মোনায়েম সরকার
৫ আগস্ট দেশে যে এত বড় কাণ্ড ঘটে যাবে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে শুধু নয়, দেশ ছেড়ে চলে যাবেন, এটা সত্যি আমার মতো অনেকের কাছেই ছিল অপ্রত্যাশিত, অভাবিত। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেক উত্থান-পতন দেখেছি, কিন্তু এবারের গণবিদ্রোহ সত্যি ব্যতিক্রমী। কোটা সংস্কারের মতো একটি সাধারণ ইস্যুকে কেন্দ্র করে সরকার পতনের আন্দোলন এত দ্রুত চূড়ান্ত পরিণতির দিকে যেতে পারে, সেটা যাঁরা স্বাভাবিক মনে করছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই অসাধারণ মেধাসম্পন্ন মানুষ। কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক ও ছাত্রসহ পেশাজীবীদের সংগঠনের নেতৃত্ব ছাড়া কয়েকজন ছাত্রের ডাকে এমন আন্দোলন আমার জীবনে এক নতুন অভিজ্ঞতা।
বলা হচ্ছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তারা রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ সম্পন্ন করে তারপর দেশে একটি নির্বাচনের আয়োজন করবে। এই সংস্কারকাজ শেষে ঠিক কত দিন পর নির্বাচন হবে, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। কাজটি কঠিন, তাই সময় তো দিতেই হবে। সেই সময়টা দুই বছর থেকে পাঁচ বছরও হতে পারে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে বলে একটি সাধারণ ধারণা আমাদের দেশে চালু আছে। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলেও বিএনপি ক্ষমতায় বসতে পারেনি। বিএনপি এখন অপেক্ষায়। তবে রাষ্ট্রক্ষমতায় না বসলেও রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করা হয় যেসব মাধ্যমে, সেগুলোর দখল মোটামুটি বিএনপির সমর্থকেরা নিয়েছেন বা নিচ্ছেন। সরকার দলনিরপেক্ষ হলেও প্রশাসন এখন বিএনপির নিয়ন্ত্রণে—এটা অস্বীকার করা যাবে না।
সত্যের সঙ্গে বসবাস করলেও কখনো কখনো কোনো বিশেষ সত্য চোখে ধরা দেয় না আমাদের। রাজনীতি যে ক্রমাগত রাজনীতিবিদদের হাত থেকে ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে, সেটা আমরা এত দিন দেখেও না দেখার ভান করেছি।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ৫৫ শতাংশই ছিলেন আইনজীবী আর ব্যবসায়ী ছিলেন মাত্র ৪ শতাংশ। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আইনজীবীর সংখ্যা কমে গিয়ে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়ে যায় অনেক। এই পার্লামেন্টে আইনজীবী নেমে আসেন ২৬ এবং ব্যবসায়ী উঠে আসেন ২৪ শতাংশে। ’৯১ সালের নির্বাচনে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। এবার আইনজীবী মাত্র ১৯ শতাংশ এবং ব্যবসায়ী ৫৩ শতাংশ। এরপর এটা আরও বেড়েছে। অর্থাৎ আমরা দেখছি, এ দেশের রাজনীতি সময়ের তালে তালে ক্রমেই প্রকৃত রাজনীতিবিদদের ছাড়িয়ে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দখলে চলে যাচ্ছে। সব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বুদ্ধিজীবী শ্রেণি রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদান করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন প্রায়ই দেখা যায়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা যাদের নেই, তারাই রাজনীতির নিয়ামক শক্তি হয়ে ওঠে।
এই উপমহাদেশের রাজনীতি একসময় প্রতিভাবান, বিশেষত আইন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা অলংকৃত হয়েছিল। গান্ধী, নেহরু, জিন্নাহ, আবুল কালাম আজাদ, এ কে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু—তাঁদের প্রত্যেকেই জনকল্যাণের প্রতি নিবেদিতপ্রাণই শুধু ছিলেন না, আইনশাস্ত্র-জ্ঞান-পাণ্ডিত্যের দিক থেকেও তাঁরা ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম সারির মানুষ। তাঁদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, প্রতিভার শক্তি আর বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশলের কারণেই পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ ব্রিটিশ জাতি এই উপমহাদেশ থেকে তাদের সাম্রাজ্য গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ভারতবিভাগের পর ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের রাজনীতিই নিয়ন্ত্রণ করছিলেন বিভাগ-পূর্ব রাজনৈতিক নেতারা। কিন্তু ভারতে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকলেও পাকিস্তানে মাত্র এক দশকের মাথায় রাজনীতি উল্টোরথে যাত্রা শুরু করে। রাজনীতিবিদ সম্প্রদায়ের গায়ে কলঙ্কের ছাপ বসানোর চেষ্টা চলে একদিকে, অন্যদিকে একপর্যায়ে আইয়ুব খানের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী দখল করে নেয় পাকিস্তানের শাসনভার। উপমহাদেশের রাজনীতিতে অরাজনৈতিক অশুভ শক্তির সেটাই প্রথম অনুপ্রবেশ। নেহরুর নেতৃত্বে ভারত যতটা এগিয়ে গেল, আইয়ুবের নেতৃত্বে পাকিস্তান পিছিয়ে পড়ল ততটাই এবং সবচেয়ে পিছিয়ে থাকল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, যা আজকের বাংলাদেশ।
আইয়ুবী সামরিকতন্ত্রের বিপরীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় গড়ে উঠেছিল সুস্থ ধারার রাজনীতি এবং চেষ্টা হয়েছিল সামরিক আমলাতন্ত্রনির্ভর রাজনীতিকে সত্যিকারের রাজনীতি দ্বারা প্রতিস্থাপনের। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ তখন পেশাদার রাজনীতিবিদ এবং পণ্ডিতজন, বিশেষত আইনজীবী সম্প্রদায় দ্বারা সমৃদ্ধ। আওয়ামী লীগ প্রণীত ছয় দফা ছিল পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনকে কেন্দ্র করে জনকল্যাণের নিমিত্তে এক উচ্চমাপের রাজনীতির নির্যাস। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক শক্তির উৎস ছিল তাজউদ্দীন আহমদের মতো নিরেট রাজনীতিবিদেরা আর দার্শনিক ও অর্থনৈতিক চিন্তার জগৎ সমৃদ্ধ করেছিলেন প্রফেসর রাজ্জাক ও রেহমান সোবহানদের মতো গুণী ব্যক্তিরা। কতই না কার্যকর আর মনোমুগ্ধকর ছিল রাজনীতির সেই চেহারা। মেইনস্ট্রিমে বঙ্গবন্ধু। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী-ফজলুল হক নেই তো কী হয়েছে, আছেন ভাসানী-মণি সিংহ-মোজাফফর আহমদের মতো নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক রাজনীতিক। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় দেশটা স্বাধীনও হয়ে গেল।
স্বাধীনতার পর ইতিহাস থমকে দাঁড়াল ’৭৫-এ। পরিবর্তন করল তার গতিপথ। আবারও সামরিক শাসন। ক্ষমতা নিয়েই জিয়াউর রহমান দল গঠন করতে চাইলেন। জিয়া হাঁটলেন এক অশুভ রাস্তায়। প্রকাশ্যে ঘোষণা দেওয়া হলো—মানি ইজ নো প্রবলেম। আরও বললেন তিনি—আই উইল মেক পলিটিকস ডিফিকাল্ট ফর দ্য পলিটিশিয়ান। শুরু হয়ে গেল রাজনীতিতে অর্থের খেলা। টাকা ছিটিয়ে, ভয় দেখিয়ে ‘রাজনীতিবিদ’ জোগাড় করতে লাগলেন তিনি। বিভিন্ন পেশা, বিশেষত ব্যবসার জগৎ থেকে লোক জড়ো করে তিনি তাদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন এই বলে যে, তাঁরা সবাই রাজনীতিবিদ। ভিন্ন দল থেকেও স্খলিত অনেককে উচ্চমূল্যে কিনে নিলেন তিনি।
এভাবেই গড়ে উঠল রাজনীতি ও ব্যবসার এক রাষ্ট্রবিনাশী নেক্সাস। জিয়ার মৃত্যুর পর যখন তাঁর সামরিক শাসন এরশাদের সামরিক শাসন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলো, সমাজ-রাষ্ট্র ও রাজনীতির চেহারার কোনো ইতরবিশেষ ঘটল না। বরং রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন আরও এক বিশেষ মাত্রা পেল। জিয়া তাঁর রাজনৈতিক শক্তি সঞ্চয়ের জন্য স্বাধীনতাবিরোধীদেরও তার মঞ্চে উঠিয়ে রাজনীতিতে তাদের পুনর্বাসন করেছিলেন, খুনের দায়ে দণ্ডিতদের মুক্তি দিয়ে তথাকথিত জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে যোগ দেওয়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এরশাদের আমলেও দেখলাম আমরা একই ধরনের ঘটনা এবং সংখ্যায় তিনি এগিয়ে গেলেন। জিয়া তাঁর রাজনীতির স্বার্থে সাত খুনের মামলায় দণ্ডিত শফিউল আলম প্রধানের প্রতি যে অনুকম্পা দেখিয়েছিলেন, ময়েজুদ্দিন হত্যা মামলায় দণ্ডিত আযম খানের প্রতি এরশাদ দেখালেন একই রকম স্নেহাশীর্বাদ।
ইতিমধ্যে অবশ্য বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছেন, জিয়াপত্নী খালেদা জিয়া ধরেছেন বিএনপির হাল। তাঁদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং বাম সংগঠনগুলো গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু সমাজের অভ্যন্তরে নৈতিক অবক্ষয়ের যে ক্ষতিটা হয়ে গেছে, সেটা সারাবে কে? নিছক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তো তা সম্ভব নয়। সামাজিক শক্তির ভারসাম্য নিজের পক্ষে থাকলে স্বৈরাচার হটানো সম্ভব; কিন্তু দেশপ্রেমের বিপরীতে আত্মপ্রেমের যে রোগ বাসা বেঁধেছে মনে, নৈতিক শক্তির যে অধঃপতন ঘটেছে, তা তো আর মাঠে-ময়দানের এ ধরনের আন্দোলনে সারানো সম্ভব নয়। রাজনৈতিক নেতারা সেদিকে নজর দিলেন
না। তাঁরা নিমগ্ন থাকলেন কেবলই স্বৈরাচার হটানোর আন্দোলনে। একপর্যায়ে এরশাদ হটলেনও, কিন্তু রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের ধারাটি হটল না। পরবর্তীকালে যেসব সরকার এসেছে, তারাও একই পথে হাঁটল।
রাজনীতিতে অর্থের প্রভাব নির্বাচনী ব্যয় থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। বড় দুই দলে নির্বাচনের মনোনয়ন নিয়ে অর্থের যে খেলা হয়, তা এখন সর্বজনবিদিত ঘটনা। এমন বহু অভিযোগ রয়েছে, কোনো নির্বাচনী এলাকায় দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নিবেদিতপ্রাণ নেতাকে বাদ দিয়ে ধনাঢ্য কোনো ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। অর্থের লেনদেন ছাড়া এসব ঘটনার অন্য কোনো ব্যাখ্যা নেই। বিলাসী জীবনের জন্য রাজনীতিবিদদের টাকা চাই, আবার ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ক্ষমতা চাই। একে অন্যের পরিপূরক হয়ে কাজ করছেন ভালোই।
অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক আমলারা যখন অবসর নিয়েই রাজনীতিতে নামেন কিংবা দলের টিকিট পেয়ে নির্বাচন করেন, তখন দুর্বল হলেও তার একটা যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁরা প্রশাসনিক একটা সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করে এসেছেন, যেটার সঙ্গে রাজনীতির কিছু সংশ্রবও রয়েছে। এদের কারও কারও মধ্যে সংগঠন পরিচালনার নেতৃত্বের গুণাবলিও রয়েছে। কিন্তু স্রেফ টাকার জোরে যাঁরা রাজনীতি করতে আসেন, তাঁদের প্রসঙ্গে কী বলা যায়? পার্লামেন্টকে ব্যবসায়ীরাই যদি নিয়ন্ত্রণ করেন, তাহলে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো যে সাধারণের অনুকূলে না গিয়ে প্রধানত তাঁদের অনুকূলেই যাবে, তাতে আর সন্দেহ কী!
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক সংস্কার করার পর নিশ্চয়ই নির্বাচনের কথা ভাববে। যে দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেবে, তারা যেন অতীত অভিজ্ঞতা মনে রেখে জনগণের জন্য রাজনীতিতে মনোনিবেশ করে, সেটাই হবে সাধারণ মানুষের মূল চাওয়া। মানুষের এই চাওয়া পূরণ না হলে ফিকে হয়ে যাবে বিজয়ের আনন্দ।
লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক; চেয়ারম্যান, বিএফডিআর
৫ আগস্ট দেশে যে এত বড় কাণ্ড ঘটে যাবে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে শুধু নয়, দেশ ছেড়ে চলে যাবেন, এটা সত্যি আমার মতো অনেকের কাছেই ছিল অপ্রত্যাশিত, অভাবিত। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেক উত্থান-পতন দেখেছি, কিন্তু এবারের গণবিদ্রোহ সত্যি ব্যতিক্রমী। কোটা সংস্কারের মতো একটি সাধারণ ইস্যুকে কেন্দ্র করে সরকার পতনের আন্দোলন এত দ্রুত চূড়ান্ত পরিণতির দিকে যেতে পারে, সেটা যাঁরা স্বাভাবিক মনে করছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই অসাধারণ মেধাসম্পন্ন মানুষ। কোনো সংগঠিত রাজনৈতিক ও ছাত্রসহ পেশাজীবীদের সংগঠনের নেতৃত্ব ছাড়া কয়েকজন ছাত্রের ডাকে এমন আন্দোলন আমার জীবনে এক নতুন অভিজ্ঞতা।
বলা হচ্ছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, তারা রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ সম্পন্ন করে তারপর দেশে একটি নির্বাচনের আয়োজন করবে। এই সংস্কারকাজ শেষে ঠিক কত দিন পর নির্বাচন হবে, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। কাজটি কঠিন, তাই সময় তো দিতেই হবে। সেই সময়টা দুই বছর থেকে পাঁচ বছরও হতে পারে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে বলে একটি সাধারণ ধারণা আমাদের দেশে চালু আছে। কিন্তু এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলেও বিএনপি ক্ষমতায় বসতে পারেনি। বিএনপি এখন অপেক্ষায়। তবে রাষ্ট্রক্ষমতায় না বসলেও রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করা হয় যেসব মাধ্যমে, সেগুলোর দখল মোটামুটি বিএনপির সমর্থকেরা নিয়েছেন বা নিচ্ছেন। সরকার দলনিরপেক্ষ হলেও প্রশাসন এখন বিএনপির নিয়ন্ত্রণে—এটা অস্বীকার করা যাবে না।
সত্যের সঙ্গে বসবাস করলেও কখনো কখনো কোনো বিশেষ সত্য চোখে ধরা দেয় না আমাদের। রাজনীতি যে ক্রমাগত রাজনীতিবিদদের হাত থেকে ব্যবসায়ীদের হাতে চলে গেছে, সেটা আমরা এত দিন দেখেও না দেখার ভান করেছি।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ৫৫ শতাংশই ছিলেন আইনজীবী আর ব্যবসায়ী ছিলেন মাত্র ৪ শতাংশ। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আইনজীবীর সংখ্যা কমে গিয়ে ব্যবসায়ীর সংখ্যা বেড়ে যায় অনেক। এই পার্লামেন্টে আইনজীবী নেমে আসেন ২৬ এবং ব্যবসায়ী উঠে আসেন ২৪ শতাংশে। ’৯১ সালের নির্বাচনে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। এবার আইনজীবী মাত্র ১৯ শতাংশ এবং ব্যবসায়ী ৫৩ শতাংশ। এরপর এটা আরও বেড়েছে। অর্থাৎ আমরা দেখছি, এ দেশের রাজনীতি সময়ের তালে তালে ক্রমেই প্রকৃত রাজনীতিবিদদের ছাড়িয়ে ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দখলে চলে যাচ্ছে। সব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বুদ্ধিজীবী শ্রেণি রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রদান করে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যদি দুর্বল হয়ে পড়ে, তখন প্রায়ই দেখা যায়, রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্যতা যাদের নেই, তারাই রাজনীতির নিয়ামক শক্তি হয়ে ওঠে।
এই উপমহাদেশের রাজনীতি একসময় প্রতিভাবান, বিশেষত আইন বিশেষজ্ঞদের দ্বারা অলংকৃত হয়েছিল। গান্ধী, নেহরু, জিন্নাহ, আবুল কালাম আজাদ, এ কে ফজলুল হক, সোহরাওয়ার্দী, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু—তাঁদের প্রত্যেকেই জনকল্যাণের প্রতি নিবেদিতপ্রাণই শুধু ছিলেন না, আইনশাস্ত্র-জ্ঞান-পাণ্ডিত্যের দিক থেকেও তাঁরা ছিলেন উপমহাদেশের প্রথম সারির মানুষ। তাঁদের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, প্রতিভার শক্তি আর বুদ্ধিবৃত্তিক কৌশলের কারণেই পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ ব্রিটিশ জাতি এই উপমহাদেশ থেকে তাদের সাম্রাজ্য গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। ভারতবিভাগের পর ভারত ও পাকিস্তান উভয় দেশের রাজনীতিই নিয়ন্ত্রণ করছিলেন বিভাগ-পূর্ব রাজনৈতিক নেতারা। কিন্তু ভারতে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা বজায় থাকলেও পাকিস্তানে মাত্র এক দশকের মাথায় রাজনীতি উল্টোরথে যাত্রা শুরু করে। রাজনীতিবিদ সম্প্রদায়ের গায়ে কলঙ্কের ছাপ বসানোর চেষ্টা চলে একদিকে, অন্যদিকে একপর্যায়ে আইয়ুব খানের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী দখল করে নেয় পাকিস্তানের শাসনভার। উপমহাদেশের রাজনীতিতে অরাজনৈতিক অশুভ শক্তির সেটাই প্রথম অনুপ্রবেশ। নেহরুর নেতৃত্বে ভারত যতটা এগিয়ে গেল, আইয়ুবের নেতৃত্বে পাকিস্তান পিছিয়ে পড়ল ততটাই এবং সবচেয়ে পিছিয়ে থাকল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, যা আজকের বাংলাদেশ।
আইয়ুবী সামরিকতন্ত্রের বিপরীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলায় গড়ে উঠেছিল সুস্থ ধারার রাজনীতি এবং চেষ্টা হয়েছিল সামরিক আমলাতন্ত্রনির্ভর রাজনীতিকে সত্যিকারের রাজনীতি দ্বারা প্রতিস্থাপনের। বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ তখন পেশাদার রাজনীতিবিদ এবং পণ্ডিতজন, বিশেষত আইনজীবী সম্প্রদায় দ্বারা সমৃদ্ধ। আওয়ামী লীগ প্রণীত ছয় দফা ছিল পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনকে কেন্দ্র করে জনকল্যাণের নিমিত্তে এক উচ্চমাপের রাজনীতির নির্যাস। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক শক্তির উৎস ছিল তাজউদ্দীন আহমদের মতো নিরেট রাজনীতিবিদেরা আর দার্শনিক ও অর্থনৈতিক চিন্তার জগৎ সমৃদ্ধ করেছিলেন প্রফেসর রাজ্জাক ও রেহমান সোবহানদের মতো গুণী ব্যক্তিরা। কতই না কার্যকর আর মনোমুগ্ধকর ছিল রাজনীতির সেই চেহারা। মেইনস্ট্রিমে বঙ্গবন্ধু। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী-ফজলুল হক নেই তো কী হয়েছে, আছেন ভাসানী-মণি সিংহ-মোজাফফর আহমদের মতো নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক রাজনীতিক। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় দেশটা স্বাধীনও হয়ে গেল।
স্বাধীনতার পর ইতিহাস থমকে দাঁড়াল ’৭৫-এ। পরিবর্তন করল তার গতিপথ। আবারও সামরিক শাসন। ক্ষমতা নিয়েই জিয়াউর রহমান দল গঠন করতে চাইলেন। জিয়া হাঁটলেন এক অশুভ রাস্তায়। প্রকাশ্যে ঘোষণা দেওয়া হলো—মানি ইজ নো প্রবলেম। আরও বললেন তিনি—আই উইল মেক পলিটিকস ডিফিকাল্ট ফর দ্য পলিটিশিয়ান। শুরু হয়ে গেল রাজনীতিতে অর্থের খেলা। টাকা ছিটিয়ে, ভয় দেখিয়ে ‘রাজনীতিবিদ’ জোগাড় করতে লাগলেন তিনি। বিভিন্ন পেশা, বিশেষত ব্যবসার জগৎ থেকে লোক জড়ো করে তিনি তাদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন এই বলে যে, তাঁরা সবাই রাজনীতিবিদ। ভিন্ন দল থেকেও স্খলিত অনেককে উচ্চমূল্যে কিনে নিলেন তিনি।
এভাবেই গড়ে উঠল রাজনীতি ও ব্যবসার এক রাষ্ট্রবিনাশী নেক্সাস। জিয়ার মৃত্যুর পর যখন তাঁর সামরিক শাসন এরশাদের সামরিক শাসন দ্বারা প্রতিস্থাপিত হলো, সমাজ-রাষ্ট্র ও রাজনীতির চেহারার কোনো ইতরবিশেষ ঘটল না। বরং রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন আরও এক বিশেষ মাত্রা পেল। জিয়া তাঁর রাজনৈতিক শক্তি সঞ্চয়ের জন্য স্বাধীনতাবিরোধীদেরও তার মঞ্চে উঠিয়ে রাজনীতিতে তাদের পুনর্বাসন করেছিলেন, খুনের দায়ে দণ্ডিতদের মুক্তি দিয়ে তথাকথিত জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে যোগ দেওয়ানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এরশাদের আমলেও দেখলাম আমরা একই ধরনের ঘটনা এবং সংখ্যায় তিনি এগিয়ে গেলেন। জিয়া তাঁর রাজনীতির স্বার্থে সাত খুনের মামলায় দণ্ডিত শফিউল আলম প্রধানের প্রতি যে অনুকম্পা দেখিয়েছিলেন, ময়েজুদ্দিন হত্যা মামলায় দণ্ডিত আযম খানের প্রতি এরশাদ দেখালেন একই রকম স্নেহাশীর্বাদ।
ইতিমধ্যে অবশ্য বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেছেন, জিয়াপত্নী খালেদা জিয়া ধরেছেন বিএনপির হাল। তাঁদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এবং বাম সংগঠনগুলো গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু করে। কিন্তু সমাজের অভ্যন্তরে নৈতিক অবক্ষয়ের যে ক্ষতিটা হয়ে গেছে, সেটা সারাবে কে? নিছক স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তো তা সম্ভব নয়। সামাজিক শক্তির ভারসাম্য নিজের পক্ষে থাকলে স্বৈরাচার হটানো সম্ভব; কিন্তু দেশপ্রেমের বিপরীতে আত্মপ্রেমের যে রোগ বাসা বেঁধেছে মনে, নৈতিক শক্তির যে অধঃপতন ঘটেছে, তা তো আর মাঠে-ময়দানের এ ধরনের আন্দোলনে সারানো সম্ভব নয়। রাজনৈতিক নেতারা সেদিকে নজর দিলেন
না। তাঁরা নিমগ্ন থাকলেন কেবলই স্বৈরাচার হটানোর আন্দোলনে। একপর্যায়ে এরশাদ হটলেনও, কিন্তু রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নের ধারাটি হটল না। পরবর্তীকালে যেসব সরকার এসেছে, তারাও একই পথে হাঁটল।
রাজনীতিতে অর্থের প্রভাব নির্বাচনী ব্যয় থেকে সহজেই অনুমান করা যায়। বড় দুই দলে নির্বাচনের মনোনয়ন নিয়ে অর্থের যে খেলা হয়, তা এখন সর্বজনবিদিত ঘটনা। এমন বহু অভিযোগ রয়েছে, কোনো নির্বাচনী এলাকায় দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নিবেদিতপ্রাণ নেতাকে বাদ দিয়ে ধনাঢ্য কোনো ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। অর্থের লেনদেন ছাড়া এসব ঘটনার অন্য কোনো ব্যাখ্যা নেই। বিলাসী জীবনের জন্য রাজনীতিবিদদের টাকা চাই, আবার ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক ক্ষমতা চাই। একে অন্যের পরিপূরক হয়ে কাজ করছেন ভালোই।
অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ও বেসামরিক আমলারা যখন অবসর নিয়েই রাজনীতিতে নামেন কিংবা দলের টিকিট পেয়ে নির্বাচন করেন, তখন দুর্বল হলেও তার একটা যুক্তি খুঁজে পাওয়া যায়। তাঁরা প্রশাসনিক একটা সাংগঠনিক কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করে এসেছেন, যেটার সঙ্গে রাজনীতির কিছু সংশ্রবও রয়েছে। এদের কারও কারও মধ্যে সংগঠন পরিচালনার নেতৃত্বের গুণাবলিও রয়েছে। কিন্তু স্রেফ টাকার জোরে যাঁরা রাজনীতি করতে আসেন, তাঁদের প্রসঙ্গে কী বলা যায়? পার্লামেন্টকে ব্যবসায়ীরাই যদি নিয়ন্ত্রণ করেন, তাহলে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো যে সাধারণের অনুকূলে না গিয়ে প্রধানত তাঁদের অনুকূলেই যাবে, তাতে আর সন্দেহ কী!
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক সংস্কার করার পর নিশ্চয়ই নির্বাচনের কথা ভাববে। যে দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেবে, তারা যেন অতীত অভিজ্ঞতা মনে রেখে জনগণের জন্য রাজনীতিতে মনোনিবেশ করে, সেটাই হবে সাধারণ মানুষের মূল চাওয়া। মানুষের এই চাওয়া পূরণ না হলে ফিকে হয়ে যাবে বিজয়ের আনন্দ।
লেখক: রাজনীতিবিদ, লেখক; চেয়ারম্যান, বিএফডিআর
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
২ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৫ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৫ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
৯ দিন আগে