন ব্যক্তি নওয়াজ শরিফ ইতিমধ্যে তৎপর হয়ে উঠেছেন সরকার গঠনে। আলোচনা শুরু করা হয়েছে নির্বাচনে তৃতীয় স্থান অর্জনকারী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টির (পিপিপি) গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে।
জোট সরকার গঠনে এ দুই পক্ষ একমত হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে তাদের অন্যান্য দলের বিজয়ীদের সমর্থন দেখাতে হবে। সে ক্ষেত্রে পিটিআইয়ের বাইরে থেকে বিজয়ী কজন স্বতন্ত্রকে পক্ষে টানার চেষ্টা হতে পারে। ইমরানের নেতৃত্বাধীন কিছু স্বতন্ত্রকেও ‘ভাগিয়ে আনা’র চেষ্টা চালানো হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
ইমরান সরকারের পতন ঘটানোর সময় তাঁর দলের একাংশ কিন্তু বিরোধীদের কাতারে এসে অনাস্থা জানিয়েছিল। এতে সরকারের প্রতি রুষ্ট হয়ে ওঠা সেনাবাহিনী শুধু নয়; পাকিস্তানে বরাবরই সক্রিয় যুক্তরাষ্ট্রও কলকাঠি নাড়ে বলে খোলাখুলি অভিযোগ করেছিলেন ইমরান খান। তিনি নিজেও একসময় সেনাবাহিনীর আস্থাভাজন ছিলেন এবং তাদের সমর্থনেই রাজনীতিতে তাঁর দ্রুত উত্থান বলে মনে করা হয়।পাকিস্তানে এটি প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেখা যাচ্ছে, আগেকার মতো বাঁধা ছক ধরে সবকিছু এগোচ্ছে না। সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনের ‘চমকপ্রদ ফল’ তার একটি প্রমাণ বলা যেতে পারে।
অবশ্য এমনটাও মনে করা হচ্ছে, প্রধান তিন দলের কোনোটিই যেন একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পায়—এর ব্যবস্থা করেছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। সেটাই ছিল ছক! বলা হয়ে থাকে, ‘সব দেশেরই সেনাবাহিনী রয়েছে; তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আছে একটি দেশ’।
পাকিস্তান তাই দীর্ঘদিন থেকেছে সেনাশাসনে এবং বেসামরিক শাসনামলেও রাজনীতিতে ছিল তার কমবেশি অপ্রতিরোধ্য প্রভাব। নির্বাচনের মাধ্যমে এলেও তাদের অসম্মতিতে কোনো দল সরকার গড়তে পারেনি এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে সুসম্পর্ক ছাড়া কোনো সরকার টিকে থাকতেও পারেনি। ইমরানসহ কোনো বেসামরিক সরকার এ পর্যন্ত দেশটিতে পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেনি।
এই বাস্তবতায় এবারের নির্বাচন যে বিশেষ প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হলো, তাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ‘প্ল্যান-বি’ও থাকতে পারে নাকি? পছন্দের দল পিএমএল-এনকে এককভাবে জেতানো না গেলে নির্বাচনী ফলে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করা হতেই পারে, যাতে ইমরান অনুগতরা ক্ষমতায় ফিরতে ব্যর্থ হন। সে অবস্থায় একটা ‘ঝুলন্ত পার্লামেন্ট’ তৈরি হয়ে ভিন্ন পরিস্থিতি সৃষ্টির সুযোগ যেন অন্তত থাকে।
তেমন অবস্থায় পাকিস্তানে সরাসরি সেনা হস্তক্ষেপ ঘটার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যেভাবে অস্বাভাবিক দীর্ঘ সময় নিয়ে, থেমে থেমে ফল ঘোষণা হয়েছে এবং এ নিবন্ধ লেখা পর্যন্ত সব আসনের ফল ঘোষণাও করা হয়নি, তাতে পিটিআইয়ের পক্ষ থেকে ভোটগ্রহণ সুষ্ঠু হলেও ফলে কারচুপি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তোলা হয়েছে জোরালোভাবে। পাকিস্তানের মিডিয়াও এ বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপনে কুণ্ঠিত হয়নি।
এ অবস্থায় সেনাবাহিনীর পাশাপাশি নির্বাচন অনুষ্ঠানে নিয়োজিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আর নির্বাচন কমিশনের ভূমিকাও হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচন যেহেতু একটি প্রক্রিয়ার ব্যাপার, তাই এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের ভূমিকা স্বচ্ছ থাকাটা নিশ্চয় জরুরি। পাকিস্তানের সদ্যসমাপ্ত নির্বাচন ঘিরে এ অবস্থায় নতুন কিছু প্রশ্নও উঠবে, যার নিষ্পত্তি করেই এগোতে হবে তাদের। এগোতে চাইলে!
নির্বাচনটি পাকিস্তানে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে—সেখান থেকে কী ধরনের সরকার আসবে এবং কে হবেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী, তা এখনো অনিশ্চিত। পিপিপির সঙ্গে পিএমএল-এনের ঐক্য হলে এবং তারা শেষতক সরকার গড়তে পারলে বিলাওয়াল তাঁর ‘দর–কষাকষির ক্ষমতা’ ব্যবহার করে প্রধানমন্ত্রীর পদ চাইতে পারেন। তবে সেনাবাহিনী মনে হয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নওয়াজকেই এগিয়ে রেখেছিল। তিনিও পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর মতো আচরণ শুরু করেছিলেন।
কিন্তু ইমরান ও তাঁর নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীর ঐক্য আর জনসমর্থনকে তাঁরা বোধ হয় হিসাবে নেয়নি। ইমরান সরকার তার অঙ্গীকার অনুযায়ী, দুর্নীতি দমন ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সফল হয়েছিল, তা কিন্তু বলা যাবে না। তাঁর সরকারের কিছু ‘ভুল নীতি’র কারণেও পাকিস্তানে অর্থনৈতিক সংকট বরং তীব্রতর হয়েছিল বলে মনে করা হয়। এ অবস্থায় দেশটির সিংহভাগ মানুষকে অশেষ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এখনো।
তা সত্ত্বেও ইমরান খান ও পিটিআই সেভাবে জনপ্রিয়তা হারায়নি। ক্ষমতা হারানোর পর তাঁর ও দলটির প্রতি যা যা করা হয়েছে, তাতে বরং নতুন করে জনপ্রিয় হন ইমরান। ক্ষমতার বাইরে থেকে অংশ নেওয়া সিংহভাগ উপনির্বাচনে তাঁর দলের প্রার্থীদের জয়ী হওয়া সেটারই প্রমাণ দেয়। এটা আবার পাকিস্তানের নির্বাচন-প্রক্রিয়ার তুলনামূলক স্বচ্ছতার ব্যাপারে বিশ্বাস জাগিয়ে তোলে বিরোধীদের মনে।
তীব্র বাধাবিপত্তির মুখেও ইমরান অনুগতরা যে মাঠ ছাড়েননি, সেটা এ বিশ্বাসের কারণেও। ভোটার, বিশেষ করে বিপুলসংখ্যক তরুণ ভোটারের ওপরও তাঁদের আস্থা ছিল। এমনটিও মনে করা হচ্ছে, স্বাভাবিকভাবে নির্বাচনে অংশ নিতে পারলে পিটিআই এবার এককভাবেই জিতে ক্ষমতায় ফিরে আসত। ২০১৮ সালে কিন্তু অন্যদের সমর্থন নিয়ে তবেই তাদের সরকার গড়তে হয়েছিল।
যা-ই হোক, সরকার গড়তে না পারলেও ইমরান-সমর্থিতরা একটি প্রায় একতরফা নির্বাচনে দেশটির অত্যন্ত ক্ষমতাধর সেনাবাহিনীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেভাবে লড়লেন, তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ইমরান খান তাঁকে ক্ষমতা থেকে হটানোর জন্য যাদের বিষয়ে অভিযোগ করে আসছিলেন–যুক্তরাষ্ট্রসহ সেই পশ্চিমারাও কিন্তু দেরি না করে নির্বাচনটির মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তদন্ত চেয়েছে নির্বাচনে হস্তক্ষেপসহ উত্থাপিত অভিযোগগুলোর। এর পেছনে তাদের কী স্বার্থ বা উদ্দেশ্য রয়েছে, কে জানে। এমন অবস্থান ‘মূল্যবোধভিত্তিক’, এটা বিশ্বাস করা কঠিন। তাদের অবস্থানে তো পরিবর্তনও ঘটে থাকে। একই সময়ে একেক দেশে একেক অবস্থানও নিতে দেখা যায়।
এখন সামনে দেখতে হবে, পশ্চিমা প্রভাবেও কোন দিকে মোড় নেয় পাকিস্তানের রাজনীতি। সেনাবাহিনীও বা নতুন কোনো অবস্থান নেয় কি না। এ অবস্থায় সংকট থেকে অধিকতর সংকটের দিকে যাত্রা করলে দেশটির অর্থনীতিও আরও বিপদগ্রস্ত হবে বলে ধারণা। শুধু বিদেশি ঋণদাতা, বিনিয়োগকারী আর বাণিজ্যিক অংশীদার নয়; দল-মতনির্বিশেষে জনগণেরও আস্থা কমবে দেশটির ওপর। সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনকেন্দ্রিক ঘটনাবলিতে পাকিস্তানের শেয়ারবাজার এরই মধ্যে নিম্নমুখী হয়ে পড়েছে বলে খবর মিলল। পড়ে গেছে সার্বভৌম বন্ডের দামও!
লেখক: সাংবাদিক, বিশ্লেষক
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৮ দিন আগে