বিধান রিবেরু
গজদন্ত মিনারে যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের কাছে এখনো বাংলা ছোটলোকের ভাষা। একটু কান পাতলেই শোনা যাবে, নিজেদের ভেতর বাতচিতকালে তাঁরা বাংলায় নয়, শব্দ ভাঁজেন ইংরেজিতেই। শিক্ষার মাধ্যমে, অনুষ্ঠানের শিরোনামে, রাস্তাঘাটে দোকানপাটের নামকরণে যেভাবে বাংলা অবহেলিত হচ্ছে, তাতে মনেই হয় না বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা।
ইংরেজির প্রতি বিদ্বেষ নেই, কিন্তু বাংলার প্রতি অবজ্ঞা, কী আশ্চর্য, সমাজের উঁচু শ্রেণি ও ক্ষমতাধরদের চোখেই পড়ছে না। অথচ দেখুন প্রতিদিন আমরা কত আক্ষেপ করি আমাদের আগের মতো ভালো বাংলা সাহিত্য নেই, ভালো বাংলা চলচ্চিত্র নেই! এটা অনেকটা নিজের চোখে কড়িকাঠ রেখে, অন্যের চোখের কুটো নিয়ে সমালোচনা করার মতোই। বাংলাকে যথাযথ মর্যাদা দিন, ভালো সাহিত্যকর্ম ও চলচ্চিত্র হবে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করে দেশের একটি শ্রেণি যে রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল অপরাধ করছে, সেই বোধের ঘণ্টি কে পরিয়ে দেবে তাদের গলায়? প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আমরা শিক্ষিত করছি ইংরেজিতে, অথচ ফল চাইছি বাংলা ভাষায়। এ যেন বটবৃক্ষের কাছে আম্রপালি প্রত্যাশা! যেন মঙ্গল গ্রহ থেকে কেউ এসে ভূমিসংলগ্ন শিল্প সৃজন করে দিয়ে যাবে! নিজের দেশের মেধাবী ছেলেমেয়েরা যদি মাতৃভাষা ভালো করে আয়ত্ত না করে, যদি ভাষার প্রয়োগ ঠিকঠাক না শেখে, তাহলে সেই ভাষায় সে সৃষ্টি করবে কেমন করে?
যারা ইংরেজি মাধ্যমে না ঘরকা, না ঘাটকা শিক্ষা অর্জন করছে, তারা না শিখছে দেশের ভাষা, না শিখছে ইতিহাস ও সংস্কৃতি। বাইরের দেশের পাঠ্যক্রমে দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি কোথায়? বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে আবির্ভূত হয়েছে ইংরেজি ভাষায় দেশি পাঠ্যক্রম।এই ইংরেজি কি ব্রিটিশ, না উত্তর আমেরিকার, তার হিসাব কে রাখে? শুনেছি দেশীয় পাঠ্যক্রমের ইংরেজি বই নাকি এখন ধর-তক্তা-মার-পেরেক কায়দায় গুগলের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অনুবাদ-দক্ষতার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের বিপর্যয় রুখবে কে?
বাংলার জলবায়ুর ভেতর থেকে, কেউ যখন ইংরেজি আত্মস্থ করার চেষ্টায় রত থাকে, তখন তার অচেতনের গঠনেও সেটার প্রভাব পড়ে। বাংলা ও ইংরেজির গঠন এক রকম নয়। দেখবেন যারা ইংরেজিতে সড়গড়, তারা ইংরেজির কাঠামো মেনে বাংলা বলার চেষ্টা করে। এতে বাংলা হয়ে পড়ে বিকৃত। এর উল্টোটাও হয়। এখন অচেতনের গঠন যদি ভাষার মতো হয়, তবে আমরা গত কয়েক প্রজন্মের অচেতন এমন করে তৈরি করেছি, যা ইংরেজির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। মজার বিষয়, ইংরেজি আমাদের সমাজে এসেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুদের আধিপত্যকামী শাসনব্যবস্থার হাত ধরে। এখন মগজে ঔপনিবেশিকদের ভাষার গঠন নিয়ে, নিজ দেশের ভাষায় শ্রেষ্ঠ সাহিত্য ও চলচ্চিত্র নির্মাণ কি সম্ভব?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কথা ভীষণ মনে বাজে—বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ—কায়মনে বাঙালি হওয়ার অর্থ মগজটাকে মাতৃভাষায় নিমজ্জিত করতে হবে। ইরানের প্রখ্যাত পরিচালক আব্বাস কিয়ারোস্তামিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কেন তিনি ইরানের কঠোর নিষেধাজ্ঞার ভেতরে থেকেই সিনেমা বানিয়ে গেলেন। তিনি দেশ ছাড়েনি, কেননা, তিনি জানতেন পারস্যের ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে দূরে যাওয়া মানে তিনি পরিণত হবেন মূল উৎপাটিত এক বৃক্ষে। গোটা দুনিয়ায় যে লেখক ও চলচ্চিত্র পরিচালকেরা সমাদৃত হচ্ছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই নিজের ভাষা, সংস্কৃতি ও জনপদের কথা বলেছেন। সেনেগালের উসমান সেমবেন আফ্রিকার মানুষের কথাই বলেছেন।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ স্প্যানিশ ভাষায় লাতিন আমেরিকার গল্পটাই শুনিয়েছেন। আর এর ভেতর দিয়ে তাঁরা স্থানিক উপাদানকে মিলিয়ে দিয়েছেন বৈশ্বিক সংবেদনশীলতায়। এ কারণেই তাঁরা নমস্য। এ কারণেই তাঁরা বিশ্বমানব। আমরাও বিশ্বমানব হতে চাই।
আমরা ভাবছি ইংরেজিই সেই জাদুকাঠি, যার মাধ্যমে আমরা বিশ্বের দরবারে পৌঁছাব। পৌঁছানো যাবে ঠিকই, তবে তাতে দেয়ালের ওপর আরও একটি ইট যুক্ত হবে কেবল। আলাদা মিনার গড়ে উঠবে না।
এসব যুক্তি শুনতে নারাজ আমাদের দেশের হর্তাকর্তা ও প্রভুরা। তাদের আরও বেশি ইংরেজি মাধ্যম চাই, এমনকি ইংরেজি মাধ্যমের মাদ্রাসাও চাই। এই অদ্ভুত চাওয়া যে জাতি হিসেবে আমাদের সব অর্জনকে শূন্য করে দিয়ে বিশাল গহ্বরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সে খবর কে রাখে? কেবল ফেব্রুয়ারি মাস এলেই দেখবেন কুমিরের ক্রন্দন। আরও আজব ঠেকে, যখন কোনো ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করা হয়। তাও আবার ভাষাশহীদ দিবস নামে নয়, পালন করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটাও গাওয়া হয়। এসব করে যে একুশে ফেব্রুয়ারির মূল চেতনার সঙ্গে বেইমানি করা হচ্ছে, সেটা কি তারা বোঝে না? বুঝেশুনেই কি ভাষাশহীদ দিবসকে বিদায় করে তার জায়গায় এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে? এখানে সূক্ষ্ম শুভংকরের ফাঁকিটা কি আমরা ধরতে পারছি?
ইংরেজি কেজো ভাষা। ইংরেজি জানা থাকলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা সহজ। আয়-উপার্জনেও সুবিধা হয়। এই সত্য কে অস্বীকার করছে? যত বেশি ভাষা জানা থাকবে, তত বেশি জ্ঞানার্জন হবে। প্রশ্ন হলো ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অনেক ভাষা জানতেন বলে কি বাংলা ভুলে গিয়েছিলেন? না তিনি বাংলা কম জানতেন? পরিতাপের বিষয় আজকের ইংরেজি পড়ুয়া প্রজন্ম কিন্তু বাংলাটা ভুলে যাচ্ছে। তারা বাংলা ভালো করে পড়তেও পারে না।
তাই বাংলা বই কিনতেও চায় না। তাহলে বইমেলায় তিন-চার হাজার বই বের করে লাভটা কী, যদি আমাদের বর্তমান প্রজন্ম সেই ভাষার বই পড়তেই না পারে? কিনতেই না চায়? দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে ওঠা বইয়ের দোকানেও দেখবেন থরে থরে ইংরেজি বই এবং সেগুলোর অধিকাংশই থ্রিলার-হরর-রোমান্টিক ঘরানার বই। ইংরেজিতেও যে এ দেশের মানুষ খুব গভীর চিন্তাশীল বইপত্র পড়ছে, তা-ও কিন্তু নয়।
বাংলার প্রতি অবহেলার কারণে আমরা একদিকে বিশ্বমানের শিল্প সৃষ্টি করতে পারছি না। অপরদিকে, ভালো সাহিত্য বাংলায় অনুবাদও করতে পারছি না। চীনা, জাপানি বা রুশরা কিন্তু নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে বিশ্বের অনেক ধ্রুপদি সাহিত্য পড়ে ফেলেছে। আমাদের এখানে অনুবাদ হলেও, বাংলায় দুর্বলতার দরুন অধিকাংশ অনুবাদ সাহিত্যই হয়ে পড়ে পাঠের অযোগ্য।
কাজেই একদিকে আমরা সৃষ্টি করতে পারছি না, অপরদিকে অন্যদের অনন্য সৃষ্টির স্বাদও আমরা ভালো করে নিতে পারছি না। আর কে না জানে, অনুবাদকর্ম মূলত আরেকটি নতুন সাহিত্যকর্মই। তাই অনুবাদ যিনি করবেন তাঁর মূল ভাষা ও উদ্দিষ্ট ভাষার ওপর দখল থাকা অত্যন্ত জরুরি। আসলে একটি ভাষায় তখনই অনুবাদ সাহিত্য ভালো পাওয়া যায়, যখন সেই ভাষায় দক্ষ সাহিত্যিক, লেখক ও সাংবাদিক থাকেন।
ভাষা কিন্তু শুধু শুদ্ধ করে লেখার ব্যাপার নয়। ভাষাকে শুদ্ধ করে বলারও একটা ব্যাপার রয়েছে। প্রমিত উচ্চারণের ক্ষেত্রেও আমাদের ভেতর উদাসীনতা লক্ষ করা যায়। আমরা এই লেখার শুদ্ধতা নিয়ে অনেকটা ভাবলেও, বলার শুদ্ধতা নিয়ে একেবারেই ভাবি না বললে চলে। আবৃত্তি দলের সভ্য হলে এই শুদ্ধ উচ্চারণ শেখার সুযোগ হয়। কিন্তু সেই সুযোগ তো সবাই পায় না। এর সমাধান হতে পারে, আমরা যদি নবম ও দশম শ্রেণিতে ছেলেমেয়েদের বাংলা উচ্চারণ শেখার জন্য বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ের সঙ্গে একটি ব্যবহারিক ক্লাস জুড়ে দিই। আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে জোর দেওয়া হয় লেখা, পড়া ও শোনার ওপর। কিন্তু বলার ওপর জোর দিলে ভাষা শেখার ষোলোকলা পূর্ণ হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভাষা শেখার ক্ষেত্রে দেখা যায় পড়া-লেখা-বলা-শোনা এই চারের ওপর মনোযোগ দিতে। এমনকি ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিল বলি, কিংবা আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, সেখানে ইংরেজি ও ফরাসি শেখানো হয় এই চারটি দক্ষতাকে বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। তাই আমার প্রস্তাব, বাংলাদেশে শুদ্ধ উচ্চারণের জন্য মাধ্যমিক স্তরে বাংলা ব্যবহারিক চালু করা হোক। বাংলা নিয়ে এসব কথা অরণ্যে রোদন হলেও, আমি বারবারই কথাগুলো বলে যেতে চাই।
লেখক: চলচ্চিত্র সমালোচক
গজদন্ত মিনারে যাঁরা বসে আছেন, তাঁদের কাছে এখনো বাংলা ছোটলোকের ভাষা। একটু কান পাতলেই শোনা যাবে, নিজেদের ভেতর বাতচিতকালে তাঁরা বাংলায় নয়, শব্দ ভাঁজেন ইংরেজিতেই। শিক্ষার মাধ্যমে, অনুষ্ঠানের শিরোনামে, রাস্তাঘাটে দোকানপাটের নামকরণে যেভাবে বাংলা অবহেলিত হচ্ছে, তাতে মনেই হয় না বাংলা আমাদের রাষ্ট্রভাষা।
ইংরেজির প্রতি বিদ্বেষ নেই, কিন্তু বাংলার প্রতি অবজ্ঞা, কী আশ্চর্য, সমাজের উঁচু শ্রেণি ও ক্ষমতাধরদের চোখেই পড়ছে না। অথচ দেখুন প্রতিদিন আমরা কত আক্ষেপ করি আমাদের আগের মতো ভালো বাংলা সাহিত্য নেই, ভালো বাংলা চলচ্চিত্র নেই! এটা অনেকটা নিজের চোখে কড়িকাঠ রেখে, অন্যের চোখের কুটো নিয়ে সমালোচনা করার মতোই। বাংলাকে যথাযথ মর্যাদা দিন, ভালো সাহিত্যকর্ম ও চলচ্চিত্র হবে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলাকে অবজ্ঞা করে দেশের একটি শ্রেণি যে রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল অপরাধ করছে, সেই বোধের ঘণ্টি কে পরিয়ে দেবে তাদের গলায়? প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আমরা শিক্ষিত করছি ইংরেজিতে, অথচ ফল চাইছি বাংলা ভাষায়। এ যেন বটবৃক্ষের কাছে আম্রপালি প্রত্যাশা! যেন মঙ্গল গ্রহ থেকে কেউ এসে ভূমিসংলগ্ন শিল্প সৃজন করে দিয়ে যাবে! নিজের দেশের মেধাবী ছেলেমেয়েরা যদি মাতৃভাষা ভালো করে আয়ত্ত না করে, যদি ভাষার প্রয়োগ ঠিকঠাক না শেখে, তাহলে সেই ভাষায় সে সৃষ্টি করবে কেমন করে?
যারা ইংরেজি মাধ্যমে না ঘরকা, না ঘাটকা শিক্ষা অর্জন করছে, তারা না শিখছে দেশের ভাষা, না শিখছে ইতিহাস ও সংস্কৃতি। বাইরের দেশের পাঠ্যক্রমে দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি কোথায়? বোঝার ওপর শাকের আঁটি হয়ে আবির্ভূত হয়েছে ইংরেজি ভাষায় দেশি পাঠ্যক্রম।এই ইংরেজি কি ব্রিটিশ, না উত্তর আমেরিকার, তার হিসাব কে রাখে? শুনেছি দেশীয় পাঠ্যক্রমের ইংরেজি বই নাকি এখন ধর-তক্তা-মার-পেরেক কায়দায় গুগলের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অনুবাদ-দক্ষতার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আমাদের বিপর্যয় রুখবে কে?
বাংলার জলবায়ুর ভেতর থেকে, কেউ যখন ইংরেজি আত্মস্থ করার চেষ্টায় রত থাকে, তখন তার অচেতনের গঠনেও সেটার প্রভাব পড়ে। বাংলা ও ইংরেজির গঠন এক রকম নয়। দেখবেন যারা ইংরেজিতে সড়গড়, তারা ইংরেজির কাঠামো মেনে বাংলা বলার চেষ্টা করে। এতে বাংলা হয়ে পড়ে বিকৃত। এর উল্টোটাও হয়। এখন অচেতনের গঠন যদি ভাষার মতো হয়, তবে আমরা গত কয়েক প্রজন্মের অচেতন এমন করে তৈরি করেছি, যা ইংরেজির সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ। মজার বিষয়, ইংরেজি আমাদের সমাজে এসেছে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুদের আধিপত্যকামী শাসনব্যবস্থার হাত ধরে। এখন মগজে ঔপনিবেশিকদের ভাষার গঠন নিয়ে, নিজ দেশের ভাষায় শ্রেষ্ঠ সাহিত্য ও চলচ্চিত্র নির্মাণ কি সম্ভব?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কথা ভীষণ মনে বাজে—বিশ্বমানব হবি যদি কায়মনে বাঙালি হ—কায়মনে বাঙালি হওয়ার অর্থ মগজটাকে মাতৃভাষায় নিমজ্জিত করতে হবে। ইরানের প্রখ্যাত পরিচালক আব্বাস কিয়ারোস্তামিকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কেন তিনি ইরানের কঠোর নিষেধাজ্ঞার ভেতরে থেকেই সিনেমা বানিয়ে গেলেন। তিনি দেশ ছাড়েনি, কেননা, তিনি জানতেন পারস্যের ভাষা ও সংস্কৃতি থেকে দূরে যাওয়া মানে তিনি পরিণত হবেন মূল উৎপাটিত এক বৃক্ষে। গোটা দুনিয়ায় যে লেখক ও চলচ্চিত্র পরিচালকেরা সমাদৃত হচ্ছেন, তাঁদের প্রত্যেকেই নিজের ভাষা, সংস্কৃতি ও জনপদের কথা বলেছেন। সেনেগালের উসমান সেমবেন আফ্রিকার মানুষের কথাই বলেছেন।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ স্প্যানিশ ভাষায় লাতিন আমেরিকার গল্পটাই শুনিয়েছেন। আর এর ভেতর দিয়ে তাঁরা স্থানিক উপাদানকে মিলিয়ে দিয়েছেন বৈশ্বিক সংবেদনশীলতায়। এ কারণেই তাঁরা নমস্য। এ কারণেই তাঁরা বিশ্বমানব। আমরাও বিশ্বমানব হতে চাই।
আমরা ভাবছি ইংরেজিই সেই জাদুকাঠি, যার মাধ্যমে আমরা বিশ্বের দরবারে পৌঁছাব। পৌঁছানো যাবে ঠিকই, তবে তাতে দেয়ালের ওপর আরও একটি ইট যুক্ত হবে কেবল। আলাদা মিনার গড়ে উঠবে না।
এসব যুক্তি শুনতে নারাজ আমাদের দেশের হর্তাকর্তা ও প্রভুরা। তাদের আরও বেশি ইংরেজি মাধ্যম চাই, এমনকি ইংরেজি মাধ্যমের মাদ্রাসাও চাই। এই অদ্ভুত চাওয়া যে জাতি হিসেবে আমাদের সব অর্জনকে শূন্য করে দিয়ে বিশাল গহ্বরের দিকে ঠেলে দিচ্ছে, সে খবর কে রাখে? কেবল ফেব্রুয়ারি মাস এলেই দেখবেন কুমিরের ক্রন্দন। আরও আজব ঠেকে, যখন কোনো ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করা হয়। তাও আবার ভাষাশহীদ দিবস নামে নয়, পালন করা হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ গানটাও গাওয়া হয়। এসব করে যে একুশে ফেব্রুয়ারির মূল চেতনার সঙ্গে বেইমানি করা হচ্ছে, সেটা কি তারা বোঝে না? বুঝেশুনেই কি ভাষাশহীদ দিবসকে বিদায় করে তার জায়গায় এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে? এখানে সূক্ষ্ম শুভংকরের ফাঁকিটা কি আমরা ধরতে পারছি?
ইংরেজি কেজো ভাষা। ইংরেজি জানা থাকলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা সহজ। আয়-উপার্জনেও সুবিধা হয়। এই সত্য কে অস্বীকার করছে? যত বেশি ভাষা জানা থাকবে, তত বেশি জ্ঞানার্জন হবে। প্রশ্ন হলো ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ অনেক ভাষা জানতেন বলে কি বাংলা ভুলে গিয়েছিলেন? না তিনি বাংলা কম জানতেন? পরিতাপের বিষয় আজকের ইংরেজি পড়ুয়া প্রজন্ম কিন্তু বাংলাটা ভুলে যাচ্ছে। তারা বাংলা ভালো করে পড়তেও পারে না।
তাই বাংলা বই কিনতেও চায় না। তাহলে বইমেলায় তিন-চার হাজার বই বের করে লাভটা কী, যদি আমাদের বর্তমান প্রজন্ম সেই ভাষার বই পড়তেই না পারে? কিনতেই না চায়? দেশের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে ওঠা বইয়ের দোকানেও দেখবেন থরে থরে ইংরেজি বই এবং সেগুলোর অধিকাংশই থ্রিলার-হরর-রোমান্টিক ঘরানার বই। ইংরেজিতেও যে এ দেশের মানুষ খুব গভীর চিন্তাশীল বইপত্র পড়ছে, তা-ও কিন্তু নয়।
বাংলার প্রতি অবহেলার কারণে আমরা একদিকে বিশ্বমানের শিল্প সৃষ্টি করতে পারছি না। অপরদিকে, ভালো সাহিত্য বাংলায় অনুবাদও করতে পারছি না। চীনা, জাপানি বা রুশরা কিন্তু নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে বিশ্বের অনেক ধ্রুপদি সাহিত্য পড়ে ফেলেছে। আমাদের এখানে অনুবাদ হলেও, বাংলায় দুর্বলতার দরুন অধিকাংশ অনুবাদ সাহিত্যই হয়ে পড়ে পাঠের অযোগ্য।
কাজেই একদিকে আমরা সৃষ্টি করতে পারছি না, অপরদিকে অন্যদের অনন্য সৃষ্টির স্বাদও আমরা ভালো করে নিতে পারছি না। আর কে না জানে, অনুবাদকর্ম মূলত আরেকটি নতুন সাহিত্যকর্মই। তাই অনুবাদ যিনি করবেন তাঁর মূল ভাষা ও উদ্দিষ্ট ভাষার ওপর দখল থাকা অত্যন্ত জরুরি। আসলে একটি ভাষায় তখনই অনুবাদ সাহিত্য ভালো পাওয়া যায়, যখন সেই ভাষায় দক্ষ সাহিত্যিক, লেখক ও সাংবাদিক থাকেন।
ভাষা কিন্তু শুধু শুদ্ধ করে লেখার ব্যাপার নয়। ভাষাকে শুদ্ধ করে বলারও একটা ব্যাপার রয়েছে। প্রমিত উচ্চারণের ক্ষেত্রেও আমাদের ভেতর উদাসীনতা লক্ষ করা যায়। আমরা এই লেখার শুদ্ধতা নিয়ে অনেকটা ভাবলেও, বলার শুদ্ধতা নিয়ে একেবারেই ভাবি না বললে চলে। আবৃত্তি দলের সভ্য হলে এই শুদ্ধ উচ্চারণ শেখার সুযোগ হয়। কিন্তু সেই সুযোগ তো সবাই পায় না। এর সমাধান হতে পারে, আমরা যদি নবম ও দশম শ্রেণিতে ছেলেমেয়েদের বাংলা উচ্চারণ শেখার জন্য বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ের সঙ্গে একটি ব্যবহারিক ক্লাস জুড়ে দিই। আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে জোর দেওয়া হয় লেখা, পড়া ও শোনার ওপর। কিন্তু বলার ওপর জোর দিলে ভাষা শেখার ষোলোকলা পূর্ণ হয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভাষা শেখার ক্ষেত্রে দেখা যায় পড়া-লেখা-বলা-শোনা এই চারের ওপর মনোযোগ দিতে। এমনকি ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিল বলি, কিংবা আলিয়ঁস ফ্রঁসেজ, সেখানে ইংরেজি ও ফরাসি শেখানো হয় এই চারটি দক্ষতাকে বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। তাই আমার প্রস্তাব, বাংলাদেশে শুদ্ধ উচ্চারণের জন্য মাধ্যমিক স্তরে বাংলা ব্যবহারিক চালু করা হোক। বাংলা নিয়ে এসব কথা অরণ্যে রোদন হলেও, আমি বারবারই কথাগুলো বলে যেতে চাই।
লেখক: চলচ্চিত্র সমালোচক
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
২০ ঘণ্টা আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১ দিন আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৫ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৮ দিন আগে