মনিজা রহমান
আমরা ভাইবোনরা ওনাকে ডাকতাম ধার করা খালাম্মা। সব সময় আমাদের বাসায় আসতেন টাকা ধার নেবার জন্য—‘বিশটা টাকা হোবে। কদিন পরেই লিয়ে দোব।’
‘লিয়ে দোব’ শব্দটা শুনে মুখে হাত দিয়ে হাসি চাপতাম। মাটির মানুষ আম্মাকেও দেখতাম ওনাকে দেখলে বিরক্ত হতে। খালাম্মা কখনো অন্য কোনো কারণে আসতেন না! শুধু টাকা ধার চাইতে আসতেন। শুধু আমাদের বাসা না, পাড়ার সব বাড়িতে যেতেন একই উদ্দেশ্যে।
আজাদের কাছে শুনেছি, দেশভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা থেকে ঢাকায় এসেছিল ওদের পরিবার। ধার করা খালাম্মার ছোট ছেলে আজাদ আমার সমবয়সী হলেও আমরা এক স্কুলে পড়তাম না। ও পড়ত বয়েজ স্কুলে আর আমি গার্লস স্কুলে। আজাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয় কচিকাঁচার আসর করতে গিয়ে। ওখানে আরও অনেকের মতো আজাদ ছিল আমার সাথি ভাই আর আমি ওর সাথি বোন।
‘আমি কি তোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকব?’
কচিকাঁচার আসরে গান আর ছবি আঁকা শিখতে আসা শিশুদের আমরা দেখাশোনা করতাম। সংগঠকের কাজ বলতে যা বোঝায়। কোনো দিন সন্ধ্যা হয়ে গেলে আজাদ আমার জন্য অপেক্ষা করত।
রজনী চৌধুরী রোডে কচিকাঁচার ভবন থেকে ডিস্ট্রিলারি রোডের বাসায় হেঁটে আসতে পনেরো-বিশ মিনিট লেগে যেত। ধূপখোলা মাঠের পূর্ব দিকে যে তিনটা গলি চলে গেছে, তার প্রথমটায় থাকতাম আমরা। আজাদেরা থাকত আমাদের বাসা থেকে আরও দশ মিনিট দূরত্বে।
কচিকাঁচায় যুক্ত থাকার কারণে সেই সময় খেলাঘরকে দুই চোখে দেখতে পারতাম না। স্কুলে তো অনেকের সঙ্গে রীতিমতো মারামারি লেগে যেত এ নিয়ে। কচিকাঁচার দুই সাথি ভাই-বোন আজাদ আর আমাকে অবশ্য কেউ সীমান্ত খেলাঘরের লাইব্রেরিতে যেতে আটকাতে পারত না। আজাদ আমাকে পথ দেখিয়েছিল লাইব্রেরির। মাসিক পনেরো টাকায় নিয়মিত ওখান থেকে বই নিয়ে এনে পড়তাম।
‘আচ্ছা, তোর মা সব সময় এভাবে ধার চাইতে আসে কেন?’
কথাটা বহুবার ঠোঁটের ডগায় এলেও আজাদকে বলা হয়নি। যেমন ওদের আমরা আড়ালে ঘটি বলে ডাকি, সেটা কখনো বলিনি। ওইটুকু ভদ্রতা-সভ্যতা আব্বা-আম্মা আমাদের ভাইবোনদের শিখিয়েছিলেন।
আব্বার পাড়াতো বন্ধুদের বেশির ভাগ ছিলেন এমন ক্যালকেশিয়ান। এমনকি বরিশালের অজ পাড়াগাঁ থেকে ঢাকায় আসা আম্মারও।
কেউন্দিয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পরে আম্মার বিয়ে হয় আব্বার সঙ্গে। তারপর ঢাকায় এসে গেন্ডারিয়ার ফজলুল হক মহিলা কলেজে ভর্তি হন। ওই কলেজে পড়ার সূত্রে আম্মার যত বান্ধবী হয়েছিল, তাদের বেশির ভাগ ছিলেন ক্যালকেশিয়ান। দেশভাগের পরে আসা মানুষগুলো আমাদের মহল্লায় শিক্ষাদীক্ষায় বেশ অগ্রসর ছিল।
ধার করা খালাম্মা আম্মার বান্ধবী ছিলেন না। তবে আম্মার বান্ধবী রেবা খালাম্মার সঙ্গে এক বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। যে কারণে মাসে দুই-তিনবার যাওয়া হতো ওনাদের বাসায়।
আজাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত মাঝেমধ্যে। বাসায় দেখা হয়ে গেলে ওকে খুব খুশি মনে হতো না। খুশি হওয়ার কোনো কারণও ছিল না ওর আশপাশে। ওর মা যে ধার করে বেড়ান সব জায়গায়, সেটা কিশোর বয়সে ওর স্বতঃস্ফূর্ততা শুষে নিয়েছিল। তদুপরি ওর ছিল মানসিকভাবে অসুস্থ দুই বোন, যাদের সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করতে দেখতাম আমি।
আজাদদের বাসার পাশে ছিল বস্তি, তার ওই পাশে রেললাইন। দিনরাত সেখান থেকে ট্রেন যেত প্রচণ্ড আওয়াজ করে। ট্রেনের শব্দ ওদের সহনীয় হয়ে গিয়েছিল। ওদের বাসায় ঢুকতেই একটা কুয়ার মতো ছিল দরজার সঙ্গে। ঢোকার মুখে খুব আতঙ্কে থাকতাম—যদি পা পিছলে কুয়ায় পড়ে যাই, তাহলে তো সলিলসমাধি হবে।
আম্মার বান্ধবী রেবা খালা আর ওনার দুই মেয়ে নীলা ও শিলা গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতিতে বেকারি, সেলাই, ইকেবানাসহ অনেক কিছু শেখাতেন। এত গুণ থাকার পরেও রেবা খালার দুই মেয়ের খুব ভালো বিয়ের সম্বন্ধ আসত না। পরে আম্মার কাছে শুনেছি, ঘটি বলে ওনাদের স্থানীয় পরিবার থেকে কেউ বিয়ে করতে চাইত না।
পাত্র পাওয়া না যাওয়ায় আম্মার দুজন ক্যালকেশিয়ান বান্ধবী শেলি খালা আর কামরুন খালার বিয়ে হয়েছিল বেশি বয়সে। তা-ও আবার বিপত্নীক লোকের সঙ্গে। শেলি আর কামরুন খালা একসঙ্গে পড়লেও আম্মার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। শুধু জেসমিন খালা ছিলেন আম্মার বয়সী, যে কারণে দুজনের মধ্যে ভাব ছিল বেশি। জেসমিন খালা আর ওনার দুই বোন লোটাস আর রোজ খালা—প্রত্যেকে ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী। সেই রকম সেজেগুজে ধূপখোলা মাঠের পশ্চিম পাশে মুরগিটোলার বাসা থেকে আমাদের বাসায় আসতেন দলেবলে।
তখন আমাদের বেশির ভাগ বাড়িতে টেলিভিশন থাকলেও ভিসিআর ছিল না। দোকান থেকে ভিডিও ক্যাসেট ভাড়া করে সবাই মিলে যেতাম ভিসিআর আছে এমন কারও বাড়িতে। ওই দিনগুলি ছিল আমার কাছে স্বপ্নের মতো। হিন্দি সিনেমার রঙিন কাহিনি আমাকে নিয়ে যেত কল্পনার অন্য জগতে।
চোখের সামনে ধীরে ধীরে শৈশবের পুরান ঢাকা পাল্টাতে লাগল। একতলা বাড়ির ছাদে উঠে জীতেন্দ্র-শ্রীদেবীর সিনেমার গল্প করার আর সময় পেতাম না। আশপাশে বাড়ির ছাদে যেসব ছেলে আমাদের সঙ্গে টাঙ্কি মারত, তারাও কোথায় হারিয়ে গেল।
একতলা ভবনগুলো চারতলা-পাঁচতলা ভবনে রূপান্তরিত হলো। ভবনগুলো উঁচু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষে মানুষে দূরত্ব বাড়ল। দূরত্ব মোচনের চেয়ে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নতিতে।
কলেজে ওঠার পরে পড়াশোনার ব্যস্ততা বাড়লেও কচিকাঁচার সঙ্গে আমার সম্পর্কের একদম ছেদ পড়তে দিইনি। তবে আজাদ আসত না আর। শুনেছি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পরে ও ইসলামপুরে এক থানকাপড়ের দোকানে কাজ নিয়েছে।
আব্বার সামর্থ্যের অভাবে আমাদের একতলা বাড়ি তখনো চার-পাঁচতলা হয়নি। আমাদের বাসাটা ছিল চার রাস্তার মোড়ে। বাসার এক পাশে ছিল ড্রেন, অন্য পাশে ট্যাপ কল। রিকশাওয়ালারা রিকশা থামিয়ে ওখানে পানি খেয়ে বিশ্রাম নিতেন।
বাসার সামনে একটা রকের মতো ছিল, যেখানে পাড়ার ছেলেরা বসে আড্ডা দিত। অনেক সময় আমরাও বসে থাকতাম। সেরকম একদিন আব্বা বসে পাড়ার একজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন আর আমরা আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলাম।
ধার করা খালাম্মা প্রচণ্ড রোদের মধ্যে কোথা থেকে হেঁটে আসছিলেন। পরনে মলিন শিফন শাড়ি আর হাতে একটা বাজারের থলে। এই বেশে তাঁকে দেখা যেত সব সময়। হঠাৎ মোড়ে এসে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন তিনি। আব্বা আর আশপাশের অনেকে ছুটে গিয়ে ওনাকে আমাদের বাড়ির রকে এনে শোয়ালেন। চারপাশে ভিড় জমে যেতে লাগল। সবার চোখে আন্তরিক সমবেদনা।
হয়তো আশপাশের সব বাড়ির মানুষ খালাম্মার কাছে টাকা পেতেন। এর জন্য কাউকে অভিযোগ করতে দেখলাম না, বরং তাঁর জীবনের বঞ্চনার কথা বলতে লাগলেন সবাই। স্বামীর রেখে যাওয়া সামান্য পেনশনের টাকায় দুই মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়েকে নিয়ে ওনার লড়াইয়ের বেদনাকে সবাই অনুভব করতেন। বিশ-ত্রিশ টাকা ধার করা মানুষের ওপর বিরক্ত হলেও কেউ ঘৃণা করতেন না ওনাকে। মানুষ তখনো রাঘববোয়ালদের বাদ দিয়ে চুনোপুঁটিদের নিয়ে ব্যস্ত হতে শেখেনি।
আম্মা এক গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে এসেছিলেন। কোনোক্রমে সেটা পান করানোর পরে দুই প্রতিবেশী বেবিট্যাক্সি ডেকে ওনাকে জনসন রোডে ন্যাশনাল হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। পরে উনি সুস্থ হয়ে ফিরলেও বেশ কাবু হয়ে গিয়েছিলেন।
বিয়ের পরে পুরান ঢাকা ছেড়ে নতুন ঢাকায় থিতু হলাম। মাসে একবার জ্যাম ঠেলে পুরান ঢাকায় যেতাম আব্বা-আম্মার সঙ্গে দেখা করতে। এর মধ্যে একদিন ঢাকা স্টেডিয়ামের বারান্দায় আজাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। স্টেডিয়ামের সুইমিংপুলের উল্টো দিকে ক্রীড়া সাংবাদিকদের অফিস থেকে আমি যাচ্ছিলাম প্রেসবক্সে ফুটবল ম্যাচ কভার করতে।
‘তুই এখানে! কত দিন পর দেখা!’
ছোটবেলার সেই হালকা-পাতলা টিনটিনে আজাদ এখন বেশ স্বাস্থ্যবান হয়ে গেছে। মাথার সামনে চুল পাতলা হতে শুরু করায় বেশ বয়স্ক ভাব চলে এসেছে।
আজাদের মুখে একটা ভালো লাগার হাসি খেলে যায়। শৈশবের বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ দেখার চেয়ে ভালো লাগার কী থাকতে পারে দুনিয়ায়!
‘আমার এক ফ্রেন্ড ডিপফ্রিজ কিনবে। ওকে নিয়ে যাব এক পরিচিত দোকানে।’
‘তোর বন্ধু কোথায়?’
‘দৈনিক বাংলা মোড়ে সিগন্যালে আছে, বলল এইমাত্র।’
‘ওহ্। তারপর তোর খবর কী?’
‘এই তো, ভালো। সদরঘাটে একটা শাড়ির দোকান দিয়েছি। বিয়েও করেছি দুই বছর হলো।’
‘দুই বছর! আমি কিছুই জানি না!’
‘আমার বউ সীমা বিক্রমপুরের মেয়ে। তুই মনে হয় চিনবি। পুকুরপাড়ে থাকত।’
‘তার মানে, প্রেমের বিয়ে!’
‘প্রেমের না হলে কি বিক্রমপুরের পরিবার ঘটি ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিত!’
আজাদের কথাটা শুনে থমকে যাই।
‘চাচার সঙ্গে একবার কথা হয়েছিল মসজিদে। তোর বিয়ের খবরও শুনেছি।’
‘হ্যাঁ, আমি আমার কলিগকে বিয়ে করেছি। মনে আছে, দুজনে মিলে সীমান্ত গ্রন্থাগার থেকে বই এনে ভাগাভাগি করে পড়তাম।’
‘কতকাল চলে গেল, বই হাতে নিইনি পড়ার জন্য!’
‘কী বলিস! তোর মাধ্যমেই তো পরিচয় বাংলা সাহিত্যের তিন সেরা ডিটেকটিভ, কী যেন নাম—টুনুদা, ঘনাদা আর ফেলুদার সঙ্গে।’
অবাক লাগে ভাবতে, একসময় আমরা কত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম, অথচ এখন দুজন দুজনের কিছুই জানি না। আজাদকে কখনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতাম না। ওই সুদূর শৈশবে বুঝতে পারতাম ব্যক্তিগত প্রশ্ন ওকে শুধু বিব্রত করে। তবু আজকে না করে পারলাম না।
‘তোর না দুই বোন ছিল, ওদের কী অবস্থা এখন?’
‘ওরা এখন সাভারে এক মানসিক পুনর্বাসনকেন্দ্রে আছে।’
আজাদের চেহারা ভাবলেশহীন।
‘আর খালাম্মা? উনি কেমন আছেন?’
‘ধার করা’ শব্দটা ঊহ্য রাখি। বহুদিন পরে ফ্যাকাশে চেহারার মলিন শিফন শাড়ি পরা খালাম্মার অবয়ব চোখে ভাসে।
‘আম্মা তো মারা গেছেন বছরখানেক হলো!’
‘কী বলিস! আমি তো কতবার এর মধ্যে গেন্ডারিয়া গেলাম। আব্বা-আম্মা তো বলল না! কী হয়েছিল ওনার?’
ওর মায়ের মৃত্যু যে আমার পরিবারের জন্য তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর নয়, আজাদ সেটা বুঝতে পারছিল। তবু ও ধীরে ধীরে বলল—‘আম্মার তো হাই ব্লাডপ্রেশার, ডায়বেটিস, গ্যাস্ট্রিক—সব সমস্যা ছিল। একটা থেকে ভুগে সুস্থ হলে আরেকটা এসে ধরত। শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন স্ট্রোক করে। ওনাকে আর বেশি কষ্ট করতে হলো না।’
আজাদের বন্ধু চলে এসেছে। ও বারবার ফোন করছে আজাদের মোবাইলে। ‘মসজিদে দেখা হলে চাচার কাছ থেকে আমি তোর নম্বর নিয়ে নেব, এখন যাই রে’ বলে আজাদ ঘুরে চলে যায়।
পেছন থেকে আজাদকে ডাকতে গিয়েও থেমে যাই। পেছন থেকে কাউকে ডাকা শুভ নয়। খুব জানার ইচ্ছে ছিল ধার করা খালাম্মার নাম কী ছিল। আম্মার বান্ধবী রেবা, শেলি, জেসমিন কিংবা কামরুন খালার মতোই কি কোনো নাম! আমার আর জানা হলো না।
সারা জীবন আমার স্মৃতিতে উনি ধার করা খালাম্মাই থেকে গেলেন।
আমরা ভাইবোনরা ওনাকে ডাকতাম ধার করা খালাম্মা। সব সময় আমাদের বাসায় আসতেন টাকা ধার নেবার জন্য—‘বিশটা টাকা হোবে। কদিন পরেই লিয়ে দোব।’
‘লিয়ে দোব’ শব্দটা শুনে মুখে হাত দিয়ে হাসি চাপতাম। মাটির মানুষ আম্মাকেও দেখতাম ওনাকে দেখলে বিরক্ত হতে। খালাম্মা কখনো অন্য কোনো কারণে আসতেন না! শুধু টাকা ধার চাইতে আসতেন। শুধু আমাদের বাসা না, পাড়ার সব বাড়িতে যেতেন একই উদ্দেশ্যে।
আজাদের কাছে শুনেছি, দেশভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা থেকে ঢাকায় এসেছিল ওদের পরিবার। ধার করা খালাম্মার ছোট ছেলে আজাদ আমার সমবয়সী হলেও আমরা এক স্কুলে পড়তাম না। ও পড়ত বয়েজ স্কুলে আর আমি গার্লস স্কুলে। আজাদের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয় কচিকাঁচার আসর করতে গিয়ে। ওখানে আরও অনেকের মতো আজাদ ছিল আমার সাথি ভাই আর আমি ওর সাথি বোন।
‘আমি কি তোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকব?’
কচিকাঁচার আসরে গান আর ছবি আঁকা শিখতে আসা শিশুদের আমরা দেখাশোনা করতাম। সংগঠকের কাজ বলতে যা বোঝায়। কোনো দিন সন্ধ্যা হয়ে গেলে আজাদ আমার জন্য অপেক্ষা করত।
রজনী চৌধুরী রোডে কচিকাঁচার ভবন থেকে ডিস্ট্রিলারি রোডের বাসায় হেঁটে আসতে পনেরো-বিশ মিনিট লেগে যেত। ধূপখোলা মাঠের পূর্ব দিকে যে তিনটা গলি চলে গেছে, তার প্রথমটায় থাকতাম আমরা। আজাদেরা থাকত আমাদের বাসা থেকে আরও দশ মিনিট দূরত্বে।
কচিকাঁচায় যুক্ত থাকার কারণে সেই সময় খেলাঘরকে দুই চোখে দেখতে পারতাম না। স্কুলে তো অনেকের সঙ্গে রীতিমতো মারামারি লেগে যেত এ নিয়ে। কচিকাঁচার দুই সাথি ভাই-বোন আজাদ আর আমাকে অবশ্য কেউ সীমান্ত খেলাঘরের লাইব্রেরিতে যেতে আটকাতে পারত না। আজাদ আমাকে পথ দেখিয়েছিল লাইব্রেরির। মাসিক পনেরো টাকায় নিয়মিত ওখান থেকে বই নিয়ে এনে পড়তাম।
‘আচ্ছা, তোর মা সব সময় এভাবে ধার চাইতে আসে কেন?’
কথাটা বহুবার ঠোঁটের ডগায় এলেও আজাদকে বলা হয়নি। যেমন ওদের আমরা আড়ালে ঘটি বলে ডাকি, সেটা কখনো বলিনি। ওইটুকু ভদ্রতা-সভ্যতা আব্বা-আম্মা আমাদের ভাইবোনদের শিখিয়েছিলেন।
আব্বার পাড়াতো বন্ধুদের বেশির ভাগ ছিলেন এমন ক্যালকেশিয়ান। এমনকি বরিশালের অজ পাড়াগাঁ থেকে ঢাকায় আসা আম্মারও।
কেউন্দিয়া হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করার পরে আম্মার বিয়ে হয় আব্বার সঙ্গে। তারপর ঢাকায় এসে গেন্ডারিয়ার ফজলুল হক মহিলা কলেজে ভর্তি হন। ওই কলেজে পড়ার সূত্রে আম্মার যত বান্ধবী হয়েছিল, তাদের বেশির ভাগ ছিলেন ক্যালকেশিয়ান। দেশভাগের পরে আসা মানুষগুলো আমাদের মহল্লায় শিক্ষাদীক্ষায় বেশ অগ্রসর ছিল।
ধার করা খালাম্মা আম্মার বান্ধবী ছিলেন না। তবে আম্মার বান্ধবী রেবা খালাম্মার সঙ্গে এক বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। যে কারণে মাসে দুই-তিনবার যাওয়া হতো ওনাদের বাসায়।
আজাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত মাঝেমধ্যে। বাসায় দেখা হয়ে গেলে ওকে খুব খুশি মনে হতো না। খুশি হওয়ার কোনো কারণও ছিল না ওর আশপাশে। ওর মা যে ধার করে বেড়ান সব জায়গায়, সেটা কিশোর বয়সে ওর স্বতঃস্ফূর্ততা শুষে নিয়েছিল। তদুপরি ওর ছিল মানসিকভাবে অসুস্থ দুই বোন, যাদের সারাক্ষণ ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করতে দেখতাম আমি।
আজাদদের বাসার পাশে ছিল বস্তি, তার ওই পাশে রেললাইন। দিনরাত সেখান থেকে ট্রেন যেত প্রচণ্ড আওয়াজ করে। ট্রেনের শব্দ ওদের সহনীয় হয়ে গিয়েছিল। ওদের বাসায় ঢুকতেই একটা কুয়ার মতো ছিল দরজার সঙ্গে। ঢোকার মুখে খুব আতঙ্কে থাকতাম—যদি পা পিছলে কুয়ায় পড়ে যাই, তাহলে তো সলিলসমাধি হবে।
আম্মার বান্ধবী রেবা খালা আর ওনার দুই মেয়ে নীলা ও শিলা গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতিতে বেকারি, সেলাই, ইকেবানাসহ অনেক কিছু শেখাতেন। এত গুণ থাকার পরেও রেবা খালার দুই মেয়ের খুব ভালো বিয়ের সম্বন্ধ আসত না। পরে আম্মার কাছে শুনেছি, ঘটি বলে ওনাদের স্থানীয় পরিবার থেকে কেউ বিয়ে করতে চাইত না।
পাত্র পাওয়া না যাওয়ায় আম্মার দুজন ক্যালকেশিয়ান বান্ধবী শেলি খালা আর কামরুন খালার বিয়ে হয়েছিল বেশি বয়সে। তা-ও আবার বিপত্নীক লোকের সঙ্গে। শেলি আর কামরুন খালা একসঙ্গে পড়লেও আম্মার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন। শুধু জেসমিন খালা ছিলেন আম্মার বয়সী, যে কারণে দুজনের মধ্যে ভাব ছিল বেশি। জেসমিন খালা আর ওনার দুই বোন লোটাস আর রোজ খালা—প্রত্যেকে ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী। সেই রকম সেজেগুজে ধূপখোলা মাঠের পশ্চিম পাশে মুরগিটোলার বাসা থেকে আমাদের বাসায় আসতেন দলেবলে।
তখন আমাদের বেশির ভাগ বাড়িতে টেলিভিশন থাকলেও ভিসিআর ছিল না। দোকান থেকে ভিডিও ক্যাসেট ভাড়া করে সবাই মিলে যেতাম ভিসিআর আছে এমন কারও বাড়িতে। ওই দিনগুলি ছিল আমার কাছে স্বপ্নের মতো। হিন্দি সিনেমার রঙিন কাহিনি আমাকে নিয়ে যেত কল্পনার অন্য জগতে।
চোখের সামনে ধীরে ধীরে শৈশবের পুরান ঢাকা পাল্টাতে লাগল। একতলা বাড়ির ছাদে উঠে জীতেন্দ্র-শ্রীদেবীর সিনেমার গল্প করার আর সময় পেতাম না। আশপাশে বাড়ির ছাদে যেসব ছেলে আমাদের সঙ্গে টাঙ্কি মারত, তারাও কোথায় হারিয়ে গেল।
একতলা ভবনগুলো চারতলা-পাঁচতলা ভবনে রূপান্তরিত হলো। ভবনগুলো উঁচু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষে মানুষে দূরত্ব বাড়ল। দূরত্ব মোচনের চেয়ে আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়লাম নিজেদের ব্যক্তিগত উন্নতিতে।
কলেজে ওঠার পরে পড়াশোনার ব্যস্ততা বাড়লেও কচিকাঁচার সঙ্গে আমার সম্পর্কের একদম ছেদ পড়তে দিইনি। তবে আজাদ আসত না আর। শুনেছি ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেওয়ার পরে ও ইসলামপুরে এক থানকাপড়ের দোকানে কাজ নিয়েছে।
আব্বার সামর্থ্যের অভাবে আমাদের একতলা বাড়ি তখনো চার-পাঁচতলা হয়নি। আমাদের বাসাটা ছিল চার রাস্তার মোড়ে। বাসার এক পাশে ছিল ড্রেন, অন্য পাশে ট্যাপ কল। রিকশাওয়ালারা রিকশা থামিয়ে ওখানে পানি খেয়ে বিশ্রাম নিতেন।
বাসার সামনে একটা রকের মতো ছিল, যেখানে পাড়ার ছেলেরা বসে আড্ডা দিত। অনেক সময় আমরাও বসে থাকতাম। সেরকম একদিন আব্বা বসে পাড়ার একজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন আর আমরা আসা-যাওয়ার মধ্যে ছিলাম।
ধার করা খালাম্মা প্রচণ্ড রোদের মধ্যে কোথা থেকে হেঁটে আসছিলেন। পরনে মলিন শিফন শাড়ি আর হাতে একটা বাজারের থলে। এই বেশে তাঁকে দেখা যেত সব সময়। হঠাৎ মোড়ে এসে মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন তিনি। আব্বা আর আশপাশের অনেকে ছুটে গিয়ে ওনাকে আমাদের বাড়ির রকে এনে শোয়ালেন। চারপাশে ভিড় জমে যেতে লাগল। সবার চোখে আন্তরিক সমবেদনা।
হয়তো আশপাশের সব বাড়ির মানুষ খালাম্মার কাছে টাকা পেতেন। এর জন্য কাউকে অভিযোগ করতে দেখলাম না, বরং তাঁর জীবনের বঞ্চনার কথা বলতে লাগলেন সবাই। স্বামীর রেখে যাওয়া সামান্য পেনশনের টাকায় দুই মানসিক ভারসাম্যহীন মেয়েকে নিয়ে ওনার লড়াইয়ের বেদনাকে সবাই অনুভব করতেন। বিশ-ত্রিশ টাকা ধার করা মানুষের ওপর বিরক্ত হলেও কেউ ঘৃণা করতেন না ওনাকে। মানুষ তখনো রাঘববোয়ালদের বাদ দিয়ে চুনোপুঁটিদের নিয়ে ব্যস্ত হতে শেখেনি।
আম্মা এক গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে এসেছিলেন। কোনোক্রমে সেটা পান করানোর পরে দুই প্রতিবেশী বেবিট্যাক্সি ডেকে ওনাকে জনসন রোডে ন্যাশনাল হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। পরে উনি সুস্থ হয়ে ফিরলেও বেশ কাবু হয়ে গিয়েছিলেন।
বিয়ের পরে পুরান ঢাকা ছেড়ে নতুন ঢাকায় থিতু হলাম। মাসে একবার জ্যাম ঠেলে পুরান ঢাকায় যেতাম আব্বা-আম্মার সঙ্গে দেখা করতে। এর মধ্যে একদিন ঢাকা স্টেডিয়ামের বারান্দায় আজাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। স্টেডিয়ামের সুইমিংপুলের উল্টো দিকে ক্রীড়া সাংবাদিকদের অফিস থেকে আমি যাচ্ছিলাম প্রেসবক্সে ফুটবল ম্যাচ কভার করতে।
‘তুই এখানে! কত দিন পর দেখা!’
ছোটবেলার সেই হালকা-পাতলা টিনটিনে আজাদ এখন বেশ স্বাস্থ্যবান হয়ে গেছে। মাথার সামনে চুল পাতলা হতে শুরু করায় বেশ বয়স্ক ভাব চলে এসেছে।
আজাদের মুখে একটা ভালো লাগার হাসি খেলে যায়। শৈশবের বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ দেখার চেয়ে ভালো লাগার কী থাকতে পারে দুনিয়ায়!
‘আমার এক ফ্রেন্ড ডিপফ্রিজ কিনবে। ওকে নিয়ে যাব এক পরিচিত দোকানে।’
‘তোর বন্ধু কোথায়?’
‘দৈনিক বাংলা মোড়ে সিগন্যালে আছে, বলল এইমাত্র।’
‘ওহ্। তারপর তোর খবর কী?’
‘এই তো, ভালো। সদরঘাটে একটা শাড়ির দোকান দিয়েছি। বিয়েও করেছি দুই বছর হলো।’
‘দুই বছর! আমি কিছুই জানি না!’
‘আমার বউ সীমা বিক্রমপুরের মেয়ে। তুই মনে হয় চিনবি। পুকুরপাড়ে থাকত।’
‘তার মানে, প্রেমের বিয়ে!’
‘প্রেমের না হলে কি বিক্রমপুরের পরিবার ঘটি ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিত!’
আজাদের কথাটা শুনে থমকে যাই।
‘চাচার সঙ্গে একবার কথা হয়েছিল মসজিদে। তোর বিয়ের খবরও শুনেছি।’
‘হ্যাঁ, আমি আমার কলিগকে বিয়ে করেছি। মনে আছে, দুজনে মিলে সীমান্ত গ্রন্থাগার থেকে বই এনে ভাগাভাগি করে পড়তাম।’
‘কতকাল চলে গেল, বই হাতে নিইনি পড়ার জন্য!’
‘কী বলিস! তোর মাধ্যমেই তো পরিচয় বাংলা সাহিত্যের তিন সেরা ডিটেকটিভ, কী যেন নাম—টুনুদা, ঘনাদা আর ফেলুদার সঙ্গে।’
অবাক লাগে ভাবতে, একসময় আমরা কত ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম, অথচ এখন দুজন দুজনের কিছুই জানি না। আজাদকে কখনো ব্যক্তিগত প্রশ্ন করতাম না। ওই সুদূর শৈশবে বুঝতে পারতাম ব্যক্তিগত প্রশ্ন ওকে শুধু বিব্রত করে। তবু আজকে না করে পারলাম না।
‘তোর না দুই বোন ছিল, ওদের কী অবস্থা এখন?’
‘ওরা এখন সাভারে এক মানসিক পুনর্বাসনকেন্দ্রে আছে।’
আজাদের চেহারা ভাবলেশহীন।
‘আর খালাম্মা? উনি কেমন আছেন?’
‘ধার করা’ শব্দটা ঊহ্য রাখি। বহুদিন পরে ফ্যাকাশে চেহারার মলিন শিফন শাড়ি পরা খালাম্মার অবয়ব চোখে ভাসে।
‘আম্মা তো মারা গেছেন বছরখানেক হলো!’
‘কী বলিস! আমি তো কতবার এর মধ্যে গেন্ডারিয়া গেলাম। আব্বা-আম্মা তো বলল না! কী হয়েছিল ওনার?’
ওর মায়ের মৃত্যু যে আমার পরিবারের জন্য তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ খবর নয়, আজাদ সেটা বুঝতে পারছিল। তবু ও ধীরে ধীরে বলল—‘আম্মার তো হাই ব্লাডপ্রেশার, ডায়বেটিস, গ্যাস্ট্রিক—সব সমস্যা ছিল। একটা থেকে ভুগে সুস্থ হলে আরেকটা এসে ধরত। শেষ পর্যন্ত চলে গেলেন স্ট্রোক করে। ওনাকে আর বেশি কষ্ট করতে হলো না।’
আজাদের বন্ধু চলে এসেছে। ও বারবার ফোন করছে আজাদের মোবাইলে। ‘মসজিদে দেখা হলে চাচার কাছ থেকে আমি তোর নম্বর নিয়ে নেব, এখন যাই রে’ বলে আজাদ ঘুরে চলে যায়।
পেছন থেকে আজাদকে ডাকতে গিয়েও থেমে যাই। পেছন থেকে কাউকে ডাকা শুভ নয়। খুব জানার ইচ্ছে ছিল ধার করা খালাম্মার নাম কী ছিল। আম্মার বান্ধবী রেবা, শেলি, জেসমিন কিংবা কামরুন খালার মতোই কি কোনো নাম! আমার আর জানা হলো না।
সারা জীবন আমার স্মৃতিতে উনি ধার করা খালাম্মাই থেকে গেলেন।
চারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
৭ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
১৪ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
১৪ দিন আগেদ্য ভেজিটেরিয়ানের পর হান কাঙের পরের উপন্যাস ছিল ‘দ্য উইন্ড ব্লোজ, গো’। এই উপন্যাস লেখার সময়ই ঘটে বিপত্তি! হান অনুভব করেন তিনি আর লিখতে পারছেন না। গত বছর নিজের পঞ্চম উপন্যাস ‘গ্রিক লেসন’ ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হলে স্পেনের এল-পাইস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি।
১০ অক্টোবর ২০২৪