ভারতের উত্তর সিকিমে ভারী বর্ষণসহ উজান থেকে নেমে আসা ঢলে রংপুর, গাইবান্ধা ও কুড়িগ্রাম জেলার প্রধান প্রধান নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। এর মধ্যে রংপুর ও কুড়িগ্রামের তিস্তা, দুধকুমার নদীর দুই পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে নদী ভাঙন। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় এই তিন জেলায় স্বল্পমেয়াদি বন্যার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, সক্রিয় মৌসুমি বায়ুর প্রভাবে রংপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগে আজ বুধবার সকাল ৯টা থেকে পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় ভারী (৪৪-৮৮ মিলিমিটার/ ২৪ ঘণ্টা) থেকে অতি ভারী (৯৮৯ মিলিমিটার/ ২৪ ঘণ্টা) বর্ষণ হতে পারে।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বন্যা মোকাবিলায় সম্ভাব্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চরে থাকা মানুষজনকে নিরাপদে থাকার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
রংপুর: ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে। তিস্তায় পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জেলার কাউনিয়া, পীরগাছা ও গঙ্গাচড়া উপজেলার তিস্তা অববাহিকার বেশ কয়েকটি এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে।
পাউবো কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না থাকায় ভাঙনকবলিত পরিবারগুলোর অনেকে নিরুপায় হয়ে বসতি সরিয়ে নিচ্ছে। কিছু চরাঞ্চলের বাড়িঘরের চারপাশে পানি প্রবেশ করার খবর পাওয়া গেছে। তলিয়ে গেছে গ্রামীণ সড়ক। ডুবে গেছে ওই সব এলাকার সবজিখেতসহ ফসলি মাঠ।
প্রধান নদ-নদীগুলোতে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এ অবস্থায় আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রংপুরের নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
পাউবোর নিয়ন্ত্রণকক্ষ থেকে জানা যায়, রংপুর জেলায় অবস্থিত সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে। গত ২৪ ঘণ্টায় (গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে আজ বুধবার সকাল ৬টা পর্যন্ত) রংপুর অঞ্চলে ২২১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। বুধবার সকাল নয়টায় তিস্তার কাউনিয়া পয়েন্টে শূন্য দশমিক ২০ সেন্টিমিটার পানি প্রবাহ বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এর আগে ভোর ছয়টায় ওই পয়েন্টে পানি প্রবাহ বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপরে ছিল। কাউনিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমা ২৮ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার ধরা হয়।
এদিকে দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজের ডালিয়া পয়েন্টে আজ বুধবার সকাল নয়টায় পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয় ৫১ দশমিক ৯২ সেন্টিমিটার। যা বিপৎসীমার শূন্য দশমিক ২৩ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়। এখানে ৫২ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হলে বিপৎসীমা অতিক্রম করে। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৬টা থেকে আজ বুধবার সকাল ৬টা পর্যন্ত ডালিয়া পয়েন্টে ১২০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে।
তিস্তা নদীর কাউনিয়ার পাঞ্চরভাঙা গ্রামের কৃষক ইউসুফ আলী বলেন, ‘তিস্তা হামাক শ্যাষ করি দিছে। বছর বছর বাড়ি ভাঙে, ফসল কাড়ে, প্রাণ নেয়। আল্লাহ জানে আর কত কাল তিস্তার সঙ্গে যুদ্ধ করা নাগবে।’
কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আনছার আলী বলেন, তিস্তার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীর নিম্নাঞ্চল কিছুটা প্লাবিত হয়েছে। হঠাৎ করে পানি বাড়ায় গবাদি পশুপাখি নিয়ে এসব এলাকার মানুষ সমস্যায় পড়েছে। বাদাম ও শাক-সবজিসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি হবে।
কাউনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মহিদুল হক আজকের পত্রিকাকে বলেন, কোনো পরিবার যাতে উজানের ঢলে সৃষ্ট বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে জন্য সরকারিভাবে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক নদীপাড়ের মানুষের পরিস্থিতির খোঁজ-খবর রাখা হচ্ছে। পরিস্থিতি যে রকম হবে, সেভাবেই পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
গঙ্গাচড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিদ তামান্না জানান, তিস্তাবেষ্টিত গঙ্গাচড়ায় এখনো প্লাবন পরিস্থিতি হয়নি। তবুও তারা সতর্ক রয়েছেন। বন্যা হলে রেসকিউ করার জন্য টিম প্রস্তুত রেখেছেন।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রবিউল ইসলাম বলেন, উজানের ঢল আর গত কয়েক দিন ধরে বৃষ্টিপাতের কারণে ডালিয়া ও কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তায় পানি বাড়তে শুরু করেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ডালিয়া ব্যারেজের সব কটি গেটই খুলে রাখা হয়েছে। কাউনিয়া পয়েন্টে কিছুটা বাড়ছে পানি প্রবাহ। এ ছাড়া ভাটির অঞ্চলে সার্বক্ষণিক নদীপাড়ের পরিস্থিতির খোঁজ খবর রাখা হচ্ছে।
রংপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান বলেন, বন্যা মোকাবিলায় সম্ভাব্য সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এ জন্য মাঠ পর্যায়ে উপজেলা প্রশাসনকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চরে থাকা মানুষজনকে নিরাপদে থাকার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
গাইবান্ধা: উজানের ঢলে গাইবান্ধায় সব নদ-নদীর পানি বাড়তে শুরু করছে। এতে জেলার তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, ঘাঘট ও করতোয়া নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এসব নদ-নদীর পানি এখনো বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে পানি বৃদ্ধির কারণে গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি, মোল্লারচর, গিদারি, ঘাগোয়া ও ফুলছড়ি উপজেলার এরান্ডাবাড়ি, ফুলছড়ি ও ফজলুপুর এবং সুন্দরগঞ্জ উপজেলার তারাপুর ও হরিপুর ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলগুলোতে পানি ঢুকতে শুরু করছে। অন্যদিকে নদীতে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সদরের মোল্লার চর ও ফুলছড়ির ফজলুপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে নদী ভাঙন দেখা দিয়েছে।
গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নিয়ন্ত্রণকক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র ও যমুনা নদের পানি ফুলছড়ি পয়েন্টে ৫২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে ঘাঘট নদের পানি জেলা শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে ৪৪ সেন্টিমিটার এবং তিস্তার পানি সুন্দরগঞ্জ উপজেলাসংলগ্ন কাউনিয়া পয়েন্টে ৩৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ৩টা থেকে আজ বুধবার ৩টা পর্যন্ত এই পরিমাণ পানি বৃদ্ধি পায়। তবে কোনো নদ-নদীর পানি বিপৎসীমা এখনো অতিক্রম করেনি।
গাইবান্ধা পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী হাফিজুল হক বলেন, ‘পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে স্বল্পমেয়াদি বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। তবে সার্বিক পরিস্থিতির ওপর সার্বক্ষণিক নজর রাখছি।’
এ বিষয়ে গাইবান্ধা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাহমুদ আল হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, আগামীকাল জেলা ও উপজেলায় দূর্যোগকালীন মিটিং ডাকা হয়েছে। নদী বেষ্টিত যে চারটি ইউনিয়ন রয়েছে, সেই সব ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ প্রত্যক্ষ সদস্যদের বলে দেওয়া হয়েছে নদীর পাড়ে পার্শ্ববর্তী যে ওয়ার্ডগুলো আছে সেখানে গ্রুপ ভিত্তিক ভলান্টিয়ার মাধ্যমে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখার জন্য।
এছাড়া ওই সব এলাকায় শুকনা খাবার বিতরণের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রাথমিক সব প্রস্তুতি নিয়েছেন বলে জানান এই কর্মকর্তার।
কুড়িগ্রাম: ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে কুড়িগ্রামের তিস্তা ও দুধকুমার নদের পানি বিপৎসীমা অতিক্রম করছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কুড়িগ্রামের নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র।
এদিকে পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জেলার রাজারহাট উপজেলার তিস্তা অববাহিকার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের কয়েকটি এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। পাউবো কোনো প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা না নেওয়ায় ভাঙনকবলিত পরিবারগুলোর অনেকে নিরুপায় হয়ে বসতি সরিয়ে নিচ্ছে। ভাঙনের হুমকিতে আছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও স্থানীয় বাজারসহ অন্তত শতাধিক পরিবার।
কুড়িগ্রামে পাউবোর নিয়ন্ত্রণকক্ষ জানায়, জেলার সব নদ-নদীর পানি বাড়ছে। গতকাল মঙ্গলবার ভোর ৬টা থেকে আজ বুধবার সকাল ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় দুধকুমার নদের পানি পাটেশ্বরী পয়েন্টে ৩১ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে এবং তিস্তার পানি কাউনিয়া পয়েন্টে ৩৮ সেন্টিমিটার বেড়ে বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। একই সময়ে ধরলা নদীর পানি কুড়িগ্রাম (ধরলা ব্রিজ) পয়েন্টে ৪৭ সেন্টিমিটার বেড়েছে। ব্রহ্মপুত্রের পানি চিলমারী পয়েন্টে ৪২ সেন্টিমিটার বেড়ে ক্রমশ বিপৎসীমার দিকে ধাবিত হচ্ছে।
ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় বন্যার চোখরাঙানির সঙ্গে তিস্তার তীরে শুরু হয়েছে ভাঙন। রাজারহাট উপজেলার বিদ্যানন্দ ইউনিয়নের তীরবর্তী কয়েকটি এলাকায় তিস্তার ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে। পাড় ভেঙে একের পর এক বসতভিটা আর আবাদি জমি নিজের গর্ভে নিয়ে নিচ্ছে আগ্রাসী এই নদী। ভাঙনের কিনারে নিরুপায় দিন যাপন করছে অনেক দিনমজুর পরিবার। জরুরি ভিত্তিতে ভাঙন প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়া না হলে তারা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়বে বলে জানিয়েছে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো।
বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বরাতে কুড়িগ্রামে পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান বলেন, ‘নদনদীর পানি বাড়ছে। আগামী ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টায় দুধকুমার, তিস্তা ও ধরলা নদীর পানি সময় বিশেষে দ্রুত বাড়তে পারে। কয়েকটি স্থানে বিপৎসীমা অতিক্রম করে সংলগ্ন নিম্নাঞ্চলে স্বল্পমেয়াদি বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, ‘সম্ভাব্য বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় উপজেলাগুলোতে ত্রাণসহায়তা প্রস্তুত রয়েছে। দুর্যোগ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট উপজেলার দায়িত্বশীলদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতির ওপর আমরা সার্বক্ষণিক নজর রাখছি।’