আজাদুর রহমান চন্দন
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ বিচারের অঙ্গীকারসহ দিনবদলের সনদ ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করে। ফলে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়।
প্রায় ১০ বছর পর গত ১০ জুন পুলিশের অনুমতি নিয়ে ঢাকায় সমাবেশ করেছে জামায়াতে ইসলামী। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, দলের আমিরসহ রাজনৈতিক নেতা ও আলেমদের মুক্তি এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে জামায়াতের ঢাকা মহানগর শাখা এই সমাবেশ করে। এরপর আরও কয়েকবার বিভিন্ন স্থানে দলটি সমাবেশ করতে চাইলেও অনুমতি দেওয়া হয়নি। যদিও দলটি বিভিন্ন সময়ে ঝটিকা মিছিল করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত ২৫ অক্টোবর সাংবাদিকদের জানান, জামায়াতে ইসলামীর ব্যানারে ঢাকায় কোনো সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হবে না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক দল, অনেক পথ, অনেক কিছু রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী এর আগেও দু-এক জায়গায় আলোচনা করেছে। দেশের নিয়মকানুন মেনে, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্দেশনা মেনে যে কেউ যে কোনো কথা বলতে পারে। জামায়াত বলে কোনো কথা নেই, যে কেউ, যে কোনো কথা বলতে পারে, এটা গণতান্ত্রিক দেশ, গণতান্ত্রিক চর্চা এখানে আছে। কথা হলো, আমাদের যে আইনকানুন আছে, এর মধ্য থেকে তাদের কথা বলতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা পারমিশন দিইনি, আমরা তাদের কোনো পারমিশন দিই না। জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধিত দল নয় এখন পর্যন্ত। কাজেই তারা জামায়াতে ইসলামীর ব্যানারে যদি আসে, তাহলে তাদের পারমিশন দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’
উচ্চ আদালতের নির্দেশে জামায়াত নিবন্ধন হারিয়েছে, তবে নিষিদ্ধ হয়নি। নিবন্ধনহীন অনেক দলই দেশে নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে। তাদের ব্যাপারে সরকারকে এমন তৎপর হতে দেখা যায় না। জামায়াতের যে অপরাধ আছে, তার জন্য আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু সেটা না করে একটি নিষিদ্ধ দলের মতো আচরণ করলে উল্টো দলটি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি কুড়ানোর সুযোগ পাবে।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি একাত্তরের নরঘাতকদের বিচার দেখার প্রতীক্ষায় কাটিয়েছে চার দশকের বেশি সময়। নানা অনিশ্চয়তা, হতাশা আর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর কলঙ্ক মোচনের সেই বিচার-প্রক্রিয়ার শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করার মধ্য দিয়ে। যদিও ট্রাইব্যুনালের কার্যপ্রণালি বিধি প্রণয়ন করতেই কেটে যায় চার মাস। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়ায় প্রথম ফাঁসি কার্যকর হয়েছে বাংলাদেশের ৪৩তম বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে।
সেদিন রাত ১০টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় কসাই কাদের নামে পরিচিত আলবদর কমান্ডার আবদুল কাদের মোল্লাকে। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর এই নেতার ফাঁসি কার্যকর করার মধ্য দিয়ে জাতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৩ বছরে ৫৩টি মামলার রায় হয়েছে। তাতে সাজা হয়েছে ১৩৯ জন আসামির। রায়ে ৯৯ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং ২৫ জনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় ৪৩তম বিজয় দিবসে দেশবাসী যতটা না উল্লসিত ও উজ্জীবিত ছিল, পরেরবারই ততটা দেখা যায়নি। জনমনে সবচেয়ে বেশি সংশয় এখন অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার নিয়ে। আইনের অস্পষ্টতা দূর করার নামে এ ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে বলে কোনো কোনো মহলের অভিযোগ।
মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধসহ বিভিন্ন অভিযোগে সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচারের লক্ষ্যে ২০১৩ সালেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) দাখিল করার সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনা মিলিয়ে যায় দ্রুতই। প্রসিকিউশন বা রাষ্ট্রপক্ষের যে আইনজীবী দলটি জামায়াতের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ তৈরির কাজ করছিল, তারা সেই কাজ বন্ধ করে দেয় প্রসিকিউশনেরই একাংশের হস্তক্ষেপে।
এ নিয়ে শুরু হয় দুই পক্ষের বাদানুবাদ। অন্যদিকে আইনমন্ত্রী জানিয়ে দেন, অপরাধী সংগঠনের শাস্তি কী হবে, তা আইনে স্পষ্ট না করে জামায়াতের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হবে না? ঘনিষ্ঠ অনেকের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আমি তখন জামায়াতের বিচার শুরু করার আগেই আইনে অপরাধী সংগঠনের শাস্তি সুনির্দিষ্ট করার পক্ষে লিখেছি পত্রিকায়। তাই বলে আইনের সামান্য সংশোধনী আনার নামে এত সময়ক্ষেপণ সমর্থনযোগ্য নয়। সংগত কারণেই এ বিষয়টির মধ্যেও রাজনীতির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ বিচারের অঙ্গীকারসহ দিনবদলের সনদ ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করে। ফলে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী, মহাজোট সরকার ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে পরিচিত মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়ায় চার দশক পর জাতি নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর প্রথম ৯ মাসে একটি অভিযোগও গঠিত না হওয়ায় জনমনে সংশয় দানা বাঁধে। শুরুতেই সবচেয়ে বেশি সংশয় দেখা দেয়, তদন্ত সংস্থার ‘প্রধান’ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নিয়ে। পরে তাঁকে সরাতেও লেগে যায় অনেকখানি সময়।
এই বিচার নিয়ে জনমনে শুরু থেকে যে সংশয় ছিল, তা পরে আরও ঘনীভূত হয় যখন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ শীর্ষস্থানীয় চার অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের দাখিল করা ফরমাল চার্জ ‘সুবিন্যস্ত’ না হওয়ায় ফেরত দেয় ট্রাইব্যুনাল। অথচ গোলাম আযমের ফরমাল চার্জ কীভাবে সুবিন্যস্ত করে লিখতে হবে তা মৌখিকভাবে ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি লিখিত রূপরেখাও দেওয়া হয়েছিল একাধিক প্রসিকিউটরকে। কিন্তু তাঁরা তা আমলে নেননি।
পরে ট্রাইব্যুনালের রায়ে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় মানুষের সংশয় বিক্ষোভে রূপ নেয়। কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। রায় শোনার জন্য সেদিন ট্রাইব্যুনালের সামনে ভিড় জমিয়েছিলেন নানা স্তরের মানুষ। কিন্তু রায় ঘোষণার পর ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাৎক্ষণিকভাবেই হতাশা ব্যক্ত করেন। মর্মস্পর্শী সব হতাশাধ্বনির পাশাপাশি সারা দেশে সর্বস্তরের মানুষের কণ্ঠেও উচ্চারিত হয়, ‘এ রায় মানি না।’ ক্ষোভে-দুঃখে মানুষ নেমে আসে রাজপথে। একপর্যায়ে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কাদের মোল্লার সাজা বাড়িয়ে ফাঁসির আদেশ দেয় ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংক্ষিপ্ত রায়ে।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ শুরু থেকেই সোচ্চার ছিল যাতে এই বিচার-প্রক্রিয়ায় সরকারের দিক থেকে কোনো গাফিলতি না করা হয়। কোনো রকম ত্রুটি-দুর্বলতা বা রাজনৈতিক লাভ-লোকসানজনিত হিসাবের মারপ্যাঁচে যাতে বিচার-প্রক্রিয়াটি হোঁচট না খায় বা ব্যর্থ না হয়, সে জন্য সারাক্ষণ সতর্ক নজর রেখেছে তারা। অনেকে আগ বাড়িয়ে তথ্য-উপাত্ত, দলিলপত্র দিয়ে সহায়তা করেছে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনকে।
সবারই জানা, একাত্তরের ঘাতকদের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর না করার জন্যও যুক্তরাষ্ট্র চাপ দিয়েছিল, যদিও পরে দেশটি তার অবস্থান কিছুটা বদল করেছে। একপর্যায়ে দেখা যায়, ব্যক্তিবিশেষের বদলে জামায়াতকে বাঁচাতে তৎপর তারা। যুদ্ধাপরাধবিষয়ক মার্কিন দূত স্টিফেন জে র্যাপ ২০১৪ সালের আগস্টে তাঁর সর্বশেষ ঢাকা সফরকালে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ‘সামাজিক পুনর্মিলনের স্বার্থে’ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কোনো সংগঠনের বিচার হওয়া উচিত নয়। বাইরের বড় শক্তির এ ধরনের অবস্থানের কারণেই সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারের লক্ষ্যে আইন সংশোধনে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে, নাকি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কোনো সমীকরণ এতে কাজ করছে, সে নিয়েও আছে নানা সংশয়। এ ছাড়া একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তাকারী অন্য দলগুলো সম্পর্কে নীরবতাও ভালো লক্ষণ নয়। সব কয়টি দলকেই বিচারের আওতায় আনা উচিত।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ বিচারের অঙ্গীকারসহ দিনবদলের সনদ ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করে। ফলে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়।
প্রায় ১০ বছর পর গত ১০ জুন পুলিশের অনুমতি নিয়ে ঢাকায় সমাবেশ করেছে জামায়াতে ইসলামী। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, দলের আমিরসহ রাজনৈতিক নেতা ও আলেমদের মুক্তি এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দাবিতে জামায়াতের ঢাকা মহানগর শাখা এই সমাবেশ করে। এরপর আরও কয়েকবার বিভিন্ন স্থানে দলটি সমাবেশ করতে চাইলেও অনুমতি দেওয়া হয়নি। যদিও দলটি বিভিন্ন সময়ে ঝটিকা মিছিল করছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত ২৫ অক্টোবর সাংবাদিকদের জানান, জামায়াতে ইসলামীর ব্যানারে ঢাকায় কোনো সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হবে না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে অনেক দল, অনেক পথ, অনেক কিছু রয়েছে। জামায়াতে ইসলামী এর আগেও দু-এক জায়গায় আলোচনা করেছে। দেশের নিয়মকানুন মেনে, দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্দেশনা মেনে যে কেউ যে কোনো কথা বলতে পারে। জামায়াত বলে কোনো কথা নেই, যে কেউ, যে কোনো কথা বলতে পারে, এটা গণতান্ত্রিক দেশ, গণতান্ত্রিক চর্চা এখানে আছে। কথা হলো, আমাদের যে আইনকানুন আছে, এর মধ্য থেকে তাদের কথা বলতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা পারমিশন দিইনি, আমরা তাদের কোনো পারমিশন দিই না। জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধিত দল নয় এখন পর্যন্ত। কাজেই তারা জামায়াতে ইসলামীর ব্যানারে যদি আসে, তাহলে তাদের পারমিশন দেওয়ার প্রশ্নই আসে না।’
উচ্চ আদালতের নির্দেশে জামায়াত নিবন্ধন হারিয়েছে, তবে নিষিদ্ধ হয়নি। নিবন্ধনহীন অনেক দলই দেশে নানা কর্মসূচি পালন করে থাকে। তাদের ব্যাপারে সরকারকে এমন তৎপর হতে দেখা যায় না। জামায়াতের যে অপরাধ আছে, তার জন্য আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু সেটা না করে একটি নিষিদ্ধ দলের মতো আচরণ করলে উল্টো দলটি সাধারণ মানুষের সহানুভূতি কুড়ানোর সুযোগ পাবে।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি একাত্তরের নরঘাতকদের বিচার দেখার প্রতীক্ষায় কাটিয়েছে চার দশকের বেশি সময়। নানা অনিশ্চয়তা, হতাশা আর দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের পর কলঙ্ক মোচনের সেই বিচার-প্রক্রিয়ার শুরু হয় ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করার মধ্য দিয়ে। যদিও ট্রাইব্যুনালের কার্যপ্রণালি বিধি প্রণয়ন করতেই কেটে যায় চার মাস। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়ায় প্রথম ফাঁসি কার্যকর হয়েছে বাংলাদেশের ৪৩তম বিজয় দিবসের প্রাক্কালে ২০১৩ সালের ১২ ডিসেম্বর রাতে।
সেদিন রাত ১০টা ১ মিনিটে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় কসাই কাদের নামে পরিচিত আলবদর কমান্ডার আবদুল কাদের মোল্লাকে। স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতে ইসলামীর এই নেতার ফাঁসি কার্যকর করার মধ্য দিয়ে জাতির ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় শুরু হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ১৩ বছরে ৫৩টি মামলার রায় হয়েছে। তাতে সাজা হয়েছে ১৩৯ জন আসামির। রায়ে ৯৯ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং ২৫ জনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় ৪৩তম বিজয় দিবসে দেশবাসী যতটা না উল্লসিত ও উজ্জীবিত ছিল, পরেরবারই ততটা দেখা যায়নি। জনমনে সবচেয়ে বেশি সংশয় এখন অপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচার নিয়ে। আইনের অস্পষ্টতা দূর করার নামে এ ক্ষেত্রে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে বলে কোনো কোনো মহলের অভিযোগ।
মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ, যুদ্ধাপরাধসহ বিভিন্ন অভিযোগে সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিচারের লক্ষ্যে ২০১৩ সালেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ফরমাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) দাখিল করার সম্ভাবনা উঁকি দিয়েছিল। কিন্তু সেই সম্ভাবনা মিলিয়ে যায় দ্রুতই। প্রসিকিউশন বা রাষ্ট্রপক্ষের যে আইনজীবী দলটি জামায়াতের বিরুদ্ধে ফরমাল চার্জ তৈরির কাজ করছিল, তারা সেই কাজ বন্ধ করে দেয় প্রসিকিউশনেরই একাংশের হস্তক্ষেপে।
এ নিয়ে শুরু হয় দুই পক্ষের বাদানুবাদ। অন্যদিকে আইনমন্ত্রী জানিয়ে দেন, অপরাধী সংগঠনের শাস্তি কী হবে, তা আইনে স্পষ্ট না করে জামায়াতের বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হবে না? ঘনিষ্ঠ অনেকের বিরাগভাজন হওয়ার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আমি তখন জামায়াতের বিচার শুরু করার আগেই আইনে অপরাধী সংগঠনের শাস্তি সুনির্দিষ্ট করার পক্ষে লিখেছি পত্রিকায়। তাই বলে আইনের সামান্য সংশোধনী আনার নামে এত সময়ক্ষেপণ সমর্থনযোগ্য নয়। সংগত কারণেই এ বিষয়টির মধ্যেও রাজনীতির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘যুদ্ধাপরাধীদের’ বিচারের অঙ্গীকারসহ দিনবদলের সনদ ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করে। ফলে ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজয়ী হয়। নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী, মহাজোট সরকার ‘যুদ্ধাপরাধী’ হিসেবে পরিচিত মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের উদ্যোগ নেওয়ায় চার দশক পর জাতি নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর প্রথম ৯ মাসে একটি অভিযোগও গঠিত না হওয়ায় জনমনে সংশয় দানা বাঁধে। শুরুতেই সবচেয়ে বেশি সংশয় দেখা দেয়, তদন্ত সংস্থার ‘প্রধান’ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নিয়ে। পরে তাঁকে সরাতেও লেগে যায় অনেকখানি সময়।
এই বিচার নিয়ে জনমনে শুরু থেকে যে সংশয় ছিল, তা পরে আরও ঘনীভূত হয় যখন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির গোলাম আযম, বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ শীর্ষস্থানীয় চার অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের দাখিল করা ফরমাল চার্জ ‘সুবিন্যস্ত’ না হওয়ায় ফেরত দেয় ট্রাইব্যুনাল। অথচ গোলাম আযমের ফরমাল চার্জ কীভাবে সুবিন্যস্ত করে লিখতে হবে তা মৌখিকভাবে ব্যাখ্যা করার পাশাপাশি লিখিত রূপরেখাও দেওয়া হয়েছিল একাধিক প্রসিকিউটরকে। কিন্তু তাঁরা তা আমলে নেননি।
পরে ট্রাইব্যুনালের রায়ে কাদের মোল্লার সর্বোচ্চ শাস্তি না হওয়ায় মানুষের সংশয় বিক্ষোভে রূপ নেয়। কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল ২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি। রায় শোনার জন্য সেদিন ট্রাইব্যুনালের সামনে ভিড় জমিয়েছিলেন নানা স্তরের মানুষ। কিন্তু রায় ঘোষণার পর ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাৎক্ষণিকভাবেই হতাশা ব্যক্ত করেন। মর্মস্পর্শী সব হতাশাধ্বনির পাশাপাশি সারা দেশে সর্বস্তরের মানুষের কণ্ঠেও উচ্চারিত হয়, ‘এ রায় মানি না।’ ক্ষোভে-দুঃখে মানুষ নেমে আসে রাজপথে। একপর্যায়ে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ কাদের মোল্লার সাজা বাড়িয়ে ফাঁসির আদেশ দেয় ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংক্ষিপ্ত রায়ে।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ শুরু থেকেই সোচ্চার ছিল যাতে এই বিচার-প্রক্রিয়ায় সরকারের দিক থেকে কোনো গাফিলতি না করা হয়। কোনো রকম ত্রুটি-দুর্বলতা বা রাজনৈতিক লাভ-লোকসানজনিত হিসাবের মারপ্যাঁচে যাতে বিচার-প্রক্রিয়াটি হোঁচট না খায় বা ব্যর্থ না হয়, সে জন্য সারাক্ষণ সতর্ক নজর রেখেছে তারা। অনেকে আগ বাড়িয়ে তথ্য-উপাত্ত, দলিলপত্র দিয়ে সহায়তা করেছে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশনকে।
সবারই জানা, একাত্তরের ঘাতকদের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল। কাদের মোল্লার ফাঁসি কার্যকর না করার জন্যও যুক্তরাষ্ট্র চাপ দিয়েছিল, যদিও পরে দেশটি তার অবস্থান কিছুটা বদল করেছে। একপর্যায়ে দেখা যায়, ব্যক্তিবিশেষের বদলে জামায়াতকে বাঁচাতে তৎপর তারা। যুদ্ধাপরাধবিষয়ক মার্কিন দূত স্টিফেন জে র্যাপ ২০১৪ সালের আগস্টে তাঁর সর্বশেষ ঢাকা সফরকালে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ‘সামাজিক পুনর্মিলনের স্বার্থে’ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে কোনো সংগঠনের বিচার হওয়া উচিত নয়। বাইরের বড় শক্তির এ ধরনের অবস্থানের কারণেই সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারের লক্ষ্যে আইন সংশোধনে কালক্ষেপণ করা হচ্ছে, নাকি অভ্যন্তরীণ রাজনীতির কোনো সমীকরণ এতে কাজ করছে, সে নিয়েও আছে নানা সংশয়। এ ছাড়া একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তাকারী অন্য দলগুলো সম্পর্কে নীরবতাও ভালো লক্ষণ নয়। সব কয়টি দলকেই বিচারের আওতায় আনা উচিত।
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
২ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
২ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৬ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে