নির্বাচনের পক্ষে-বিপক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর মাতামাতি লক্ষ করা গেলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের নির্লিপ্ততার বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না। নির্বাচন হওয়া বা না হওয়ার ব্যাপারে ব্যাপকসংখ্যক মানুষেরই যেন দর্শকের মনোভাব। তবে দল সমর্থক জনগোষ্ঠীর কথা ভিন্ন। অথচ একসময় মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসবের মনোভাব দেখা যেত। এখন বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে দুটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। একটি হচ্ছে ‘নির্বাচনকে’ নিয়ে মাথা না ঘামানো। আরেকটি হচ্ছে হতাশা ও ক্ষোভ ব্যক্ত করা। এর পেছনের কারণগুলো বোধগম্য। বেশির ভাগ মানুষ ভাবছেন এটি আসলে একটি নির্বাচন নয়। কারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, আছে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভান। আর যেহেতু ফলাফল হচ্ছে বর্তমান শাসক দল কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত, অর্থাৎ নিশ্চিতভাবে বর্তমান সরকারের বিজয় এবং ধারাবাহিকতা রক্ষা, সেহেতু এটা কোনো ‘ইলেকশন’ নয়, ‘সিলেকশন’ মাত্র।
তাঁরা হয়তো বেশির ভাগ দীর্ঘদিন তৃণমূলে রাজনীতি করেননি। তাঁরা কষ্ট করে, সাধনা করে ভোটারের মন জয় করার যে দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থাকে তার ভেতর দিয়ে উঠে আসেননি। কোনো ক্রিকেট প্লেয়ার, কোনো অভিনেত্রী, কোনো অর্থবিত্তের মালিক, কোনো আমলা, কোনো সাবেক দলীয় বা জোট নেতা বা মন্ত্রী—এসবই হয়ে উঠেছে আগামী পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর প্রধান বিবেচ্য যোগ্যতা। আবার তাঁরাও প্রায় সবাই ভাবছেন শাসক দলের মনোনয়ন টিকিটটি পেলেই বিজয় নিশ্চিত।
কিন্তু সবাই যদি একটি দলেরই প্রার্থী হতে চান তাহলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে কীভাবে? তাহলে বিরোধী দলের কার্যত অনুপস্থিতিতে যে নির্বাচন হবে তাকে আসলে গণতান্ত্রিক নির্বাচন বলা যাবে কি? সে জন্য কেউ কেউ বর্তমান নির্বাচনকে নামকরণ করেছেন ‘অভিনয়ের নির্বাচন’ বা ‘তামাশার নির্বাচন’।
কিন্তু এই নির্বাচনে আরেকটি বিপরীত প্রবণতাও সৃষ্টি হয়েছে। সেটি কী? এটা হচ্ছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিচিত্র সমাহার। দেখা যাচ্ছে খোদ শাসক দলের মধ্যেই অনেকে ‘বিরোধী দলের’ বিকল্প হতে চাইছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তাঁদের আবার শাসক দল শুধু উৎসাহিত করছে তা-ই নয়, কোথাও কোথাও শোনা যায় নিজের দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করে স্বতন্ত্ররা যাতে জয়ী হন, সে জন্য গোপনে তাঁদের নানাভাবে সাহায্য ও আশীর্বাদ করছে। আর এটাও আমরা দেখছি, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অনেকেই দাবি করছেন যে তাঁরাও নৌকার রাজনীতিতে বিশ্বাসী, নৌকার মূল মাঝির আশীর্বাদ নাকি গোপনে তাঁর প্রতিই আছে (!) যদিও অফিশিয়ালি তাঁরা নৌকা প্রতীক থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এবং অন্য প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করছেন। সুতরাং এই নির্বাচনে দ্বিতীয় প্রবণতা হচ্ছে শাসক দলের অভ্যন্তরে সৃষ্ট ব্যাপক অনৈক্য, পারস্পরিক বিবাদ এবং বিশৃঙ্খলা। প্রশ্ন হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে সব রকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শেষে কোন নিট প্রবণতাটি প্রধান নির্ধারক প্রবণতায় পরিণত হবে?
বলা হয় জনগণই ইতিহাসের স্রষ্টা। দেখা যাক সেখানে কী প্রবণতা বিরাজ করছে? জনগণের মধ্যে বর্তমান নির্বাচন বানচাল করে দেওয়া বা ঠেকিয়ে দেওয়ার মতো তীব্র কোনো সংগ্রাম বা ‘গণ-অভ্যুত্থান’ ঘটিয়ে এরপর ১৯৭০-এর নির্বাচনের মতো কোনো গণতান্ত্রিক বিজয়গাথা রচনার প্রবণতা আমরা মোটেও দেখছি না। আমরা বলে থাকি, আমাদের রাজনীতির বা প্রজাতন্ত্রের মূল শক্তি হচ্ছে এর জনগণ। কিন্তু কেন জনগণ রাজনীতির বিষয়ে এতটা অনুৎসাহিত বা এত উদাসীন হয়ে আছেন এখনো—সেটা কি কেউ গভীরভাবে ভেবে দেখেছেন? যদিও শাসক দল আশা ও চেষ্টা করছে যাতে জনগণ খুবই উৎসাহিত হয়ে দলে দলে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হবেন ও ভোট দিয়ে এই বিদ্যমান আলংকারিক প্রতিযোগিতার ভেতর থেকেই নিজেদের পছন্দমতো অলংকারটি বেছে নেবেন। হয়তো কোনো কোনো নির্বাচনী এলাকায় যে তীব্র মারামারি, অর্থব্যয়, প্রচার, পক্ষে-বিপক্ষে বাদ্য-বাজনা-গান ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে, তাতে তাঁরা ভাবছেন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরাই নিজ উদ্যোগে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনার ব্যবস্থা করবেন এবং তাঁদের এসব সক্রিয়তা অবশেষে ভোটারদের বর্তমান নিস্পৃহতা কাটিয়ে তাঁদের সক্রিয় করে তুলবেন। একটি অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতেও পারে! নানা ঐতিহাসিক কারণে বাংলাদেশের জনগণ দুটি দলে (প্রায় গোত্রের মতো) বিভক্ত এবং দুই শিবিরের প্রতি দুই দলের সুস্থির আনুগত্য রয়েছে। এই দুই শিবিরকে সাংস্কৃতিকভাবেও বর্তমানে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। একটি শিবিরকে বলা হয় ‘জয় বাংলার শিবির’, অপরটিকে বলা হয় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’-এর শিবির। টাকার ক্ষমতা বা অর্থের দিক থেকে বা দলীয় শ্রেণিচরিত্রের দিক থেকে বা শাসনক্ষমতায় থাকাকালে নানাভাবে ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার গোপন বা প্রকাশ্য অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোনো তফাত নেই, কিন্তু মনোভঙ্গি বা সংস্কৃতিগতভাবে আমাদের বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধ, তার প্রতি এই দুই শিবিরের দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। এবারও তাই এদের মধ্যে যেকোনো একটি শিবিরের সমর্থকেরাও যদি এবারের নির্বাচনে যোগ দেন, তাহলেও কিন্তু ভোটের অনুপাত ন্যূনতম ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ হয়ে যেতে পারে।
যে নির্বাচনটি শেষ পর্যন্ত হচ্ছে তাতে শেষ ফলাফল কি শুভ হবে? আওয়ামী সমর্থকেরা বলতেই পারেন, আমরা কী করব, কেউ যদি নির্বাচনে না আসেন, তাহলে কী করার আছে আমাদের। আমরা সংবিধান মেনে নির্বাচন দিয়েছি, এ ছাড়া আমাদের অন্য কোনো পথ ছিল না। কিন্তু তাতে কী কাজ হবে?
পাল্টা প্রশ্নটি হচ্ছে—অন্য কোনো পথ কি ছিল না? আওয়ামী লীগ কি আসলেই চেয়েছিল প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীরা নির্বাচনে সুষ্ঠু প্রতিদ্বন্দ্বিতাসহ অংশগ্রহণ করুক? ২০১৪ ও ২০১৮তে সংবিধান মেনেই আওয়ামী সরকারকে ক্ষমতায় রেখেই নির্বাচন হয়েছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনে কিন্তু বিএনপি আসেনি এবং পরে স্বীকার করেছিল যে না এসে তারা ভুল করেছিল। তাই ২০১৮তে যখন তারা ভুল সংশোধন করে পুনরায় নির্বাচনে যোগ দেয়, তখন রাতের আঁধারে ভোট বাক্স ভরে ফেলায়, সেই সময় বিএনপি তার প্রত্যাশিত ফলাফল থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। বিএনপির কয়েকজন এমপি ২০১৮-এর সংসদে যোগ দিয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক মহলও সেই সংসদকে ও সরকারকে অবশেষে মেনেও নেয়। ফলে বিরাট কোনো গোলযোগ সেবার সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু এবার আর বিএনপি নির্বাচনেই যায়নি, ২০১৮-এর পুনরাবৃত্তির আশঙ্কায়। সুতরাং এবার একতরফা নির্বাচনে যে সংসদটি তৈরি হতে যাচ্ছে, সেটিও কি আবার সবাই অবশেষে মেনে নেবে? সেখানে কি যথার্থই কোনো বিরোধী দল থাকবে? আন্তর্জাতিক মহলও কি এই নির্বাচনকে অবশেষে বৈধতা দেবে? বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবারের নির্বাচনের আগে থেকেই যেসব সতর্ক বার্তা দিয়ে চলেছে, তাতে এবার
তাদের স্বীকৃতি সংগ্রহ ততটা সহজ ও নিশ্চিত নয় বলেই মনে হয়।
বর্তমানে আমরা বাতাসে একটি ‘উন্নয়নের’ তত্ত্ব শুনতে পাই। এই তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে, ‘গণতন্ত্র’ উন্নয়নের অপরিহার্য শর্ত নয়। একদলীয় কর্তৃত্বমূলক গণতন্ত্রের অধীনেও উন্নয়ন সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে একগুচ্ছ রাষ্ট্রের উন্নয়নের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়, যেমন চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি।
‘পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়’ বা ‘বাজারমুখী সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়’ বর্তমান বিশ্বে একদলীয় কর্তৃত্বমূলক রাজনৈতিক শাসনের অধীনেও প্রবৃদ্ধি এবং কিছুটা সুষম বণ্টনসহই জনগণের উন্নয়ন হচ্ছে বা হতে পারে। এসব দেশে জনগণ সংকুচিত বাক্স্বাধীনতা, নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি বা ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে এতটা উৎকণ্ঠিত নন। এসব ছাড়াও দিব্যি তাঁরা শান্তিতে, স্বস্তিতে জীবনযাপন অব্যাহত রেখেছেন। বলা হয় সেই তুলনায় অবাধ বাজার এবং অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতাসহ যে উন্নত সমাজ (আমেরিকার দৃষ্টান্ত) রয়েছে, সেখানেও অনেক অন্যায়, অনেক বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে দেখা যায়। গণতন্ত্র ও উন্নয়ন একসঙ্গে হলে খুব ভালো, কিন্তু না হলেই যে মহা সর্বনাশ হবে, সেটি আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতায় অনিবার্য সত্য নয়।
১৯৭১ সালে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই প্রথমে কিন্তু গণতন্ত্রের সংগ্রামেই নেমেছিলাম। তখন উগ্র বামপন্থীরা ভোট বর্জন করে বলেছিল যে ভোটের আগে ভাতের অধিকার অর্জন করতে হবে। ভাসানী সাহেব তখন নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। কিন্তু সেটা ছিল তখন ভুল। কিন্তু এখন আমরা কী বলব?
এখন যদি ইস্যুটা এমন হতো যে ‘আওয়ামী লীগের’ শাসক গোষ্ঠীর চরিত্র ও ধরনটি এমন যে তারা একদলীয় শাসনের অধীনেই প্রয়োজনীয় উন্নয়ন ও সুষম বণ্টন সম্পন্ন করতে সক্ষম হচ্ছে, তাহলে হয়তো আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র তা আমাদের জনগণ মেনে নিতেন। কিন্তু জনগণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বা এককথায় স্বজনতোষণমূলক পুঁজিবাদী এই ব্যবস্থা দেখে এত বীতশ্রদ্ধ যে ‘আওয়ামী উন্নয়ন’ দাবির প্রতি তাঁরা কোনো নিখাদ আস্থা রাখতে পারছেন না। কিন্তু সত্যিকার উন্নততর বিকল্প কোনো বিরোধী নেতৃত্বও তাঁরা এখন পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছেন না। ফলে তাঁদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে গণতান্ত্রিক বা অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা যেটাই থাকুক না কেন, লঙ্কায় যিনি থাকবেন বা যাবেন, তিনি দ্রুতই রাবণে পরিণত হবেন। বর্তমানে তাই জনগণ এখানে হতাশ ও উদ্যোগহীন শক্তিতে পরিণত হয়েছেন; বরং ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’—এটাই হচ্ছে জনগণের বিদ্যমান প্রধান মনোভঙ্গি। বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা ভাঙার জন্য জনগণ এখনো জান বাজি রেখে রাস্তায় নামতে প্রস্তুত নন।
এই মনোভঙ্গির পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য উন্নয়ন ও গ্রহণযোগ্য গণতন্ত্র উভয়ই ঝুলতে থাকবে।
লেখক: এম এম আকাশ, অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ
নির্বাচনের পক্ষে-বিপক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর মাতামাতি লক্ষ করা গেলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে একধরনের নির্লিপ্ততার বিষয়টি অস্বীকার করা যাবে না। নির্বাচন হওয়া বা না হওয়ার ব্যাপারে ব্যাপকসংখ্যক মানুষেরই যেন দর্শকের মনোভাব। তবে দল সমর্থক জনগোষ্ঠীর কথা ভিন্ন। অথচ একসময় মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে উৎসবের মনোভাব দেখা যেত। এখন বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে দুটি প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। একটি হচ্ছে ‘নির্বাচনকে’ নিয়ে মাথা না ঘামানো। আরেকটি হচ্ছে হতাশা ও ক্ষোভ ব্যক্ত করা। এর পেছনের কারণগুলো বোধগম্য। বেশির ভাগ মানুষ ভাবছেন এটি আসলে একটি নির্বাচন নয়। কারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, আছে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভান। আর যেহেতু ফলাফল হচ্ছে বর্তমান শাসক দল কর্তৃক পূর্বনির্ধারিত, অর্থাৎ নিশ্চিতভাবে বর্তমান সরকারের বিজয় এবং ধারাবাহিকতা রক্ষা, সেহেতু এটা কোনো ‘ইলেকশন’ নয়, ‘সিলেকশন’ মাত্র।
তাঁরা হয়তো বেশির ভাগ দীর্ঘদিন তৃণমূলে রাজনীতি করেননি। তাঁরা কষ্ট করে, সাধনা করে ভোটারের মন জয় করার যে দীর্ঘ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থাকে তার ভেতর দিয়ে উঠে আসেননি। কোনো ক্রিকেট প্লেয়ার, কোনো অভিনেত্রী, কোনো অর্থবিত্তের মালিক, কোনো আমলা, কোনো সাবেক দলীয় বা জোট নেতা বা মন্ত্রী—এসবই হয়ে উঠেছে আগামী পার্লামেন্টে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীর প্রধান বিবেচ্য যোগ্যতা। আবার তাঁরাও প্রায় সবাই ভাবছেন শাসক দলের মনোনয়ন টিকিটটি পেলেই বিজয় নিশ্চিত।
কিন্তু সবাই যদি একটি দলেরই প্রার্থী হতে চান তাহলে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে কীভাবে? তাহলে বিরোধী দলের কার্যত অনুপস্থিতিতে যে নির্বাচন হবে তাকে আসলে গণতান্ত্রিক নির্বাচন বলা যাবে কি? সে জন্য কেউ কেউ বর্তমান নির্বাচনকে নামকরণ করেছেন ‘অভিনয়ের নির্বাচন’ বা ‘তামাশার নির্বাচন’।
কিন্তু এই নির্বাচনে আরেকটি বিপরীত প্রবণতাও সৃষ্টি হয়েছে। সেটি কী? এটা হচ্ছে স্বতন্ত্র প্রার্থীর বিচিত্র সমাহার। দেখা যাচ্ছে খোদ শাসক দলের মধ্যেই অনেকে ‘বিরোধী দলের’ বিকল্প হতে চাইছেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তাঁদের আবার শাসক দল শুধু উৎসাহিত করছে তা-ই নয়, কোথাও কোথাও শোনা যায় নিজের দলীয় মনোনীত প্রার্থীকে পরাজিত করে স্বতন্ত্ররা যাতে জয়ী হন, সে জন্য গোপনে তাঁদের নানাভাবে সাহায্য ও আশীর্বাদ করছে। আর এটাও আমরা দেখছি, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অনেকেই দাবি করছেন যে তাঁরাও নৌকার রাজনীতিতে বিশ্বাসী, নৌকার মূল মাঝির আশীর্বাদ নাকি গোপনে তাঁর প্রতিই আছে (!) যদিও অফিশিয়ালি তাঁরা নৌকা প্রতীক থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এবং অন্য প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করছেন। সুতরাং এই নির্বাচনে দ্বিতীয় প্রবণতা হচ্ছে শাসক দলের অভ্যন্তরে সৃষ্ট ব্যাপক অনৈক্য, পারস্পরিক বিবাদ এবং বিশৃঙ্খলা। প্রশ্ন হচ্ছে, আগামী নির্বাচনে সব রকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শেষে কোন নিট প্রবণতাটি প্রধান নির্ধারক প্রবণতায় পরিণত হবে?
বলা হয় জনগণই ইতিহাসের স্রষ্টা। দেখা যাক সেখানে কী প্রবণতা বিরাজ করছে? জনগণের মধ্যে বর্তমান নির্বাচন বানচাল করে দেওয়া বা ঠেকিয়ে দেওয়ার মতো তীব্র কোনো সংগ্রাম বা ‘গণ-অভ্যুত্থান’ ঘটিয়ে এরপর ১৯৭০-এর নির্বাচনের মতো কোনো গণতান্ত্রিক বিজয়গাথা রচনার প্রবণতা আমরা মোটেও দেখছি না। আমরা বলে থাকি, আমাদের রাজনীতির বা প্রজাতন্ত্রের মূল শক্তি হচ্ছে এর জনগণ। কিন্তু কেন জনগণ রাজনীতির বিষয়ে এতটা অনুৎসাহিত বা এত উদাসীন হয়ে আছেন এখনো—সেটা কি কেউ গভীরভাবে ভেবে দেখেছেন? যদিও শাসক দল আশা ও চেষ্টা করছে যাতে জনগণ খুবই উৎসাহিত হয়ে দলে দলে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হবেন ও ভোট দিয়ে এই বিদ্যমান আলংকারিক প্রতিযোগিতার ভেতর থেকেই নিজেদের পছন্দমতো অলংকারটি বেছে নেবেন। হয়তো কোনো কোনো নির্বাচনী এলাকায় যে তীব্র মারামারি, অর্থব্যয়, প্রচার, পক্ষে-বিপক্ষে বাদ্য-বাজনা-গান ইত্যাদি দেখা যাচ্ছে, তাতে তাঁরা ভাবছেন, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরাই নিজ উদ্যোগে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনার ব্যবস্থা করবেন এবং তাঁদের এসব সক্রিয়তা অবশেষে ভোটারদের বর্তমান নিস্পৃহতা কাটিয়ে তাঁদের সক্রিয় করে তুলবেন। একটি অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতেও পারে! নানা ঐতিহাসিক কারণে বাংলাদেশের জনগণ দুটি দলে (প্রায় গোত্রের মতো) বিভক্ত এবং দুই শিবিরের প্রতি দুই দলের সুস্থির আনুগত্য রয়েছে। এই দুই শিবিরকে সাংস্কৃতিকভাবেও বর্তমানে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। একটি শিবিরকে বলা হয় ‘জয় বাংলার শিবির’, অপরটিকে বলা হয় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’-এর শিবির। টাকার ক্ষমতা বা অর্থের দিক থেকে বা দলীয় শ্রেণিচরিত্রের দিক থেকে বা শাসনক্ষমতায় থাকাকালে নানাভাবে ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার গোপন বা প্রকাশ্য অঙ্গীকারের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোনো তফাত নেই, কিন্তু মনোভঙ্গি বা সংস্কৃতিগতভাবে আমাদের বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধ, তার প্রতি এই দুই শিবিরের দৃষ্টিভঙ্গিতে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। এবারও তাই এদের মধ্যে যেকোনো একটি শিবিরের সমর্থকেরাও যদি এবারের নির্বাচনে যোগ দেন, তাহলেও কিন্তু ভোটের অনুপাত ন্যূনতম ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ হয়ে যেতে পারে।
যে নির্বাচনটি শেষ পর্যন্ত হচ্ছে তাতে শেষ ফলাফল কি শুভ হবে? আওয়ামী সমর্থকেরা বলতেই পারেন, আমরা কী করব, কেউ যদি নির্বাচনে না আসেন, তাহলে কী করার আছে আমাদের। আমরা সংবিধান মেনে নির্বাচন দিয়েছি, এ ছাড়া আমাদের অন্য কোনো পথ ছিল না। কিন্তু তাতে কী কাজ হবে?
পাল্টা প্রশ্নটি হচ্ছে—অন্য কোনো পথ কি ছিল না? আওয়ামী লীগ কি আসলেই চেয়েছিল প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীরা নির্বাচনে সুষ্ঠু প্রতিদ্বন্দ্বিতাসহ অংশগ্রহণ করুক? ২০১৪ ও ২০১৮তে সংবিধান মেনেই আওয়ামী সরকারকে ক্ষমতায় রেখেই নির্বাচন হয়েছিল। ২০১৪ সালের নির্বাচনে কিন্তু বিএনপি আসেনি এবং পরে স্বীকার করেছিল যে না এসে তারা ভুল করেছিল। তাই ২০১৮তে যখন তারা ভুল সংশোধন করে পুনরায় নির্বাচনে যোগ দেয়, তখন রাতের আঁধারে ভোট বাক্স ভরে ফেলায়, সেই সময় বিএনপি তার প্রত্যাশিত ফলাফল থেকে বঞ্চিত হয়েছিল। বিএনপির কয়েকজন এমপি ২০১৮-এর সংসদে যোগ দিয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক মহলও সেই সংসদকে ও সরকারকে অবশেষে মেনেও নেয়। ফলে বিরাট কোনো গোলযোগ সেবার সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু এবার আর বিএনপি নির্বাচনেই যায়নি, ২০১৮-এর পুনরাবৃত্তির আশঙ্কায়। সুতরাং এবার একতরফা নির্বাচনে যে সংসদটি তৈরি হতে যাচ্ছে, সেটিও কি আবার সবাই অবশেষে মেনে নেবে? সেখানে কি যথার্থই কোনো বিরোধী দল থাকবে? আন্তর্জাতিক মহলও কি এই নির্বাচনকে অবশেষে বৈধতা দেবে? বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবারের নির্বাচনের আগে থেকেই যেসব সতর্ক বার্তা দিয়ে চলেছে, তাতে এবার
তাদের স্বীকৃতি সংগ্রহ ততটা সহজ ও নিশ্চিত নয় বলেই মনে হয়।
বর্তমানে আমরা বাতাসে একটি ‘উন্নয়নের’ তত্ত্ব শুনতে পাই। এই তত্ত্বের মূল কথা হচ্ছে, ‘গণতন্ত্র’ উন্নয়নের অপরিহার্য শর্ত নয়। একদলীয় কর্তৃত্বমূলক গণতন্ত্রের অধীনেও উন্নয়ন সম্ভব। উদাহরণ হিসেবে একগুচ্ছ রাষ্ট্রের উন্নয়নের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়, যেমন চীন, ভিয়েতনাম, কিউবা, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর ইত্যাদি।
‘পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়’ বা ‘বাজারমুখী সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায়’ বর্তমান বিশ্বে একদলীয় কর্তৃত্বমূলক রাজনৈতিক শাসনের অধীনেও প্রবৃদ্ধি এবং কিছুটা সুষম বণ্টনসহই জনগণের উন্নয়ন হচ্ছে বা হতে পারে। এসব দেশে জনগণ সংকুচিত বাক্স্বাধীনতা, নিয়ন্ত্রিত রাজনীতি বা ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে এতটা উৎকণ্ঠিত নন। এসব ছাড়াও দিব্যি তাঁরা শান্তিতে, স্বস্তিতে জীবনযাপন অব্যাহত রেখেছেন। বলা হয় সেই তুলনায় অবাধ বাজার এবং অবাধ ব্যক্তিস্বাধীনতাসহ যে উন্নত সমাজ (আমেরিকার দৃষ্টান্ত) রয়েছে, সেখানেও অনেক অন্যায়, অনেক বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে দেখা যায়। গণতন্ত্র ও উন্নয়ন একসঙ্গে হলে খুব ভালো, কিন্তু না হলেই যে মহা সর্বনাশ হবে, সেটি আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতায় অনিবার্য সত্য নয়।
১৯৭১ সালে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্যই প্রথমে কিন্তু গণতন্ত্রের সংগ্রামেই নেমেছিলাম। তখন উগ্র বামপন্থীরা ভোট বর্জন করে বলেছিল যে ভোটের আগে ভাতের অধিকার অর্জন করতে হবে। ভাসানী সাহেব তখন নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। কিন্তু সেটা ছিল তখন ভুল। কিন্তু এখন আমরা কী বলব?
এখন যদি ইস্যুটা এমন হতো যে ‘আওয়ামী লীগের’ শাসক গোষ্ঠীর চরিত্র ও ধরনটি এমন যে তারা একদলীয় শাসনের অধীনেই প্রয়োজনীয় উন্নয়ন ও সুষম বণ্টন সম্পন্ন করতে সক্ষম হচ্ছে, তাহলে হয়তো আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র তা আমাদের জনগণ মেনে নিতেন। কিন্তু জনগণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কোটিপতির সংখ্যা বৃদ্ধি, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি বা এককথায় স্বজনতোষণমূলক পুঁজিবাদী এই ব্যবস্থা দেখে এত বীতশ্রদ্ধ যে ‘আওয়ামী উন্নয়ন’ দাবির প্রতি তাঁরা কোনো নিখাদ আস্থা রাখতে পারছেন না। কিন্তু সত্যিকার উন্নততর বিকল্প কোনো বিরোধী নেতৃত্বও তাঁরা এখন পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছেন না। ফলে তাঁদের অভিজ্ঞতা হচ্ছে গণতান্ত্রিক বা অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা যেটাই থাকুক না কেন, লঙ্কায় যিনি থাকবেন বা যাবেন, তিনি দ্রুতই রাবণে পরিণত হবেন। বর্তমানে তাই জনগণ এখানে হতাশ ও উদ্যোগহীন শক্তিতে পরিণত হয়েছেন; বরং ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’—এটাই হচ্ছে জনগণের বিদ্যমান প্রধান মনোভঙ্গি। বিদ্যমান রাষ্ট্রব্যবস্থা ভাঙার জন্য জনগণ এখনো জান বাজি রেখে রাস্তায় নামতে প্রস্তুত নন।
এই মনোভঙ্গির পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত গ্রহণযোগ্য উন্নয়ন ও গ্রহণযোগ্য গণতন্ত্র উভয়ই ঝুলতে থাকবে।
লেখক: এম এম আকাশ, অধ্যাপক, অর্থনীতিবিদ
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
২ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে