তাপস মজুমদার, সাংস্কৃতিক সংগঠক
কয়েক দিন হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এস এম আবু বকরের একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বর্তমান সময়ের ভাষায় বক্তব্যটি ‘ভাইরাল’ হয়েছে বলা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী অধ্যাপকদের এক সংবর্ধনা সভায় তিনি এই বক্তৃতা করছিলেন। তিনি বলছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শিক্ষার্থী বলে কিছু নেই, সব হয়ে গেছে পরীক্ষার্থী।’ তিনি আরও বলছেন, ‘যদি শিক্ষাকে পূর্ণ করতে চান, তাহলে তার চিত্তের বিকাশ দরকার। সকাল থেকে বেলা আড়াইটা-তিনটা পর্যন্ত একটানা ক্লাস। কোনো বিরতি নেই।...যত সময় চিত্তের বিকাশ না হচ্ছে, তত সময় হল দখল চলবে; ঠেকাতে পারবেন না; কয়জনকে বহিষ্কার করবেন! সিট দখল চলবে; ডাইনিংয়ে খেয়ে পয়সা দেবে না, এগুলো মানুষ করার দায়িত্ব শিক্ষকের না!... ’
কথাগুলো ভাবাচ্ছে। নিঃসন্দেহে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, প্রাসঙ্গিক এবং প্রণিধানযোগ্য কথা। তার মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে সব সময় পরীক্ষা লেগেই থাকে! ভাইরাল বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা অনেক মন্তব্য থেকে এ কথার সত্যতা পাওয়া যায়। আর এই ‘পরীক্ষা’ একজন ছাত্রের জন্য রীতিমতো ভয়ানক দুর্ভোগ। তাঁর এই বক্তব্যে মন্তব্য করতে গিয়ে একজন ছাত্র লিখেছেন, তিনি ২০২৩ সালে তিনটি সেমিস্টার ফাইনাল, বারোটি মিড টার্ম ও বারোটি ইনকোর্স পরীক্ষা দিয়েছেন। এর সঙ্গে তাঁর অ্যাসাইনমেন্টও ছিল। কী ভয়াবহ অবস্থা!
উপর্যুপরি পরীক্ষার ফলে ছাত্রদের শারীরিক ক্লান্তি ও মানসিক শ্রান্তি এসে যাওয়া স্বাভাবিক। এর ফলে তাঁদের চিন্তা করার সময় ও সুযোগ থাকছে না। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল চেহারা হতে পারে না। শিক্ষার সঙ্গে আনন্দ না থাকলে সেটা কোনো শিক্ষাই নয়। এমন কথা প্রায়ই শোনা যায় যে কোনো কোনো শিক্ষক নিয়মিত ক্লাস নেন না। অবশেষে তাঁর জমে যাওয়া একাধিক ক্লাস একটি ক্লাসে শেষ করে দেন। দুই সপ্তাহ বা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরীক্ষার খাতা নিরীক্ষা করে ডিপার্টমেন্টে জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও অনেক শিক্ষকই তা পরিপালন না করে মাসের পর মাস ফেলে রাখেন। ফলে সময়মতো রেজাল্ট দেওয়া সম্ভব হয় না। আমরা এ-ও জানি, একটি সেমিস্টারের রেজাল্ট হয়নি অথচ পরের সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। ফলে এমনও ঘটে, পরীক্ষায় খারাপ ফল করা ছাত্রটি ‘ইমপ্রুভমেন্ট’ দেওয়ার সুযোগ পান না। রেজাল্ট কেন হয় না? কোনো না কোনো শিক্ষকের গাফিলতি; মূল কাজের চেয়ে অন্য কাজে মনোযোগ; প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস, শিক্ষক রাজনীতি, ব্যবসা, পদোন্নতি ইত্যাদি! এস এম আবু বকর এবং তাঁর মতো কিছু শিক্ষকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, ছাত্রদের জীবন নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার কোনো অধিকার কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের থাকতে পারে না। এটা রীতিমতো অপরাধ।
কিন্তু এগুলো হচ্ছে কেন? শিক্ষকের সচেতনতার অভাব, জবাবদিহির অভাব, প্রশাসনিক দুর্বলতা, নাকি অন্য কিছু? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্টের আওতায় লিখিত ‘বিশ্ববিদ্যালয় ক্যালেন্ডার’র দ্বিতীয় চ্যাপ্টারে শিক্ষকের দায়িত্ব সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা এ রকম—তাঁরা ছাত্রদের শিক্ষা দেবেন, গবেষণা পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান করবেন, ছাত্রদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সংযোগ রেখে নির্দেশনা দেবেন ও ‘এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিস’ পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান করবেন। এখানে দুটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়—শিক্ষকেরা শিক্ষা দেবেন (শুধু ক্লাস নেওয়ার কথা বলা হয়নি) এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগ রেখে পথনির্দেশ ও এক্সট্রা কারিকুলার কার্যক্রম দেখভাল করবেন। প্রতিটি ডিপার্টমেন্টের একাডেমিক কমিটির দায়িত্বের মধ্যেও কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিসের কথা বলা হয়েছে (এখানে এক্সট্রা না বলে কো-বলা হয়েছে)। প্রফেসর আবু বকর যে চিত্তের বিকাশের কথা বলেছেন, বোধ করি তিনি এই এক্সট্রা-কারিকুলার এবং কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিসের দিকেই বিশেষভাবে অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন ঘুরলে দুটো জিনিস সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। একটা হলো পোস্টার-ব্যানারসহ রাজনৈতিক সক্রিয়তা, আরেকটি হলো বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি। আমি দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা শুরু করেন; কোচিং শুরু করেন। তাহলে তিনি কি আর শিক্ষার্থী থাকেন! তিনি হয়ে যান পরীক্ষার্থী। কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একটি রিপোর্ট পড়ছিলাম। সেখানে দেখলাম, লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করার জন্য ভোররাত থেকে লাইন পড়ে যায়। ৮টায় লাইব্রেরি খুলবে। ছেলেমেয়েদের লাইন ধরে লাইব্রেরিতে যাওয়ার ভিড়। কিন্তু শিক্ষার্থী হিসেবে শিখতে নয়; বিসিএস পরীক্ষার পরীক্ষার্থী হিসেবে প্রস্তুতি নিতে। এই যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার চিত্র হয়, তাহলে ছাত্ররা শিখবেন কখন। কীভাবেই বা শিখবেন। আমরা বিশ্বমানব হওয়ার প্রতিযোগিতায় দাঁড়াব কী করে?
এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব কার। প্রফেসর আবু বকর প্রশ্ন রেখেছেন এই দায়িত্ব কি শিক্ষকের নয়? অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলছি, আমরা যারা সাংস্কৃতিক সংগঠন করছি, তারা সংগঠনের জন্য সদস্য পাই না। স্কুলের ছেলেমেয়েদের কোচিং আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের বিসিএস প্রস্তুতি এবং নানা রকম স্কিল ডেভেলপমেন্টের প্রশিক্ষণের হিড়িকে সাংস্কৃতিক কর্মীর উৎসের জায়গায় শুষ্ক বিরানভূমি তৈরি হয়েছে। মানবিক ও সাংগঠনিক কাজের কিছুই তাদের শেখা হচ্ছে না। অথচ এগুলো সুশিক্ষার পরিপূরক।
সম্ভবত স্বামী বিবেকানন্দের কথা—শিক্ষা মানে অন্তর্নিহিত গুণাবলির বহিঃপ্রকাশ। কারিগরি শিক্ষায় মানবিক বিষয় পড়ানো হয় না। কোথাও কোথাও মানবিক বিষয় সিলেবাসে থাকলেও তার উদ্দেশ্য এবং চেতনা সম্পর্কে সচেতন না থেকেই শুধু পরীক্ষায় পাসের জন্য পড়ে যাওয়া হয়। তাহলে কীভাবে মানবিক মানুষ সৃষ্টি হবে? কীভাবে আলোকিত মানুষ পাওয়া যাবে? অতএব অন্তর্নিহিত গুণাবলি অপ্রকাশিতই থেকে যাচ্ছে।
যথার্থ শিক্ষা না হলে স্বাধীন চিন্তা করা যায় না। একজন শিক্ষককে জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান হতে হবে। রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আমরা জানি, রুচির পরিবর্তন না হলে সে শিক্ষা কোনো শিক্ষা নয়। শিক্ষক হিসেবে মনোযোগ থাকতে হবে সত্যে, অবশ্যই তোষামোদে নয়। ফল কী হচ্ছে? আজকাল অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে লক্ষ করছি, শিক্ষক নন্দিত না হয়ে নিন্দিত হচ্ছেন। এতে ব্যক্তিগতভাবে যেমন কষ্ট পাচ্ছি, তেমনি সামগ্রিকভাবে সমাজ নিয়েও আমাদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। ক্ষুদ্র দলাদলি, ভোট পলিটিকস, অর্থলিপ্সা—এসব কখনো চিত্তের বিকাশ ঘটাতে পারে না।
গত শতাব্দীর আশির দশকে দেখেছি, এমনকি নব্বইয়ের দশকেও, বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন অনুষ্ঠানে ভরপুর থাকত। গান, আবৃত্তি, নৃত্য, ছবি আঁকা, নাটক যেমন নিয়মিত হতো, তেমনি তার দর্শকসংখ্যাও ছিল প্রচুর। এখন সেসব আর নেই। নেই বলেই চিত্তের সংকট দেখা দিচ্ছে। আবার সেই চর্চা ফিরিয়ে আনা জরুরি। আরেকটি কথা। ছেলেমেয়েরা শুধু পারফর্ম করে তাদের দায়িত্ব শেষ করুক, এটাও কাম্য নয়। প্রকৃতপক্ষে সংগঠন করুক। দায়িত্ববোধসম্পন্ন মুক্তচিন্তার মানুষ হতে তা ব্যাপকভাবে সাহায্য করবে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কী করছে? আলোচ্য ভিডিওটির লাখ লাখ ভিউয়ার এবং হাজার হাজার শেয়ার দেখে এটা অনুভব করা যাচ্ছে যে মানুষের মধ্যে ভালো কিছু পাওয়ার অধিকারবোধ এখনো যথেষ্ট প্রখর। আপাতত আমরা যে বলি, মানুষ নষ্ট হয়ে গেছে, সেই ধারণাকে সম্পূর্ণ মিথ্যা পরিণত করে আমাদের প্রচণ্ডভাবে জাগ্রত হতে নির্দেশ করছে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি কাম্য নয়। অথচ যোগ্য-অযোগ্যনির্বিশেষে উপাচার্য হওয়ার জন্য শিক্ষকেরা (অবশ্যই সবাই নন) লাইন দিচ্ছেন রাজনীতির নাম ধরে। দেখা যায়, আদর্শবাদ, জ্ঞানচর্চা, স্বচ্ছতাবোধ, সততা ও প্রজ্ঞার অভাব আছে এমন অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছেন অথবা হওয়ার দৌড়ে শামিল রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নির্বাচন হচ্ছে অথচ শিক্ষার্থীদের নির্বাচন বন্ধ রয়েছে দীর্ঘকাল।
এ অবস্থায় কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রমে প্রাণ ফিরিয়ে আনা যায়, কীভাবে ‘চিত্তের বিকাশ’ ঘটানো যায়, তা গভীরভাবে অত্যন্ত দ্রততার সঙ্গে ভেবে কাজ শুরু করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি এই দায়িত্ব প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধারদের এবং বলা যেতেই পারে এখন পর্যন্ত শিক্ষককুলই কর্ণধার।
তাপস মজুমদার, সাংস্কৃতিক সংগঠক
কয়েক দিন হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক এস এম আবু বকরের একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বর্তমান সময়ের ভাষায় বক্তব্যটি ‘ভাইরাল’ হয়েছে বলা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদায়ী অধ্যাপকদের এক সংবর্ধনা সভায় তিনি এই বক্তৃতা করছিলেন। তিনি বলছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শিক্ষার্থী বলে কিছু নেই, সব হয়ে গেছে পরীক্ষার্থী।’ তিনি আরও বলছেন, ‘যদি শিক্ষাকে পূর্ণ করতে চান, তাহলে তার চিত্তের বিকাশ দরকার। সকাল থেকে বেলা আড়াইটা-তিনটা পর্যন্ত একটানা ক্লাস। কোনো বিরতি নেই।...যত সময় চিত্তের বিকাশ না হচ্ছে, তত সময় হল দখল চলবে; ঠেকাতে পারবেন না; কয়জনকে বহিষ্কার করবেন! সিট দখল চলবে; ডাইনিংয়ে খেয়ে পয়সা দেবে না, এগুলো মানুষ করার দায়িত্ব শিক্ষকের না!... ’
কথাগুলো ভাবাচ্ছে। নিঃসন্দেহে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, প্রাসঙ্গিক এবং প্রণিধানযোগ্য কথা। তার মানে বিশ্ববিদ্যালয়ে সব সময় পরীক্ষা লেগেই থাকে! ভাইরাল বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা অনেক মন্তব্য থেকে এ কথার সত্যতা পাওয়া যায়। আর এই ‘পরীক্ষা’ একজন ছাত্রের জন্য রীতিমতো ভয়ানক দুর্ভোগ। তাঁর এই বক্তব্যে মন্তব্য করতে গিয়ে একজন ছাত্র লিখেছেন, তিনি ২০২৩ সালে তিনটি সেমিস্টার ফাইনাল, বারোটি মিড টার্ম ও বারোটি ইনকোর্স পরীক্ষা দিয়েছেন। এর সঙ্গে তাঁর অ্যাসাইনমেন্টও ছিল। কী ভয়াবহ অবস্থা!
উপর্যুপরি পরীক্ষার ফলে ছাত্রদের শারীরিক ক্লান্তি ও মানসিক শ্রান্তি এসে যাওয়া স্বাভাবিক। এর ফলে তাঁদের চিন্তা করার সময় ও সুযোগ থাকছে না। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল চেহারা হতে পারে না। শিক্ষার সঙ্গে আনন্দ না থাকলে সেটা কোনো শিক্ষাই নয়। এমন কথা প্রায়ই শোনা যায় যে কোনো কোনো শিক্ষক নিয়মিত ক্লাস নেন না। অবশেষে তাঁর জমে যাওয়া একাধিক ক্লাস একটি ক্লাসে শেষ করে দেন। দুই সপ্তাহ বা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরীক্ষার খাতা নিরীক্ষা করে ডিপার্টমেন্টে জমা দেওয়ার সিদ্ধান্ত থাকলেও অনেক শিক্ষকই তা পরিপালন না করে মাসের পর মাস ফেলে রাখেন। ফলে সময়মতো রেজাল্ট দেওয়া সম্ভব হয় না। আমরা এ-ও জানি, একটি সেমিস্টারের রেজাল্ট হয়নি অথচ পরের সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। ফলে এমনও ঘটে, পরীক্ষায় খারাপ ফল করা ছাত্রটি ‘ইমপ্রুভমেন্ট’ দেওয়ার সুযোগ পান না। রেজাল্ট কেন হয় না? কোনো না কোনো শিক্ষকের গাফিলতি; মূল কাজের চেয়ে অন্য কাজে মনোযোগ; প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস, শিক্ষক রাজনীতি, ব্যবসা, পদোন্নতি ইত্যাদি! এস এম আবু বকর এবং তাঁর মতো কিছু শিক্ষকের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখেই বলছি, ছাত্রদের জীবন নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার কোনো অধিকার কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের থাকতে পারে না। এটা রীতিমতো অপরাধ।
কিন্তু এগুলো হচ্ছে কেন? শিক্ষকের সচেতনতার অভাব, জবাবদিহির অভাব, প্রশাসনিক দুর্বলতা, নাকি অন্য কিছু? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্টের আওতায় লিখিত ‘বিশ্ববিদ্যালয় ক্যালেন্ডার’র দ্বিতীয় চ্যাপ্টারে শিক্ষকের দায়িত্ব সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা এ রকম—তাঁরা ছাত্রদের শিক্ষা দেবেন, গবেষণা পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান করবেন, ছাত্রদের সঙ্গে ব্যক্তিগত সংযোগ রেখে নির্দেশনা দেবেন ও ‘এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাকটিভিটিস’ পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান করবেন। এখানে দুটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়—শিক্ষকেরা শিক্ষা দেবেন (শুধু ক্লাস নেওয়ার কথা বলা হয়নি) এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগ রেখে পথনির্দেশ ও এক্সট্রা কারিকুলার কার্যক্রম দেখভাল করবেন। প্রতিটি ডিপার্টমেন্টের একাডেমিক কমিটির দায়িত্বের মধ্যেও কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিসের কথা বলা হয়েছে (এখানে এক্সট্রা না বলে কো-বলা হয়েছে)। প্রফেসর আবু বকর যে চিত্তের বিকাশের কথা বলেছেন, বোধ করি তিনি এই এক্সট্রা-কারিকুলার এবং কো-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিসের দিকেই বিশেষভাবে অঙ্গুলিনির্দেশ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন ঘুরলে দুটো জিনিস সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। একটা হলো পোস্টার-ব্যানারসহ রাজনৈতিক সক্রিয়তা, আরেকটি হলো বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি। আমি দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষ থেকেই বিসিএসের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনা শুরু করেন; কোচিং শুরু করেন। তাহলে তিনি কি আর শিক্ষার্থী থাকেন! তিনি হয়ে যান পরীক্ষার্থী। কিছুদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে একটি রিপোর্ট পড়ছিলাম। সেখানে দেখলাম, লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করার জন্য ভোররাত থেকে লাইন পড়ে যায়। ৮টায় লাইব্রেরি খুলবে। ছেলেমেয়েদের লাইন ধরে লাইব্রেরিতে যাওয়ার ভিড়। কিন্তু শিক্ষার্থী হিসেবে শিখতে নয়; বিসিএস পরীক্ষার পরীক্ষার্থী হিসেবে প্রস্তুতি নিতে। এই যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার চিত্র হয়, তাহলে ছাত্ররা শিখবেন কখন। কীভাবেই বা শিখবেন। আমরা বিশ্বমানব হওয়ার প্রতিযোগিতায় দাঁড়াব কী করে?
এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব কার। প্রফেসর আবু বকর প্রশ্ন রেখেছেন এই দায়িত্ব কি শিক্ষকের নয়? অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলছি, আমরা যারা সাংস্কৃতিক সংগঠন করছি, তারা সংগঠনের জন্য সদস্য পাই না। স্কুলের ছেলেমেয়েদের কোচিং আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের বিসিএস প্রস্তুতি এবং নানা রকম স্কিল ডেভেলপমেন্টের প্রশিক্ষণের হিড়িকে সাংস্কৃতিক কর্মীর উৎসের জায়গায় শুষ্ক বিরানভূমি তৈরি হয়েছে। মানবিক ও সাংগঠনিক কাজের কিছুই তাদের শেখা হচ্ছে না। অথচ এগুলো সুশিক্ষার পরিপূরক।
সম্ভবত স্বামী বিবেকানন্দের কথা—শিক্ষা মানে অন্তর্নিহিত গুণাবলির বহিঃপ্রকাশ। কারিগরি শিক্ষায় মানবিক বিষয় পড়ানো হয় না। কোথাও কোথাও মানবিক বিষয় সিলেবাসে থাকলেও তার উদ্দেশ্য এবং চেতনা সম্পর্কে সচেতন না থেকেই শুধু পরীক্ষায় পাসের জন্য পড়ে যাওয়া হয়। তাহলে কীভাবে মানবিক মানুষ সৃষ্টি হবে? কীভাবে আলোকিত মানুষ পাওয়া যাবে? অতএব অন্তর্নিহিত গুণাবলি অপ্রকাশিতই থেকে যাচ্ছে।
যথার্থ শিক্ষা না হলে স্বাধীন চিন্তা করা যায় না। একজন শিক্ষককে জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান হতে হবে। রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে আমরা জানি, রুচির পরিবর্তন না হলে সে শিক্ষা কোনো শিক্ষা নয়। শিক্ষক হিসেবে মনোযোগ থাকতে হবে সত্যে, অবশ্যই তোষামোদে নয়। ফল কী হচ্ছে? আজকাল অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে লক্ষ করছি, শিক্ষক নন্দিত না হয়ে নিন্দিত হচ্ছেন। এতে ব্যক্তিগতভাবে যেমন কষ্ট পাচ্ছি, তেমনি সামগ্রিকভাবে সমাজ নিয়েও আমাদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। ক্ষুদ্র দলাদলি, ভোট পলিটিকস, অর্থলিপ্সা—এসব কখনো চিত্তের বিকাশ ঘটাতে পারে না।
গত শতাব্দীর আশির দশকে দেখেছি, এমনকি নব্বইয়ের দশকেও, বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গন অনুষ্ঠানে ভরপুর থাকত। গান, আবৃত্তি, নৃত্য, ছবি আঁকা, নাটক যেমন নিয়মিত হতো, তেমনি তার দর্শকসংখ্যাও ছিল প্রচুর। এখন সেসব আর নেই। নেই বলেই চিত্তের সংকট দেখা দিচ্ছে। আবার সেই চর্চা ফিরিয়ে আনা জরুরি। আরেকটি কথা। ছেলেমেয়েরা শুধু পারফর্ম করে তাদের দায়িত্ব শেষ করুক, এটাও কাম্য নয়। প্রকৃতপক্ষে সংগঠন করুক। দায়িত্ববোধসম্পন্ন মুক্তচিন্তার মানুষ হতে তা ব্যাপকভাবে সাহায্য করবে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কী করছে? আলোচ্য ভিডিওটির লাখ লাখ ভিউয়ার এবং হাজার হাজার শেয়ার দেখে এটা অনুভব করা যাচ্ছে যে মানুষের মধ্যে ভালো কিছু পাওয়ার অধিকারবোধ এখনো যথেষ্ট প্রখর। আপাতত আমরা যে বলি, মানুষ নষ্ট হয়ে গেছে, সেই ধারণাকে সম্পূর্ণ মিথ্যা পরিণত করে আমাদের প্রচণ্ডভাবে জাগ্রত হতে নির্দেশ করছে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি কাম্য নয়। অথচ যোগ্য-অযোগ্যনির্বিশেষে উপাচার্য হওয়ার জন্য শিক্ষকেরা (অবশ্যই সবাই নন) লাইন দিচ্ছেন রাজনীতির নাম ধরে। দেখা যায়, আদর্শবাদ, জ্ঞানচর্চা, স্বচ্ছতাবোধ, সততা ও প্রজ্ঞার অভাব আছে এমন অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছেন অথবা হওয়ার দৌড়ে শামিল রয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের নির্বাচন হচ্ছে অথচ শিক্ষার্থীদের নির্বাচন বন্ধ রয়েছে দীর্ঘকাল।
এ অবস্থায় কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকার্যক্রমে প্রাণ ফিরিয়ে আনা যায়, কীভাবে ‘চিত্তের বিকাশ’ ঘটানো যায়, তা গভীরভাবে অত্যন্ত দ্রততার সঙ্গে ভেবে কাজ শুরু করতে হবে। সরকারের পাশাপাশি এই দায়িত্ব প্রধানত বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধারদের এবং বলা যেতেই পারে এখন পর্যন্ত শিক্ষককুলই কর্ণধার।
তাপস মজুমদার, সাংস্কৃতিক সংগঠক
রাজধানীর বিমানবন্দরে শরীরে বিশেষ কৌশলে গাঁজা নিয়ে এসে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছে তিনজন কিশোর। তাঁরা বর্তমানে কিশোর সংশোধনাগারের রয়েছে।
১২ দিন আগেপরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে সিঙ্গাপুরে যান দুই ভাই উজ্জ্বল মিয়া ও মো. ঝন্টু। সেখানে থাকা অবস্থায় মুঠোফোনে ভাবির সঙ্গে পরকীয়ায় জড়ান ছোট ভাই মো. ঝন্টু। পরে দেশে ফিরে ভাবিকে বিয়ে করার জন্য আপন বড় ভাই উজ্জ্বল মিয়াকে খুন করে ছোট ভাই।
১২ দিন আগেরাজধানীর গেণ্ডারিয়ায় গত দুই মাসে দুই অটোরিকশা চালককে হত্যা করে রিকশা ছিনিয়ে নেওয়া ঘটনা ঘটেছে। পৃথক এই দুই ঘটনায় তদন্তে নেমে বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।
১২ দিন আগেপাবনার পদ্মা নদী থেকে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ১২ বছরের এক কিশোর এবং ২২ বছরের এক তরুণীর অর্ধগলিত দুইটি মরদেহ উদ্ধার করেছে নাজিরগঞ্জ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ি। উদ্ধারের দুইদিনেও কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি। রোববার সন্ধ্যায় বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নাজিরগঞ্জ নৌ-পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সাইদুর রহমান।
১৬ দিন আগে