কোটা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যায়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী ও আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু সাঈদ নিহতের পর রংপুরে কোটা আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়েছে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজারো শিক্ষার্থী কোটা সংস্কার এবং আবু সাঈদের হত্যার বিচার চেয়ে জেলা স্কুল থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বেরোবি অভিমুখে রওনা হয়েছেন।
আজ বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে শিক্ষার্থীরা জেলা স্কুলের সামনে জড়ো হন এবং বিভিন্ন ধরনে স্লোগান দিতে থাকেন। এরপর সেখান থেকে দুপুর সাড়ে ১২টায় বেরোবির দিকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে রওনা হয়। এ সময় পাশেই থাকা পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে পুলিশ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বাধা দিলে তাঁরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। এরপর পুলিশ সরে গিয়ে পুলিশ সুপারের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন।
সরেজমিন দেখা গেছে, শিক্ষার্থীরা যখন শহরের প্রধান সড়ক ধরে জেলা স্কুল থেকে বেরোবির দিকে যাচ্ছিল। সড়কের দুই ধারে থাকা দোকানপাট বন্ধ করে ব্যবসায়ী কর্মচারী শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে হাততালি দিচ্ছিলেন। এ সময় পুরো শহরের দোকানপাট বন্ধ করা হয় এবং শহরের ভেতরে ওই সড়ক দিয়ে সব যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা বেরোবির দিকে রওনা হয়েছেন। এ সময় শহরজুড়ে কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দেখা যায়নি। পুরো শহরে মধ্যরাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ রয়েছে। বিক্ষোভ মিছিলটির দৈর্ঘ্য প্রায় দুই কিলোমিটার।
আন্দোলনে অংশ নেওয়া রংপুর জিলা স্কুলের শিক্ষার্থী রাহান সরকার বলেন, ‘কোটা সংস্কার আমাদের যৌক্তিক আন্দোলন ছিল। আবু সাঈদ ভাই সেই আন্দোলনের অংশ নিয়েছিলেন। পুলিশ তাঁকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে। আমরা হত্যাকারীর বিচার চাই।’
আরেক রংপুর পলিটেকনিকের শিক্ষার্থী লাইজু আক্তার বলেন, ‘পুলিশের একবারও হাত কাঁপল না আমার ভাইকে গুলি করতে। সে তো দাঁড়িয়েছিল, পুলিশকে আঘাত করেনি কেন তাকে হত্যা করা হলো। আমরা এর বিচার চাই। এর বিচার না হলে আজ আবু সাঈদ ভাইকে গুলি করেছে। কাল আমাকে গুলি করবে। কোটা সংস্কার চাই, আবু সাঈদ ভাইয়ের হত্যার বিচার চাই।’
রংপুর জাহাজ কোম্পানির হোটেলশ্রমিক জহুরুল ইসলাম হাততালি দিয়ে বলেন, ‘ভাই আমরা গরিব মানুষ, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ছাওয়াদের পড়াই। এই কোটার তকনে তারা চাকরি পেছায় যায়। সেই ছাওয়া আন্দোলন করলে তাক গুলি খায়া মরা নাগে এ কোন দেশ কন?’
উল্লেখ, আবু সাঈদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। বেরোবির কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন তিনি। এ জন্য সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন তিনি। গত মঙ্গলবার বেলা ২টার দিকে শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত মিছিল বেরোবির দ্বিতীয় গেটে পৌঁছালে সেখানে পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকতে বাধা দেয়। এর একপর্যায়ে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছোড়ে। এ সময় পুলিশ-ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ বাধে।
এ সময় শিক্ষার্থীরা কিছুটা পিছু হটলে আবু সাঈদ সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন এবং গুলিবিদ্ধ হন। সহপাঠীরা তাঁকে উদ্ধার করে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকেরা জানান তিনি হাসপাতালে পৌঁছানোর আগে মারা যান।
গতকাল বুধবার সকাল রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার মদনখালী ইউনিয়নের বামনপুর গ্রামের বাড়িতে আবু সাঈদের লাশ দাফন করা হয়। সেখানে তাঁর জানাজায় মানুষের ঢল নামে। এর আগে গত মঙ্গলবার রাত ২টার দিকে তাঁর মরদেহ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়। এ সময় হাজারো মানুষ আবু সাঈদের লাশ দেখার জন্য তাঁর বাড়িতে অপেক্ষায় ছিলেন। মরদেহ গ্রামে পৌঁছালে সেখানে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়।