আবু তাহের খান
গত ২৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘আয় ও খানা জরিপ ২০২২’ প্রতিবেদনের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, দেশের সর্বাধিক দারিদ্র্যপীড়িত বিভাগ এখন বরিশাল, যেখানে দারিদ্র্যের হার ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ। বরিশাল বিভাগে ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ; অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে সেখানে এই হার দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। ছয় বছরে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে সিলেট বিভাগেও। উল্লিখিত তথ্য প্রমাণ করে, দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার কমলেও কোনো কোনো অঞ্চলে বা গ্রামের একটি বড় অংশে ছয় বছরে তা আরও বেড়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এমনটি কেন ঘটল?
ছয় বছরে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের কোনো কোনো অংশে দারিদ্র্য না কমে কেন বেড়ে গেল, এর নানাবিধ কারণ থাকতে পারে। একটি বড় কারণ অবশ্যই রাজনৈতিক অস্থিরতা—দ্বন্দ্ব ও পারস্পরিক বৈরিতায় দেশের অর্থনীতি-সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলো বৃহত্তর গ্রামীণ মানুষের স্বার্থের প্রতি যথেষ্ট দৃষ্টি ও মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আর সেই ব্যর্থতার জেরে দারিদ্র্যের হাত ধরে সেখানে বেড়েছে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা এবং আয়বৈষম্যও।
৩১ ডিসেম্বর প্রকাশিত ‘খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান ২০২৩’-এর তথ্য জানাচ্ছে, গড়ে দেশের প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ বর্তমানে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন খাদ্যোৎপাদনকারী কৃষক। আর তাঁদের মধ্যে এই হার ৩০ শতাংশ, যা এ-সংক্রান্ত জাতীয় গড় হারের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি। বস্তুত রাষ্ট্রের নীতিকাঠামোয় গ্রামের প্রতি যে বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি বিরাজ করছে, সেটি থেকেই কৃষকের মধ্যে বর্ধিত হারের এ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে।
অন্যদিকে, বৈষম্যের মাত্রা কতটা বেড়েছে, এর তথ্যও রয়েছে আয় ও খানা জরিপ প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ এখন দখল করে আছে সমগ্র জাতীয় আয়ের প্রায় ৪১ শতাংশ; তো রাষ্ট্রীয় নীতি, পৃষ্ঠপোষকতা ও সমর্থনে সৃষ্ট এই যে বৈষম্য, দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, সেটিকে ক্রমান্বয়ে আরও বহুলাংশে বাড়িয়ে তুলেছে এবং এরই প্রতিফলন ঘটেছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিবিএসের জরিপে।
বৈষম্য বৃদ্ধির সুবাদে সর্বাধিক মাত্রায় ও হারে এবং সবচেয়ে আগে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে গ্রামের মানুষ, যারা এখন পর্যন্ত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামীণ মানুষ যদি এরূপ ক্রমবর্ধমান হারে দারিদ্র্য, আয়বৈষম্য ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার শিকার হতে থাকে, তাহলে প্রকারান্তরে তা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকেই চরম ভোগান্তিতে ফেলে দেয় নাকি? আর যে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশে বিরাজমান রয়েছে তা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে এই ভোগান্তির মাত্রা নিকট ভবিষ্যতে আরও বেড়ে যাবে নাকি?
দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা কবে কখন কোথায় কীভাবে শেষ হবে, আমরা সাধারণ মানুষ তা জানি না। কিন্তু সেই অস্থিরতার কারণে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা যে ক্রমেই আরও কঠিন ও অবহনযোগ্য হয়ে পড়ছে, তা তো দেশের মানুষ প্রতিদিন তাদের কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে উপলব্ধি করছে। এরই মধ্যে আবার অধিকতর কঠিন হয়ে পড়েছে গ্রামীণ মানুষের জীবন, যেখানে প্রথাগত আয়ের বাইরে বাড়তি আয়ের সুযোগ খুবই সীমিত।
তবে বাড়তি বিনিয়োগ ও উদ্ভাবনাময় চিন্তাভাবনা প্রয়োগের মাধ্যমে সে ধরনের সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সে ধরনের উদ্যোগ প্রায় নেই বললেই চলে। আর সেই না থাকার প্রবণতাটি চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় আরও অধিক স্থবির ও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। প্রায় চার দশকের ব্যবধানে বাংলাদেশের কৃষি খাত যে নানাভাবে বিকশিত হয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রের অবদানের চেয়ে কৃষকের ব্যক্তিগত শ্রম, মেধা ও উদ্যমশীলতার অবদানই বেশি।
দেশে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে, যা প্রায় সব খাতের ব্যবহারকারীদের জন্যই অসহনীয়। কিন্তু তারপরও রপ্তানিমুখী ও উচ্চ মুনাফাধারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো তা কোনো না কোনোভাবে সামাল দিতে পারছে। কিন্তু একই মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে সেচপাম্প, পোলট্রি খামার কিংবা মাছ চাষের অ্যারেটর চালু রাখার সামর্থ্য কি গ্রামীণ কৃষকের আছে? সারবিষয়ক জাতীয় সমন্বয় ও পরামর্শক কমিটির সভা শেষে গত ৩ এপ্রিল সাবেক কৃষিমন্ত্রী ওয়াদা করেছিলেন সারের মূল্য আর বাড়ানো হবে না।
কিন্তু তাঁর ওই ঘোষণার এক সপ্তাহের মাথায় সব ধরনের সারের দাম কেজিতে ৫ টাকা করে বাড়ানো হয়, যা কার্যকর হয় ১০ এপ্রিল থেকে। বীজ, কীটনাশক, গোখাদ্য, মাছ ও হাঁস-মুরগির খাবার এবং অন্যান্য কৃষি উপকরণের দামও দিন দিন বাড়ছে। শহরকেন্দ্রিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর আমদানিকারকেরা শুল্ক ও কর অব্যাহতি চেয়ে বসেন, আর সরকারও এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে তা মঞ্জুর করে, যদিও এর তেমন কোনো সুফল প্রায় কখনোই মেলে না। কিন্তু শহরকেন্দ্রিক পণ্য আমদানির মতো গ্রামীণ কৃষি উপকরণ আমদানির ক্ষেত্রেও কি অনুরূপ সুবিধা ওই রূপ ‘চাহিবামাত্র’ পাওয়া যায়? মোটেও না।
৫২ বছরে বাংলাদেশের কৃষিতে ফুল, ফল, ফসল, মাছ, হাঁস-মুরগি, মাছ, গবাদিপশু ইত্যাদির চাষাবাদ ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যাপক বহুমুখীকরণ ঘটেছে। ফলে দেশে খাদ্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫ গুণ, যা দেশকে খাদ্য চাহিদাপূরণের প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু এরপরও উৎপাদনের সেই স্তর এখনো কাম্যস্তরে পৌঁছাতে পারেনি, যেখানে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় নীতিসহায়তার পাশাপাশি ব্যাপক মাত্রার সম্পদ সহায়তাও—এর মধ্যে ঋণ, উপকরণ, প্রযুক্তি ও কারিগরি সহযোগিতা, বিপণনসহায়তা ইত্যাদি অন্যতম।
কিন্তু অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এসবের অধিকাংশের সরবরাহই এখন ঘাটতি বা শৈথিল্যের মুখে, যার দালিলিক প্রমাণ হচ্ছে, কয়েক বছর যাবৎ জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদানের হার ক্রমেই নিম্নমুখী হয়ে পড়ছে। ২০১৯-২০, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদানের হার ছিল যথাক্রমে ১২, ১১ দশমিক ৬৩ ও ১১ দশমিক ২২ শতাংশ।
চাঁদাবাজির বিষয়ে একসময় সবচেয়ে বেশি দুর্নাম ছিল শহরকেন্দ্রিক পরিবহন খাত ও ফুটপাতের হকার নিয়ন্ত্রণকারীদের বিষয়ে। সেই চাঁদাবাজি এখন গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে উৎপাদিত প্রতিটি কৃষিপণ্য বাজারে বিক্রির আগে এর সঙ্গে চাঁদার অর্থ যোগ করা এখন প্রায় বাধ্যতামূলক।
দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা যত বাড়ছে, চাঁদার বিস্তার ও পরিমাণও ততই জোরদার হচ্ছে। ধারণা করা যায়, সামনের দিনগুলোতে এর গতি আরও বাড়বে এবং এর অনিবার্য ফল হিসেবে কৃষি খাতের উৎপাদন বড় মাত্রার ঝুঁকিতে পড়বে।
ফেব্রুয়ারি-মার্চে দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে বলে বর্তমানে যে প্রচার রয়েছে, সেটিকে এই মুহূর্তে রাজনৈতিক প্রচারণা বলে হয়তো উড়িয়ে দেওয়া যাবে।
কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার ডামাডোলে গ্রামীণ তথা কৃষি-অর্থনীতির প্রতি যে উপেক্ষা বা মনোযোগহীনতা বিরাজ করছে, তা উতরে যেতে না পারলে শিগগিরই দেশে খাদ্যপণ্যের বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দেওয়াটা মোটেও অসম্ভব কিছু নয়। একই সূত্র ধরে গ্রামাঞ্চলে নয়া কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার পরিবর্তে সেখানে বিদ্যমান ছদ্মবেকারত্ব পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা পোষণ করার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে।
২০০৮-এর বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা কিংবা ২০২০-এর ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশ কিন্তু মোটামুটি বেশ ভালোভাবেই টিকে গিয়েছিল, যার পেছনে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা ছিল কৃষির। আজ যে দেশে ধারাবাহিক রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে, সে ক্ষেত্রেও যদি সেই অস্থিরতার নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠে ভালোভাবে টিকে থাকতে হয়, তাহলেও কৃষিই মূল ভরসা। অতএব শত দুর্যোগ-দুরবস্থার মধ্যেও কৃষি খাত যেন রাষ্ট্রের মনোযোগ না হারায়।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক
গত ২৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘আয় ও খানা জরিপ ২০২২’ প্রতিবেদনের তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, দেশের সর্বাধিক দারিদ্র্যপীড়িত বিভাগ এখন বরিশাল, যেখানে দারিদ্র্যের হার ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ। বরিশাল বিভাগে ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৬ দশমিক ৫ শতাংশ; অর্থাৎ ছয় বছরের ব্যবধানে সেখানে এই হার দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে। ছয় বছরে দারিদ্র্যের হার বেড়েছে সিলেট বিভাগেও। উল্লিখিত তথ্য প্রমাণ করে, দেশে সার্বিক দারিদ্র্যের হার কমলেও কোনো কোনো অঞ্চলে বা গ্রামের একটি বড় অংশে ছয় বছরে তা আরও বেড়ে গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এমনটি কেন ঘটল?
ছয় বছরে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের কোনো কোনো অংশে দারিদ্র্য না কমে কেন বেড়ে গেল, এর নানাবিধ কারণ থাকতে পারে। একটি বড় কারণ অবশ্যই রাজনৈতিক অস্থিরতা—দ্বন্দ্ব ও পারস্পরিক বৈরিতায় দেশের অর্থনীতি-সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তগুলো বৃহত্তর গ্রামীণ মানুষের স্বার্থের প্রতি যথেষ্ট দৃষ্টি ও মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। আর সেই ব্যর্থতার জেরে দারিদ্র্যের হাত ধরে সেখানে বেড়েছে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা এবং আয়বৈষম্যও।
৩১ ডিসেম্বর প্রকাশিত ‘খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান ২০২৩’-এর তথ্য জানাচ্ছে, গড়ে দেশের প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ বর্তমানে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন খাদ্যোৎপাদনকারী কৃষক। আর তাঁদের মধ্যে এই হার ৩০ শতাংশ, যা এ-সংক্রান্ত জাতীয় গড় হারের চেয়ে ৮ শতাংশ বেশি। বস্তুত রাষ্ট্রের নীতিকাঠামোয় গ্রামের প্রতি যে বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি বিরাজ করছে, সেটি থেকেই কৃষকের মধ্যে বর্ধিত হারের এ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার সৃষ্টি হয়েছে।
অন্যদিকে, বৈষম্যের মাত্রা কতটা বেড়েছে, এর তথ্যও রয়েছে আয় ও খানা জরিপ প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মাত্র ১০ শতাংশ মানুষ এখন দখল করে আছে সমগ্র জাতীয় আয়ের প্রায় ৪১ শতাংশ; তো রাষ্ট্রীয় নীতি, পৃষ্ঠপোষকতা ও সমর্থনে সৃষ্ট এই যে বৈষম্য, দীর্ঘদিন ধরে বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, সেটিকে ক্রমান্বয়ে আরও বহুলাংশে বাড়িয়ে তুলেছে এবং এরই প্রতিফলন ঘটেছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিবিএসের জরিপে।
বৈষম্য বৃদ্ধির সুবাদে সর্বাধিক মাত্রায় ও হারে এবং সবচেয়ে আগে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে গ্রামের মানুষ, যারা এখন পর্যন্ত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গ্রামীণ মানুষ যদি এরূপ ক্রমবর্ধমান হারে দারিদ্র্য, আয়বৈষম্য ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার শিকার হতে থাকে, তাহলে প্রকারান্তরে তা দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকেই চরম ভোগান্তিতে ফেলে দেয় নাকি? আর যে রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশে বিরাজমান রয়েছে তা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে এই ভোগান্তির মাত্রা নিকট ভবিষ্যতে আরও বেড়ে যাবে নাকি?
দেশের চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা কবে কখন কোথায় কীভাবে শেষ হবে, আমরা সাধারণ মানুষ তা জানি না। কিন্তু সেই অস্থিরতার কারণে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকা যে ক্রমেই আরও কঠিন ও অবহনযোগ্য হয়ে পড়ছে, তা তো দেশের মানুষ প্রতিদিন তাদের কষ্টদায়ক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে উপলব্ধি করছে। এরই মধ্যে আবার অধিকতর কঠিন হয়ে পড়েছে গ্রামীণ মানুষের জীবন, যেখানে প্রথাগত আয়ের বাইরে বাড়তি আয়ের সুযোগ খুবই সীমিত।
তবে বাড়তি বিনিয়োগ ও উদ্ভাবনাময় চিন্তাভাবনা প্রয়োগের মাধ্যমে সে ধরনের সুযোগ সৃষ্টির সম্ভাবনা অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সে ধরনের উদ্যোগ প্রায় নেই বললেই চলে। আর সেই না থাকার প্রবণতাটি চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় আরও অধিক স্থবির ও সংকুচিত হয়ে পড়েছে। প্রায় চার দশকের ব্যবধানে বাংলাদেশের কৃষি খাত যে নানাভাবে বিকশিত হয়েছে, সেখানে রাষ্ট্রের অবদানের চেয়ে কৃষকের ব্যক্তিগত শ্রম, মেধা ও উদ্যমশীলতার অবদানই বেশি।
দেশে দফায় দফায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে, যা প্রায় সব খাতের ব্যবহারকারীদের জন্যই অসহনীয়। কিন্তু তারপরও রপ্তানিমুখী ও উচ্চ মুনাফাধারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো তা কোনো না কোনোভাবে সামাল দিতে পারছে। কিন্তু একই মূল্যে বিদ্যুৎ কিনে সেচপাম্প, পোলট্রি খামার কিংবা মাছ চাষের অ্যারেটর চালু রাখার সামর্থ্য কি গ্রামীণ কৃষকের আছে? সারবিষয়ক জাতীয় সমন্বয় ও পরামর্শক কমিটির সভা শেষে গত ৩ এপ্রিল সাবেক কৃষিমন্ত্রী ওয়াদা করেছিলেন সারের মূল্য আর বাড়ানো হবে না।
কিন্তু তাঁর ওই ঘোষণার এক সপ্তাহের মাথায় সব ধরনের সারের দাম কেজিতে ৫ টাকা করে বাড়ানো হয়, যা কার্যকর হয় ১০ এপ্রিল থেকে। বীজ, কীটনাশক, গোখাদ্য, মাছ ও হাঁস-মুরগির খাবার এবং অন্যান্য কৃষি উপকরণের দামও দিন দিন বাড়ছে। শহরকেন্দ্রিক বাজারে কোনো পণ্যের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এর আমদানিকারকেরা শুল্ক ও কর অব্যাহতি চেয়ে বসেন, আর সরকারও এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে তা মঞ্জুর করে, যদিও এর তেমন কোনো সুফল প্রায় কখনোই মেলে না। কিন্তু শহরকেন্দ্রিক পণ্য আমদানির মতো গ্রামীণ কৃষি উপকরণ আমদানির ক্ষেত্রেও কি অনুরূপ সুবিধা ওই রূপ ‘চাহিবামাত্র’ পাওয়া যায়? মোটেও না।
৫২ বছরে বাংলাদেশের কৃষিতে ফুল, ফল, ফসল, মাছ, হাঁস-মুরগি, মাছ, গবাদিপশু ইত্যাদির চাষাবাদ ও উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যাপক বহুমুখীকরণ ঘটেছে। ফলে দেশে খাদ্যের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫ গুণ, যা দেশকে খাদ্য চাহিদাপূরণের প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু এরপরও উৎপাদনের সেই স্তর এখনো কাম্যস্তরে পৌঁছাতে পারেনি, যেখানে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় নীতিসহায়তার পাশাপাশি ব্যাপক মাত্রার সম্পদ সহায়তাও—এর মধ্যে ঋণ, উপকরণ, প্রযুক্তি ও কারিগরি সহযোগিতা, বিপণনসহায়তা ইত্যাদি অন্যতম।
কিন্তু অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এসবের অধিকাংশের সরবরাহই এখন ঘাটতি বা শৈথিল্যের মুখে, যার দালিলিক প্রমাণ হচ্ছে, কয়েক বছর যাবৎ জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদানের হার ক্রমেই নিম্নমুখী হয়ে পড়ছে। ২০১৯-২০, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদানের হার ছিল যথাক্রমে ১২, ১১ দশমিক ৬৩ ও ১১ দশমিক ২২ শতাংশ।
চাঁদাবাজির বিষয়ে একসময় সবচেয়ে বেশি দুর্নাম ছিল শহরকেন্দ্রিক পরিবহন খাত ও ফুটপাতের হকার নিয়ন্ত্রণকারীদের বিষয়ে। সেই চাঁদাবাজি এখন গ্রামাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে উৎপাদিত প্রতিটি কৃষিপণ্য বাজারে বিক্রির আগে এর সঙ্গে চাঁদার অর্থ যোগ করা এখন প্রায় বাধ্যতামূলক।
দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা যত বাড়ছে, চাঁদার বিস্তার ও পরিমাণও ততই জোরদার হচ্ছে। ধারণা করা যায়, সামনের দিনগুলোতে এর গতি আরও বাড়বে এবং এর অনিবার্য ফল হিসেবে কৃষি খাতের উৎপাদন বড় মাত্রার ঝুঁকিতে পড়বে।
ফেব্রুয়ারি-মার্চে দেশে দুর্ভিক্ষাবস্থা সৃষ্টি হতে পারে বলে বর্তমানে যে প্রচার রয়েছে, সেটিকে এই মুহূর্তে রাজনৈতিক প্রচারণা বলে হয়তো উড়িয়ে দেওয়া যাবে।
কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতার ডামাডোলে গ্রামীণ তথা কৃষি-অর্থনীতির প্রতি যে উপেক্ষা বা মনোযোগহীনতা বিরাজ করছে, তা উতরে যেতে না পারলে শিগগিরই দেশে খাদ্যপণ্যের বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দেওয়াটা মোটেও অসম্ভব কিছু নয়। একই সূত্র ধরে গ্রামাঞ্চলে নয়া কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার পরিবর্তে সেখানে বিদ্যমান ছদ্মবেকারত্ব পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা পোষণ করার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে।
২০০৮-এর বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা কিংবা ২০২০-এর ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশ কিন্তু মোটামুটি বেশ ভালোভাবেই টিকে গিয়েছিল, যার পেছনে সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকা ছিল কৃষির। আজ যে দেশে ধারাবাহিক রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে, সে ক্ষেত্রেও যদি সেই অস্থিরতার নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠে ভালোভাবে টিকে থাকতে হয়, তাহলেও কৃষিই মূল ভরসা। অতএব শত দুর্যোগ-দুরবস্থার মধ্যেও কৃষি খাত যেন রাষ্ট্রের মনোযোগ না হারায়।
লেখক: সাবেক পরিচালক, বিসিক
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে