চট্টগ্রাম বিএনপির বিতর্কিত কাণ্ডে বাড়ছে অস্বস্তি

সবুর শুভ, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯: ২৬

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর চট্টগ্রামের রাজনীতিতে পটপরিবর্তন এসেছে। দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। এই সুযোগে তাঁদের দখলে থাকা বিভিন্ন হাটবাজার, ঘাট ও প্রতিষ্ঠানে বিএনপির নেতা-কর্মী ও অনুসারীরা দখলে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

নেতা-কর্মীদের এই দখলবাজির সঙ্গে অন্তর্কোন্দলেরও অভিযোগ পাওয়া গেছে। বিশেষ করে ব্যাংক লুটকারী চট্টগ্রামের শিল্প গ্রুপ এস আলমের ডেরা থেকে ১৪টি বিলাসবহুল গাড়ি সরিয়ে নিতে সহযোগিতা করায় দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির তিন প্রভাবশালী নেতাকে বহিষ্কার ও কমিটি স্থগিত করা হয়েছে। উচ্চপর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে দলটিতে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের দলের অস্থিরতা নিয়ে কেন্দ্রীয় বিএনপিও বেশ চিন্তিত। মহানগর বিএনপিতে নেতৃত্বের দুর্বলতা রয়েছে। যদিও সম্প্রতি মাত্র দুজনের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে নগর বিএনপিতে। অপর দিকে এস আলমের ডেরা থেকে বিলাসবহুল গাড়ি বের করতে সহযোগিতা করায় দক্ষিণ জেলা বিএনপির পুরো কমিটিই স্থগিত করেছে কেন্দ্র। আর উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি থাকলেও কোন্দল এবং আহ্বায়কের বিরুদ্ধে যুবলীগ নেতার বাসায় যাওয়ায় মিরসরাই বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে তুমুল ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর আয়ের উৎস হিসেবে পরিচিত নগরীর বিভিন্ন ঘাট, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিকানা রাতারাতি পাল্টে যায়। আগে যেখানে আওয়ামী লীগ ছিল, সেখানে প্রতিস্থাপিত হয়েছে বিএনপি। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের রাজস্ব বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ইজারাদারেরা জানান, চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব মো. ওসমান ও তাঁর লোকজন সল্টগোলা, ৯ নম্বর বিওসি ঘাট, ১১ নম্বর মাতব্বর ঘাট ও ১২ নম্বর তিনটিংগা ঘাট দখল নিয়ে টাকা আদায় করছেন।

এসব ঘাট থেকে প্রতিদিন এক থেকে দেড় লাখ টাকা আয় হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর চট্টগ্রাম নগরীর ঘাটগুলো থেকে টাকা আদায়ের মুখও পরিবর্তন হয়েছে। নতুন মুখ হিসেবে দৃশ্যপটে এসেছে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা।

এ বিষয়ে মো. ওসমান জানান, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার আগে তাঁদের দলের লোকজনই ঘাটগুলো ইজারা নিতেন। ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের ইজারাদারেরা পালিয়ে গেছেন। তাই ঘাট পরিচালনার ক্ষেত্রে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। এ ঘাটগুলো পরিচালনার ক্ষেত্রে নিজের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বলেও জানান বিএনপির এ নেতা।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, সিটি করপোরেশনের আওতায় কর্ণফুলী নদী ও নগরীর বড় খালগুলোতে ১৯টি ঘাট রয়েছে। এর মধ্যে ১২টি ঘাট থেকে টাকা আদায়ের জন্য গত বছর ইজারা দেওয়া হয়। ইজাদারেরা প্রায় সবাই ছিল আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দৃশ্যপট বদলে যায়। এখন ঘাটগুলোর দখলে নেন স্থানীয় বিএনপির নেতারা। আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ইজারাদারেরা পালিয়ে যাওয়ার পর ঘাটগুলোতে পালাবদল ঘটে। দৃশ্যপটে আসে বিএনপি।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম জানান, ‘উল্লিখিত ঘাটগুলো সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন। ঘাটগুলো থেকে টাকা আদায় করা নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে শুনেছি।’ এখন আইনি জটিলতা নিরসন করে ঘাটগুলো ইজারা দেওয়ার চেষ্টা করছেন তাঁরা।

এদিকে আলোচিত এস আলম গ্রুপের ১৪টি বিলাসবহুল গাড়ি সরিয়ে নিতে সহযোগিতার অভিযোগে দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়কসহ তিন প্রভাবশালী নেতার প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব ধরনের পদ দল থেকে স্থগিত করা হয়েছে। তাঁরা হলেন চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক এনামুল হক এনাম ও কর্ণফুলী উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এস এম মামুন মিয়া। তাঁদের মধ্যে এনামুল হক এনাম ও এস এম মামুন মিয়া এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদের ঘনিষ্ঠজন।

অন্যদিকে ১৭ আগস্ট দুপুরে মিরসরাইয়ের উদ্দেশে চট্টগ্রাম থেকে রওনা হন জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকার। পথে বড়তাকিয়া গ্রুপের চেয়ারম্যান মনিরুল ইসলাম ইউসুফের বাড়িতে যান। মনিরুল ইসলাম ইউসুফের ছেলে হলেন কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য নিয়াজ মোর্শেদ এলিট। তাঁদের বাড়িতে যাওয়ার খবরে স্থানীয় বিএনপি নেতা-কর্মীরা দলে দলে জড়ো হয়ে বাড়িটি ঘেরাও করে বিক্ষোভ মিছিল করেন এবং বাড়ির পার্শ্ববর্তী ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন। ইউসুফের বাড়ির ভেতরে অবস্থান নেওয়া গোলাম আকবর খন্দকারের ওপরও চড়াও হওয়ার চেষ্টা করেন কয়েকজন বিএনপির নেতা। পরে সেনাবাহিনী এসে গোলাম আকবর খন্দকারকে উদ্ধার করে ওই বাড়ি থেকে।

অন্যদিকে চট্টগ্রামের রাউজানে বিএনপির দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে ১৭ আগস্ট। ওই দিন বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে স্থানীয় জিয়া বাজার এলাকায় বিএনপির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান সাবেক সংসদ সদস্য গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারীরা মিছিল বের করলে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক সংসদ সদস্য ও চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খন্দকারের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ নিয়ে উত্তর জেলা বিএনপিতেও অস্থিরতা বিরাজ করছে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম নগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব নাজিমুর রহমান বলেন, বিএনপির কেউ অনিয়ম ও অন্যায্য কোনো কিছুর সঙ্গে জড়িত হলেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত