এম আর খায়রুল উমাম
ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী থেকে দেশ—আজ সবার মুখে উন্নতি, অগ্রগতি আর সাফল্যের কথা। এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে দেশে কিছু মানুষের উন্নতি হচ্ছে। একজন যখন মাত্র কয়েক বছরে তাঁর সম্পদ ১০ লাখ টাকা থেকে ৭৭ কোটি টাকায় নিয়ে যেতে সমর্থ হচ্ছেন, তখন এটাকেই উন্নতি, অগ্রগতি আর সাফল্য মনে করা হচ্ছে। বিজ্ঞজনেরা মনে করেন, উন্নতি, অগ্রগতি আর সাফল্যের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। বিজ্ঞজনের মতে, উন্নতির সঙ্গে যখন নৈতিক জীবনবোধ অর্থাৎ শৃঙ্খলা, সততা ও আদর্শ যোগ করা হবে, তখন তা হবে অগ্রগতি এবং অগ্রগতির সঙ্গে যখন মানবতা, সদাচরণ ও আধ্যাত্মিকতা যোগ হবে, তখন তা সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হবে।
যদিও আমাদের দেশে বিজ্ঞজনেরা কী বলেন তা বিবেচ্য বিষয় হয় না; তাই উন্নতি, অগ্রগতি ও সাফল্য সব এক কাতারে মিলেমিশে গেছে। দেশে এখন উন্নতির জন্য নৈতিক শৃঙ্খলা, সততা, আদর্শ, মানবতা, সদাচরণ ও আধ্যাত্মিকতার কোনো স্থান নেই। সবাই নিজের উন্নতি, মানে সম্পদের পাহাড়ে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করার বুদ্ধি ব্যয়ে নিবেদিত। ব্যক্তি থেকে দেশ কোনোখানেই এর ব্যতিক্রম নেই। ‘দেশটা চিরকালের’—এই মতে বিশ্বাসী একটা গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে, যারা জনকল্যাণের আস্ফালনে আমজনতার ভাগ্য পরিবর্তনের কথা বলে নিজেদের অভিজাত জীবনভাবনায় ব্যস্ত। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিয়ে কোনো কথা বলার সুযোগ আছে—এমন ভাবনা মনে আনার কেউ নেই বললেই চলে।
দেশ আজ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উন্নত দেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লিপ্ত। সরকার জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন এনেছে। তাতে গড় আয়ু আর আয় বেড়েছে, শিক্ষার হার আর জনশক্তি রপ্তানি বেড়েছে, অর্থনীতির পরিধির সঙ্গে বেড়েছে কোটিপতির সংখ্যা, মেগা প্রকল্প বেড়েছে, শাসকশ্রেণির সেকেন্ড হোম-ব্যক্তিগত সম্পদ-বিদেশে পরিবার স্থানান্তর বেড়েছে, স্ব-অর্থায়নে প্রকল্প সম্পন্ন করার সক্ষমতা বেড়েছে। বিশ্বে অনেক বিষয়ে রোল মডেল হয়েছি আমরা, সামাজিক নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টি করা হয়েছে, প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দিতে কমিউনিটি ক্লিনিক হয়েছে, শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কয়েক শ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট পরিচালনার অনুমতিদানের মধ্য দিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরির কার্যক্রম চলছে।
দেশের যে বিপুল উন্নতি হয়েছে, তাতে মৌলিক মূল্যবোধের দ্রবণের অনুপস্থিতির কারণে জনগণের জীবনমানের যে উন্নতি হওয়ার কথা ছিল, তার সিংহভাগও অর্জিত হয়নি, সেটাই সবচেয়ে অনুতাপের। স্বাধীনতা আমজনতাকে স্বজাতির শাসনের মধ্যে সীমিত করে রেখেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আংশিক বাস্তবায়নে শাসকশ্রেণি নিবেদিত থাকছে। জনপ্রতিনিধি, আমলা, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী সবাই সম্মিলিত উদ্যোগে আমজনতাকে একপাশে সরিয়ে শুধু নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তনে ব্রতী হওয়ার ফলে জনকল্যাণ, জনস্বার্থ, জনসেবা সোনার হরিণ হয়ে আছে।
বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু গড় আয়, যা স্বাধীনতার সময়কালে ছিল ৯৪ ডলার, তা আজ ২ হাজার ৯৬১ ডলার হয়েছে। যদিও গড় আয়ের পরিসংখ্যানটা বড়ই মজার। ধরা যাক, একজনের আয় যদি ১ লাখ টাকা হয় আর অন্যজনের আয় যদি ১০০ টাকা হয়, তবে তাদের গড় আয় ৫০ হাজার ৫০ টাকা। অথচ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের পরিধি দেখে মনে হয়, দেশের মানুষের গড় আয়ের হিসাব একেবারে ওপরের দুজনের মতো। অর্থনীতি সমিতি যদি দেশের ভাগ্যবান বিত্তশালী ১০ হাজার জনকে বাদ রেখে বাকি ১৭ কোটি আমজনতার গড় আয়ের হিসাব প্রকাশ করার দায়িত্ব নিত, তবে জনগণ সমিতির প্রতি কৃতজ্ঞ থেকে দেখতে পেত গড় আয় বৃদ্ধির সরকারি হিসাবের প্রকৃত চিত্র।
স্বাধীনতার পর থেকে রাজস্ব আয় বেড়েছে ১৬৬ কোটি থেকে ৫ লাখ কোটি টাকা। বাজেটের আকার বেড়েছে ৭৮৬ কোটি থেকে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। জিডিপির আকার বেড়েছে ৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪২৬ বিলিয়ন ডলার। কৃষি ও শিল্প উৎপাদন পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। এত সব উন্নতি, অগ্রগতি আর সাফল্যের পাশাপাশি সমানভাবে প্রতিযোগিতা করে বেড়েছে বিশাল আয়বৈষম্য।
দেশের অর্থনৈতিক গণ্ডি পেরিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও বৈষম্য লক্ষণীয়। রাজনীতিতে আমজনতার কণ্ঠস্বর ও প্রতিনিধিত্ব নিতান্ত প্রান্তিক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের সভাপতির অনুমতি নেওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মোট আসনের ২০ ভাগের বেশিতে বিজয়ী হয়ে প্রমাণ করেছে রাজনীতিতে আমজনতার সংশ্লিষ্টতা। আমজনতার চাওয়া-পাওয়াকে উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকেরা কীভাবে মূল্যায়ন করেন, তার একটা জ্বলন্ত প্রমাণও এই নির্বাচন। যদিও আমজনতার জন্য ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’, তাই বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যে জনগণের কথা মনে রাখবেন, সেই বিশ্বাস রাখা কঠিন।
দেশের উন্নতির জন্য ইতিমধ্যে ঘোষিত মেগা প্রকল্পের তালিকায় রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বুলেট ট্রেন, দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পূর্বাচলে ১১০ তলা বঙ্গবন্ধু বহুতল ভবন কমপ্লেক্স, শরীয়তপুরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, নোয়াখালীতে বিমানবন্দর, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া দ্বিতীয় পদ্মা সেতু ইত্যাদি। জনকল্যাণে এসব মেগা প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনার কথা পুনঃক্ষমতাসীনদের মনে আসে বলে মনে হয় না। জনপ্রতিনিধিরা দেশকে একজন প্যারিসের মতো দেখেন তো অন্যজন ভেনাসরূপে দেখেন। দেশ ও দেশের মানুষ উপযোগী উন্নতি-অগ্রগতি পরিকল্পনায় এঁদের কারোরই আগ্রহ নেই।
এসব জনপ্রতিনিধি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারে আগুন লাগলেও সিন্ডিকেট ভাঙার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেন না, মানবসম্পদ পরিকল্পনা করেন না, প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে ও ব্যয়ে শেষ করেন না। ব্যাংক জালিয়াতি, শেয়ারবাজারে ধস, মানি লন্ডারিংয়ের সহযোগী হতে দেখা যায় এঁদের। ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং করে বিদেশে অর্থ পাচারও বন্ধ হয় না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রের মতোই সামাজিক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ সমাজের প্রান্তসীমায় অবস্থান করছে। রাজধানীর বিত্তবান এলাকার জীবনযাত্রার সঙ্গে দরিদ্র এলাকার জীবনযাত্রার চিত্রে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না বহুদিন। দিনে দিনে এই অসম চিত্র বেড়েই চলেছে, যেখানে সামাজিক সুরক্ষাবলয় ন্যূনতম মিল আনতে পারছে না।
রাজনীতিবিদদের চিন্তার দৈন্য ও ক্ষমতালিপ্সার ফলস্বরূপ সমাজে মানুষের মধ্যে ধারাবাহিক আত্মকেন্দ্রিকতা সৃষ্টি হয়েছে; ঘুষ-দুর্নীতি-সন্ত্রাস-সহিংসতার বিস্তার ঘটেছে; সহনশীলতা-পরমতসহিষ্ণুতা-পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কমেছে; আমলাতন্ত্রের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে স্বার্থোদ্ধার বেড়েছে; ব্যবসায়ীরা লুটেরা মানসিকতা নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন; রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে লেজুড়বৃত্তিতে পেশাজীবীদের আত্মা সমর্পিত; জ্ঞানীগুণীরা আত্মসম্মানে নিজেদের লুকিয়ে রাখার মানসিকতায় ঘরবদ্ধ। জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদী চেতনা লুপ্ত হয়েছে ক্রমান্বয়ে। ফলে রাজনৈতিক স্বাধীনতালাভের পরও সার্বিক মুক্তি আসেনি।
জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকারপ্রাপ্তসহ ক্ষমতার বলয়ে থাকা মানুষ মনে করেন—দেশটা যখন স্বাধীন, তখন বিত্তবানদের সুখে আর আমজনতার দুঃখেও দেশ স্বাধীনই থাকবে। তাই বিত্তবান মানুষ আরও বিত্তের মালিক হয়ে সমাজে কোটিপতি হিসেবে সংখ্যা বৃদ্ধি করে বিশ্বের রোল মডেলের খেরোখাতায় নাম লেখান। এতে দেশের কোনো ক্ষতি হয় না, বরং শত শত কোটিপতি দেশ বা সমাজের শোভা বৃদ্ধি করেন নিয়ত। আর নাগরিক কবিয়ালেরা আমজনতাকে স্বপ্নাতুর করতে গেয়ে চলেন—‘সুখে আছ যারা সুখে থাকো, এ সুখ সইবে না, দুঃখে আছ যারা বেঁচে থাকো, এ দুঃখ রইবে না।’
সদ্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দেশে নতুন মোড়কে পুরোনো সরকার পথচলা শুরু করেছে। নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীনেরা ইশতেহার বাস্তবায়নে কতটা আন্তরিকতা দেখাবেন, সেটাই জনগণের কাছে লক্ষণীয় বিষয়। স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে উন্নতি, অগ্রগতি আর সাফল্য অতীতের স্বসংজ্ঞায়নের ধারাবাহিকতায় চলমান থাকবে, নাকি প্রকৃত সংজ্ঞায়নের পথ বেয়ে জনকল্যাণের পথে অগ্রসর হবে, সেটাই দেখার বিষয়।
লেখক: এম আর খায়রুল উমাম, সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ
ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী থেকে দেশ—আজ সবার মুখে উন্নতি, অগ্রগতি আর সাফল্যের কথা। এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে দেশে কিছু মানুষের উন্নতি হচ্ছে। একজন যখন মাত্র কয়েক বছরে তাঁর সম্পদ ১০ লাখ টাকা থেকে ৭৭ কোটি টাকায় নিয়ে যেতে সমর্থ হচ্ছেন, তখন এটাকেই উন্নতি, অগ্রগতি আর সাফল্য মনে করা হচ্ছে। বিজ্ঞজনেরা মনে করেন, উন্নতি, অগ্রগতি আর সাফল্যের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। বিজ্ঞজনের মতে, উন্নতির সঙ্গে যখন নৈতিক জীবনবোধ অর্থাৎ শৃঙ্খলা, সততা ও আদর্শ যোগ করা হবে, তখন তা হবে অগ্রগতি এবং অগ্রগতির সঙ্গে যখন মানবতা, সদাচরণ ও আধ্যাত্মিকতা যোগ হবে, তখন তা সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হবে।
যদিও আমাদের দেশে বিজ্ঞজনেরা কী বলেন তা বিবেচ্য বিষয় হয় না; তাই উন্নতি, অগ্রগতি ও সাফল্য সব এক কাতারে মিলেমিশে গেছে। দেশে এখন উন্নতির জন্য নৈতিক শৃঙ্খলা, সততা, আদর্শ, মানবতা, সদাচরণ ও আধ্যাত্মিকতার কোনো স্থান নেই। সবাই নিজের উন্নতি, মানে সম্পদের পাহাড়ে নিজের অবস্থান নিশ্চিত করার বুদ্ধি ব্যয়ে নিবেদিত। ব্যক্তি থেকে দেশ কোনোখানেই এর ব্যতিক্রম নেই। ‘দেশটা চিরকালের’—এই মতে বিশ্বাসী একটা গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে, যারা জনকল্যাণের আস্ফালনে আমজনতার ভাগ্য পরিবর্তনের কথা বলে নিজেদের অভিজাত জীবনভাবনায় ব্যস্ত। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিয়ে কোনো কথা বলার সুযোগ আছে—এমন ভাবনা মনে আনার কেউ নেই বললেই চলে।
দেশ আজ তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে উন্নত দেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লিপ্ত। সরকার জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন এনেছে। তাতে গড় আয়ু আর আয় বেড়েছে, শিক্ষার হার আর জনশক্তি রপ্তানি বেড়েছে, অর্থনীতির পরিধির সঙ্গে বেড়েছে কোটিপতির সংখ্যা, মেগা প্রকল্প বেড়েছে, শাসকশ্রেণির সেকেন্ড হোম-ব্যক্তিগত সম্পদ-বিদেশে পরিবার স্থানান্তর বেড়েছে, স্ব-অর্থায়নে প্রকল্প সম্পন্ন করার সক্ষমতা বেড়েছে। বিশ্বে অনেক বিষয়ে রোল মডেল হয়েছি আমরা, সামাজিক নিরাপত্তাবলয় সৃষ্টি করা হয়েছে, প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দিতে কমিউনিটি ক্লিনিক হয়েছে, শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কয়েক শ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট পরিচালনার অনুমতিদানের মধ্য দিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরির কার্যক্রম চলছে।
দেশের যে বিপুল উন্নতি হয়েছে, তাতে মৌলিক মূল্যবোধের দ্রবণের অনুপস্থিতির কারণে জনগণের জীবনমানের যে উন্নতি হওয়ার কথা ছিল, তার সিংহভাগও অর্জিত হয়নি, সেটাই সবচেয়ে অনুতাপের। স্বাধীনতা আমজনতাকে স্বজাতির শাসনের মধ্যে সীমিত করে রেখেছে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আংশিক বাস্তবায়নে শাসকশ্রেণি নিবেদিত থাকছে। জনপ্রতিনিধি, আমলা, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী সবাই সম্মিলিত উদ্যোগে আমজনতাকে একপাশে সরিয়ে শুধু নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তনে ব্রতী হওয়ার ফলে জনকল্যাণ, জনস্বার্থ, জনসেবা সোনার হরিণ হয়ে আছে।
বাংলাদেশের জনগণের মাথাপিছু গড় আয়, যা স্বাধীনতার সময়কালে ছিল ৯৪ ডলার, তা আজ ২ হাজার ৯৬১ ডলার হয়েছে। যদিও গড় আয়ের পরিসংখ্যানটা বড়ই মজার। ধরা যাক, একজনের আয় যদি ১ লাখ টাকা হয় আর অন্যজনের আয় যদি ১০০ টাকা হয়, তবে তাদের গড় আয় ৫০ হাজার ৫০ টাকা। অথচ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের পরিধি দেখে মনে হয়, দেশের মানুষের গড় আয়ের হিসাব একেবারে ওপরের দুজনের মতো। অর্থনীতি সমিতি যদি দেশের ভাগ্যবান বিত্তশালী ১০ হাজার জনকে বাদ রেখে বাকি ১৭ কোটি আমজনতার গড় আয়ের হিসাব প্রকাশ করার দায়িত্ব নিত, তবে জনগণ সমিতির প্রতি কৃতজ্ঞ থেকে দেখতে পেত গড় আয় বৃদ্ধির সরকারি হিসাবের প্রকৃত চিত্র।
স্বাধীনতার পর থেকে রাজস্ব আয় বেড়েছে ১৬৬ কোটি থেকে ৫ লাখ কোটি টাকা। বাজেটের আকার বেড়েছে ৭৮৬ কোটি থেকে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা। জিডিপির আকার বেড়েছে ৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৪২৬ বিলিয়ন ডলার। কৃষি ও শিল্প উৎপাদন পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। এত সব উন্নতি, অগ্রগতি আর সাফল্যের পাশাপাশি সমানভাবে প্রতিযোগিতা করে বেড়েছে বিশাল আয়বৈষম্য।
দেশের অর্থনৈতিক গণ্ডি পেরিয়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও বৈষম্য লক্ষণীয়। রাজনীতিতে আমজনতার কণ্ঠস্বর ও প্রতিনিধিত্ব নিতান্ত প্রান্তিক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের সভাপতির অনুমতি নেওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মোট আসনের ২০ ভাগের বেশিতে বিজয়ী হয়ে প্রমাণ করেছে রাজনীতিতে আমজনতার সংশ্লিষ্টতা। আমজনতার চাওয়া-পাওয়াকে উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকেরা কীভাবে মূল্যায়ন করেন, তার একটা জ্বলন্ত প্রমাণও এই নির্বাচন। যদিও আমজনতার জন্য ‘যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’, তাই বিজয়ী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যে জনগণের কথা মনে রাখবেন, সেই বিশ্বাস রাখা কঠিন।
দেশের উন্নতির জন্য ইতিমধ্যে ঘোষিত মেগা প্রকল্পের তালিকায় রয়েছে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার বুলেট ট্রেন, দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পূর্বাচলে ১১০ তলা বঙ্গবন্ধু বহুতল ভবন কমপ্লেক্স, শরীয়তপুরে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, নোয়াখালীতে বিমানবন্দর, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া দ্বিতীয় পদ্মা সেতু ইত্যাদি। জনকল্যাণে এসব মেগা প্রকল্পের গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনার কথা পুনঃক্ষমতাসীনদের মনে আসে বলে মনে হয় না। জনপ্রতিনিধিরা দেশকে একজন প্যারিসের মতো দেখেন তো অন্যজন ভেনাসরূপে দেখেন। দেশ ও দেশের মানুষ উপযোগী উন্নতি-অগ্রগতি পরিকল্পনায় এঁদের কারোরই আগ্রহ নেই।
এসব জনপ্রতিনিধি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজারে আগুন লাগলেও সিন্ডিকেট ভাঙার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেন না, মানবসম্পদ পরিকল্পনা করেন না, প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে ও ব্যয়ে শেষ করেন না। ব্যাংক জালিয়াতি, শেয়ারবাজারে ধস, মানি লন্ডারিংয়ের সহযোগী হতে দেখা যায় এঁদের। ওভার ও আন্ডার ইনভয়েসিং করে বিদেশে অর্থ পাচারও বন্ধ হয় না। রাজনৈতিক ক্ষেত্রের মতোই সামাজিক ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ সমাজের প্রান্তসীমায় অবস্থান করছে। রাজধানীর বিত্তবান এলাকার জীবনযাত্রার সঙ্গে দরিদ্র এলাকার জীবনযাত্রার চিত্রে কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায় না বহুদিন। দিনে দিনে এই অসম চিত্র বেড়েই চলেছে, যেখানে সামাজিক সুরক্ষাবলয় ন্যূনতম মিল আনতে পারছে না।
রাজনীতিবিদদের চিন্তার দৈন্য ও ক্ষমতালিপ্সার ফলস্বরূপ সমাজে মানুষের মধ্যে ধারাবাহিক আত্মকেন্দ্রিকতা সৃষ্টি হয়েছে; ঘুষ-দুর্নীতি-সন্ত্রাস-সহিংসতার বিস্তার ঘটেছে; সহনশীলতা-পরমতসহিষ্ণুতা-পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ কমেছে; আমলাতন্ত্রের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্নতার সঙ্গে স্বার্থোদ্ধার বেড়েছে; ব্যবসায়ীরা লুটেরা মানসিকতা নিয়ে মাঠে নেমে পড়েছেন; রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে লেজুড়বৃত্তিতে পেশাজীবীদের আত্মা সমর্পিত; জ্ঞানীগুণীরা আত্মসম্মানে নিজেদের লুকিয়ে রাখার মানসিকতায় ঘরবদ্ধ। জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদী চেতনা লুপ্ত হয়েছে ক্রমান্বয়ে। ফলে রাজনৈতিক স্বাধীনতালাভের পরও সার্বিক মুক্তি আসেনি।
জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকারপ্রাপ্তসহ ক্ষমতার বলয়ে থাকা মানুষ মনে করেন—দেশটা যখন স্বাধীন, তখন বিত্তবানদের সুখে আর আমজনতার দুঃখেও দেশ স্বাধীনই থাকবে। তাই বিত্তবান মানুষ আরও বিত্তের মালিক হয়ে সমাজে কোটিপতি হিসেবে সংখ্যা বৃদ্ধি করে বিশ্বের রোল মডেলের খেরোখাতায় নাম লেখান। এতে দেশের কোনো ক্ষতি হয় না, বরং শত শত কোটিপতি দেশ বা সমাজের শোভা বৃদ্ধি করেন নিয়ত। আর নাগরিক কবিয়ালেরা আমজনতাকে স্বপ্নাতুর করতে গেয়ে চলেন—‘সুখে আছ যারা সুখে থাকো, এ সুখ সইবে না, দুঃখে আছ যারা বেঁচে থাকো, এ দুঃখ রইবে না।’
সদ্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে দেশে নতুন মোড়কে পুরোনো সরকার পথচলা শুরু করেছে। নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে ক্ষমতাসীনেরা ইশতেহার বাস্তবায়নে কতটা আন্তরিকতা দেখাবেন, সেটাই জনগণের কাছে লক্ষণীয় বিষয়। স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে উন্নতি, অগ্রগতি আর সাফল্য অতীতের স্বসংজ্ঞায়নের ধারাবাহিকতায় চলমান থাকবে, নাকি প্রকৃত সংজ্ঞায়নের পথ বেয়ে জনকল্যাণের পথে অগ্রসর হবে, সেটাই দেখার বিষয়।
লেখক: এম আর খায়রুল উমাম, সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
১ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে