হাসান মামুন
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা নজিরবিহীন। নতুন অর্থবছরের প্রথম মাসেই সৃষ্ট এ পরিস্থিতি অর্থনীতির বিভিন্ন দিকে প্রভাব ফেলেছে দ্রুত। এটা এড়ানো সম্ভব ছিল কি না, তা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। তবে অর্থনীতিতে এর প্রভাব এড়ানো স্বভাবতই সম্ভব হয়নি। প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকে এর প্রভাব পড়েছে ইতিমধ্যে। তবে এই নিবন্ধে দেশীয় পণ্যবাজারে উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রভাব নিয়ে আলোচনা কেন্দ্রীভূত রাখতে চাইব। এর কারণটাও ব্যাখ্যা করব শুরুতেই।
আমাদের অর্থনীতি নানান চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিংহভাগ সূচক নিম্নগামী। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা সবচেয়ে পীড়াদায়ক। এর রয়েছে প্রত্যক্ষ অভিঘাত, বিশেষত নিম্ন ও সীমিত আয়ের সিংহভাগ মানুষের জীবনে। জানুয়ারিতে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠনের সময় তো বটেই; নতুন বাজেটেও মূল্যস্ফীতি সহনীয় করে আনার কথাই সবচেয়ে বেশি করে বলা হয়েছে। এর কারণ, কমবেশি দুই বছর ধরে মানুষকে একটা উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ সইতে হচ্ছে। গেল অর্থবছরে সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ ছুঁই-ছুঁই। মতান্তরে এটা আরও অনেক বেশি। গেল অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার লক্ষ্য মোটেও অর্জিত হয়নি। এ অবস্থায় নতুন অর্থবছরে এটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে কি? প্রশ্নটা ছিলই; তবে কোটা আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে এটা তীব্রতর হয়েছে। কেননা শুধু পণ্য নয়; সেবার বাজারেও পড়েছে এর সরাসরি প্রভাব।
দেশে আন্দোলনের যে চরিত্র, তাতে রাস্তাঘাট বন্ধ হলেও পণ্য পরিবহন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় কমই। সেবার প্রবাহও অচল হয়ে যায় না। দেখা যায়, সড়ক যোগাযোগ বিঘ্নিত হলেও নৌপথ সচল। রেস্তোরাঁয় ব্যবসা কমে এলেও কাঁচাবাজার মোটামুটি স্বাভাবিক। ব্যাংক খাত সচল। আমদানি, রপ্তানিপণ্য পরিবহনেও বড় রকম সমস্যা হতে দেখা যায় না। আর ইন্টারনেট-সংযোগ বিঘ্নিত না হলে তো জনজীবন মোটামুটি সচল। কিন্তু এবার এর প্রায় সবকিছুই অচল হয়ে পড়ে দ্রুত। আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। মাত্র কদিনে ঘটে রেকর্ড প্রাণহানি। অনিশ্চয়তা হয়ে ওঠে তীব্র। সুদীর্ঘ সময় পর দেশে জারি হয় কারফিউ; নামানো হয় সেনাবাহিনী। ঘোষিত হয় ‘সাধারণ ছুটি’। তার আগে ইন্টারনেট হয় বন্ধ। এরও সুগভীর প্রভাব পড়ে জনজীবনে আর অর্থনীতিতে নেমে আসে স্থবিরতা। শুরুতে শুধু পণ্য চলাচল ব্যাহত হলেও পরে ডিজিটাল লেনদেনের সুযোগ হয় রহিত। শেষে বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসা আর উৎপাদনও। রপ্তানি খাতের দিকে তাকালে এটা চট করেই বোঝা যাবে। দেশে পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও দ্রুত চলে আসে এর আওতায়। কৃষি খাত অবশ্য সচল ছিল এবং রয়েছে। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কৃষিপণ্য পরিবহনও ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হলে পড়ে এর দ্বিমুখী প্রভাব।
‘দ্বিমুখী প্রভাব’ মানে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় উৎপাদন অঞ্চলে পণ্যের দাম পড়ে যাওয়া এবং ভোক্তাপর্যায়ে দাম ‘অস্বাভাবিকভাবে’ বেড়ে যাওয়া। দেশে উৎপাদিত সিংহভাগ কৃষিপণ্যের দাম এমনিতেও সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ছিল না। পেঁয়াজ, আলু, কাঁচা মরিচের মতো পণ্য আবার আমদানি করা হচ্ছিল ঘাটতির শিকার হয়ে। তাতে একটি ক্ষেত্রে পরিস্থিতির উন্নতি হলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে আমরা ছিলাম উন্নতি দেখার আশায়। এ অবস্থায় প্রায় হঠাৎ করে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ‘প্রোটিনের সহজতম উৎস’ ডিমের দাম যায় বেড়ে। সঙ্গে সব শাকসবজির দাম। দেশে সবজির উৎপাদন অনেক বেড়েছে; সঙ্গে বেড়েছে সর্বস্তরে এর পরিভোগ। সবজির দাম তাই আগেকার যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি করে আলোচনার বিষয়। এদিকে প্রধান খাদ্যশস্য চালের বাজার শান্ত থাকুক, এটা আমাদের সব সময়ের প্রত্যাশা। সরকারও এতে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে খাদ্যনিরাপত্তার স্বার্থে। তবে বোরোর ভরা মৌসুমেও এবার চালের দামে ছিল বৃদ্ধির প্রবণতা। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এর দাম নতুন করে বেড়ে যাওয়ার খবর রয়েছে। মোকাম থেকে আনার সুযোগ থাকলেও অস্থির সময়ে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রভাব স্বভাবতই পড়ে পণ্যের দামে। হালে এ পরিস্থিতির বিশেষ অবনতি ঘটে টিসিবির কার্যক্রম, এমনকি ওএমএস বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। বিশেষত নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী এর শিকার হয়ে পড়ে—যারা কম দামে কিছু নিত্যপণ্য এ ব্যবস্থায় কিনতে পারত। ইতিমধ্যে এর কতটা উন্নতি হয়েছে, কে জানে। জানি না, গ্রামাঞ্চলে একই সময়ে খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি, যেমন ভিজিএফ ব্যাহত হয়েছে কি না। দেশের সবখানে কোটা আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতা হয়নি বটে; তবে এর কমবেশি প্রভাব পড়েছে সবখানেই। উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার প্রভাবেও তো অনেক কিছু ঘটে যায়!
অবশ্য লক্ষণীয়, কারফিউ জারি থাকলেও এটাকে আরও বেশি সময় ধরে শিথিল করা হচ্ছে এবং এ ক্ষেত্রে কঠোরতা কম। এতে জীবনযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে নিত্যদিনের অর্থনীতিও ক্রমে সচল হওয়ার অবকাশ পাচ্ছে। জরুরি পণ্য, যেমন জ্বালানি তেল পরিবহন স্বাভাবিক রাখার প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল। সমুদ্র ও স্থলবন্দরে আটকে পড়া পণ্য খালাস এবং নিরাপদে তা পরিবহনের চেষ্টাও পরিলক্ষিত। এর মধ্যে আমদানি করা খাদ্যপণ্য, যেমন পেঁয়াজও ছিল বৈকি। মাঝে কাঁচা মরিচের দাম আবার ৫০০-৬০০ টাকা কেজি হয়ে গিয়েছিল ঢাকায়। সরবরাহ বাড়লে দ্রুতই দাম আবার অর্ধেক হয়ে যায়। অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সচ্ছলদের মধ্যে টেকসই পণ্যসামগ্রী একবারে বেশি করে কিনে রাখার প্রবণতা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। সেটা দেখা দিয়েছিল বৈকি। চালের দামে এর প্রভাব পড়েছিল কি না, কে জানে। সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় সবজির দাম অবশ্য কমে এসেছে। সঙ্গে ডিম, মুরগি ও মাছের দাম। তবে আগের জায়গায় ফিরে আসার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না বাজারে।
অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে হাতে অর্থ ধরে রাখা এবং জরুরি পণ্য বাদে আর সবকিছু কম কেনার প্রবণতাও দেখা দেয়। দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলাকালেও এমন প্রবণতা ছিল বৈকি। এ অবস্থায় ব্যাংক খোলার পর লোকে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে অর্থ উত্তোলনে এবং তাতে বাংলাদেশ ব্যাংককেও বিশেষ ব্যবস্থায় অর্থ জোগাতে হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংককে। এতে বাজারে বেড়েছে অর্থ সরবরাহ এবং এটাও হবে নতুন করে মূল্যস্ফীতির কারণ। একশ্রেণির সংকটগ্রস্ত ব্যাংকের ওপর অনাস্থার কারণেও গ্রাহকদের মধ্যে অর্থ উত্তোলনের প্রবণতা ছিল আগেই। নতুন পরিস্থিতিতে এটা আরও বাড়লে অবাক হওয়া যাবে না। সাম্প্রতিককালে সুদের হার বাড়তে থাকায় ব্যাংকে টাকাপয়সা রাখা অবশ্য কিছুটা লাভজনক হয়েছে। তবে আমানতকৃত অর্থের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা মানুষকে বেশি তাড়া করে। অব্যাহত উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে আমানত ভেঙে খাওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। ঋণ করে চলার প্রবণতাও। একশ্রেণির মানুষ অবশ্য ব্যাংক বা ব্যক্তি কোনো খাত থেকেই ঋণ নিতে পারে না। বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মনুষ্যসৃষ্ট কোনো প্রতিকূল অবস্থায় এদের রুজি-রোজগার বন্ধ হয়ে গেলে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা ক্ষমতাবানদের পক্ষে অনুমান করা স্বভাবতই কঠিন। তেমন পরিস্থিতিতে বিপন্নদের কল্যাণে তাদের এগিয়ে আসতেও দেখা যায় না। তাই সংশ্লিষ্ট সব পক্ষেরই বিশেষ সতর্ক থাকা প্রয়োজন, যেন পরিহার করা যায় এমন কোনো ‘ভুলে’ তেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়—যা কিনা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিপর্যয়কর।
অব্যাহত উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে মধ্যবিত্ত ক্রমে নিম্নমধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত দরিদ্রের খাতায় নাম লেখানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এ অবস্থায় সরকার মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে, সেটা অর্জন করতে পারবে বলে মনে হয় না। এ লক্ষ্যে কিছু নীতিকৌশল গ্রহণের প্রয়াস অবশ্য লক্ষ করা যাচ্ছে। এতে অসংগতি এবং নীতির প্রয়োগে ব্যর্থতাও কম পরিলক্ষিত হচ্ছে না। নতুন অর্থবছরে সেদিকে যথাসম্ভব মনোযোগ দেওয়া যাবে কি না, সেটা কেবল অর্থনীতি পরিচালনায় সুশাসনের ওপর নির্ভরশীল নয়। রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন থাকে, তার ওপরও বহুলাংশে নির্ভরশীল। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের মতো একটা ‘প্রান্তিক ইস্যু’ ঘিরে পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠবে, তা সম্ভবত কারও কল্পনায়ও ছিল না। উঠে আসা বাস্তবতা অবশ্য কখনো কখনো কল্পনাকেও হার মানায়। অর্থনীতিতেও পড়ে এর অনিবার্য প্রভাব। উদ্ভূত পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক প্রভাবের সঙ্গে রয়েছে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবের শঙ্কাও। পণ্যবাজারে নতুন করে সৃষ্ট অস্থিরতা কমে আসতে হয়তো বেশি সময় লাগবে না; তবে বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে থেকে যাবে এর প্রভাব। প্রধান রপ্তানি খাতে বাড়তে পারে ক্রেতাদের অনাস্থা। এর প্রভাবে এত বেকারত্বের মধ্যেও না বাড়তে পারে কর্মসংস্থান।
অনিশ্চয়তার প্রভাব কিন্তু পড়ে মজুরি বৃদ্ধিতেও। এর পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি না কমে সময়ে-সময়ে যদি আরও বেড়ে যায়!
লেখক: হাসান মামুন
সাংবাদিক, বিশ্লেষক
কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তা নজিরবিহীন। নতুন অর্থবছরের প্রথম মাসেই সৃষ্ট এ পরিস্থিতি অর্থনীতির বিভিন্ন দিকে প্রভাব ফেলেছে দ্রুত। এটা এড়ানো সম্ভব ছিল কি না, তা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। তবে অর্থনীতিতে এর প্রভাব এড়ানো স্বভাবতই সম্ভব হয়নি। প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকে এর প্রভাব পড়েছে ইতিমধ্যে। তবে এই নিবন্ধে দেশীয় পণ্যবাজারে উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রভাব নিয়ে আলোচনা কেন্দ্রীভূত রাখতে চাইব। এর কারণটাও ব্যাখ্যা করব শুরুতেই।
আমাদের অর্থনীতি নানান চ্যালেঞ্জের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। সিংহভাগ সূচক নিম্নগামী। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা সবচেয়ে পীড়াদায়ক। এর রয়েছে প্রত্যক্ষ অভিঘাত, বিশেষত নিম্ন ও সীমিত আয়ের সিংহভাগ মানুষের জীবনে। জানুয়ারিতে টানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠনের সময় তো বটেই; নতুন বাজেটেও মূল্যস্ফীতি সহনীয় করে আনার কথাই সবচেয়ে বেশি করে বলা হয়েছে। এর কারণ, কমবেশি দুই বছর ধরে মানুষকে একটা উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ সইতে হচ্ছে। গেল অর্থবছরে সরকারি হিসাবেই মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ ছুঁই-ছুঁই। মতান্তরে এটা আরও অনেক বেশি। গেল অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার লক্ষ্য মোটেও অর্জিত হয়নি। এ অবস্থায় নতুন অর্থবছরে এটা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে কি? প্রশ্নটা ছিলই; তবে কোটা আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে এটা তীব্রতর হয়েছে। কেননা শুধু পণ্য নয়; সেবার বাজারেও পড়েছে এর সরাসরি প্রভাব।
দেশে আন্দোলনের যে চরিত্র, তাতে রাস্তাঘাট বন্ধ হলেও পণ্য পরিবহন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় কমই। সেবার প্রবাহও অচল হয়ে যায় না। দেখা যায়, সড়ক যোগাযোগ বিঘ্নিত হলেও নৌপথ সচল। রেস্তোরাঁয় ব্যবসা কমে এলেও কাঁচাবাজার মোটামুটি স্বাভাবিক। ব্যাংক খাত সচল। আমদানি, রপ্তানিপণ্য পরিবহনেও বড় রকম সমস্যা হতে দেখা যায় না। আর ইন্টারনেট-সংযোগ বিঘ্নিত না হলে তো জনজীবন মোটামুটি সচল। কিন্তু এবার এর প্রায় সবকিছুই অচল হয়ে পড়ে দ্রুত। আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। মাত্র কদিনে ঘটে রেকর্ড প্রাণহানি। অনিশ্চয়তা হয়ে ওঠে তীব্র। সুদীর্ঘ সময় পর দেশে জারি হয় কারফিউ; নামানো হয় সেনাবাহিনী। ঘোষিত হয় ‘সাধারণ ছুটি’। তার আগে ইন্টারনেট হয় বন্ধ। এরও সুগভীর প্রভাব পড়ে জনজীবনে আর অর্থনীতিতে নেমে আসে স্থবিরতা। শুরুতে শুধু পণ্য চলাচল ব্যাহত হলেও পরে ডিজিটাল লেনদেনের সুযোগ হয় রহিত। শেষে বন্ধ হয়ে যায় ব্যবসা আর উৎপাদনও। রপ্তানি খাতের দিকে তাকালে এটা চট করেই বোঝা যাবে। দেশে পণ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও দ্রুত চলে আসে এর আওতায়। কৃষি খাত অবশ্য সচল ছিল এবং রয়েছে। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কৃষিপণ্য পরিবহনও ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হলে পড়ে এর দ্বিমুখী প্রভাব।
‘দ্বিমুখী প্রভাব’ মানে যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় উৎপাদন অঞ্চলে পণ্যের দাম পড়ে যাওয়া এবং ভোক্তাপর্যায়ে দাম ‘অস্বাভাবিকভাবে’ বেড়ে যাওয়া। দেশে উৎপাদিত সিংহভাগ কৃষিপণ্যের দাম এমনিতেও সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে ছিল না। পেঁয়াজ, আলু, কাঁচা মরিচের মতো পণ্য আবার আমদানি করা হচ্ছিল ঘাটতির শিকার হয়ে। তাতে একটি ক্ষেত্রে পরিস্থিতির উন্নতি হলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে আমরা ছিলাম উন্নতি দেখার আশায়। এ অবস্থায় প্রায় হঠাৎ করে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ‘প্রোটিনের সহজতম উৎস’ ডিমের দাম যায় বেড়ে। সঙ্গে সব শাকসবজির দাম। দেশে সবজির উৎপাদন অনেক বেড়েছে; সঙ্গে বেড়েছে সর্বস্তরে এর পরিভোগ। সবজির দাম তাই আগেকার যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি করে আলোচনার বিষয়। এদিকে প্রধান খাদ্যশস্য চালের বাজার শান্ত থাকুক, এটা আমাদের সব সময়ের প্রত্যাশা। সরকারও এতে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে খাদ্যনিরাপত্তার স্বার্থে। তবে বোরোর ভরা মৌসুমেও এবার চালের দামে ছিল বৃদ্ধির প্রবণতা। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে এর দাম নতুন করে বেড়ে যাওয়ার খবর রয়েছে। মোকাম থেকে আনার সুযোগ থাকলেও অস্থির সময়ে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার প্রভাব স্বভাবতই পড়ে পণ্যের দামে। হালে এ পরিস্থিতির বিশেষ অবনতি ঘটে টিসিবির কার্যক্রম, এমনকি ওএমএস বন্ধ হয়ে যাওয়ায়। বিশেষত নগরের দরিদ্র জনগোষ্ঠী এর শিকার হয়ে পড়ে—যারা কম দামে কিছু নিত্যপণ্য এ ব্যবস্থায় কিনতে পারত। ইতিমধ্যে এর কতটা উন্নতি হয়েছে, কে জানে। জানি না, গ্রামাঞ্চলে একই সময়ে খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি, যেমন ভিজিএফ ব্যাহত হয়েছে কি না। দেশের সবখানে কোটা আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতা হয়নি বটে; তবে এর কমবেশি প্রভাব পড়েছে সবখানেই। উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তার প্রভাবেও তো অনেক কিছু ঘটে যায়!
অবশ্য লক্ষণীয়, কারফিউ জারি থাকলেও এটাকে আরও বেশি সময় ধরে শিথিল করা হচ্ছে এবং এ ক্ষেত্রে কঠোরতা কম। এতে জীবনযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে নিত্যদিনের অর্থনীতিও ক্রমে সচল হওয়ার অবকাশ পাচ্ছে। জরুরি পণ্য, যেমন জ্বালানি তেল পরিবহন স্বাভাবিক রাখার প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল। সমুদ্র ও স্থলবন্দরে আটকে পড়া পণ্য খালাস এবং নিরাপদে তা পরিবহনের চেষ্টাও পরিলক্ষিত। এর মধ্যে আমদানি করা খাদ্যপণ্য, যেমন পেঁয়াজও ছিল বৈকি। মাঝে কাঁচা মরিচের দাম আবার ৫০০-৬০০ টাকা কেজি হয়ে গিয়েছিল ঢাকায়। সরবরাহ বাড়লে দ্রুতই দাম আবার অর্ধেক হয়ে যায়। অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে সচ্ছলদের মধ্যে টেকসই পণ্যসামগ্রী একবারে বেশি করে কিনে রাখার প্রবণতা দেখা দেওয়া স্বাভাবিক। সেটা দেখা দিয়েছিল বৈকি। চালের দামে এর প্রভাব পড়েছিল কি না, কে জানে। সরবরাহ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় সবজির দাম অবশ্য কমে এসেছে। সঙ্গে ডিম, মুরগি ও মাছের দাম। তবে আগের জায়গায় ফিরে আসার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে না বাজারে।
অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে হাতে অর্থ ধরে রাখা এবং জরুরি পণ্য বাদে আর সবকিছু কম কেনার প্রবণতাও দেখা দেয়। দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি চলাকালেও এমন প্রবণতা ছিল বৈকি। এ অবস্থায় ব্যাংক খোলার পর লোকে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে অর্থ উত্তোলনে এবং তাতে বাংলাদেশ ব্যাংককেও বিশেষ ব্যবস্থায় অর্থ জোগাতে হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংককে। এতে বাজারে বেড়েছে অর্থ সরবরাহ এবং এটাও হবে নতুন করে মূল্যস্ফীতির কারণ। একশ্রেণির সংকটগ্রস্ত ব্যাংকের ওপর অনাস্থার কারণেও গ্রাহকদের মধ্যে অর্থ উত্তোলনের প্রবণতা ছিল আগেই। নতুন পরিস্থিতিতে এটা আরও বাড়লে অবাক হওয়া যাবে না। সাম্প্রতিককালে সুদের হার বাড়তে থাকায় ব্যাংকে টাকাপয়সা রাখা অবশ্য কিছুটা লাভজনক হয়েছে। তবে আমানতকৃত অর্থের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কা মানুষকে বেশি তাড়া করে। অব্যাহত উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে আমানত ভেঙে খাওয়ার প্রবণতাও বেড়েছে। ঋণ করে চলার প্রবণতাও। একশ্রেণির মানুষ অবশ্য ব্যাংক বা ব্যক্তি কোনো খাত থেকেই ঋণ নিতে পারে না। বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা মনুষ্যসৃষ্ট কোনো প্রতিকূল অবস্থায় এদের রুজি-রোজগার বন্ধ হয়ে গেলে কী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তা ক্ষমতাবানদের পক্ষে অনুমান করা স্বভাবতই কঠিন। তেমন পরিস্থিতিতে বিপন্নদের কল্যাণে তাদের এগিয়ে আসতেও দেখা যায় না। তাই সংশ্লিষ্ট সব পক্ষেরই বিশেষ সতর্ক থাকা প্রয়োজন, যেন পরিহার করা যায় এমন কোনো ‘ভুলে’ তেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়—যা কিনা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিপর্যয়কর।
অব্যাহত উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে মধ্যবিত্ত ক্রমে নিম্নমধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত দরিদ্রের খাতায় নাম লেখানোর প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এ অবস্থায় সরকার মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার যে লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে, সেটা অর্জন করতে পারবে বলে মনে হয় না। এ লক্ষ্যে কিছু নীতিকৌশল গ্রহণের প্রয়াস অবশ্য লক্ষ করা যাচ্ছে। এতে অসংগতি এবং নীতির প্রয়োগে ব্যর্থতাও কম পরিলক্ষিত হচ্ছে না। নতুন অর্থবছরে সেদিকে যথাসম্ভব মনোযোগ দেওয়া যাবে কি না, সেটা কেবল অর্থনীতি পরিচালনায় সুশাসনের ওপর নির্ভরশীল নয়। রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন থাকে, তার ওপরও বহুলাংশে নির্ভরশীল। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের মতো একটা ‘প্রান্তিক ইস্যু’ ঘিরে পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ হয়ে উঠবে, তা সম্ভবত কারও কল্পনায়ও ছিল না। উঠে আসা বাস্তবতা অবশ্য কখনো কখনো কল্পনাকেও হার মানায়। অর্থনীতিতেও পড়ে এর অনিবার্য প্রভাব। উদ্ভূত পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক প্রভাবের সঙ্গে রয়েছে এর সুদূরপ্রসারী প্রভাবের শঙ্কাও। পণ্যবাজারে নতুন করে সৃষ্ট অস্থিরতা কমে আসতে হয়তো বেশি সময় লাগবে না; তবে বিনিয়োগ পরিস্থিতিতে থেকে যাবে এর প্রভাব। প্রধান রপ্তানি খাতে বাড়তে পারে ক্রেতাদের অনাস্থা। এর প্রভাবে এত বেকারত্বের মধ্যেও না বাড়তে পারে কর্মসংস্থান।
অনিশ্চয়তার প্রভাব কিন্তু পড়ে মজুরি বৃদ্ধিতেও। এর পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি না কমে সময়ে-সময়ে যদি আরও বেড়ে যায়!
লেখক: হাসান মামুন
সাংবাদিক, বিশ্লেষক
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৩ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৬ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৬ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১০ দিন আগে