অরুণ কর্মকার
আজ সেই দিন, যেদিন আমরা যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলাম। রক্তের এক উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে, ঊষর ধূসর অগ্নিগর্ভ মরুপথ অতিক্রম করে পৌঁছে গিয়েছিলাম বহু কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। নোঙর ফেলেছিলাম বিজয়ের বন্দরে। ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান, ২ লাখ নির্যাতিত নারীর সম্ভ্রম এবং দেশের প্রতিটি মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টভোগ আর ত্যাগে মহীয়ান হয়েছিল এই বিজয়। আর ছিল অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্রবাহিনীর বীরত্ব। সব মিলে আপাদমস্তক শিহরণ জাগানো ছিল যুদ্ধ জয়ের অনন্য সেই দিন। আজকের দিনটি বহন করছে যার উত্তরাধিকার।
সেই বিজয় শিহরণ জাগিয়েছিল একাত্তরের প্রতিটি মানুষের অন্তরে-বাইরে। উদ্দীপিত করেছিল সমগ্র বাঙালি জাতিকে। হতবাক করে দিয়েছিল সারা পৃথিবীকে। সেই প্রজন্মের একজন হিসেবে অন্যদের মতো আমিও আজীবন গর্ববোধ করব। রাজনীতি এবং সমাজের গণ্ডির বাইরে সেই প্রজন্মের প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত স্মৃতিতেও চিরভাস্বর হয়ে থাকবে অবিস্মরণীয় সেই বিজয়ের দিনের অনুভূতি। যেমন রয়েছে আমার।
মনে পড়ে, প্রশিক্ষণ শেষে আমরা তখন টাকি ক্যাম্পে অপেক্ষমাণ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার হাসনাবাদ-সংলগ্ন একটি গ্রাম টাকি। সেই ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ যেমন হতো, তেমনি প্রশিক্ষণ শেষ করা মুক্তিযোদ্ধাদের রণাঙ্গনে কিংবা উচ্চতর প্রশিক্ষণে পাঠানোর আগে অপেক্ষমাণও রাখা হতো। ডিসেম্বরেও ভারতের একটি প্রশিক্ষণ ও ট্রানজিট ক্যাম্পে অপেক্ষমাণ ছিলাম। কারণ যুদ্ধের শুরুতে দেশের ভেতরেই নিজের এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম।
তাঁরা ছিলেন অতি বামপন্থী। তাঁরা যখন মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি শ্রেণিশত্রু খতমে লিপ্ত হয়ে পড়েন এবং আপসকামী প্রভৃতি অপবাদ দিয়ে নিজেদের মধ্যেও হত্যাকাণ্ড ঘটাতে থাকেন, তখন সেখান থেকে সরে পড়ার সিদ্ধান্ত নিই। আর নিশ্চিত নিরাপত্তার জন্য চলে যাই ভারতের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। তত দিনে যশোর রোডে সেপ্টেম্বর এসে গেছে।
টাকি ক্যাম্পে একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর সকাল গড়িয়ে গেছে। নিয়মমাফিক সকালের পিটি-প্যারেড শেষে নাশতার পর্বও শেষ। কেউ তাঁবুর মধ্যে, কেউ বাইরে রোদে বসেছে। এ সময় একযোগে ৬টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান আমাদের মাথার ওপর দিয়ে খুব নিচ থেকে উড়ে গেল।
বিমানগুলোর লক্ষ্য যে বাংলাদেশ সীমান্ত, তা সেগুলোর গতিমুখ দেখেই বোঝা গেল। টাকি ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা সীমান্ত খুব বেশি হলে ১০ কিলোমিটারের দূরত্ব। মাঝখানে অবশ্য বহমান সম্ভবত ইছামতী নদী।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ ঘনীভূত হওয়ার খবরা-খবর আমাদের জানা ছিল। কিন্তু প্রায় তিন মাস এই ক্যাম্পে অবস্থানকালে এভাবে যুদ্ধবিমান উড়ে যাওয়ার ঘটনা কখনো ঘটেনি। তাই আমরা ধারণা করলাম, গুরুতর কিছু একটা ঘটেছে বা ঘটতে যাচ্ছে। এর মিনিট দশেকের মধ্যে আরও একঝাঁক যুদ্ধবিমান একইভাবে, একই দিকে উড়ে গেল। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ক্যাম্পের অফিস থেকে উচ্ছ্বসিত সব কমান্ডার এবং কর্মকর্তা বাইরে বেরিয়ে এলেন। ততক্ষণে তাঁবুগুলোও সব ফাঁকা। সবাই প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হয়েছেন। সেখানেই আমাদের জানানো হলো প্রত্যাশিত সুখবরটি—ভারত সরকার স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো গগনবিদারী জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান। আর মুহুর্মুহু করতালি। পরস্পরকে আলিঙ্গন। কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলিও ছোড়া হলো। ক্যাম্পের সন্নিহিত এলাকার লোকজন বেরিয়ে এসেছে। তারা তখনো জানে না কী ঘটেছে? ক্যাম্পের ভেতরে আমাদের উচ্ছ্বাস বেড়েই চলেছে। হঠাৎ আওয়াজ উঠল আর আমরা ক্যাম্পে অপেক্ষা করব না। চলো সবাই সীমান্তের দিকে। দেশের ভেতরে ঢুকব। ফ্রন্টে যাব। কেউ আবার বলছে, আমাদের যেতে হবে পশ্চিম সীমান্তে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে আনতে হবে। সে এক মাথা খারাপ করা হুলুস্থুল কাণ্ড।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, মুক্তিযুদ্ধে ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল মাঝেমধ্যেই টাকি ক্যাম্পে আসতেন। প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণার্থীদের খোঁজখবর নিতেন। জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতেন। প্রতিবারই তিনি বক্তৃতায় বলতেন, ‘বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হবে না। আমাদের পশ্চিম সীমান্তে গিয়ে পাকিস্তানকে আক্রমণ করতে হবে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে আনতে হবে।’
যা-ই হোক, ক্যাম্প কর্তৃপক্ষের আহ্বানে শেষ পর্যন্ত সবাই শান্ত হলাম। কর্তৃপক্ষ ঘণ্টাখানেক সময় নিল। এরপরই সীমান্তের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার অনুমতি দিলেন আগ্রহী সবাইকে। আমরা তৈরি হয়েই ছিলাম। সঙ্গে ছিল হালকা কিছু অস্ত্র। সামান্য কিছু অর্থ। আর মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট। আমরা যখন ক্যাম্প ছাড়লাম, তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। সন্ধ্যা নাগাদ নদী পার হয়ে আমরা শ দেড়েক যোদ্ধার দলটি পৌঁছে যাই সাতক্ষীরা অঞ্চলে। সেই রাতেই সাক্ষাৎ পাই অগ্রবর্তী একটি দলের।
তারা জানায়, আমাদের দলটি তাদের সঙ্গে যৌথভাবে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কমান্ড সেন্টার থেকে। আমরা সেভাবেই তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হই। এরপর জানতে পারি আমাদের সামনে আরও ছয়টি অগ্রবর্তী দল রয়েছে। প্রতিটি দলে রয়েছে ৮০০ থেকে ১ হাজার যোদ্ধা। সবচেয়ে সামনে রয়েছে মিত্রবাহিনীর সৈনিকেরা। তাঁদের সঙ্গে আছে আগে থেকেই দেশের ভেতরে যুদ্ধরত এবং ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের ভেতরে ঢোকা মুক্তিযোদ্ধারা।
প্রতিটি দলের জন্য কমান্ড সেন্টারের নির্দেশ হলো, আমরা যে অঞ্চল ধরে অগ্রসর হচ্ছি, সেখানে যেন শত্রুর কোনো অবশেষ না থাকে।প্রতিটি অঞ্চল যেন প্রকৃতই মুক্ত হয় সেটা নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্যে শুরু হয় আমাদের চিরুনি অভিযান। চলার পথের প্রতিটি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক-সামাজিক নেতৃত্বদানকারীদের কাছে খোঁজখবর নিয়ে অগ্রসর হওয়া। আমাদের গন্তব্য কোথায়, কবে কোথায় আমরা পৌঁছাব তা নির্ধারিত হচ্ছে কমান্ড সেন্টার থেকে। সেই সেন্টারের অবস্থান কোথায়, আমরা তা জানি না। সুতরাং চোখ বন্ধ করে চলা আর পথে পথে নির্ধারিত দায়িত্ব পালন। দিন-রাতের কোনো তফাত নেই। খাওয়া বিশ্রাম-ঘুমের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। দিন-তারিখও ভুলে যাওয়ার মতো অবস্থা। শুধু বিরামহীন সামনে চলা।
আমাদের সামনে যশোর-খুলনা অঞ্চলে তখনো প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। সেই যুদ্ধের খবরা-খবরও আমরা পাচ্ছি। যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত অবস্থানের কথা আমাদের জানাই ছিল। এভাবে চলতে চলতে আমরা একসময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামরিক ট্রাকে কিছু কিছু পথ দ্রুত এগোতে শুরু করলাম। এক স্থান থেকে অন্য কোনো নির্ধারিত স্থানে আমাদের পৌঁছে দেওয়া হচ্ছিল। এভাবে ১৬ ডিসেম্বর দুপুর নাগাদ আমরা খুলনা পৌঁছালাম। সেখানেই পাওয়া গেল পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত এবং আমাদের যুদ্ধজয়ের খবর। সেখানেও আবার সৃষ্টি হলো সেই টাকি ক্যাম্পের মতো উন্মাদনা।
খুলনায় আমাদের বলা হলো, আমরা চাইলে যে যার এলাকায় চলে যেতে পারি। সঙ্গে সঙ্গে আমরা ৭৯ জন, যারা একসঙ্গে আমাদের গ্রাম থেকে আগস্টের শেষের এক অন্ধকার রাতে যাত্রা শুরু করেছিলাম। আমরা সবাই নিজেদের এলাকায় রওনা করার জন্য মনস্থির করলাম।
রূপসা ফেরি পার হয়ে খুলনা-বাগেরহাট ট্রেন ধরে আমরা পিরোজপুরের ওপর দিয়ে ঝালকাঠির দিকে যাব। কিন্তু ফেরি পার হয়ে শুনি মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পর থেকেই সেই ট্রেন চলাচল বন্ধ। ট্রেনের লোকজন খুঁজে পাওয়া গেল। তাঁরা ট্রেন চালু করতে পারবেন বলেও জানালেন। আমরা সেই ট্রেনে যাত্রা শুরু করলাম। সারা পথে দেখতে পেলাম রেললাইনের দুই পাশে দাঁড়িয়ে মানুষ স্লোগান দিচ্ছে। আমরা সেই বিজয়ের আনন্দে আপ্লুত অসংখ্য মানুষের মধ্য দিয়ে যেন শামিল আছি।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
আজ সেই দিন, যেদিন আমরা যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলাম। রক্তের এক উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে, ঊষর ধূসর অগ্নিগর্ভ মরুপথ অতিক্রম করে পৌঁছে গিয়েছিলাম বহু কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। নোঙর ফেলেছিলাম বিজয়ের বন্দরে। ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান, ২ লাখ নির্যাতিত নারীর সম্ভ্রম এবং দেশের প্রতিটি মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টভোগ আর ত্যাগে মহীয়ান হয়েছিল এই বিজয়। আর ছিল অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা এবং মিত্রবাহিনীর বীরত্ব। সব মিলে আপাদমস্তক শিহরণ জাগানো ছিল যুদ্ধ জয়ের অনন্য সেই দিন। আজকের দিনটি বহন করছে যার উত্তরাধিকার।
সেই বিজয় শিহরণ জাগিয়েছিল একাত্তরের প্রতিটি মানুষের অন্তরে-বাইরে। উদ্দীপিত করেছিল সমগ্র বাঙালি জাতিকে। হতবাক করে দিয়েছিল সারা পৃথিবীকে। সেই প্রজন্মের একজন হিসেবে অন্যদের মতো আমিও আজীবন গর্ববোধ করব। রাজনীতি এবং সমাজের গণ্ডির বাইরে সেই প্রজন্মের প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত স্মৃতিতেও চিরভাস্বর হয়ে থাকবে অবিস্মরণীয় সেই বিজয়ের দিনের অনুভূতি। যেমন রয়েছে আমার।
মনে পড়ে, প্রশিক্ষণ শেষে আমরা তখন টাকি ক্যাম্পে অপেক্ষমাণ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার হাসনাবাদ-সংলগ্ন একটি গ্রাম টাকি। সেই ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ যেমন হতো, তেমনি প্রশিক্ষণ শেষ করা মুক্তিযোদ্ধাদের রণাঙ্গনে কিংবা উচ্চতর প্রশিক্ষণে পাঠানোর আগে অপেক্ষমাণও রাখা হতো। ডিসেম্বরেও ভারতের একটি প্রশিক্ষণ ও ট্রানজিট ক্যাম্পে অপেক্ষমাণ ছিলাম। কারণ যুদ্ধের শুরুতে দেশের ভেতরেই নিজের এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলাম।
তাঁরা ছিলেন অতি বামপন্থী। তাঁরা যখন মুক্তিযুদ্ধের পাশাপাশি শ্রেণিশত্রু খতমে লিপ্ত হয়ে পড়েন এবং আপসকামী প্রভৃতি অপবাদ দিয়ে নিজেদের মধ্যেও হত্যাকাণ্ড ঘটাতে থাকেন, তখন সেখান থেকে সরে পড়ার সিদ্ধান্ত নিই। আর নিশ্চিত নিরাপত্তার জন্য চলে যাই ভারতের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। তত দিনে যশোর রোডে সেপ্টেম্বর এসে গেছে।
টাকি ক্যাম্পে একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর সকাল গড়িয়ে গেছে। নিয়মমাফিক সকালের পিটি-প্যারেড শেষে নাশতার পর্বও শেষ। কেউ তাঁবুর মধ্যে, কেউ বাইরে রোদে বসেছে। এ সময় একযোগে ৬টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান আমাদের মাথার ওপর দিয়ে খুব নিচ থেকে উড়ে গেল।
বিমানগুলোর লক্ষ্য যে বাংলাদেশ সীমান্ত, তা সেগুলোর গতিমুখ দেখেই বোঝা গেল। টাকি ক্যাম্প থেকে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা সীমান্ত খুব বেশি হলে ১০ কিলোমিটারের দূরত্ব। মাঝখানে অবশ্য বহমান সম্ভবত ইছামতী নদী।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ ঘনীভূত হওয়ার খবরা-খবর আমাদের জানা ছিল। কিন্তু প্রায় তিন মাস এই ক্যাম্পে অবস্থানকালে এভাবে যুদ্ধবিমান উড়ে যাওয়ার ঘটনা কখনো ঘটেনি। তাই আমরা ধারণা করলাম, গুরুতর কিছু একটা ঘটেছে বা ঘটতে যাচ্ছে। এর মিনিট দশেকের মধ্যে আরও একঝাঁক যুদ্ধবিমান একইভাবে, একই দিকে উড়ে গেল। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ক্যাম্পের অফিস থেকে উচ্ছ্বসিত সব কমান্ডার এবং কর্মকর্তা বাইরে বেরিয়ে এলেন। ততক্ষণে তাঁবুগুলোও সব ফাঁকা। সবাই প্রাঙ্গণে এসে জড়ো হয়েছেন। সেখানেই আমাদের জানানো হলো প্রত্যাশিত সুখবরটি—ভারত সরকার স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো গগনবিদারী জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান। আর মুহুর্মুহু করতালি। পরস্পরকে আলিঙ্গন। কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলিও ছোড়া হলো। ক্যাম্পের সন্নিহিত এলাকার লোকজন বেরিয়ে এসেছে। তারা তখনো জানে না কী ঘটেছে? ক্যাম্পের ভেতরে আমাদের উচ্ছ্বাস বেড়েই চলেছে। হঠাৎ আওয়াজ উঠল আর আমরা ক্যাম্পে অপেক্ষা করব না। চলো সবাই সীমান্তের দিকে। দেশের ভেতরে ঢুকব। ফ্রন্টে যাব। কেউ আবার বলছে, আমাদের যেতে হবে পশ্চিম সীমান্তে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে আনতে হবে। সে এক মাথা খারাপ করা হুলুস্থুল কাণ্ড।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য, মুক্তিযুদ্ধে ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল মাঝেমধ্যেই টাকি ক্যাম্পে আসতেন। প্রশিক্ষণ ও প্রশিক্ষণার্থীদের খোঁজখবর নিতেন। জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতেন। প্রতিবারই তিনি বক্তৃতায় বলতেন, ‘বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হবে না। আমাদের পশ্চিম সীমান্তে গিয়ে পাকিস্তানকে আক্রমণ করতে হবে। পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে আনতে হবে।’
যা-ই হোক, ক্যাম্প কর্তৃপক্ষের আহ্বানে শেষ পর্যন্ত সবাই শান্ত হলাম। কর্তৃপক্ষ ঘণ্টাখানেক সময় নিল। এরপরই সীমান্তের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার অনুমতি দিলেন আগ্রহী সবাইকে। আমরা তৈরি হয়েই ছিলাম। সঙ্গে ছিল হালকা কিছু অস্ত্র। সামান্য কিছু অর্থ। আর মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট। আমরা যখন ক্যাম্প ছাড়লাম, তখন দুপুর গড়িয়ে গেছে। সন্ধ্যা নাগাদ নদী পার হয়ে আমরা শ দেড়েক যোদ্ধার দলটি পৌঁছে যাই সাতক্ষীরা অঞ্চলে। সেই রাতেই সাক্ষাৎ পাই অগ্রবর্তী একটি দলের।
তারা জানায়, আমাদের দলটি তাদের সঙ্গে যৌথভাবে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে কমান্ড সেন্টার থেকে। আমরা সেভাবেই তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হই। এরপর জানতে পারি আমাদের সামনে আরও ছয়টি অগ্রবর্তী দল রয়েছে। প্রতিটি দলে রয়েছে ৮০০ থেকে ১ হাজার যোদ্ধা। সবচেয়ে সামনে রয়েছে মিত্রবাহিনীর সৈনিকেরা। তাঁদের সঙ্গে আছে আগে থেকেই দেশের ভেতরে যুদ্ধরত এবং ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশের ভেতরে ঢোকা মুক্তিযোদ্ধারা।
প্রতিটি দলের জন্য কমান্ড সেন্টারের নির্দেশ হলো, আমরা যে অঞ্চল ধরে অগ্রসর হচ্ছি, সেখানে যেন শত্রুর কোনো অবশেষ না থাকে।প্রতিটি অঞ্চল যেন প্রকৃতই মুক্ত হয় সেটা নিশ্চিত করা। সেই লক্ষ্যে শুরু হয় আমাদের চিরুনি অভিযান। চলার পথের প্রতিটি এলাকায় মুক্তিযুদ্ধে রাজনৈতিক-সামাজিক নেতৃত্বদানকারীদের কাছে খোঁজখবর নিয়ে অগ্রসর হওয়া। আমাদের গন্তব্য কোথায়, কবে কোথায় আমরা পৌঁছাব তা নির্ধারিত হচ্ছে কমান্ড সেন্টার থেকে। সেই সেন্টারের অবস্থান কোথায়, আমরা তা জানি না। সুতরাং চোখ বন্ধ করে চলা আর পথে পথে নির্ধারিত দায়িত্ব পালন। দিন-রাতের কোনো তফাত নেই। খাওয়া বিশ্রাম-ঘুমের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। দিন-তারিখও ভুলে যাওয়ার মতো অবস্থা। শুধু বিরামহীন সামনে চলা।
আমাদের সামনে যশোর-খুলনা অঞ্চলে তখনো প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে। সেই যুদ্ধের খবরা-খবরও আমরা পাচ্ছি। যশোর ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত অবস্থানের কথা আমাদের জানাই ছিল। এভাবে চলতে চলতে আমরা একসময় ভারতীয় সেনাবাহিনীর সামরিক ট্রাকে কিছু কিছু পথ দ্রুত এগোতে শুরু করলাম। এক স্থান থেকে অন্য কোনো নির্ধারিত স্থানে আমাদের পৌঁছে দেওয়া হচ্ছিল। এভাবে ১৬ ডিসেম্বর দুপুর নাগাদ আমরা খুলনা পৌঁছালাম। সেখানেই পাওয়া গেল পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত এবং আমাদের যুদ্ধজয়ের খবর। সেখানেও আবার সৃষ্টি হলো সেই টাকি ক্যাম্পের মতো উন্মাদনা।
খুলনায় আমাদের বলা হলো, আমরা চাইলে যে যার এলাকায় চলে যেতে পারি। সঙ্গে সঙ্গে আমরা ৭৯ জন, যারা একসঙ্গে আমাদের গ্রাম থেকে আগস্টের শেষের এক অন্ধকার রাতে যাত্রা শুরু করেছিলাম। আমরা সবাই নিজেদের এলাকায় রওনা করার জন্য মনস্থির করলাম।
রূপসা ফেরি পার হয়ে খুলনা-বাগেরহাট ট্রেন ধরে আমরা পিরোজপুরের ওপর দিয়ে ঝালকাঠির দিকে যাব। কিন্তু ফেরি পার হয়ে শুনি মুক্তিযুদ্ধ শুরুর কিছুদিন পর থেকেই সেই ট্রেন চলাচল বন্ধ। ট্রেনের লোকজন খুঁজে পাওয়া গেল। তাঁরা ট্রেন চালু করতে পারবেন বলেও জানালেন। আমরা সেই ট্রেনে যাত্রা শুরু করলাম। সারা পথে দেখতে পেলাম রেললাইনের দুই পাশে দাঁড়িয়ে মানুষ স্লোগান দিচ্ছে। আমরা সেই বিজয়ের আনন্দে আপ্লুত অসংখ্য মানুষের মধ্য দিয়ে যেন শামিল আছি।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
২ দিন আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
২ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৬ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৯ দিন আগে