নাসিরুদ্দিন চৌধুরী
পাকিস্তান চলে গেছে, কিন্তু পাকিস্তানের ভূত রয়ে গেছে। বাঙালি ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে পাকিস্তানি শাসনের অবসান ঘটায়। পাকিস্তান থেকে মুক্ত হওয়ার পর ৫২ বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু পাকিস্তানি মানসিকতা, চিন্তা, চেতনা থেকে আমরা এখনো পুরোপুরি মুক্ত হতে পারিনি। আমাদের মন ও মননে পাকিস্তানির রেশ রয়ে গেছে। হিন্দু-মুসলমান দুই জাতি— মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ফলে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পূর্ববঙ্গের বাঙালি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ইত্যাদি ধর্মীয় পরিচয়ে বিভক্ত হয়ে গেল।
যদিও জিন্নাহ পাকিস্তান গণপরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনে বলেছিলেন, ‘এখন থেকে হিন্দু আর হিন্দু থাকবে না, মুসলমান আর মুসলমান থাকবে না, সবাই হবে পাকিস্তানের নাগরিক, ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার, তার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনার সম্পর্ক থাকবে না।’ কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে; দ্বিজাতি তত্ত্বের বিষ পান করার ফলে মুসলমানদের মধ্যে তত দিনে সাম্প্রদায়িকতার বিষক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।
দ্বিজাতি তত্ত্ব হিন্দু-মুসলমান দুই প্রতিবেশীর মধ্যে যে বিভেদের দেয়াল তুলে দিয়েছিল, ভাষা আন্দোলনে সেই পাঁচিল উঠে গেল।
জাতীয়তার ভিত্তি হিসেবে ধর্মের দাবি বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়ে ভেঙে তছনছ হয়ে গেল। এর জন্য রমনার রাজপথ বাঙালির রক্তে রাঙিয়ে গেল; বাঙালি ঠেকে শিখল এবং পাকিস্তান শাসকদেরও বুঝিয়ে দিল ধর্ম নয়, জাতিই হতে পারে জাতীয়তার ভিত্তি। ভাষা আন্দোলন থেকে পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু রুখে দাঁড়ান। এরপর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ সালের স্বায়ত্তশাসনের দাবি, ১৯৬৬ সালে ৬ দফা প্রস্তাব পেশ করে তিনি বাঙালি জাতিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করলেন।
সত্তরের নির্বাচনে সমগ্র বাঙালি জাতি তাঁর পেছনে দাঁড়িয়েছিল। নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ২৫ মার্চ বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর হামলে পড়ার পর বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বাঙালি জাতি অসম সাহসিকতায় নয় মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের কথিত টাইগার নিয়াজি পাকিস্তানকে লজ্জায় ডুবিয়ে ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে মাথা নিচু করে অস্ত্রসমর্পণ করেন। তখন ঘন কৃষ্ণ অন্ধকারে সহস্র বর্ষের রাত্রির তপস্যার প্রহর গোনার অবসান হয়েছিল স্বাধীনতার সূর্যোদয়ে, তুমুল গর্জনে নবীন জাতির আত্মপ্রকাশের শিহরিত মুহূর্তে স্বাধীনতার সোনারোদে মাখামাখি হতে হতে সহর্ষে সে কী ওড়াউড়ি শৃঙ্খলমুক্ত বাঙালির!
রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে আমরা বাংলাদেশ কায়েম করেছি। পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করা মানে আমরা পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে পরাজিত করেছিলাম। তাহলে আবার পাকিস্তানি ভাবাদর্শ স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এল কোন ফাঁকফোকরে?
পাকিস্তানি আমলের মতো বাঙালি জাতি এখন আবার ধর্মীয় পরিচয়ে বিভক্ত হয়ে গেছে। এখন আমরা কেউ বাঙালি নই; আমরা কেউ মুসলমান, কেউ হিন্দু, কেউ বৌদ্ধ, কেউ খ্রিষ্টান। কোথায় গেল বাঙালি? পাকিস্তান আমলের মতো মুসলমানদের মধ্যে ইসলামি সেন্টিমেন্ট, ভারত বিরোধিতা, হিন্দুবিদ্বেষ প্রবল পরাক্রমে ফিরে এসেছে।
বাঙালির হৃদয়ে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা ও বাঙালি জাতীয়তার একটা দোলাচলবৃত্তি সব সময় ছিল—কখনো তা সুপ্ত, কখনো বা প্রত্যক্ষ। স্বাধীনতার জন্য জাতি যখন সংগ্রামে লিপ্ত ছিল, তখনো সাম্প্রদায়িকতার চোরাস্রোত ছিল, কিন্তু তার প্রকাশ তেমন ছিল না। বাঙালির মনের গহিন থেকে সাম্প্রদায়িকতাকে লড়াই করে মুছে ফেলার জন্য প্রয়োজন ছিল একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব, চীনে যেমন জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর সাংস্কৃতিক বিপ্লব হয়েছিল, বাংলাদেশেও জাতির মনোজগতে মৌলিক পরিবর্তন আনার জন্য ভাবাদর্শগত বা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রয়োজন ছিল। সেটা না হওয়ায় স্বাধীনতার দু-তিন বছরের মধ্যেই মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছিল। সেই বিষাক্ত আবহাওয়াতেই সংঘটিত হয়েছিল ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ড।
এরপর জিয়াউর রহমান রাজাকার শাহ আজিজ, আবদুল আলিম, আবদুল মতিন চৌধুরীকে মন্ত্রী বানান। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে আরেক রাজাকার আবদুর রহমান বিশ্বাসকে রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসিয়ে স্বাধীনতাকে উপহাস করলেন।
সাতচল্লিশে পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা যেভাবে আপসের চোরাগলি পথে এসেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা তো সেভাবে আসেনি। তবু পাকিস্তানি ভাবাদর্শ, অর্থাৎ ইসলামি জাতীয়তার দোহাই পেড়ে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি হয়েছে এবং হচ্ছে। ভারতে বিজেপির উত্থানের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে বিএনপি, জামায়াত, এমনকি মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, খেলাফত, হেফাজত, ইসলামী আন্দোলন ইত্যাদি নামে রাজনৈতিক দল গঠন করে যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা কী হতে পারে?
যুদ্ধে জয়-পরাজয় মানে তো এক পক্ষের উত্থান, অপর পক্ষের পতন। যুদ্ধে মাঝামাঝি কোনো পথ নেই, হয় জীবন, না হয় মৃত্যু। মুক্তিযুদ্ধে যারা পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষাবলম্বন করে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল, পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের পর তাদের বেঁচে থাকার কোনো কথা ছিল না। তবু তারা বেঁচে গেল এবং অন্ধকার বিবরে আত্মগোপন করে নাকটা ভাসিয়ে নীরবে অপেক্ষা করছিল অনুকূল সময়ের জন্য। ইতিমধ্যে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানে পাশার দান পাল্টে গেল। স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা অজ্ঞাতবাস থেকে বেরিয়ে এসে আবার সহজ-সরল বাঙালিকে ইসলামি ‘শরাব’ পান করাতে লাগল।
পাঞ্জাবি সামরিক-বেসামরিক আমলাদের অশুভ প্রভাবে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক রাজনীতি বিকশিত হতে পারেনি। পঞ্চাশের দশকে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বাঙালি নেতৃত্বের উত্থান লক্ষ করে আতঙ্কিত পাকিস্তানি জেনারেলরা আটান্ন সালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অগ্রগতিকে থামিয়ে দিয়েছিল। পাকিস্তানি জেনারেলরা দুবার রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছিল। একবার আটান্ন সালে, আরেকবার উনসত্তর সালে। সে জন্য বলা হয়ে থাকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় করতে না পারলেও নিজের দেশকে দুবার জয় করেছিল।
বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে আমলাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে গোটা পাকিস্তানি আমলে অবিরাম সংগ্রাম করেছেন এবং প্রাপ্তবয়স্কের সর্বজনীন ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে চেয়েছেন, যাতে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ ঘটে, যার অনিবার্য ফল আমলাতন্ত্রের ওপর রাজনীতিবিদদের হেজিমনি বা আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সালাউদ্দিন আহমদের পর্যবেক্ষণ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে: ‘১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রকারান্তরে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এভাবে শুরু হয় রাষ্ট্রের মিলিটারাইজেশন বা সামরিকীকরণ। পাকিস্তানি ভাবাপন্ন বাংলাদেশের সামরিক শাসকেরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও মূল্যবোধকে ধ্বংস করে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করতে উঠেপড়ে লাগে। পাকিস্তানি ভাবধারাকে এ দেশে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পাকিস্তানি কায়দায় ইসলামীকরণের প্রক্রিয়াও সেই সঙ্গে শুরু হয়ে গেল। কিন্তু সামরিক শাসকেরা যখন বুঝতে পারল যে, এ দেশের জনগণ এবং বিশ্ব সম্প্রদায় সামরিক শাসন পছন্দ করে না, তখন তারা সুকৌশলে বেসামরিক ছদ্মবেশ ধারণ করে সেনানিবাসে বসেই রাজনৈতিক দল গঠন করল। সেনানায়কেরা বেসামরিক পোশাক পরিধান করে রাতারাতি জননেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
এভাবে জন্ম হয় পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির। আর এভাবে সামরিক বাহিনীর দুই সেনাপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জাতীয় নেতা হিসেবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে অবতীর্ণ হন।’
পাকিস্তান চলে গেছে, কিন্তু পাকিস্তানের ভূত রয়ে গেছে। বাঙালি ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে পাকিস্তানি শাসনের অবসান ঘটায়। পাকিস্তান থেকে মুক্ত হওয়ার পর ৫২ বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু পাকিস্তানি মানসিকতা, চিন্তা, চেতনা থেকে আমরা এখনো পুরোপুরি মুক্ত হতে পারিনি। আমাদের মন ও মননে পাকিস্তানির রেশ রয়ে গেছে। হিন্দু-মুসলমান দুই জাতি— মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর এই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, ফলে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পূর্ববঙ্গের বাঙালি হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ইত্যাদি ধর্মীয় পরিচয়ে বিভক্ত হয়ে গেল।
যদিও জিন্নাহ পাকিস্তান গণপরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশনে বলেছিলেন, ‘এখন থেকে হিন্দু আর হিন্দু থাকবে না, মুসলমান আর মুসলমান থাকবে না, সবাই হবে পাকিস্তানের নাগরিক, ধর্ম ব্যক্তিগত ব্যাপার, তার সঙ্গে রাষ্ট্র পরিচালনার সম্পর্ক থাকবে না।’ কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে; দ্বিজাতি তত্ত্বের বিষ পান করার ফলে মুসলমানদের মধ্যে তত দিনে সাম্প্রদায়িকতার বিষক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে।
দ্বিজাতি তত্ত্ব হিন্দু-মুসলমান দুই প্রতিবেশীর মধ্যে যে বিভেদের দেয়াল তুলে দিয়েছিল, ভাষা আন্দোলনে সেই পাঁচিল উঠে গেল।
জাতীয়তার ভিত্তি হিসেবে ধর্মের দাবি বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়ে ভেঙে তছনছ হয়ে গেল। এর জন্য রমনার রাজপথ বাঙালির রক্তে রাঙিয়ে গেল; বাঙালি ঠেকে শিখল এবং পাকিস্তান শাসকদেরও বুঝিয়ে দিল ধর্ম নয়, জাতিই হতে পারে জাতীয়তার ভিত্তি। ভাষা আন্দোলন থেকে পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু রুখে দাঁড়ান। এরপর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৬ সালের স্বায়ত্তশাসনের দাবি, ১৯৬৬ সালে ৬ দফা প্রস্তাব পেশ করে তিনি বাঙালি জাতিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করলেন।
সত্তরের নির্বাচনে সমগ্র বাঙালি জাতি তাঁর পেছনে দাঁড়িয়েছিল। নির্বাচনের ফলাফলের ভিত্তিতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ২৫ মার্চ বাঙালি জাতির ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর হামলে পড়ার পর বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। বাঙালি জাতি অসম সাহসিকতায় নয় মাসের যুদ্ধে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে পরাজিত করে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের কথিত টাইগার নিয়াজি পাকিস্তানকে লজ্জায় ডুবিয়ে ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে রেসকোর্স ময়দানে মাথা নিচু করে অস্ত্রসমর্পণ করেন। তখন ঘন কৃষ্ণ অন্ধকারে সহস্র বর্ষের রাত্রির তপস্যার প্রহর গোনার অবসান হয়েছিল স্বাধীনতার সূর্যোদয়ে, তুমুল গর্জনে নবীন জাতির আত্মপ্রকাশের শিহরিত মুহূর্তে স্বাধীনতার সোনারোদে মাখামাখি হতে হতে সহর্ষে সে কী ওড়াউড়ি শৃঙ্খলমুক্ত বাঙালির!
রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করে আমরা বাংলাদেশ কায়েম করেছি। পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাজিত করা মানে আমরা পাকিস্তানি ভাবাদর্শকে পরাজিত করেছিলাম। তাহলে আবার পাকিস্তানি ভাবাদর্শ স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এল কোন ফাঁকফোকরে?
পাকিস্তানি আমলের মতো বাঙালি জাতি এখন আবার ধর্মীয় পরিচয়ে বিভক্ত হয়ে গেছে। এখন আমরা কেউ বাঙালি নই; আমরা কেউ মুসলমান, কেউ হিন্দু, কেউ বৌদ্ধ, কেউ খ্রিষ্টান। কোথায় গেল বাঙালি? পাকিস্তান আমলের মতো মুসলমানদের মধ্যে ইসলামি সেন্টিমেন্ট, ভারত বিরোধিতা, হিন্দুবিদ্বেষ প্রবল পরাক্রমে ফিরে এসেছে।
বাঙালির হৃদয়ে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা ও বাঙালি জাতীয়তার একটা দোলাচলবৃত্তি সব সময় ছিল—কখনো তা সুপ্ত, কখনো বা প্রত্যক্ষ। স্বাধীনতার জন্য জাতি যখন সংগ্রামে লিপ্ত ছিল, তখনো সাম্প্রদায়িকতার চোরাস্রোত ছিল, কিন্তু তার প্রকাশ তেমন ছিল না। বাঙালির মনের গহিন থেকে সাম্প্রদায়িকতাকে লড়াই করে মুছে ফেলার জন্য প্রয়োজন ছিল একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব, চীনে যেমন জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পর সাংস্কৃতিক বিপ্লব হয়েছিল, বাংলাদেশেও জাতির মনোজগতে মৌলিক পরিবর্তন আনার জন্য ভাবাদর্শগত বা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের প্রয়োজন ছিল। সেটা না হওয়ায় স্বাধীনতার দু-তিন বছরের মধ্যেই মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়ছিল। সেই বিষাক্ত আবহাওয়াতেই সংঘটিত হয়েছিল ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ড।
এরপর জিয়াউর রহমান রাজাকার শাহ আজিজ, আবদুল আলিম, আবদুল মতিন চৌধুরীকে মন্ত্রী বানান। খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে আরেক রাজাকার আবদুর রহমান বিশ্বাসকে রাষ্ট্রপতির চেয়ারে বসিয়ে স্বাধীনতাকে উপহাস করলেন।
সাতচল্লিশে পাকিস্তান ও ভারতের স্বাধীনতা যেভাবে আপসের চোরাগলি পথে এসেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা তো সেভাবে আসেনি। তবু পাকিস্তানি ভাবাদর্শ, অর্থাৎ ইসলামি জাতীয়তার দোহাই পেড়ে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি হয়েছে এবং হচ্ছে। ভারতে বিজেপির উত্থানের ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে বিএনপি, জামায়াত, এমনকি মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম, খেলাফত, হেফাজত, ইসলামী আন্দোলন ইত্যাদি নামে রাজনৈতিক দল গঠন করে যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চর্চা হচ্ছে, তার ব্যাখ্যা কী হতে পারে?
যুদ্ধে জয়-পরাজয় মানে তো এক পক্ষের উত্থান, অপর পক্ষের পতন। যুদ্ধে মাঝামাঝি কোনো পথ নেই, হয় জীবন, না হয় মৃত্যু। মুক্তিযুদ্ধে যারা পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষাবলম্বন করে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছিল, পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের পর তাদের বেঁচে থাকার কোনো কথা ছিল না। তবু তারা বেঁচে গেল এবং অন্ধকার বিবরে আত্মগোপন করে নাকটা ভাসিয়ে নীরবে অপেক্ষা করছিল অনুকূল সময়ের জন্য। ইতিমধ্যে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানে পাশার দান পাল্টে গেল। স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা অজ্ঞাতবাস থেকে বেরিয়ে এসে আবার সহজ-সরল বাঙালিকে ইসলামি ‘শরাব’ পান করাতে লাগল।
পাঞ্জাবি সামরিক-বেসামরিক আমলাদের অশুভ প্রভাবে পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক রাজনীতি বিকশিত হতে পারেনি। পঞ্চাশের দশকে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বাঙালি নেতৃত্বের উত্থান লক্ষ করে আতঙ্কিত পাকিস্তানি জেনারেলরা আটান্ন সালে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অগ্রগতিকে থামিয়ে দিয়েছিল। পাকিস্তানি জেনারেলরা দুবার রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেছিল। একবার আটান্ন সালে, আরেকবার উনসত্তর সালে। সে জন্য বলা হয়ে থাকে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয় করতে না পারলেও নিজের দেশকে দুবার জয় করেছিল।
বঙ্গবন্ধু রাজনীতিতে আমলাদের আধিপত্যের বিরুদ্ধে গোটা পাকিস্তানি আমলে অবিরাম সংগ্রাম করেছেন এবং প্রাপ্তবয়স্কের সর্বজনীন ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে চেয়েছেন, যাতে গণতান্ত্রিক রাজনীতির বিকাশ ঘটে, যার অনিবার্য ফল আমলাতন্ত্রের ওপর রাজনীতিবিদদের হেজিমনি বা আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ অধ্যাপক সালাউদ্দিন আহমদের পর্যবেক্ষণ এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে: ‘১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসের হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রকারান্তরে সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এভাবে শুরু হয় রাষ্ট্রের মিলিটারাইজেশন বা সামরিকীকরণ। পাকিস্তানি ভাবাপন্ন বাংলাদেশের সামরিক শাসকেরা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও মূল্যবোধকে ধ্বংস করে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় পাকিস্তানে পরিণত করতে উঠেপড়ে লাগে। পাকিস্তানি ভাবধারাকে এ দেশে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য পাকিস্তানি কায়দায় ইসলামীকরণের প্রক্রিয়াও সেই সঙ্গে শুরু হয়ে গেল। কিন্তু সামরিক শাসকেরা যখন বুঝতে পারল যে, এ দেশের জনগণ এবং বিশ্ব সম্প্রদায় সামরিক শাসন পছন্দ করে না, তখন তারা সুকৌশলে বেসামরিক ছদ্মবেশ ধারণ করে সেনানিবাসে বসেই রাজনৈতিক দল গঠন করল। সেনানায়কেরা বেসামরিক পোশাক পরিধান করে রাতারাতি জননেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
এভাবে জন্ম হয় পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি এবং জাতীয় পার্টির। আর এভাবে সামরিক বাহিনীর দুই সেনাপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ জাতীয় নেতা হিসেবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে অবতীর্ণ হন।’
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
২ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
২ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৬ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে