এম এ ওয়াজেদ মিয়া
১০ জানুয়ারি (১৯৭২) বঙ্গবন্ধুর শুভাগমনের খবর শুনে পুরো ঢাকার মানুষ আনন্দ ও উচ্ছ্বাস-উল্লাসে ফেটে পড়ে। সকালে হাজার হাজার লোক রাস্তায় নেমে পড়ে। দলে দলে কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধ, ফেস্টুন, ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’সংবলিত ব্যানারসহ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হাতে রেসকোর্স ও তেজগাঁও বিমানবন্দরের দিকে আসতে থাকে।
দুপুরের মধ্যে লাখ লাখ মানুষের সমাগমে রেসকোর্স ময়দান ভরে যায়। রেসকোর্স ময়দান থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত রাস্তা হয়ে যায় লোকে লোকারণ্য। বিমানবন্দরের ভেতরেও হাজার হাজার লোক অবস্থান নেয়। এত জনতার সমাবেশ ইতিপূর্বে কখনো ঘটেনি। মুশকিলে পড়লেন পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা। ইতিমধ্যে একটা গুজব ছড়িয়ে গিয়েছিল যে বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স আসার পথে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেষ্টা করা হতে পারে। একে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়ারও দরকার ছিল। কেননা, রাজাকার, আলবদর, আলশামসের ধর্মোন্মত্ত পাকিস্তানি বহু এজেন্ট তখনো ঘুরে বেড়াচ্ছিল। নিরাপত্তা বিভাগের পরামর্শ ছিল বঙ্গবন্ধুকে আর্মাড কারে করে এয়ারপোর্ট থেকে রেসকোর্স ময়দানে নিয়ে আসার জন্য। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা দ্রুত মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিল যে দায়িত্ব নিরাপত্তা বাহিনীর চেয়ে তাদেরই বেশি। অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্ব তারা নিল। এয়ারপোর্ট থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত পুরো রুটেই তারা অবস্থান নিল। বিভিন্নভাবে অবস্থান নিয়েছিল তারা। গুরুত্বপূর্ণ, কম গুরুত্বপূর্ণনির্বিশেষে সবগুলো জায়গায় গিয়ে এবং জনতার সঙ্গে মিশে তারা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল।
বেলা ৩টায় ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর বিশেষ (সাদা কমেট) বিমানটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এরপর সেখানে সমবেত লাখ লাখ জনতা আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ে। তারা শোকরানা জানায় মহান আল্লাহ তাআলার দরবারে। বিমানবন্দরের ভেতরেও ছিল হাজার হাজার মানুষ। বিমান থেকে অবতরণের সিঁড়ির মুখে কোনো রকমে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা। তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ প্রমুখ ছাত্রনেতা এক এক করে বিমানে উঠে বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে রেখে মাল্যভূষিত করে। বঙ্গবন্ধুসহ প্রত্যেকে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন। এয়ারপোর্ট থেকে একটি ডজ ট্রাকে বঙ্গবন্ধুকে রেসকোর্স ময়দানে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, ছাত্রনেতাসহ প্রায় বিশ-পঁচিশ জন ট্রাকের ওপর বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে রেখেছিলেন। হৃদয়ের গভীর থেকে মানুষের গলায় তালে তালে ভেসে আসতে থাকে শুভাশীষ ধ্বনি, ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ, শেখ মুজিব জিন্দাবাদ, জয় বাংলা’। লোকের প্রচণ্ড ভিড়ে গাড়িটি অতি মন্থর গতিতে রেসকোর্স ময়দানের দিকে এগোয়। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত এতটুকু রাস্তা অতিক্রম করতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লেগে যায়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ওই ট্রাকটি রেসকোর্স ময়দানের জনসভাস্থলে পৌঁছায় পৌনে ৫টার দিকে। বঙ্গবন্ধুর গলায় তখন এত ফুলের মালা যে তাঁকে আর দেখাই যাচ্ছিল না।
রেসকোর্সে পৌঁছাতেই বঙ্গবন্ধু দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেলেন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ব্যূহের মতো করে তাঁকে বেষ্টনীতে নিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ করে সভামঞ্চে উঠে তোফায়েল আহমেদ বললেন, ‘ভাইসব, বঙ্গবন্ধু মঞ্চের দিকে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আপনাদের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। কিন্তু তার আগে বঙ্গবন্ধু এবং আমাদের সবার নিরাপত্তার জন্য দয়া করে প্রত্যেকে বসে পড়ুন। হাত দুটোকে মাটির ওপর রাখুন। সঙ্গে সঙ্গে নজর রাখুন আপনার আশপাশের প্রত্যেকের ওপর। খুনির হাত যেকোনো জায়গা থেকে উঠে আসতে পারে। কড়া নজর রাখবেন।’ এর একটু পরেই মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু। উত্তেজনায় সবার নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। পুরো রেসকোর্স ময়দান ভরা মানুষগুলো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে সামনে তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেই দেখছেন। উত্তেজনায় উদ্বেল আনন্দধ্বনি ক্রমেই বেড়ে চলল। ওই অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধু বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর বঙ্গবন্ধু বললেন, ১৯৭১ সালের সাতই মার্চ এই ময়দানে আমি আপনাদের বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আপনারা বাংলাদেশের মানুষের সেই স্বাধীনতা জয় করে এনেছেন।
আজ আবার বলছি, আপনারা সবাই এই ঐক্য বজায় রাখুন। ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। একজন বাঙালিও প্রাণ থাকতে এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবে না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই টিকে থাকবে।’ অতঃপর বঙ্গবন্ধু ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আজ সোনার বাংলার কোটি কোটি মানুষ গৃহহারা, আশ্রয়হারা। তারা নিঃসম্বল। আমি মানবতার খাতিরে বিশ্ববাসীর প্রতি বাংলাদেশের এই দুঃখী মানুষদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসতে অনুরোধ করছি। আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায়, খাবার না পায়, যুবকেরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে আমাদের এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে–পূর্ণ হবে না। আমাদের এখন তাই অনেক কাজ করতে হবে। যুদ্ধ চলাকালে রাস্তাঘাট নষ্ট হয়ে গেছে, শত শত সড়ক-পুল, রেলওয়ে ব্রিজ ধ্বংস হয়ে গেছে। হাজার হাজার স্কুল-কলেজ, কলকারখানা, দোকানপাট হানাদার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর লোকেরা ধ্বংস করে দিয়েছে। অফিস, ব্যাংক ও ট্রেজারিগুলো লুট করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পর্যুদস্ত করেছে।’
পশ্চিম পাকিস্তানে জেলখানায় তাঁর বন্দিদশা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনারা জানেন যে, আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবরও খোঁড়া হয়েছিল। আমি মুসলমান। আমি জানি মুসলমান মাত্র একবারই মরে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের নিকট নতি স্বীকার করব না। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’
এরপর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইয়েরা, আপনাদের প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নাই। আমি কামনা করি আপনারা সুখে থাকুন। আপনাদের সেনাবাহিনী আমাদের লাখ লাখ লোককে হত্যা করেছে, লাখ লাখ মা-বোনদের মর্যাদাহানি করেছে, আমাদের গ্রামগুলো বিধ্বস্ত করেছে।
তবুও আপনাদের প্রতি আমার কোনো আক্রোশ নাই।’ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি কী হবে তা ব্যাখ্যা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ। ইন্দোনেশিয়ার পরেই এর স্থান। মুসলিম সংখ্যার দিক দিয়ে ভারতের স্থান তৃতীয় এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস, পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ইসলামের নামে এ দেশের মুসলমানদের হত্যা করেছে, আমাদের নারীদের বে-ইজ্জত করেছে। ইসলাম ধর্মের অবমাননা আমরা চাই না। আমি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছি, আমাদের দেশ হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক দেশ। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে। যার যা ধর্ম তা স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পালন করবে।’ দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর সংক্ষিপ্ত আলাপের কথা উল্লেখ করে অতঃপর বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তাঁর সঙ্গে আমি দিল্লিতে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করেছি। আমি যখনই চাইব, ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে তার সৈন্যবাহিনী তখনই প্রত্যাহার করে নেবে। ইতিমধ্যেই ভারতীয় সৈন্যের একটা বিরাট অংশ বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
এরপর মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘প্রায় এক কোটি মানুষ যাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং বাকি যাঁরা দেশে রয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই অনেক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছেন। আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা রক্ত দিয়েছেন, সেই বীর মুক্তিবাহিনী, ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক সমাজ, বাংলার হিন্দু-মুসলমান, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পুলিশ, আনসার বাহিনীর সদস্যবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী ও নাম না-জানা লাখ লাখ নর-নারী তাঁদের সবাইকে আমার সালাম জানাই। আপনাদের মুজিব ভাই আহ্বান জানিয়েছিলেন আর সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে আপনারা যুদ্ধ করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন।’ বক্তৃতার এই পর্যায়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘রেখেছ বাঙালি ক’রে মানুষ কর নি’ উদ্ধৃত করে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এবার নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালি পুড়ে সোনার মানুষ হয়ে উঠেছে। কবিগুরুর খেদোক্তির জবাবে আপনারা প্রমাণ করেছেন যে বাঙালি বীরের জাতি। পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাদের পদানত করতে পারবে না।’
(এম এ ওয়াজেদ মিয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা ১১৮-১২১)
এম এ ওয়াজেদ মিয়া: পরমাণুবিজ্ঞানী ও বঙ্গবন্ধুর কন্যা-জামাতা
১০ জানুয়ারি (১৯৭২) বঙ্গবন্ধুর শুভাগমনের খবর শুনে পুরো ঢাকার মানুষ আনন্দ ও উচ্ছ্বাস-উল্লাসে ফেটে পড়ে। সকালে হাজার হাজার লোক রাস্তায় নেমে পড়ে। দলে দলে কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধ, ফেস্টুন, ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’সংবলিত ব্যানারসহ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা হাতে রেসকোর্স ও তেজগাঁও বিমানবন্দরের দিকে আসতে থাকে।
দুপুরের মধ্যে লাখ লাখ মানুষের সমাগমে রেসকোর্স ময়দান ভরে যায়। রেসকোর্স ময়দান থেকে তেজগাঁও পর্যন্ত রাস্তা হয়ে যায় লোকে লোকারণ্য। বিমানবন্দরের ভেতরেও হাজার হাজার লোক অবস্থান নেয়। এত জনতার সমাবেশ ইতিপূর্বে কখনো ঘটেনি। মুশকিলে পড়লেন পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা। ইতিমধ্যে একটা গুজব ছড়িয়ে গিয়েছিল যে বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স আসার পথে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেষ্টা করা হতে পারে। একে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়ারও দরকার ছিল। কেননা, রাজাকার, আলবদর, আলশামসের ধর্মোন্মত্ত পাকিস্তানি বহু এজেন্ট তখনো ঘুরে বেড়াচ্ছিল। নিরাপত্তা বিভাগের পরামর্শ ছিল বঙ্গবন্ধুকে আর্মাড কারে করে এয়ারপোর্ট থেকে রেসকোর্স ময়দানে নিয়ে আসার জন্য। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা দ্রুত মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিল যে দায়িত্ব নিরাপত্তা বাহিনীর চেয়ে তাদেরই বেশি। অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তার দায়িত্ব তারা নিল। এয়ারপোর্ট থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত পুরো রুটেই তারা অবস্থান নিল। বিভিন্নভাবে অবস্থান নিয়েছিল তারা। গুরুত্বপূর্ণ, কম গুরুত্বপূর্ণনির্বিশেষে সবগুলো জায়গায় গিয়ে এবং জনতার সঙ্গে মিশে তারা নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল।
বেলা ৩টায় ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানবাহিনীর বিশেষ (সাদা কমেট) বিমানটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এরপর সেখানে সমবেত লাখ লাখ জনতা আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ে। তারা শোকরানা জানায় মহান আল্লাহ তাআলার দরবারে। বিমানবন্দরের ভেতরেও ছিল হাজার হাজার মানুষ। বিমান থেকে অবতরণের সিঁড়ির মুখে কোনো রকমে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা। তোফায়েল আহমেদ, শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, আ স ম আব্দুর রব, শাজাহান সিরাজ প্রমুখ ছাত্রনেতা এক এক করে বিমানে উঠে বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে রেখে মাল্যভূষিত করে। বঙ্গবন্ধুসহ প্রত্যেকে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলেন। এয়ারপোর্ট থেকে একটি ডজ ট্রাকে বঙ্গবন্ধুকে রেসকোর্স ময়দানে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, ছাত্রনেতাসহ প্রায় বিশ-পঁচিশ জন ট্রাকের ওপর বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে রেখেছিলেন। হৃদয়ের গভীর থেকে মানুষের গলায় তালে তালে ভেসে আসতে থাকে শুভাশীষ ধ্বনি, ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ, শেখ মুজিব জিন্দাবাদ, জয় বাংলা’। লোকের প্রচণ্ড ভিড়ে গাড়িটি অতি মন্থর গতিতে রেসকোর্স ময়দানের দিকে এগোয়। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত এতটুকু রাস্তা অতিক্রম করতে প্রায় দুই ঘণ্টা সময় লেগে যায়। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ওই ট্রাকটি রেসকোর্স ময়দানের জনসভাস্থলে পৌঁছায় পৌনে ৫টার দিকে। বঙ্গবন্ধুর গলায় তখন এত ফুলের মালা যে তাঁকে আর দেখাই যাচ্ছিল না।
রেসকোর্সে পৌঁছাতেই বঙ্গবন্ধু দৃষ্টির আড়ালে হারিয়ে গেলেন। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ব্যূহের মতো করে তাঁকে বেষ্টনীতে নিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ করে সভামঞ্চে উঠে তোফায়েল আহমেদ বললেন, ‘ভাইসব, বঙ্গবন্ধু মঞ্চের দিকে আসছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে আপনাদের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। কিন্তু তার আগে বঙ্গবন্ধু এবং আমাদের সবার নিরাপত্তার জন্য দয়া করে প্রত্যেকে বসে পড়ুন। হাত দুটোকে মাটির ওপর রাখুন। সঙ্গে সঙ্গে নজর রাখুন আপনার আশপাশের প্রত্যেকের ওপর। খুনির হাত যেকোনো জায়গা থেকে উঠে আসতে পারে। কড়া নজর রাখবেন।’ এর একটু পরেই মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন বঙ্গবন্ধু। উত্তেজনায় সবার নিশ্বাস যেন বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। পুরো রেসকোর্স ময়দান ভরা মানুষগুলো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না যে সামনে তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেই দেখছেন। উত্তেজনায় উদ্বেল আনন্দধ্বনি ক্রমেই বেড়ে চলল। ওই অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধু বেশ খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। তারপর বঙ্গবন্ধু বললেন, ১৯৭১ সালের সাতই মার্চ এই ময়দানে আমি আপনাদের বলেছিলাম, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলুন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। আপনারা বাংলাদেশের মানুষের সেই স্বাধীনতা জয় করে এনেছেন।
আজ আবার বলছি, আপনারা সবাই এই ঐক্য বজায় রাখুন। ষড়যন্ত্র এখনো শেষ হয়নি। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। একজন বাঙালিও প্রাণ থাকতে এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবে না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই টিকে থাকবে।’ অতঃপর বঙ্গবন্ধু ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আজ সোনার বাংলার কোটি কোটি মানুষ গৃহহারা, আশ্রয়হারা। তারা নিঃসম্বল। আমি মানবতার খাতিরে বিশ্ববাসীর প্রতি বাংলাদেশের এই দুঃখী মানুষদের সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসতে অনুরোধ করছি। আমাদের সাধারণ মানুষ যদি আশ্রয় না পায়, খাবার না পায়, যুবকেরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে আমাদের এই স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে–পূর্ণ হবে না। আমাদের এখন তাই অনেক কাজ করতে হবে। যুদ্ধ চলাকালে রাস্তাঘাট নষ্ট হয়ে গেছে, শত শত সড়ক-পুল, রেলওয়ে ব্রিজ ধ্বংস হয়ে গেছে। হাজার হাজার স্কুল-কলেজ, কলকারখানা, দোকানপাট হানাদার পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর লোকেরা ধ্বংস করে দিয়েছে। অফিস, ব্যাংক ও ট্রেজারিগুলো লুট করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের অর্থনীতিকে পর্যুদস্ত করেছে।’
পশ্চিম পাকিস্তানে জেলখানায় তাঁর বন্দিদশা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনারা জানেন যে, আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবরও খোঁড়া হয়েছিল। আমি মুসলমান। আমি জানি মুসলমান মাত্র একবারই মরে। তাই আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের নিকট নতি স্বীকার করব না। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’
এরপর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইয়েরা, আপনাদের প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ নাই। আমি কামনা করি আপনারা সুখে থাকুন। আপনাদের সেনাবাহিনী আমাদের লাখ লাখ লোককে হত্যা করেছে, লাখ লাখ মা-বোনদের মর্যাদাহানি করেছে, আমাদের গ্রামগুলো বিধ্বস্ত করেছে।
তবুও আপনাদের প্রতি আমার কোনো আক্রোশ নাই।’ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি কী হবে তা ব্যাখ্যা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশ পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম-অধ্যুষিত দেশ। ইন্দোনেশিয়ার পরেই এর স্থান। মুসলিম সংখ্যার দিক দিয়ে ভারতের স্থান তৃতীয় এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস, পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ইসলামের নামে এ দেশের মুসলমানদের হত্যা করেছে, আমাদের নারীদের বে-ইজ্জত করেছে। ইসলাম ধর্মের অবমাননা আমরা চাই না। আমি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীনভাবে বলছি, আমাদের দেশ হবে গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ও সমাজতান্ত্রিক দেশ। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে। যার যা ধর্ম তা স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পালন করবে।’ দিল্লিতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর সংক্ষিপ্ত আলাপের কথা উল্লেখ করে অতঃপর বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তাঁর সঙ্গে আমি দিল্লিতে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করেছি। আমি যখনই চাইব, ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে তার সৈন্যবাহিনী তখনই প্রত্যাহার করে নেবে। ইতিমধ্যেই ভারতীয় সৈন্যের একটা বিরাট অংশ বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।
এরপর মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন এবং মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘প্রায় এক কোটি মানুষ যাঁরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচার, নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং বাকি যাঁরা দেশে রয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা সবাই অনেক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করেছেন। আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা রক্ত দিয়েছেন, সেই বীর মুক্তিবাহিনী, ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক সমাজ, বাংলার হিন্দু-মুসলমান, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, পুলিশ, আনসার বাহিনীর সদস্যবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী ও নাম না-জানা লাখ লাখ নর-নারী তাঁদের সবাইকে আমার সালাম জানাই। আপনাদের মুজিব ভাই আহ্বান জানিয়েছিলেন আর সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে আপনারা যুদ্ধ করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছেন।’ বক্তৃতার এই পর্যায়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ‘রেখেছ বাঙালি ক’রে মানুষ কর নি’ উদ্ধৃত করে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘এবার নিশ্চয়ই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালি পুড়ে সোনার মানুষ হয়ে উঠেছে। কবিগুরুর খেদোক্তির জবাবে আপনারা প্রমাণ করেছেন যে বাঙালি বীরের জাতি। পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাদের পদানত করতে পারবে না।’
(এম এ ওয়াজেদ মিয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা ১১৮-১২১)
এম এ ওয়াজেদ মিয়া: পরমাণুবিজ্ঞানী ও বঙ্গবন্ধুর কন্যা-জামাতা
জমির মালিক হযরত শাহ্ আলী বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। তবে ওই জমিতে ৩৯১টি দোকান নির্মাণ করে কয়েক বছর ধরে ভাড়া নিচ্ছে হযরত শাহ্ আলী মহিলা ডিগ্রি কলেজ। দোকানগুলোর ভাড়া থেকে সরকারের প্রাপ্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা ভ্যাটও দেওয়া হয়নি। বিষয়টি উঠে এসেছে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে।
৩ দিন আগেকুড়িগ্রাম পৌর শহরে বাসচাপায় মোটরসাইকেল আরোহী ছোট ভাই নিহত ও বড় ভাই আহত হয়েছেন। গতকাল রোববার সকালে মৎস্য খামারের কাছে কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে দুর্ঘটনাটি ঘটে।
৭ দিন আগেবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার ওপর হামলাসহ বিভিন্ন অভিযোগের মামলায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের ১৮ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত শনিবার রাতে ও গতকাল রোববার তাঁরা গ্রেপ্তার হন।
৭ দিন আগেএক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটেছে শিল্পকলা একাডেমিতে। শিল্পকলা একাডেমির তিনটি হলেই কিছুদিন আগেও নাটক চলত। নাট্যকর্মীদের সৃজনশীলতার বহিঃপ্রকাশ ঘটত সেখানে। বহু পরিশ্রমে মাসের পর মাস নিজের খেয়ে, নিজের গাড়িভাড়া দিয়ে নাট্যকর্মীরা একেবারেই স্বেচ্ছাশ্রমে একটি শিল্প তিপ্পান্ন বছর ধরে গড়ে তুলেছেন। শিল্পকলা একাডেমি এখন
১১ দিন আগে