শাইখ সিরাজ
সারা পৃথিবীতেই চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। প্রতিদিন বেড়ে চলেছে জিনিসপত্রের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে সারের মূল্য। তার প্রভাব পড়েছে আমাদের কৃষি খাতেও। জ্বালানির দাম বেড়েছে, বেড়েছে ইউরিয়া সারের দাম, বেড়েছে লোডশেডিং। ফলে স্বাভাবিক সময় থেকে একটা বাজে সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে আমাদের। দুর্মূল্যের বাজারে হিসেবি হতে হয়। কমাতে হয় অপচয়। সারের ক্ষেত্রেও আমাদের অপচয় কমাতে হবে। ফসলে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সার প্রয়োগে ফলন কমে। মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘খাঁটি সোনার চেয়েও খাঁটি আমার দেশের মাটি...’। সত্যি, আমার দেশের মাটি সোনার চেয়ে খাঁটি। এ মাটির উর্বরতা শক্তি বিশ্বের বিস্ময় ছিল। নদীবিধৌত পলি জমা উর্বর মাটিতে সহজেই ফলত সোনার ফসল। কিন্তু আমরাই দিন দিন মাটিকে দূষিত করে তুলেছি, নষ্ট করে ফেলেছি এর উর্বরতা শক্তি। বর্ধিত জনসংখ্যার মুখে খাদ্য তুলে দিতে অধিক ফসল ফলানোর জন্য জমিতে প্রয়োগ করতে হচ্ছে রাসায়নিক সার। অন্যদিকে অধিক কর্ষণে মাটি হারিয়েছে তার উর্বরতা শক্তি, নষ্ট হয়েছে জৈবগুণ। সময়ের সঙ্গে বেড়েছে ফসলবৈচিত্র্য। কিন্তু কোন জমিতে কোন ফসল চাষ করলে কী পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে, সে-সম্পর্কে কৃষকের তেমন জানা-বোঝা নেই। সত্যি বলতে, সরকারের কৃষি বিভাগের লোকজনও এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন না।
কয়েক বছর ধরেই ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর অনুষ্ঠানগুলোতে আমি কৃষকের কাছে জানতে চেয়েছি তাঁরা মাটি পরীক্ষা করেন কি না। ১ শতাংশের কম কৃষক বলেছেন তাঁরা মাটি পরীক্ষা করেন। সবচেয়ে হতাশার বিষয়, মাটি পরীক্ষার বিষয় সম্পর্কে ধারণা রাখেন—এমন কৃষকের সংখ্যা শতকরা ৫ জনও পাইনি। অথচ এই মানুষগুলোরই জানা দরকার ছিল জৈব পদার্থই হলো মাটির প্রাণ। শস্য উৎপাদন এবং উৎপাদনশীলতা রক্ষার্থে প্রয়োজন মাটিতে শতকরা ৫ ভাগ জৈব সার থাকা। এই না জানার ফলে তাঁরা বছরের পর বছর ধরে অতিরিক্ত সার আর কীটনাশক ব্যবহার করেছেন। এতে অধিকাংশ এলাকার মাটির জৈব পদার্থ নেমে এসেছে শতকরা ১ ভাগের নিচে—যা ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক বিরাট হুমকিস্বরূপ। আমি আশাবাদী মানুষ, আমি জানি আর সব সংকটের মতো এই সংকট থেকেও আমাদের কৃষকেরা ক্রমে বের হয়ে আসবেন। এর জন্য চাই উদ্যোগ। যাঁরা এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে ভেতরে-ভেতরে কাজ করছেন, তাঁদের আমরা হৃদয়ে মাটি ও মানুষের নিয়মিত অভিযান গ্রো-গ্রিনে অনেকবার তুলে ধরেছি; যা দেশের বহু কৃষক, কৃষি উদ্যোক্তা, তরুণকে অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁদের বুঝতে শিখিয়েছে, আজকের দিনে উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন কৃষিচর্চার বিকল্প নেই। উপায় নেই মাটিকে বাঁচানোর চিন্তা থেকে দূরে সরে আসার। টেলিভিশনের কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠানগুলো অনুপ্রাণিত করেছে অসংখ্য তরুণকে। তাঁরা কৃষির পরিবর্তনে নিয়েছেন নানা রকম উদ্যোগ।
ফসল পেতে হলে সার প্রয়োগ করতেই হবে। কিন্তু বেশি ফলন পেতে বেশি বেশি রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে আমরা কি মাটির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারছি? মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ফসলের বেশি ফলনের প্রশ্নে সার প্রয়োগের আধুনিক অনুশীলনগুলো নিয়ে বেশ কিছুদিন আগে কথা বলেছিলাম বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সোহেলা আখতারের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, একটি গাছ বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে ফল দেওয়া পর্যন্ত জীবনচক্রে মাটি থেকে ১৭টি উপাদান গ্রহণ করে। এর কোনো উপাদান কম হলেই স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। আবার কোনো উপাদান বেশি হলেও উদ্ভিদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা জরুরি।
আমি প্রায়ই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষকের কাছে জানতে চেয়েছি মাটি পরীক্ষার বিষয়টি। দেখেছি অনেক কৃষকই এ ব্যাপারে অবগত নন। আবার যাঁরা মাটি পরীক্ষা করাতে চান, তাঁরাও সহজে পরীক্ষা করাতে পারছেন না। অনেকের অভিযোগ, মাটি পরীক্ষার ফল হাতে পেতে পেতে ফসলের মৌসুম চলে যায়। এ ব্যাপারে সরকারের কার্যকর উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি।
গত এপ্রিলে নেদারল্যান্ডসে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেখানে মাটির সুরক্ষা নিয়ে কাজ করে, এমন একটি প্রতিষ্ঠান রয়্যাল আইকোলকাম্প। তারা মাটির সুস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে। সেই প্রতিষ্ঠানের তরুণ গবেষক বব বলছিলেন, মাটিতে কী পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে কিংবা আদৌ সার প্রয়োগের প্রয়োজন আছে কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে তাঁরা কৃষিকাজ করেন না। রাসায়নিক সার বেশি প্রয়োগের ফলে মাটি তার স্বাভাবিকত্ব হারিয়ে ফেলে। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের চর্চাটি নেই। বব বলছিলেন, জৈব সার ব্যবহারে রাসায়নিক সারের প্রয়োগ কমানো সম্ভব। ববের কথায় মনে পড়ছিল বছর চারেক আগে রাজশাহীতে জৈব সারের প্রয়োগ নিয়ে কাজকর্ম দেখতে গিয়েছিলাম। কামরুল ইসলাম রিপন নামের এক তরুণের উদ্যোগে সেখানকার কৃষকেরা মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে জৈব সার ও রাসায়নিক সারের ভারসাম্যপূর্ণ প্রয়োগের মাধ্যমে বেশ লাভবান হচ্ছিলেন। সেখানে পেয়ারাচাষি আমিনুল ইসলাম তাঁর সার প্রয়োগের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলছিলেন, তিন বিঘা জমি লিজ নিয়ে তিনি পেয়ারা চাষ করছেন তিন বছর ধরে। প্রথম বছর বেশ ভালো ফলন হয়।
কিন্তু দ্বিতীয় বছরে এসে ফলন কমে যায়। এরপর মাটি পরীক্ষা করে জৈব সার প্রয়োগ করেন। জৈব সার ব্যবহার করার ফলে তাঁর ফলন ভালো হয়। উৎপাদন খরচ কমে যায়। পেয়ারার আকারও বড় হয়। আগে যেখানে একটা পেয়ারার আকার হতো ৩০০-৪০০ গ্রাম। সে বছর পেয়েছেন ৬০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ওজনের পেয়ারা। আমিনুলের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘উৎপাদন খরচ কীভাবে কমল?’ উত্তরে জানিয়েছিলেন, জৈব সার ব্যবহার করার ফলে রাসায়নিক সার কম দিতে হয়। জৈব সারের খরচ ৬০০ টাকা হলে টিএসপিতে খরচ হতো ১ হাজার ২০০ টাকা। পাশেই ছিলেন পেয়ারাচাষি আতাউর রহমান। তিনি বলছিলেন, সাড়ে ৪ বিঘা জমিতে এ বছর পেয়ারা উৎপাদনে তিনি খরচ করেছেন ৩ লাখ টাকা, আর পেয়ারা বিক্রি করেছেন ১০ লাখ টাকার। জৈব সার ব্যবহারের কারণেই তাঁর পেয়ারার ফলন সে বছর ভালো হয়। পেঁয়াজচাষি হিমেল শুনিয়েছিলেন তাঁর লাভের গল্প। তিনি বলেছিলেন, জৈব সার ব্যবহারে রাসায়নিক সার যেমন কম প্রয়োগ করতে হয়, তেমনি সেচও কম লাগে। এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষে আগে খরচ হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। পেঁয়াজ পেয়েছিলেন ৭০ মণ। জৈব সার ব্যবহারের কারণে খরচ হয়েছে ২২ হাজার টাকা। পেঁয়াজ পেয়েছেন ১২০ মণ।
মাটির অবস্থা ও ফসলের প্রকৃতি যাচাই-বাছাই করেই চাষাবাদ করা প্রয়োজন। অধিক সার প্রয়োগ না করে অপচয় কমিয়ে পরিমিত সারের ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে ফলন যেমন বাড়বে, কমবে উৎপাদন খরচও।
মাটির সুস্থতাই নিশ্চিত করে সুস্থ ফসলের তথা নিরাপদ খাদ্যের। আগামী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে টেকসই কৃষির তাগিদে আমাদের এখন থেকেই মাটির সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি কৃষকের দায়িত্ব রয়েছে মাটির স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করার। টেকসই ব্যবস্থাপনার আলোকে ফসলের বেশি ফলন নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে মাটির স্বাস্থ্যও টিকিয়ে রাখা জরুরি। ভারসাম্যপূর্ণ সারের ব্যবহার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আরও বেশি কৃষক সচেতনতার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে; বিশেষ করে মাত্রাতিরিক্ত সারের প্রয়োগ, সুষম মাত্রা ও ব্যবস্থাপনা অনুসরণ না করায় যেসব কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তাঁদের সচেতন করে তোলাটা অনেক বেশি জরুরি। সারের সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিতকরণে সরকারের কৃষি বিভাগ কৃষকদের সহায়তা করবে—এমনটাই আমার প্রত্যাশা।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান চ্যানেল আই
সারা পৃথিবীতেই চলছে অর্থনৈতিক মন্দা। প্রতিদিন বেড়ে চলেছে জিনিসপত্রের দাম। আন্তর্জাতিক বাজারে বেড়েছে সারের মূল্য। তার প্রভাব পড়েছে আমাদের কৃষি খাতেও। জ্বালানির দাম বেড়েছে, বেড়েছে ইউরিয়া সারের দাম, বেড়েছে লোডশেডিং। ফলে স্বাভাবিক সময় থেকে একটা বাজে সময়ের ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে আমাদের। দুর্মূল্যের বাজারে হিসেবি হতে হয়। কমাতে হয় অপচয়। সারের ক্ষেত্রেও আমাদের অপচয় কমাতে হবে। ফসলে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সার প্রয়োগে ফলন কমে। মাটির উর্বরতা শক্তি নষ্ট হয়।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘খাঁটি সোনার চেয়েও খাঁটি আমার দেশের মাটি...’। সত্যি, আমার দেশের মাটি সোনার চেয়ে খাঁটি। এ মাটির উর্বরতা শক্তি বিশ্বের বিস্ময় ছিল। নদীবিধৌত পলি জমা উর্বর মাটিতে সহজেই ফলত সোনার ফসল। কিন্তু আমরাই দিন দিন মাটিকে দূষিত করে তুলেছি, নষ্ট করে ফেলেছি এর উর্বরতা শক্তি। বর্ধিত জনসংখ্যার মুখে খাদ্য তুলে দিতে অধিক ফসল ফলানোর জন্য জমিতে প্রয়োগ করতে হচ্ছে রাসায়নিক সার। অন্যদিকে অধিক কর্ষণে মাটি হারিয়েছে তার উর্বরতা শক্তি, নষ্ট হয়েছে জৈবগুণ। সময়ের সঙ্গে বেড়েছে ফসলবৈচিত্র্য। কিন্তু কোন জমিতে কোন ফসল চাষ করলে কী পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে, সে-সম্পর্কে কৃষকের তেমন জানা-বোঝা নেই। সত্যি বলতে, সরকারের কৃষি বিভাগের লোকজনও এ বিষয়ে সচেতন ছিলেন না।
কয়েক বছর ধরেই ‘কৃষি বাজেট কৃষকের বাজেট’-এর অনুষ্ঠানগুলোতে আমি কৃষকের কাছে জানতে চেয়েছি তাঁরা মাটি পরীক্ষা করেন কি না। ১ শতাংশের কম কৃষক বলেছেন তাঁরা মাটি পরীক্ষা করেন। সবচেয়ে হতাশার বিষয়, মাটি পরীক্ষার বিষয় সম্পর্কে ধারণা রাখেন—এমন কৃষকের সংখ্যা শতকরা ৫ জনও পাইনি। অথচ এই মানুষগুলোরই জানা দরকার ছিল জৈব পদার্থই হলো মাটির প্রাণ। শস্য উৎপাদন এবং উৎপাদনশীলতা রক্ষার্থে প্রয়োজন মাটিতে শতকরা ৫ ভাগ জৈব সার থাকা। এই না জানার ফলে তাঁরা বছরের পর বছর ধরে অতিরিক্ত সার আর কীটনাশক ব্যবহার করেছেন। এতে অধিকাংশ এলাকার মাটির জৈব পদার্থ নেমে এসেছে শতকরা ১ ভাগের নিচে—যা ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে এক বিরাট হুমকিস্বরূপ। আমি আশাবাদী মানুষ, আমি জানি আর সব সংকটের মতো এই সংকট থেকেও আমাদের কৃষকেরা ক্রমে বের হয়ে আসবেন। এর জন্য চাই উদ্যোগ। যাঁরা এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে ভেতরে-ভেতরে কাজ করছেন, তাঁদের আমরা হৃদয়ে মাটি ও মানুষের নিয়মিত অভিযান গ্রো-গ্রিনে অনেকবার তুলে ধরেছি; যা দেশের বহু কৃষক, কৃষি উদ্যোক্তা, তরুণকে অনুপ্রাণিত করেছে। তাঁদের বুঝতে শিখিয়েছে, আজকের দিনে উন্নত প্রযুক্তিসম্পন্ন কৃষিচর্চার বিকল্প নেই। উপায় নেই মাটিকে বাঁচানোর চিন্তা থেকে দূরে সরে আসার। টেলিভিশনের কৃষিবিষয়ক অনুষ্ঠানগুলো অনুপ্রাণিত করেছে অসংখ্য তরুণকে। তাঁরা কৃষির পরিবর্তনে নিয়েছেন নানা রকম উদ্যোগ।
ফসল পেতে হলে সার প্রয়োগ করতেই হবে। কিন্তু বেশি ফলন পেতে বেশি বেশি রাসায়নিক সার প্রয়োগ করে আমরা কি মাটির স্বাস্থ্য ভালো রাখতে পারছি? মাটির স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ফসলের বেশি ফলনের প্রশ্নে সার প্রয়োগের আধুনিক অনুশীলনগুলো নিয়ে বেশ কিছুদিন আগে কথা বলেছিলাম বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সোহেলা আখতারের সঙ্গে। তিনি বলেছেন, একটি গাছ বেড়ে ওঠা থেকে শুরু করে ফল দেওয়া পর্যন্ত জীবনচক্রে মাটি থেকে ১৭টি উপাদান গ্রহণ করে। এর কোনো উপাদান কম হলেই স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। আবার কোনো উপাদান বেশি হলেও উদ্ভিদের জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ফলে মাটির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা জরুরি।
আমি প্রায়ই দেশের বিভিন্ন প্রান্তের কৃষকের কাছে জানতে চেয়েছি মাটি পরীক্ষার বিষয়টি। দেখেছি অনেক কৃষকই এ ব্যাপারে অবগত নন। আবার যাঁরা মাটি পরীক্ষা করাতে চান, তাঁরাও সহজে পরীক্ষা করাতে পারছেন না। অনেকের অভিযোগ, মাটি পরীক্ষার ফল হাতে পেতে পেতে ফসলের মৌসুম চলে যায়। এ ব্যাপারে সরকারের কার্যকর উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে বলে আমি মনে করি।
গত এপ্রিলে নেদারল্যান্ডসে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল আমার। সেখানে মাটির সুরক্ষা নিয়ে কাজ করে, এমন একটি প্রতিষ্ঠান রয়্যাল আইকোলকাম্প। তারা মাটির সুস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে। সেই প্রতিষ্ঠানের তরুণ গবেষক বব বলছিলেন, মাটিতে কী পরিমাণ সার প্রয়োগ করতে হবে কিংবা আদৌ সার প্রয়োগের প্রয়োজন আছে কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে তাঁরা কৃষিকাজ করেন না। রাসায়নিক সার বেশি প্রয়োগের ফলে মাটি তার স্বাভাবিকত্ব হারিয়ে ফেলে। কিন্তু আমাদের দেশে এ ধরনের চর্চাটি নেই। বব বলছিলেন, জৈব সার ব্যবহারে রাসায়নিক সারের প্রয়োগ কমানো সম্ভব। ববের কথায় মনে পড়ছিল বছর চারেক আগে রাজশাহীতে জৈব সারের প্রয়োগ নিয়ে কাজকর্ম দেখতে গিয়েছিলাম। কামরুল ইসলাম রিপন নামের এক তরুণের উদ্যোগে সেখানকার কৃষকেরা মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে জৈব সার ও রাসায়নিক সারের ভারসাম্যপূর্ণ প্রয়োগের মাধ্যমে বেশ লাভবান হচ্ছিলেন। সেখানে পেয়ারাচাষি আমিনুল ইসলাম তাঁর সার প্রয়োগের অভিজ্ঞতা নিয়ে বলছিলেন, তিন বিঘা জমি লিজ নিয়ে তিনি পেয়ারা চাষ করছেন তিন বছর ধরে। প্রথম বছর বেশ ভালো ফলন হয়।
কিন্তু দ্বিতীয় বছরে এসে ফলন কমে যায়। এরপর মাটি পরীক্ষা করে জৈব সার প্রয়োগ করেন। জৈব সার ব্যবহার করার ফলে তাঁর ফলন ভালো হয়। উৎপাদন খরচ কমে যায়। পেয়ারার আকারও বড় হয়। আগে যেখানে একটা পেয়ারার আকার হতো ৩০০-৪০০ গ্রাম। সে বছর পেয়েছেন ৬০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ওজনের পেয়ারা। আমিনুলের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘উৎপাদন খরচ কীভাবে কমল?’ উত্তরে জানিয়েছিলেন, জৈব সার ব্যবহার করার ফলে রাসায়নিক সার কম দিতে হয়। জৈব সারের খরচ ৬০০ টাকা হলে টিএসপিতে খরচ হতো ১ হাজার ২০০ টাকা। পাশেই ছিলেন পেয়ারাচাষি আতাউর রহমান। তিনি বলছিলেন, সাড়ে ৪ বিঘা জমিতে এ বছর পেয়ারা উৎপাদনে তিনি খরচ করেছেন ৩ লাখ টাকা, আর পেয়ারা বিক্রি করেছেন ১০ লাখ টাকার। জৈব সার ব্যবহারের কারণেই তাঁর পেয়ারার ফলন সে বছর ভালো হয়। পেঁয়াজচাষি হিমেল শুনিয়েছিলেন তাঁর লাভের গল্প। তিনি বলেছিলেন, জৈব সার ব্যবহারে রাসায়নিক সার যেমন কম প্রয়োগ করতে হয়, তেমনি সেচও কম লাগে। এক বিঘা জমিতে পেঁয়াজ চাষে আগে খরচ হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। পেঁয়াজ পেয়েছিলেন ৭০ মণ। জৈব সার ব্যবহারের কারণে খরচ হয়েছে ২২ হাজার টাকা। পেঁয়াজ পেয়েছেন ১২০ মণ।
মাটির অবস্থা ও ফসলের প্রকৃতি যাচাই-বাছাই করেই চাষাবাদ করা প্রয়োজন। অধিক সার প্রয়োগ না করে অপচয় কমিয়ে পরিমিত সারের ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে ফলন যেমন বাড়বে, কমবে উৎপাদন খরচও।
মাটির সুস্থতাই নিশ্চিত করে সুস্থ ফসলের তথা নিরাপদ খাদ্যের। আগামী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে টেকসই কৃষির তাগিদে আমাদের এখন থেকেই মাটির সুরক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। পাশাপাশি কৃষকের দায়িত্ব রয়েছে মাটির স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করার। টেকসই ব্যবস্থাপনার আলোকে ফসলের বেশি ফলন নিশ্চিত করার সঙ্গে সঙ্গে মাটির স্বাস্থ্যও টিকিয়ে রাখা জরুরি। ভারসাম্যপূর্ণ সারের ব্যবহার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আরও বেশি কৃষক সচেতনতার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে; বিশেষ করে মাত্রাতিরিক্ত সারের প্রয়োগ, সুষম মাত্রা ও ব্যবস্থাপনা অনুসরণ না করায় যেসব কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তাঁদের সচেতন করে তোলাটা অনেক বেশি জরুরি। সারের সাশ্রয়ী ব্যবহার নিশ্চিতকরণে সরকারের কৃষি বিভাগ কৃষকদের সহায়তা করবে—এমনটাই আমার প্রত্যাশা।
লেখক: পরিচালক ও বার্তাপ্রধান চ্যানেল আই
প্রবৃদ্ধির শীর্ষে থেকেও বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের দৌড়ে পিছিয়ে রয়েছে। ২০১৪ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি ৫০ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেড়েছে
৭ ঘণ্টা আগেদুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি, উচ্চ করহারসহ ১৭ ধরনের বাধায় বিপর্যস্ত দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য। রয়েছে সামাজিক সমস্যাও।
১০ ঘণ্টা আগেজমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৪ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৮ দিন আগে