সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
গণতন্ত্র চাই, কিন্তু আসবে কি? আমাদের নিজেদের কথা থাক, ওই প্রসঙ্গ ওঠাতে গেলে গভীর দুঃখ উথলে ওঠে, অন্য দেশের কথাটাই ভাবতে হয়। ভারতে নির্বাচনে যে গেরুয়াধারী রামভক্তরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁদের ভাবসাব কিন্তু মোটেই গণতন্ত্রীদের মতো নয়। সেখানে আবারও নির্বাচন হবে, তাতে বুর্জোয়া দলগুলো যে রামভক্তদের হটিয়ে সর্বভারতীয় রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিতে পারবে, এমন ভরসা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। বামপন্থীরা মোটামুটি ছত্রভঙ্গ দশাতে রয়েছেন। বড় রকমের পরিবর্তন প্রত্যাশা করা মোটেই ন্যায়সংগত নয়।
নির্বাচন হয়েছে বেলারুশেও। ছাব্বিশ বছর ধরে যিনি ক্ষমতায় রয়েছেন, আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো, তিনি এবারও জিতেছেন বলে দাবি করছেন। বিরোধীদের দাবি, নির্বাচন হয়নি, একটা প্রহসন হয়েছে মাত্র, ব্যাপক প্রতারণা ও কারচুপি ঘটেছে। মুখের কথা নয় শুধু, প্রবল বিক্ষোভ হয়েছে। বিরোধীদলীয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী, যিনি দাবি করেছেন তিনিই জিতেছেন, তিনি দেশের ভেতর থেকে আন্দোলনের যে নেতৃত্ব দেবেন তা পারেননি, গোপনে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। আন্দোলনের পরও কিন্তু লুকাশেঙ্কো অনড় রয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে, সেনাবাহিনী তাঁর সঙ্গে আছে।
থাইল্যান্ডে যে নির্বাচন হয় না তা নয়, মাঝে মাঝেই হয়ে থাকে; কিন্তু দেখা যায় যারাই জিতুক, ঘুরেফিরে সেনাবাহিনীর কর্তারাই ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করছেন। কিন্তু ঘটেছে ভিন্ন রকমের ঘটনাও। ছাত্ররা নেমে পড়েছিল রাস্তায়। ছাত্ররা অতীতেও একবার প্রবলভাবে নেমেছিল। সেই বিক্ষোভ দমন করেই সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আসে।
থাইল্যান্ডে যে বিক্ষোভ কার্যকর হচ্ছে না, সেটা অন্যত্রও সত্য, বিশ্বব্যাপী এখন যে লড়াইটা দেখা দিয়েছে, সেটা আর বুর্জোয়াদের গৃহবিবাদ মাত্র নয়; বুর্জোয়া রাজত্বের চরম প্রকাশের সময়ে যা অনিবার্য, তারই আভাস ফুটে উঠছে সর্বত্র। সেটা গৃহযুদ্ধ।
মিয়ানমারও গৃহযুদ্ধের দিকেই এগোচ্ছে। সেখানেও নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি আগের চেয়েও ভালো ফল করেছিল এবং তাতেই ঘটেছে তাদের এবং ভোটদাতা জনগণের বিপদ। আসল ক্ষমতা সেখানে সেনাবাহিনীর হাতে, ক্ষমতা তারাই দখল করে রেখেছে এবং জবাবদিহির দায়বিহীন ক্ষমতায় থাকলে যা যা করা সম্ভব, সেসবই তারা করেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি—সবকিছুতেই অবাধ লুণ্ঠনের রাজত্ব বসিয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর গণনির্যাতন, তাদের গৃহে অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, হত্যাসহ যত রকমের জুলুম কল্পনা করা সম্ভব, সব চালিয়েও শান্ত থাকেনি, ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে অস্ত্রের মুখে দেশছাড়া করেছে, দুর্ভাগা মানুষদের জায়গা-জমি ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট যা ছিল সব দখল করে নিয়েছে। একদা বিশ্ববরেণ্য নেত্রী সু চি; তিনি প্রতিবাদ করবেন কি, উল্টো সহযোগিতাই করেছেন। অথচ ওই সেনাবাহিনী তাঁকে বছরের পর বছর আটক করে রেখেছিল, পারলে মেরেই ফেলত। আপসের ফর্মুলায় ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেবেন এবং নির্বাচনের পথে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেবেন, এই ছিল তাঁর আশা। তা সেনাবাহিনী সেটা হতে দেবে কেন? তাদের হাতে বন্দুক আছে, সেটা ব্যবহার করে পুনরায় তারা ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে। সু চিকে আবারও আটক করা হয়েছে। সু চির দল কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারেনি। তারা না পারুক, সাধারণ মানুষ ঠিকই পেরেছে। ওই একই ঘটনা। বুর্জোয়াদের গৃহবিবাদ মীমাংসার কাল শেষ হয়ে এসেছে। সামরিক দুঃশাসনের নিদারুণ শিকার যে সাধারণ মানুষ, লড়াইটা তাদেরই করতে হবে। তারা ভোট দিয়েছে সামরিক বাহিনীর বিপক্ষে; দেখেছে তাতে কাজ হলো না, ভোটে কুলাল না, এবার তাই নেমে এসেছে রাজপথে। কেবল রাজধানীতে নয়, দেশের সব শহরে। এসেছে ছাত্ররা। তারাই অধিক সংগঠিত। মিয়ানমারে ছাত্রবিদ্রোহ আগেও একবার হয়েছিল; সেবার সেনাবাহিনী ভয়াবহ রকমের রক্তপাত ঘটিয়ে তাদের দমন করেছিল। কিন্তু এবার আর সুবিধা করতে পারছে না। কারণ, ছাত্রদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পেশাজীবীরাও। সে দেশের মানুষ আর সেনাশাসন সহ্য করতে সম্মত নয়। এমনটা যে ঘটতে পারে, তা ছিল জেনারেলদের একেবারেই ধারণার বাইরে। কিন্তু অভ্যুত্থান না ঘটিয়ে তাদের পক্ষে কোনো উপায়ও ছিল না; নির্বাচনে বিজয়ী বুর্জোয়ারা তাদের ক্ষমতা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার আয়োজন করছিল। জেনারেলরা তাই একেবারে মরণকামড়ই বসিয়েছে। কিন্তু এটা তারা টের পাচ্ছে যে তাদের প্রতিপক্ষ এখন আর ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি নামের একটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল নয়, প্রতিপক্ষ মিয়ানমারের জনসাধারণ। অস্ত্র হাতে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে বিপদের শঙ্কা আছে। কে জানে শেষ পর্যন্ত পুলিশ হয়তো হুকুম শুনবে না, সেনাসদস্যরাও হয়তো আপনজনদের ওপর ট্যাংক-কামান-বন্দুক ইত্যাদি নিয়ে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে রাজি হবে না।
রোহিঙ্গা দমনের সময় যে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা লাখ লাখ অসহায় মানুষের মরণকান্নায় সাড়া তো দেয়ইনি, উল্টো সেনাবাহিনী ঠিক কাজ করছে বলে রাস্তায় বের হয়ে জেনারেলদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছিল, তারাও দেখা গেল এবার জেনারেলদের প্রতি সমর্থন জানাতে নারাজ। সু চি এবং তাঁর বুর্জোয়া সাথিরা না বুঝুক, বিক্ষোভরতরা নিশ্চয়ই টের পাচ্ছে যে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের হত্যা ও উচ্ছেদ-কাণ্ড সমাপ্ত করে তারা এখন কতটা যে হাত পাকিয়েছে, তারই একটা পরীক্ষা নিজের দেশের মানুষদের ওপর চালানোর পাঁয়তারায় আছে। রাজপথে সেনাবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ হয়তো নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের বেদনাটাও এখন অনুমান করতে পারছে। অভিজ্ঞতার চেয়ে বড় শিক্ষক তো আর হয় না। ছবিতে তো দেখাও গেল হাতে-ধরা প্ল্যাকার্ডগুলোর একটিতে লেখা রয়েছে, ‘রোহিঙ্গা সংকটের জন্য আমরা সত্যি দুঃখিত’।
রোহিঙ্গারা যে অপরাধী নয়, তারা যে মিয়ানমারের নিপীড়িত মানুষদেরই একাংশ এবং দুর্বল বলেই যে জেনারেলদের লেলিয়ে দেওয়া সেনাদের হাতে তারা মার খেয়েছে, এসব সত্য রণসজ্জায় সজ্জিত হন্তারকদের একেবারে সামনাসামনি দেখার পরে সাধারণ মানুষের স্মৃতিতে ভেসে ওঠাটা অসম্ভব নয়। উগ্র জাতীয়তাবাদীদের মৌতাত ভেঙে মানবিকতার এই নাড়াচাড়া দেওয়াটা দৃশ্য হিসেবে সুখকর, ঘটনা হিসেবে আশাপ্রদ। নব্য পুঁজিবাদী চীনের এবং পাকাপোক্ত পুঁজিবাদী রাশিয়ার যে কতটা অধঃপতন ঘটে গেছে, সেটাও সামরিক জান্তার প্রতি ওই দুই দেশের শাসকদের নীরব সমর্থন দেখে মিয়ানমারবাসীর বিলক্ষণ টের পাওয়ার কথা।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট, কেজেবির সাবেক কর্মচারী ভ্লাদিমির পুতিনও বেশ ‘গণতন্ত্রমনা’ দেখা যাচ্ছে। তিনি নির্বাচন দিয়ে থাকেন; তবে নির্বাচনব্যবস্থাটাকে এতটাই নিখুঁত করে ফেলেছেন যে তাঁর আমৃত্যু নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট থাকতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কমিউনিস্টদের উপস্থিতি যাতে শক্তিশালী না হয় তার ব্যবস্থা অবশ্য আগেই করে রাখা হয়েছে। বুর্জোয়ারা যে দল গঠন করবে এমন সম্ভাবনাও তাঁর গোয়েন্দা বাহিনী প্রায় নির্মূল করে ফেলেছে। তবু প্রতিবাদ কিন্তু হচ্ছে। এক ব্যক্তি, তাঁর কোনো গোছানো দল নেই, সাহস করে তিনি যেই বলেছেন যে আগামী নির্বাচনে তিনি পুতিনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন, অমনি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দারা তৎপর হয়ে উঠেছে; বলা তো যায় না লোকেরা না আবার ওই প্রায়-অচেনা ব্যক্তিটির পেছনেই দাঁড়িয়ে যায় কি না। গোয়েন্দারা কোনো ঝুঁকি নেয়নি, লোকটিকে তারা ইহজগৎ থেকেই সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। খাবারে নয়, তাঁর অন্তর্বাসের ভেতরে বিষ মাখিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। লোকটির টেকার কথা ছিল না। হাসপাতালে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে ছিল; জার্মান দূতাবাসের লোকেরা বললেন, চিকিৎসার জন্য তাঁকে আমরা আমাদের দেশের হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাই। রুশ দেশের বড় বড় চিকিৎসক সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠলেন, সর্বনাশ! এই রোগীকে তো তাঁর রোগশয্যার বাইরে নেওয়া যাবে না, নাড়াচাড়া করলেই তাঁর প্রাণবায়ু পলাতক হবে। জার্মানরা তবু পীড়াপীড়ি করতে থাকলেন, সংজ্ঞাহীন মৃতপ্রায় ব্যক্তিটির আপনজনেরাও বললেন, আমরা ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। লোকটি জার্মানির হাসপাতালে গেলেন এবং কী কঠিন তাঁর প্রাণশক্তি ও অবিচল দক্ষতা জার্মান চিকিৎসকদের যে চিকিৎসায় তিনি সেরে উঠলেন। তবে ফেরত আসার সঙ্গে সঙ্গে, বিমানবন্দরেই তাঁকে আটক করা হলো। যথারীতি মামলা দেওয়া হলো এবং যথাপ্রত্যাশিত স্বাধীন আদালতের সুবিবেচিত রায়ে তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে গেলেন। অনেক লোক প্রতিবাদ করল। শত শত নয়, হাজারে হাজার। এক দিন নয়, অনেক দিন ধরে। কিন্তু তাতে কী হবে? অদম্য ব্যক্তিটি জেলেই আছেন, কারণ, তিনি তাঁর এই ঘোষণায় অনড় রয়েছেন যে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়বেনই। কাজেই তাঁর জন্য আরও অনেক দুর্ভোগ যে অপেক্ষা করছে, এটা নিশ্চিতরূপেই বলা যায়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এটাই দাঁড়াবে যে পুতিনই জিতবেন। তবে এটা লোকে বুঝবে; যেমনটা অন্য দেশের মানুষেরাও বুঝতে পারছে যে স্বৈরশাসকদের হটাতে গেলে নির্বাচনে আর কুলাবে না, অনিবার্য হচ্ছে অভ্যুত্থান। যার অপর নাম গৃহযুদ্ধ। সেই যুদ্ধেও কিন্তু কাজ হবে না, যুদ্ধটা যদি কেবল ব্যক্তিকে সরানোর জন্যই হয়। প্রয়োজন হবে সামাজিক বিপ্লবের, যে বিপ্লব লেনিন ঘটিয়েছিলেন রাশিয়ায়, মাও সে-তুং চীনে। কিন্তু সেই বিপ্লবের অর্জনও স্থায়ী হবে না যদি না বিপ্লব বিশ্বময় ঘটে। এর বাইরে যা, সেসব কেবলি সংঘর্ষ, অরাজকতা ও মেরুকরণ বৃদ্ধি।
রাশিয়া যে পুরোপুরি পুঁজিবাদী হয়ে গেছে তার প্রমাণ ভেতরে-বাইরে সুন্দরভাবে দৃশ্যমান। ভেতরে চলছে স্বৈরাচার, বিরোধীদের নিষ্পেষণ, দুর্নীতি, পরিবেশদূষণ। বাইরে বিক্রি করছে অস্ত্র; মিয়ানমারের সেনা-শাসকেরা অস্ত্র পাচ্ছে রাশিয়ার কাছ থেকে। শেষমেশ ঘটল ইউক্রেনের ওপর হামলে পড়া। কারণ, ইউক্রেন বশ মানছিল না; পুঁজিবাদে দীক্ষিত হয়ে ইউক্রেনও চাইছিল পুঁজিবাদী দেশগুলোর সঙ্গে মিলেমিশে ‘উন্নতি’ করবে। যোগ দেবে ন্যাটোতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে এবং বন্ধুত্ব গড়ে তুলবে আমেরিকার সঙ্গে। মহামতি পুতিনের তাতে ভীষণ রাগ। ইউক্রেন একসময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, ইউক্রেনকে রাশিয়া এখন অনুগত প্রতিবেশী হিসেবে দেখতে চায়, শত্রুদের সঙ্গে হাত মেলানো তার জন্য বড় অপরাধ; তাতে ‘রাশিয়ার নিরাপত্তা’ বিঘ্নিত হওয়ারও আশঙ্কা।
লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
গণতন্ত্র চাই, কিন্তু আসবে কি? আমাদের নিজেদের কথা থাক, ওই প্রসঙ্গ ওঠাতে গেলে গভীর দুঃখ উথলে ওঠে, অন্য দেশের কথাটাই ভাবতে হয়। ভারতে নির্বাচনে যে গেরুয়াধারী রামভক্তরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁদের ভাবসাব কিন্তু মোটেই গণতন্ত্রীদের মতো নয়। সেখানে আবারও নির্বাচন হবে, তাতে বুর্জোয়া দলগুলো যে রামভক্তদের হটিয়ে সর্বভারতীয় রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিতে পারবে, এমন ভরসা আপাতত দেখা যাচ্ছে না। বামপন্থীরা মোটামুটি ছত্রভঙ্গ দশাতে রয়েছেন। বড় রকমের পরিবর্তন প্রত্যাশা করা মোটেই ন্যায়সংগত নয়।
নির্বাচন হয়েছে বেলারুশেও। ছাব্বিশ বছর ধরে যিনি ক্ষমতায় রয়েছেন, আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কো, তিনি এবারও জিতেছেন বলে দাবি করছেন। বিরোধীদের দাবি, নির্বাচন হয়নি, একটা প্রহসন হয়েছে মাত্র, ব্যাপক প্রতারণা ও কারচুপি ঘটেছে। মুখের কথা নয় শুধু, প্রবল বিক্ষোভ হয়েছে। বিরোধীদলীয় প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী, যিনি দাবি করেছেন তিনিই জিতেছেন, তিনি দেশের ভেতর থেকে আন্দোলনের যে নেতৃত্ব দেবেন তা পারেননি, গোপনে দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। আন্দোলনের পরও কিন্তু লুকাশেঙ্কো অনড় রয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে, সেনাবাহিনী তাঁর সঙ্গে আছে।
থাইল্যান্ডে যে নির্বাচন হয় না তা নয়, মাঝে মাঝেই হয়ে থাকে; কিন্তু দেখা যায় যারাই জিতুক, ঘুরেফিরে সেনাবাহিনীর কর্তারাই ক্ষমতায় আসা-যাওয়া করছেন। কিন্তু ঘটেছে ভিন্ন রকমের ঘটনাও। ছাত্ররা নেমে পড়েছিল রাস্তায়। ছাত্ররা অতীতেও একবার প্রবলভাবে নেমেছিল। সেই বিক্ষোভ দমন করেই সেনাবাহিনী ক্ষমতায় আসে।
থাইল্যান্ডে যে বিক্ষোভ কার্যকর হচ্ছে না, সেটা অন্যত্রও সত্য, বিশ্বব্যাপী এখন যে লড়াইটা দেখা দিয়েছে, সেটা আর বুর্জোয়াদের গৃহবিবাদ মাত্র নয়; বুর্জোয়া রাজত্বের চরম প্রকাশের সময়ে যা অনিবার্য, তারই আভাস ফুটে উঠছে সর্বত্র। সেটা গৃহযুদ্ধ।
মিয়ানমারও গৃহযুদ্ধের দিকেই এগোচ্ছে। সেখানেও নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনে অং সান সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি আগের চেয়েও ভালো ফল করেছিল এবং তাতেই ঘটেছে তাদের এবং ভোটদাতা জনগণের বিপদ। আসল ক্ষমতা সেখানে সেনাবাহিনীর হাতে, ক্ষমতা তারাই দখল করে রেখেছে এবং জবাবদিহির দায়বিহীন ক্ষমতায় থাকলে যা যা করা সম্ভব, সেসবই তারা করেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি—সবকিছুতেই অবাধ লুণ্ঠনের রাজত্ব বসিয়েছে। রোহিঙ্গাদের ওপর গণনির্যাতন, তাদের গৃহে অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, হত্যাসহ যত রকমের জুলুম কল্পনা করা সম্ভব, সব চালিয়েও শান্ত থাকেনি, ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে অস্ত্রের মুখে দেশছাড়া করেছে, দুর্ভাগা মানুষদের জায়গা-জমি ব্যবসা-বাণিজ্য, দোকানপাট যা ছিল সব দখল করে নিয়েছে। একদা বিশ্ববরেণ্য নেত্রী সু চি; তিনি প্রতিবাদ করবেন কি, উল্টো সহযোগিতাই করেছেন। অথচ ওই সেনাবাহিনী তাঁকে বছরের পর বছর আটক করে রেখেছিল, পারলে মেরেই ফেলত। আপসের ফর্মুলায় ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেবেন এবং নির্বাচনের পথে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেবেন, এই ছিল তাঁর আশা। তা সেনাবাহিনী সেটা হতে দেবে কেন? তাদের হাতে বন্দুক আছে, সেটা ব্যবহার করে পুনরায় তারা ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে। সু চিকে আবারও আটক করা হয়েছে। সু চির দল কিন্তু প্রতিবাদ করতে পারেনি। তারা না পারুক, সাধারণ মানুষ ঠিকই পেরেছে। ওই একই ঘটনা। বুর্জোয়াদের গৃহবিবাদ মীমাংসার কাল শেষ হয়ে এসেছে। সামরিক দুঃশাসনের নিদারুণ শিকার যে সাধারণ মানুষ, লড়াইটা তাদেরই করতে হবে। তারা ভোট দিয়েছে সামরিক বাহিনীর বিপক্ষে; দেখেছে তাতে কাজ হলো না, ভোটে কুলাল না, এবার তাই নেমে এসেছে রাজপথে। কেবল রাজধানীতে নয়, দেশের সব শহরে। এসেছে ছাত্ররা। তারাই অধিক সংগঠিত। মিয়ানমারে ছাত্রবিদ্রোহ আগেও একবার হয়েছিল; সেবার সেনাবাহিনী ভয়াবহ রকমের রক্তপাত ঘটিয়ে তাদের দমন করেছিল। কিন্তু এবার আর সুবিধা করতে পারছে না। কারণ, ছাত্রদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পেশাজীবীরাও। সে দেশের মানুষ আর সেনাশাসন সহ্য করতে সম্মত নয়। এমনটা যে ঘটতে পারে, তা ছিল জেনারেলদের একেবারেই ধারণার বাইরে। কিন্তু অভ্যুত্থান না ঘটিয়ে তাদের পক্ষে কোনো উপায়ও ছিল না; নির্বাচনে বিজয়ী বুর্জোয়ারা তাদের ক্ষমতা থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার আয়োজন করছিল। জেনারেলরা তাই একেবারে মরণকামড়ই বসিয়েছে। কিন্তু এটা তারা টের পাচ্ছে যে তাদের প্রতিপক্ষ এখন আর ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি নামের একটি বুর্জোয়া রাজনৈতিক দল নয়, প্রতিপক্ষ মিয়ানমারের জনসাধারণ। অস্ত্র হাতে তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে বিপদের শঙ্কা আছে। কে জানে শেষ পর্যন্ত পুলিশ হয়তো হুকুম শুনবে না, সেনাসদস্যরাও হয়তো আপনজনদের ওপর ট্যাংক-কামান-বন্দুক ইত্যাদি নিয়ে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে রাজি হবে না।
রোহিঙ্গা দমনের সময় যে বৌদ্ধ সন্ন্যাসীরা লাখ লাখ অসহায় মানুষের মরণকান্নায় সাড়া তো দেয়ইনি, উল্টো সেনাবাহিনী ঠিক কাজ করছে বলে রাস্তায় বের হয়ে জেনারেলদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছিল, তারাও দেখা গেল এবার জেনারেলদের প্রতি সমর্থন জানাতে নারাজ। সু চি এবং তাঁর বুর্জোয়া সাথিরা না বুঝুক, বিক্ষোভরতরা নিশ্চয়ই টের পাচ্ছে যে সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের হত্যা ও উচ্ছেদ-কাণ্ড সমাপ্ত করে তারা এখন কতটা যে হাত পাকিয়েছে, তারই একটা পরীক্ষা নিজের দেশের মানুষদের ওপর চালানোর পাঁয়তারায় আছে। রাজপথে সেনাবাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মিয়ানমারের সাধারণ মানুষ হয়তো নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের বেদনাটাও এখন অনুমান করতে পারছে। অভিজ্ঞতার চেয়ে বড় শিক্ষক তো আর হয় না। ছবিতে তো দেখাও গেল হাতে-ধরা প্ল্যাকার্ডগুলোর একটিতে লেখা রয়েছে, ‘রোহিঙ্গা সংকটের জন্য আমরা সত্যি দুঃখিত’।
রোহিঙ্গারা যে অপরাধী নয়, তারা যে মিয়ানমারের নিপীড়িত মানুষদেরই একাংশ এবং দুর্বল বলেই যে জেনারেলদের লেলিয়ে দেওয়া সেনাদের হাতে তারা মার খেয়েছে, এসব সত্য রণসজ্জায় সজ্জিত হন্তারকদের একেবারে সামনাসামনি দেখার পরে সাধারণ মানুষের স্মৃতিতে ভেসে ওঠাটা অসম্ভব নয়। উগ্র জাতীয়তাবাদীদের মৌতাত ভেঙে মানবিকতার এই নাড়াচাড়া দেওয়াটা দৃশ্য হিসেবে সুখকর, ঘটনা হিসেবে আশাপ্রদ। নব্য পুঁজিবাদী চীনের এবং পাকাপোক্ত পুঁজিবাদী রাশিয়ার যে কতটা অধঃপতন ঘটে গেছে, সেটাও সামরিক জান্তার প্রতি ওই দুই দেশের শাসকদের নীরব সমর্থন দেখে মিয়ানমারবাসীর বিলক্ষণ টের পাওয়ার কথা।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট, কেজেবির সাবেক কর্মচারী ভ্লাদিমির পুতিনও বেশ ‘গণতন্ত্রমনা’ দেখা যাচ্ছে। তিনি নির্বাচন দিয়ে থাকেন; তবে নির্বাচনব্যবস্থাটাকে এতটাই নিখুঁত করে ফেলেছেন যে তাঁর আমৃত্যু নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট থাকতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। কমিউনিস্টদের উপস্থিতি যাতে শক্তিশালী না হয় তার ব্যবস্থা অবশ্য আগেই করে রাখা হয়েছে। বুর্জোয়ারা যে দল গঠন করবে এমন সম্ভাবনাও তাঁর গোয়েন্দা বাহিনী প্রায় নির্মূল করে ফেলেছে। তবু প্রতিবাদ কিন্তু হচ্ছে। এক ব্যক্তি, তাঁর কোনো গোছানো দল নেই, সাহস করে তিনি যেই বলেছেন যে আগামী নির্বাচনে তিনি পুতিনের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন, অমনি রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দারা তৎপর হয়ে উঠেছে; বলা তো যায় না লোকেরা না আবার ওই প্রায়-অচেনা ব্যক্তিটির পেছনেই দাঁড়িয়ে যায় কি না। গোয়েন্দারা কোনো ঝুঁকি নেয়নি, লোকটিকে তারা ইহজগৎ থেকেই সরিয়ে দিতে চেয়েছিল। খাবারে নয়, তাঁর অন্তর্বাসের ভেতরে বিষ মাখিয়ে দেওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। লোকটির টেকার কথা ছিল না। হাসপাতালে মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে ছিল; জার্মান দূতাবাসের লোকেরা বললেন, চিকিৎসার জন্য তাঁকে আমরা আমাদের দেশের হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাই। রুশ দেশের বড় বড় চিকিৎসক সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠলেন, সর্বনাশ! এই রোগীকে তো তাঁর রোগশয্যার বাইরে নেওয়া যাবে না, নাড়াচাড়া করলেই তাঁর প্রাণবায়ু পলাতক হবে। জার্মানরা তবু পীড়াপীড়ি করতে থাকলেন, সংজ্ঞাহীন মৃতপ্রায় ব্যক্তিটির আপনজনেরাও বললেন, আমরা ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত। লোকটি জার্মানির হাসপাতালে গেলেন এবং কী কঠিন তাঁর প্রাণশক্তি ও অবিচল দক্ষতা জার্মান চিকিৎসকদের যে চিকিৎসায় তিনি সেরে উঠলেন। তবে ফেরত আসার সঙ্গে সঙ্গে, বিমানবন্দরেই তাঁকে আটক করা হলো। যথারীতি মামলা দেওয়া হলো এবং যথাপ্রত্যাশিত স্বাধীন আদালতের সুবিবেচিত রায়ে তিনি দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে গেলেন। অনেক লোক প্রতিবাদ করল। শত শত নয়, হাজারে হাজার। এক দিন নয়, অনেক দিন ধরে। কিন্তু তাতে কী হবে? অদম্য ব্যক্তিটি জেলেই আছেন, কারণ, তিনি তাঁর এই ঘোষণায় অনড় রয়েছেন যে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে নির্বাচনে লড়বেনই। কাজেই তাঁর জন্য আরও অনেক দুর্ভোগ যে অপেক্ষা করছে, এটা নিশ্চিতরূপেই বলা যায়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য এটাই দাঁড়াবে যে পুতিনই জিতবেন। তবে এটা লোকে বুঝবে; যেমনটা অন্য দেশের মানুষেরাও বুঝতে পারছে যে স্বৈরশাসকদের হটাতে গেলে নির্বাচনে আর কুলাবে না, অনিবার্য হচ্ছে অভ্যুত্থান। যার অপর নাম গৃহযুদ্ধ। সেই যুদ্ধেও কিন্তু কাজ হবে না, যুদ্ধটা যদি কেবল ব্যক্তিকে সরানোর জন্যই হয়। প্রয়োজন হবে সামাজিক বিপ্লবের, যে বিপ্লব লেনিন ঘটিয়েছিলেন রাশিয়ায়, মাও সে-তুং চীনে। কিন্তু সেই বিপ্লবের অর্জনও স্থায়ী হবে না যদি না বিপ্লব বিশ্বময় ঘটে। এর বাইরে যা, সেসব কেবলি সংঘর্ষ, অরাজকতা ও মেরুকরণ বৃদ্ধি।
রাশিয়া যে পুরোপুরি পুঁজিবাদী হয়ে গেছে তার প্রমাণ ভেতরে-বাইরে সুন্দরভাবে দৃশ্যমান। ভেতরে চলছে স্বৈরাচার, বিরোধীদের নিষ্পেষণ, দুর্নীতি, পরিবেশদূষণ। বাইরে বিক্রি করছে অস্ত্র; মিয়ানমারের সেনা-শাসকেরা অস্ত্র পাচ্ছে রাশিয়ার কাছ থেকে। শেষমেশ ঘটল ইউক্রেনের ওপর হামলে পড়া। কারণ, ইউক্রেন বশ মানছিল না; পুঁজিবাদে দীক্ষিত হয়ে ইউক্রেনও চাইছিল পুঁজিবাদী দেশগুলোর সঙ্গে মিলেমিশে ‘উন্নতি’ করবে। যোগ দেবে ন্যাটোতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নে এবং বন্ধুত্ব গড়ে তুলবে আমেরিকার সঙ্গে। মহামতি পুতিনের তাতে ভীষণ রাগ। ইউক্রেন একসময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল, ইউক্রেনকে রাশিয়া এখন অনুগত প্রতিবেশী হিসেবে দেখতে চায়, শত্রুদের সঙ্গে হাত মেলানো তার জন্য বড় অপরাধ; তাতে ‘রাশিয়ার নিরাপত্তা’ বিঘ্নিত হওয়ারও আশঙ্কা।
লেখক: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৩ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৭ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৭ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১১ দিন আগে