রেলের সিপাহি নিয়োগে ‘আয়’ ১৩ কোটি

জমির উদ্দিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১১: ০২
আপডেট : ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৩: ৫৯

রেলের সিপাহি। সেই পদে চাকরির জন্য ঘুষ দিতে হয়েছে ৬-৭ লাখ টাকা। তবে সবকিছু হয়েছে নিয়ম মেনে! মৌখিক ও শারীরিক পরীক্ষায় যাঁদের পাস দেখানো হয়েছে, ঘুষ নেওয়া হয়েছে কেবল তাঁদের কাছ থেকে। এভাবে ১৮৫ জন সিপাহি নিয়োগে ‘আয়’ হয়েছে ১৩ কোটি টাকা। সেই ঘুষের টাকা অবশ্য কেউ একা খাননি। পদ অনুসারে বণ্ঠন করা হয়েছে। তাহলে রেলের শ্রমিকনেতারা বাদ যাবেন কেন, তাঁরাও নিয়েছেন।

বাংলাদেশ রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) সিপাহি পদে নিয়োগ নিয়ে ঘুষ-দুর্নীতির এই চিত্র ফুটে উঠেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তে। এ নিয়ে দুদক চট্টগ্রাম-১-এ মামলা করেছে গত ২৮ আগস্ট।

ঘুষ দিয়ে চাকরিটা পাননি এমন একজন প্রার্থীর নাম শাহাদাত হোসেন। ঘুষ দিয়ে তালিকার ১৪ নম্বরে উঠে এসেছিলেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরির জন্য মনোনীতও হয়েছিলেন। কিন্তু নিয়োগ চূড়ান্ত করার সময় দেখা গেল, মুক্তিযোদ্ধা কোটার জন্য প্রয়োজনীয় সনদই নেই তাঁর। সবকিছু জানাজানি হওয়ার পর নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয় এই প্রার্থীর। তবে শাহাদাত হোসেনের নিয়োগ স্থগিত করা হলেও কোটায় নয়ছয় করে চাকরি দেওয়া হয়েছে অনেককেই। এ জন্য বঞ্চিত করা হয়েছে যোগ্য প্রার্থীদের।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিয়োগ পরীক্ষায় ঢাকা বিভাগের পাঁচজন চাকরি প্রার্থীকে নম্বর কমিয়ে দেওয়া হয়। তারপর মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অযোগ্য পাঁচজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। এ ছাড়া চট্টগ্রামের ১১ জন প্রার্থীকে নেওয়া হয় কোটাবহির্ভূত। অর্থাৎ কোটায় লোক পাওয়া যায়নি বলে ১১ জনকে নেওয়া হয়। অথচ কোটায় লোক ছিল।

দুদকের মামলার এজাহারে বলা হয়, অবৈধভাবে নিজেরা লাভবান হয়ে বা অন্যকে লাভবান করার অসাধু অভিপ্রায়ে নিয়োগ কমিটির সদস্যরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে এই নিয়োগ দেন। 
২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর ১৮৫ জন ‘সিপাহি’ নিয়োগে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। কমিটিতে আহ্বায়ক হিসেবে ছিলেন রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের তৎকালীন নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান ইকবাল হোসেন। যিনি ২০২১ সালে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান। কমিটিতে কমান্ড্যান্ট আশাবুল ইসলাম সদস্যসচিব ও কমান্ড্যান্ট জহিরুল ইসলাম, এসপিও সিরাজুল্লাহ, কমান্ড্যান্ট ফুয়াদ হাসান পরাগকে সদস্য করা হয়।

পরের বছর ২০১৮ সালে চট্টগ্রামের আরএনবির ট্রেনিং একাডেমি ও রাজশাহীতে মৌখিক ও শারীরিক পরীক্ষা নেওয়া হয়। মৌখিক ও শারীরিক পরীক্ষায় তাঁদেরই উত্তীর্ণ দেখানো হয়, যাঁরা ৬-৭ লাখ টাকা দিতে পেরেছেন।

ওই সময় নিয়োগ পাওয়া পাঁচজন সিপাহির সঙ্গে কথা হয়। এর মধ্যে দুজন চট্টগ্রামের, অন্যরা রাজশাহী অঞ্চলের। এদের মধ্যে চট্টগ্রামের দুজন ৬ লাখ টাকা, অন্য তিনজন সাড়ে ৬ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা আজকের পত্রিকাকে জানান, পরীক্ষা দেওয়ার আগেই নিশ্চয়তা হিসেবে তাঁদের অর্ধেক টাকা দিতে হয়েছে বিভিন্ন মাধ্যমে। তারপর তাঁদের থেকে প্রবেশপত্র সংগ্রহ করে ওই চক্র। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় তাঁদের পাস দেখানো হয়। ফলাফল ঘোষণা ও তাঁদের নামে নিয়োগের চিঠি আসার পর বাকি অর্ধেক টাকা দিতে হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, নিয়োগ থেকে পাওয়া ঘুষের ১৩ কোটি টাকার মধ্যে রেলের শ্রমিকনেতা ও কমিটিতে থাকা লোকজন ভাগাভাগি করে নেন। এর মধ্যে বেশির ভাগ টাকা নেন কমিটির আহ্বায়ক ইকবাল হোসেন। তিনি ঘুষের এই টাকা আমেরিকায় পাচার করেন। ইকবাল হোসেন ব্যক্তিগত কোনো হিসাবে লেনদেন করেননি। ব্যবহার করেছেন আমেরিকাপ্রবাসী বোন ও বোনের স্বামীর হিসাব নম্বরে।

নিয়োগে দুর্নীতির বিষয়টি সামনে আসার পর ২০১৮ সালে চট্টগ্রামের দুদকের এক উপপরিচালক তদন্তে নামেন। তখন দুদক ইকবাল হোসেনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। পাশাপাশি ৭৫টি প্রতিষ্ঠানে ইকবাল হোসেনের বিষয়ে তথ্য চেয়ে চিঠিও দেন। দুদকের ওই কর্মকর্তা বদলি হওয়ার পর তদন্ত করেন ঢাকার দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ সিরাজুল হক।

সিরাজুল হক সম্প্রতি যে মামলাটি করেন, সেখানে ইকবাল হোসেন মারা যাওয়ায় তাঁকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে। ইকবাল হোসেন ছাড়াও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বর্তমান আরএনবির প্রধান জহিরুল ইসলাম ভূঁইয়াকে প্রধান আসামি করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে নিয়োগ ছাড়াও বদলি-বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি তাঁকে রেলের পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমাঞ্চলে বদলি করা হলেও সেখানে যাননি তিনি। অজ্ঞাত কারণে সরকারি সেই আদেশ বদলে যায়।

জানতে চাইলে জহিরুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, সিপাহি নিয়োগে কোনো ধরনের দুর্নীতি করা হয়নি। বক্তব্য জানতে আরএনবির পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান আশাবুল ইসলামের মুঠোফোনে বারবার কল করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ওয়াহিদুর রহমান আজকের পত্রিকাকে জানান, দুদকের মামলার বিষয়টি এখনো কোনো কাগজপত্র তাঁরা পাননি। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা মুহাম্মদ আরিফ সাদেক আজকের পত্রিকাকে বলেন, মামলা হওয়ার পর আবার তদন্ত হবে। তারপর দুদক চেয়ারম্যানের অনুমোদনের পর আদালতে চার্জশিট দেওয়া হবে। 

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

পুলিশের নতুন আইজি হতে পারেন বাহারুল আলম, ডিএমপি কমিশনার সাজ্জাত

রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিধান থাকছে না আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে: আসিফ নজরুল

জুলাই–আগস্ট গণহত্যা: ৮ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিতে সময় এক মাস

বগুড়ায় নিখোঁজের পর মুক্তিপণ দাবি করা শিশুর লাশ মিলল পুকুরে

সাবেক আইজিপি মামুন ছিলেন গণহত্যার প্রধান সেনাপতি: শুনানিতে চিফ প্রসিকিউটর

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত