বিভুরঞ্জন সরকার
আমাদের দেশে গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্ক আছে। আবার সংবাদকর্মীদের ‘কণ্ঠরোধ’ নিয়ে যতটা উতলা ভাব পশ্চিমা কিংবা আমাদের দেশের কারও কারও মধ্যে দেখা যায়, তার সিকি ভাগও সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতা, চাকরির নিশ্চয়তা ইত্যাদি ব্যাপারে দেখা যায় না। যেন সাংবাদিকদের কাজ হলো ‘ওয়াচডগ’ হিসেবে সবার ‘অধিকার ও স্বাধীনতা’ পাহারা দেওয়া, নিজেদের খাওয়া-পরার বিষয়টি তাদের জন্য জরুরি নয়।
পশ্চিমা দেশগুলোয় গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সব অবস্থায়, সব ক্ষেত্রে অবাধ কি না, আমি জানি না। ওই সব দেশে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়নি। আমার কাছে সেটা অনেকটা ‘না-দেখা ফুলের গোপন গন্ধ’র মতো। তবে স্পনসরড সাংবাদিকতা যে ওই সব দেশেও আছে, তা কি মাঝে মাঝে শোনা যায় না? ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় ‘এমবেডেড সাংবাদিকতা’র কথা কি আমরা শুনিনি? তখন সামরিক বাহিনীর ছাড় করা সংবাদই মার্কিন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। যারা দুনিয়াজুড়ে রাজনৈতিক আধিপত্য জারি রাখতে চায়, তারা সব সময় ‘বাস্তবভিত্তিক তথ্য প্রচার’ করতে সবাইকে সমানভাবে উৎসাহিত করে বলে অন্তত আমার মনে হয় না। যে খবর তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, সেই খবর ‘কিল’ করার ভূরি ভূরি নজির আছে। আবার ভুয়া খবর পরিবেশন করে পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়ার নিন্দনীয় উদাহরণও আমাদের সামনে আছে।
আমরা যে অনেক সময় নানা বিষয়ে পশ্চিমের দৃষ্টান্ত দিই, এটাও আমার কাছে খুব ভালো লাগে না। পশ্চিমের সমাজ, রাজনীতি, গণতান্ত্রিক চর্চা—কোনোটাই আমাদের মতো নয়। তবে হ্যাঁ, ভালো জিনিস গ্রহণের মতো উদারতা অবশ্যই থাকা উচিত।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রই এখনো ভঙ্গুরতা কাটিয়ে শক্ত ভিত গাঁথতে পারেনি। আমাদের দেশে যাঁরা উদার গণতন্ত্রের কথা বলেন, তাঁরাও সর্বতোভাবে সামন্ত মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। ব্যক্তিজীবনে, পারিবারিকভাবে এবং নিজস্ব রাজনৈতিক দলের মধ্যে যাঁরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বরদাশত করেন না, তাঁরাই আবার গণমাধ্যমের ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে হা-হুতাশ করেন।
অনেকে হয়তো অখুশি হবেন, তারপরও আমি এটা মনে করি যে বাংলাদেশে মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতার পরিবেশ এখন নেই। খুব শিগগির সেটা হবে বলেও আমি মনে করি না। গণমাধ্যমের মালিকানা এবং পরিচালনা যাঁদের হাতে, তাঁরা কেউ নিজেদের স্বার্থের পরিমণ্ডলের বাইরে হাঁটতে চান না, চাইবেন না।
আমি অবশ্য আজকের আলোচনাটি সীমাবদ্ধ রাখতে চাই সাংবাদিকদের বেতন ও চাকরির নিশ্চয়তার ওপর। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের সমস্যা নিয়ে বলার মতো কথা অনেক আছে। তবে সংক্ষেপে এটাই বলা যায় যে দেশে কর্মরত সাংবাদিকদের অধিকাংশ এখন নানা ধরনের সংকটে জর্জরিত। তাঁদের বেশির ভাগের চাকরির নিশ্চয়তা নেই। চাকরি চলে গেলে তাঁদের শূন্য হাতে বিদায় নিতে হয়। অনেক প্রতিষ্ঠানেই নিয়মিত বেতন দেওয়া হয় না। সৎ সাংবাদিকতার পথে সরকার যত না অন্তরায় সৃষ্টি করে, তার চেয়ে বেশি বাধা তৈরি করেন কোনো কোনো মালিক। এটা নিয়ে কেউ বিতর্ক করতে পারেন; কিন্তু তাতে বাস্তব অবস্থার তেমন পরিবর্তন হবে না। সাংবাদিকদের যতক্ষণ পর্যন্ত বেঁচে থাকার মতো সম্মানজনক বেতন-ভাতা নিশ্চিত করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত গণমাধ্যম মানসম্পন্ন হবে না। সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতার দেখাও পাওয়া যাবে না।
শত ফুল ফুটতে দেওয়ার নীতি অনুসরণ করে দেশে অসংখ্য সংবাদমাধ্যমের জন্ম হয়েছে। তবে এগুলোর কয়েকটি ছাড়া বাকিগুলো এখন নানা ব্যাধিতে ধুঁকছে। খামখেয়ালিপনার কারণে গণমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে, সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু প্রত্যাশিত মান অর্জনের সক্ষমতা রয়েছে অধরা। ঢাকঢোল পিটিয়ে গণমাধ্যমের যাত্রা শুরু হয়, কিন্তু অল্প পথ চলার পরই শুরু হয় আর্থিক সংকট। আয় ও ব্যয়ের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকলে মালিকের উৎসাহে ভাটা পড়ে। এই সংকট কাটানোর উপায় নিয়ে কারও কোনো গভীর চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। আর্থিক সংকট দূর না হলে কীভাবে এগুলো চলবে?
আর্থিক সংকট দূর করার উপায় আয় বাড়ানো। আয় বাড়ানোর সুযোগ সীমিত। সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করে এত এত ‘মিডিয়া’ চলবে না। আবার বেসরকারি বিজ্ঞাপন পেতে হলে যে সার্কুলেশন বা প্রচারসংখ্যা থাকা দরকার, তা-ও অনেক পত্রিকার নেই। বেশির ভাগ পত্রিকাই আসলে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’—কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। গ্রামবাংলায় একটি কথা চালু আছে—‘তোলা দুধে পোলা বাঁচে না’।
গণমাধ্যমের সংকট কাটাতে হলে আবেগময় এবং তাত্ত্বিক কথাবার্তা না বলে বাস্তবতার আলোকেই সমাধান খুঁজতে হবে। প্রয়োজনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যে রোগীর জন্য শল্যচিকিৎসা দরকার, তাকে হোমিওপ্যাথি ডোজ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা যাবে কি?
মতলবি বা অসৎ সাংবাদিকতা নতুন কিছু নয়। সাংবাদিক কিংবা সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের চেষ্টাও নতুন কিছু নয়। ১৮৮৪ সালেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের একটি রহস্যজনক মৃত্যুর খবর ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সংবাদপত্রে ‘ঘুষ’ দেওয়ার অভিযোগ আছে। তবে অতীতে এসব ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে থাকলেও এখন তা প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। লুটেরা পুঁজির মালিক কিংবা পুঁজি গঠনের জন্য লুণ্ঠন প্রবৃত্তি যাদের মধ্যে প্রবল, তাদের হাতে গণমাধ্যমের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ থাকলে ‘সত্য প্রকাশের দুরন্ত সাহস’ দেখানো গণমাধ্যমের পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
গণমাধ্যমের রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে এখন অনেক কথা হয়। সবাই গণমাধ্যমের কাছে নিরপেক্ষতা প্রত্যাশা করেন। এই ‘নিরপেক্ষতা’ বিষয়টিও আমাদের দেশে একটি বিশেষ অর্থ বহন করে। এখন অনেকের কাছে নিরপেক্ষতা মানে সরকারের বিরুদ্ধে থাকা। আবার এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁদের কাছে আওয়ামী লীগ বিরোধিতাই হলো নিরপেক্ষতা। সরকার বা আওয়ামী লীগের পক্ষে হলে ‘দালাল’ কিন্তু বিএনপি বা আওয়ামী লীগবিরোধী অন্য কোনো দলের সমর্থক হলে তাঁকে সচরাচর দালাল বলা হয় না, তাঁর অবস্থান নিরপেক্ষ। দেশের মানুষের মনোজগৎ মূলত স্ববিরোধী চিন্তা-চেতনায় ঠাসা। মানুষের মধ্যে ধারণাগত স্বচ্ছতা তৈরিতে বা বিশেষ রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটাতে গণমাধ্যম ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। অতীতে সেটা করেওছে। ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী সময় থেকে স্বাধীনতার সময়কাল পর্যন্ত দৈনিক ইত্তেফাক এবং দৈনিক সংবাদ প্রধানত এই দায়িত্ব পালন করেছে। দেশে বিশেষ রাজনৈতিক ধারা তৈরিতে এই পত্রিকা দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘কারাগারের রোজনামচা’য় লিখেছেন: ‘পূর্ব বাংলার জনসাধারণের জন্য ইত্তেফাক যা করেছে তা কোনো খবরের কাগজই দাবি করতে পারে না। এ দেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) থেকে বিরুদ্ধ রাজনীতি মুছে যেত যদি মানিক মিয়া এবং ইত্তেফাক না থাকত। এ কথা স্বীকার না করলে সত্যের অপলাপ করা হবে।’ বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন: ‘ছয় দফার আন্দোলন যে আজ এত তাড়াতাড়ি গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, এখানেও মানিক ভাইয়ের লেখনী না হলে তা সম্ভব হতো কি না তাহা সন্দেহ।’
আমাদের দেশে গণমাধ্যম এখন আর জনমত গঠনে ভূমিকা পালন করাকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে না। প্রতিটি গণমাধ্যমের মালিক-সম্পাদকদের হয়তো একটি রাজনৈতিক পরিচয় আছে, তবে সেটা গণমাধ্যম পরিচালনায় বড় ভূমিকা পালন করে না। ব্যবসায়িক স্বার্থই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। জনমত গঠন নয়, জনমতকে বিভ্রান্ত করাই বেশির ভাগ গণমাধ্যমের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার এই বক্তব্য নিয়েও হয়তো কেউ কেউ বিতর্ক করবেন, কিন্তু নির্দিষ্ট করে একটি গণমাধ্যমের নামও বলতে পারবেন না, যে গণমাধ্যম বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণের জন্য লাগাতার কাজ করছে। সংবাদ পরিবেশন এমনকি উপসম্পাদকীয় কলামে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রেও
অনুদারতার চরম প্রকাশই দেখা যায়। কোনো না কোনো কোটারি স্বার্থের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা বা প্রবণতা কোনোটাই লক্ষ করা যায় না।
এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার। গণমাধ্যমকে জনস্বার্থের অনুকূল করতে হলে বর্তমান মালিকানা কাঠামোয় সেটা সম্ভব হবে না। তাহলে পথ কী? উপায় কী? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, প্রকৃত গণউদ্যোগে যদি পেশাদারি মনোভাব নিয়ে গণমাধ্যমের জন্ম দেওয়া যায়, তাহলে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতার ধারা তৈরি হতে পারে। এখানেও প্রশ্ন আসবে, এমন উদ্যোগ কার্যকর করা কি আদৌ সম্ভব? আমার জবাব: কেন নয়? মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব। পথের বাধা যেমন মানুষ তৈরি করে, তেমনি বাধা অপসারণের কাজও মানুষই করে। মন্দের সংখ্যা বেড়েছে, তাই বলে ‘ভালো’ বিলীন হয়ে যায়নি। এক বা একাধিক মানুষের সৎ ও আন্তরিক উদ্যোগ গণমাধ্যমে নতুন প্রাণপ্রবাহ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
আমাদের দেশে গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্ক আছে। আবার সংবাদকর্মীদের ‘কণ্ঠরোধ’ নিয়ে যতটা উতলা ভাব পশ্চিমা কিংবা আমাদের দেশের কারও কারও মধ্যে দেখা যায়, তার সিকি ভাগও সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতা, চাকরির নিশ্চয়তা ইত্যাদি ব্যাপারে দেখা যায় না। যেন সাংবাদিকদের কাজ হলো ‘ওয়াচডগ’ হিসেবে সবার ‘অধিকার ও স্বাধীনতা’ পাহারা দেওয়া, নিজেদের খাওয়া-পরার বিষয়টি তাদের জন্য জরুরি নয়।
পশ্চিমা দেশগুলোয় গণমাধ্যম ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সব অবস্থায়, সব ক্ষেত্রে অবাধ কি না, আমি জানি না। ওই সব দেশে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়নি। আমার কাছে সেটা অনেকটা ‘না-দেখা ফুলের গোপন গন্ধ’র মতো। তবে স্পনসরড সাংবাদিকতা যে ওই সব দেশেও আছে, তা কি মাঝে মাঝে শোনা যায় না? ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের সময় ‘এমবেডেড সাংবাদিকতা’র কথা কি আমরা শুনিনি? তখন সামরিক বাহিনীর ছাড় করা সংবাদই মার্কিন গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে। যারা দুনিয়াজুড়ে রাজনৈতিক আধিপত্য জারি রাখতে চায়, তারা সব সময় ‘বাস্তবভিত্তিক তথ্য প্রচার’ করতে সবাইকে সমানভাবে উৎসাহিত করে বলে অন্তত আমার মনে হয় না। যে খবর তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায়, সেই খবর ‘কিল’ করার ভূরি ভূরি নজির আছে। আবার ভুয়া খবর পরিবেশন করে পুলিৎজার পুরস্কার পাওয়ার নিন্দনীয় উদাহরণও আমাদের সামনে আছে।
আমরা যে অনেক সময় নানা বিষয়ে পশ্চিমের দৃষ্টান্ত দিই, এটাও আমার কাছে খুব ভালো লাগে না। পশ্চিমের সমাজ, রাজনীতি, গণতান্ত্রিক চর্চা—কোনোটাই আমাদের মতো নয়। তবে হ্যাঁ, ভালো জিনিস গ্রহণের মতো উদারতা অবশ্যই থাকা উচিত।
বাংলাদেশে গণতন্ত্রই এখনো ভঙ্গুরতা কাটিয়ে শক্ত ভিত গাঁথতে পারেনি। আমাদের দেশে যাঁরা উদার গণতন্ত্রের কথা বলেন, তাঁরাও সর্বতোভাবে সামন্ত মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। ব্যক্তিজীবনে, পারিবারিকভাবে এবং নিজস্ব রাজনৈতিক দলের মধ্যে যাঁরা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বরদাশত করেন না, তাঁরাই আবার গণমাধ্যমের ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে হা-হুতাশ করেন।
অনেকে হয়তো অখুশি হবেন, তারপরও আমি এটা মনে করি যে বাংলাদেশে মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতার পরিবেশ এখন নেই। খুব শিগগির সেটা হবে বলেও আমি মনে করি না। গণমাধ্যমের মালিকানা এবং পরিচালনা যাঁদের হাতে, তাঁরা কেউ নিজেদের স্বার্থের পরিমণ্ডলের বাইরে হাঁটতে চান না, চাইবেন না।
আমি অবশ্য আজকের আলোচনাটি সীমাবদ্ধ রাখতে চাই সাংবাদিকদের বেতন ও চাকরির নিশ্চয়তার ওপর। গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের সমস্যা নিয়ে বলার মতো কথা অনেক আছে। তবে সংক্ষেপে এটাই বলা যায় যে দেশে কর্মরত সাংবাদিকদের অধিকাংশ এখন নানা ধরনের সংকটে জর্জরিত। তাঁদের বেশির ভাগের চাকরির নিশ্চয়তা নেই। চাকরি চলে গেলে তাঁদের শূন্য হাতে বিদায় নিতে হয়। অনেক প্রতিষ্ঠানেই নিয়মিত বেতন দেওয়া হয় না। সৎ সাংবাদিকতার পথে সরকার যত না অন্তরায় সৃষ্টি করে, তার চেয়ে বেশি বাধা তৈরি করেন কোনো কোনো মালিক। এটা নিয়ে কেউ বিতর্ক করতে পারেন; কিন্তু তাতে বাস্তব অবস্থার তেমন পরিবর্তন হবে না। সাংবাদিকদের যতক্ষণ পর্যন্ত বেঁচে থাকার মতো সম্মানজনক বেতন-ভাতা নিশ্চিত করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত গণমাধ্যম মানসম্পন্ন হবে না। সৎ ও সাহসী সাংবাদিকতার দেখাও পাওয়া যাবে না।
শত ফুল ফুটতে দেওয়ার নীতি অনুসরণ করে দেশে অসংখ্য সংবাদমাধ্যমের জন্ম হয়েছে। তবে এগুলোর কয়েকটি ছাড়া বাকিগুলো এখন নানা ব্যাধিতে ধুঁকছে। খামখেয়ালিপনার কারণে গণমাধ্যমের সংখ্যা বেড়েছে, সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু প্রত্যাশিত মান অর্জনের সক্ষমতা রয়েছে অধরা। ঢাকঢোল পিটিয়ে গণমাধ্যমের যাত্রা শুরু হয়, কিন্তু অল্প পথ চলার পরই শুরু হয় আর্থিক সংকট। আয় ও ব্যয়ের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকলে মালিকের উৎসাহে ভাটা পড়ে। এই সংকট কাটানোর উপায় নিয়ে কারও কোনো গভীর চিন্তা আছে বলে মনে হয় না। আর্থিক সংকট দূর না হলে কীভাবে এগুলো চলবে?
আর্থিক সংকট দূর করার উপায় আয় বাড়ানো। আয় বাড়ানোর সুযোগ সীমিত। সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর করে এত এত ‘মিডিয়া’ চলবে না। আবার বেসরকারি বিজ্ঞাপন পেতে হলে যে সার্কুলেশন বা প্রচারসংখ্যা থাকা দরকার, তা-ও অনেক পত্রিকার নেই। বেশির ভাগ পত্রিকাই আসলে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’—কেতাবে আছে, গোয়ালে নেই। গ্রামবাংলায় একটি কথা চালু আছে—‘তোলা দুধে পোলা বাঁচে না’।
গণমাধ্যমের সংকট কাটাতে হলে আবেগময় এবং তাত্ত্বিক কথাবার্তা না বলে বাস্তবতার আলোকেই সমাধান খুঁজতে হবে। প্রয়োজনে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যে রোগীর জন্য শল্যচিকিৎসা দরকার, তাকে হোমিওপ্যাথি ডোজ দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা যাবে কি?
মতলবি বা অসৎ সাংবাদিকতা নতুন কিছু নয়। সাংবাদিক কিংবা সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধের চেষ্টাও নতুন কিছু নয়। ১৮৮৪ সালেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের একটি রহস্যজনক মৃত্যুর খবর ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সংবাদপত্রে ‘ঘুষ’ দেওয়ার অভিযোগ আছে। তবে অতীতে এসব ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসেবে থাকলেও এখন তা প্রায় নিয়মে পরিণত হয়েছে। লুটেরা পুঁজির মালিক কিংবা পুঁজি গঠনের জন্য লুণ্ঠন প্রবৃত্তি যাদের মধ্যে প্রবল, তাদের হাতে গণমাধ্যমের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ থাকলে ‘সত্য প্রকাশের দুরন্ত সাহস’ দেখানো গণমাধ্যমের পক্ষে সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
গণমাধ্যমের রাজনৈতিক চরিত্র নিয়ে এখন অনেক কথা হয়। সবাই গণমাধ্যমের কাছে নিরপেক্ষতা প্রত্যাশা করেন। এই ‘নিরপেক্ষতা’ বিষয়টিও আমাদের দেশে একটি বিশেষ অর্থ বহন করে। এখন অনেকের কাছে নিরপেক্ষতা মানে সরকারের বিরুদ্ধে থাকা। আবার এমন অনেক মানুষ আছেন, যাঁদের কাছে আওয়ামী লীগ বিরোধিতাই হলো নিরপেক্ষতা। সরকার বা আওয়ামী লীগের পক্ষে হলে ‘দালাল’ কিন্তু বিএনপি বা আওয়ামী লীগবিরোধী অন্য কোনো দলের সমর্থক হলে তাঁকে সচরাচর দালাল বলা হয় না, তাঁর অবস্থান নিরপেক্ষ। দেশের মানুষের মনোজগৎ মূলত স্ববিরোধী চিন্তা-চেতনায় ঠাসা। মানুষের মধ্যে ধারণাগত স্বচ্ছতা তৈরিতে বা বিশেষ রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ ঘটাতে গণমাধ্যম ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। অতীতে সেটা করেওছে। ভাষা আন্দোলন-পরবর্তী সময় থেকে স্বাধীনতার সময়কাল পর্যন্ত দৈনিক ইত্তেফাক এবং দৈনিক সংবাদ প্রধানত এই দায়িত্ব পালন করেছে। দেশে বিশেষ রাজনৈতিক ধারা তৈরিতে এই পত্রিকা দুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ‘কারাগারের রোজনামচা’য় লিখেছেন: ‘পূর্ব বাংলার জনসাধারণের জন্য ইত্তেফাক যা করেছে তা কোনো খবরের কাগজই দাবি করতে পারে না। এ দেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) থেকে বিরুদ্ধ রাজনীতি মুছে যেত যদি মানিক মিয়া এবং ইত্তেফাক না থাকত। এ কথা স্বীকার না করলে সত্যের অপলাপ করা হবে।’ বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন: ‘ছয় দফার আন্দোলন যে আজ এত তাড়াতাড়ি গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়েছে, এখানেও মানিক ভাইয়ের লেখনী না হলে তা সম্ভব হতো কি না তাহা সন্দেহ।’
আমাদের দেশে গণমাধ্যম এখন আর জনমত গঠনে ভূমিকা পালন করাকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে না। প্রতিটি গণমাধ্যমের মালিক-সম্পাদকদের হয়তো একটি রাজনৈতিক পরিচয় আছে, তবে সেটা গণমাধ্যম পরিচালনায় বড় ভূমিকা পালন করে না। ব্যবসায়িক স্বার্থই নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। জনমত গঠন নয়, জনমতকে বিভ্রান্ত করাই বেশির ভাগ গণমাধ্যমের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার এই বক্তব্য নিয়েও হয়তো কেউ কেউ বিতর্ক করবেন, কিন্তু নির্দিষ্ট করে একটি গণমাধ্যমের নামও বলতে পারবেন না, যে গণমাধ্যম বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণের জন্য লাগাতার কাজ করছে। সংবাদ পরিবেশন এমনকি উপসম্পাদকীয় কলামে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রেও
অনুদারতার চরম প্রকাশই দেখা যায়। কোনো না কোনো কোটারি স্বার্থের বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা বা প্রবণতা কোনোটাই লক্ষ করা যায় না।
এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার। গণমাধ্যমকে জনস্বার্থের অনুকূল করতে হলে বর্তমান মালিকানা কাঠামোয় সেটা সম্ভব হবে না। তাহলে পথ কী? উপায় কী? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, প্রকৃত গণউদ্যোগে যদি পেশাদারি মনোভাব নিয়ে গণমাধ্যমের জন্ম দেওয়া যায়, তাহলে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতার ধারা তৈরি হতে পারে। এখানেও প্রশ্ন আসবে, এমন উদ্যোগ কার্যকর করা কি আদৌ সম্ভব? আমার জবাব: কেন নয়? মানুষের পক্ষে সবই সম্ভব। পথের বাধা যেমন মানুষ তৈরি করে, তেমনি বাধা অপসারণের কাজও মানুষই করে। মন্দের সংখ্যা বেড়েছে, তাই বলে ‘ভালো’ বিলীন হয়ে যায়নি। এক বা একাধিক মানুষের সৎ ও আন্তরিক উদ্যোগ গণমাধ্যমে নতুন প্রাণপ্রবাহ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
বিভুরঞ্জন সরকার, জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৩ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৭ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৭ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১১ দিন আগে