সাদিয়া সুলতানা
মুরাদ বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে জোরে জোরে চিৎকার করছে, ‘ক-তে কুকুর...ক-তে কুকুর...।’ কুকুরের দলও সোল্লাসে চিৎকার করছে, ওউওওও...।
ছেলে ও কুকুরের কণ্ঠের সমবেত ধ্বনি কানে ঢুকতেই হামিদের শিরদাঁড়া মুচড়ে শিরশিরে একটা স্রোত ঘাড়ের দিকে উঠতে থাকে। বিছানায় উপুড় হয়ে দেহের ঊর্ধ্বাংশে বালিশ চাপা দিয়েও রক্ষা পায় না সে। কানের পর্দা ছিদ্র করে মগজের কোনায় কোনায় ছেলের ক-তে কুকুর...আর কুকুরের ওউওওও ওউওওও...ডাক ছড়িয়ে পড়ে।
বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হামিদ এবার গালাগাল করার প্রস্তুতি নেয়। যেদিন এপাড়ায় এসেছে, সেদিন থেকেই এই উৎপাত শুরু হয়েছে। এমনিতেই দশ দিক থেকে দশ উপদ্রব ধেয়ে আসছে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কবে শুরু হয় তার কোনো ঠিক নেই। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেছে। ইউক্রেনের প্রধান প্রধান শহর লক্ষ্য করে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। ওদিকে কোন দূর দেশে যুদ্ধ হচ্ছে আর এদিকে দেশে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ৫০ টাকা। শুধু কি তেলের দাম বেড়েছে? আজ হামিদ পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে মাসকাবারি বাজার করতে গিয়েছিল। শুকনো সদাইয়ে ব্যাগের অর্ধেকটা ভরতে না ভরতেই পকেটের টাকা ফুরিয়ে গেছে। সামনে রোজা, কী করে যে চারদিক সামাল দেবে, সেসব ভাবার ফুরসতও দিচ্ছে না কুকুরগুলো।
সারা জীবন শুনে এসেছে, কুকুর ডাকে ঘেউঘেউ। আর এই বজ্জাত কুকুরের দল ওউওওও ওউওওও শব্দে অবিরাম ডেকে চলে। এবার খিস্তি করতে ছাড়ে না হামিদ। ‘ওই শালা...’ বাবার কণ্ঠস্বর শুনে ছেলে চটজলদি অদৃশ্য হয়ে যায়। ওদিকে নতুন সঙ্গী পেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে চিৎকার করতে থাকে কুকুরের দল। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত আসতেই কুকুরের দলের কোরাস আরও উচ্চকিত হতে থাকে। পথচারীরা আড়ে আড়ে তাকাতে তাকাতে রাস্তা পার হয়। চেনা মানুষগুলোকে ছাড় দেয় ওরা, পাড়ায় ঢোকা আগন্তুক রিকশা থেকে নামতেই তাকে ঘিরে ধরে ‘ওউওওওও’ স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে।
সেদিন রাতে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ে, আকাশে মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ চমকায়। আচমকা পুরো পাড়া অন্ধকারে ঢেকে যায়। কুকুরগুলো অন্ধকারের ভেতরে কিসের আভাস পায় কে জানে, মুহূর্তের জন্যও বিরাম দেয় না। রাতভর ডেকে ডেকে পাড়া মাথায় তুলে রাখে।
অস্থির হামিদের মনে হতে থাকে পাশে শুয়ে থাকা আল্পনা বিদ্রুপের হাসি হাসছে। অন্ধকারের ভেতরেই সে আল্পনার ঠোঁটে লেগে থাকা হাসির বিচ্ছুরণটুকু দেখতে পায়। যদিও অন্ধকারের সান্নিধ্যে হাসির সমান্তরালে থাকা বিদ্রুপের অভিব্যক্তি হামিদের পরিষ্কারভাবে দেখতে পাওয়ার কথা নয়; তবু সে স্পষ্টভাবেই কিছু একটা দেখতে পায়। হামিদের ইচ্ছে করে এখনই আল্পনাকে টেনে আনে, তারপর কুকুরের মতো ওর গালে-ঠোঁটে কামড়ে দেয়। স্বামীর ভাবভঙ্গি দেখে সন্ত্রস্ত আল্পনা পিঠ ফিরে শুয়ে সে যাত্রা রক্ষা পেলেও হামিদ ওউওওও ডাক থেকে সহজে রক্ষা পায় না।
পরের দিন বিপত্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। এমনিতেই ওর মনমেজাজ বিশেষ ভালো ছিল না। অফিসে কুকুরের ওউওওও ডাক কানে না এলেও বসের অবিশ্রান্ত হাঁকডাক লেগেই থাকে। ‘বিমার টার্গেট পূরণ করতে না পারলে সামনের মাস থেকে অফিসে আসার দরকার নেই’ বলে বুড়ো ভামটা আজ এক বিঘত দীর্ঘ জিব বের করে হাঁপাতে শুরু করল। দেখে হামিদের মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, ‘ক-তে কুকুর।’
ভাগ্যিস, বুড়োটার কান অবধি পৌঁছায়নি কথাটা। ওদিকে অফিস থেকে বের হয়ে বাসা পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে বসের অশালীন কথাগুলো হামিদের কানের কাছে পুনরাবৃত্তি হচ্ছিল। খানিকটা আনমনা, বেখেয়াল হয়ে উঠেছিল সে। তখনই মোটা লেজের দামড়া একটা কালো কুকুর এসে ওর প্যান্ট খামচে ধরল। নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে হামিদের পা গিয়ে পড়ল খোলা ড্রেনের একেবারে ভেতরে।
পোড় খাওয়া মনে বাসায় ফিরে বাথরুমে ঢোকে হামিদ। পানির স্পর্শ পেতেই শরীর-মনে বেশ একটা ফুরফুরে ভাব হয়। হামিদের এই ভাব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। মুরাদ দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে বলে, ‘একটা নতুন স্কুলড্রেস লাগবে...।’
ছেলের কথা শেষ করতে দেয় না হামিদ। ছুটে এসে ছেলেকে চড়-থাপ্পড় মারতে থাকে। বাবার মার খেয়ে তাল সামলাতে পারে না মুরাদ, মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে অনুচ্চ স্বরে কুঁই কুঁই করে। কচিকণ্ঠের কান্নার সুর বিকৃত করে বাইরে একটা কুকুর ডেকে ওঠে, ওওওউউউ...।
হামিদ হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘কেমনে ছিঁড়ল হ্যাঁ...বাপের টাকার গাছ আছে না?’
আল্পনার শরীর থরথর কাঁপছে।
‘ক্লাস ফাইভে পড়া ছেলেরে লাথি-ঘুষি মারতেছেন? আপনি কি মানুষ?’
‘না, আমি মানুষ না...’
হামিদের কণ্ঠ ছাপিয়ে বাইরে কারও প্রবল চিৎকার শোনা যায়। পাশের বাসা থেকে হইচই ভেসে আসছে। ডোর ভিউতে চোখ রেখে হামিদ দেখার চেষ্টা করে কী নিয়ে এত হইচই। পাশের বাসার রন্টুর মা ছেলেকে মারছে। হামিদ দরজার কাছ থেকে সরে আসে। যার বাচ্চা সে মারবে, আদর করবে, তাতে কার কী? হামিদও তার বাচ্চাকে মারবে, সে নিজেও তো কত মার খেয়েছে।
হেফজখানা থেকে প্রথম যেবার পালায়, সেবার বাবা ওকে টেনেহিঁচড়ে ওস্তাদজির কাছে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, ‘হুজুর মাংসগুলা আপনার, হাড্ডিগুলা আমার।’ ওস্তাদজিও ওর মাংস খেয়েছিল একটু একটু করে। হামিদ তাই দ্বিতীয়বারের মতো হেফজখানা থেকে পালিয়েছিল।
হাফেজ হওয়া হয়নি ওর। বাবার বেহেশতে যাওয়ার পথও মসৃণ হয়নি। সেই দুঃখে বাবা হামিদকে প্রতিদিন রুটিন করে পেটাত।
হামিদের মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করে আল্পনা বলে, ‘বাচ্চাটারে একটু ছুটাই?’
আল্পনার আবদার শুনে খেঁকিয়ে ওঠে হামিদ। ‘নিজের কাজে যাও’ বলে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সিঁড়িঘরে নিরবচ্ছিন্ন শব্দ হচ্ছে। হামিদ গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে শব্দের উৎস খোঁজার চেষ্টা করে। তখনই দৃশ্যটা চোখে পড়ে ওর। হেফজখানার ওস্তাদজি যেভাবে ওর দেহে নিজেকে ঢোকাত, সেভাবে একটা মদ্দা কুকুর মাদি কুকুরের ভেতরে ঢুকছে। সঙ্গমরত প্রাণী দুটোকে দেখে শৈশবের আতঙ্ক জেগে ওঠার বদলে হামিদের দেহে কাম জেগে ওঠে। ঘরে ঢুকে হতবিহ্বল আল্পনাকে টানতে টানতে ও বিছানায় নিয়ে যায়। আল্পনার অনিচ্ছুক দেহকে বাগে আনতে হামিদকে বাড়তি পরিশ্রম করতে হয়। রতিক্লান্ত হামিদ ঘুমে চোখ বন্ধ করার মুহূর্তে ফের কুকুরের কোরাস শুরু হয়। নিজের মাথায় বালিশ চাপা দিয়ে কানে শব্দ প্রবেশের পথ বন্ধ করতে চায় হামিদ। ব্যর্থ হয়ে বিছানা ছেড়ে ঘরময় পায়চারি করে আর সিগারেটে আগুন ধরায়।
দিন দুয়েকের মধ্যে স্বস্তি মেলে।
বাজারের ফর্দ নিয়ে আল্পনার সঙ্গে অনর্থক বাদানুবাদ শেষে হামিদ সকাল সকাল বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে টের পায় কিছু একটা নেই।
এই সময়টায় বাড়ির উল্টো দিকের ফাঁকা জায়গার পুব পাশের আবর্জনার স্তূপের পাশে এক বা একাধিক কুকুর মুখ গুঁজে থাকে। বাসি-পচা ময়লা ঘেঁটে দুর্গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে এরা হাড়ের বখরা নিয়ে বচসা করে। অনর্গল ডাকচিৎকারে পাড়া মাথায় তোলে। আজ এসবের কিছুই নেই।
হামিদ অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে দেখে স্তূপীকৃত আবর্জনার ধারে একটা বাদামি কুকুর শুয়ে আছে। পাশে আরেকটা, এর পাশে আরেকটা, আরও একটা। ওদের শরীর নিশ্চল।
দেখতে দেখতে হামিদের আশপাশে কয়েকজন দর্শনার্থী এসে দাঁড়ায়। তাদের কথোপকথন থেকে জানা যায়, সকাল থেকে পাড়ার গলিতে গলিতে পনেরোটি কুকুরের মৃতদেহ দেখা গেছে। এ পাড়ারই একজন এদের খাবারের সঙ্গে বিষ খাইয়ে মেরেছে। দর্শনার্থী একজন
বলে, ‘উচিত কাজ।’
ঠিক এই কাজটিই হোক—মনেপ্রাণে সেটিই তো চাইছিল হামিদ। তবে কেন দৃশ্যটা দেখে ওর সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে উঠছে? হামিদ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই টের পায় ওর শিরদাঁড়া শিরশির করে ওঠে। শরীরের শিরা-উপশিরার পাতলা পর্দা ছিন্ন করে রক্তের স্রোত বেরিয়ে আসতে চায়। বুকের ভেতরে বাতাস নিতে গিয়ে মুখ হাঁ হয়ে যায় হামিদের। চোখের ঝলসানো মণি দুটো প্রসারিত করে সে দেখে দর্শনার্থীরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ওর দিকেই এগিয়ে আসছে সবাই। এদের প্রত্যেকের হাতে খাবার। পাউরুটি, মাংস, হাড়...।
মুরাদ বারান্দার গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে জোরে জোরে চিৎকার করছে, ‘ক-তে কুকুর...ক-তে কুকুর...।’ কুকুরের দলও সোল্লাসে চিৎকার করছে, ওউওওও...।
ছেলে ও কুকুরের কণ্ঠের সমবেত ধ্বনি কানে ঢুকতেই হামিদের শিরদাঁড়া মুচড়ে শিরশিরে একটা স্রোত ঘাড়ের দিকে উঠতে থাকে। বিছানায় উপুড় হয়ে দেহের ঊর্ধ্বাংশে বালিশ চাপা দিয়েও রক্ষা পায় না সে। কানের পর্দা ছিদ্র করে মগজের কোনায় কোনায় ছেলের ক-তে কুকুর...আর কুকুরের ওউওওও ওউওওও...ডাক ছড়িয়ে পড়ে।
বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হামিদ এবার গালাগাল করার প্রস্তুতি নেয়। যেদিন এপাড়ায় এসেছে, সেদিন থেকেই এই উৎপাত শুরু হয়েছে। এমনিতেই দশ দিক থেকে দশ উপদ্রব ধেয়ে আসছে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কবে শুরু হয় তার কোনো ঠিক নেই। রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করেছে। ইউক্রেনের প্রধান প্রধান শহর লক্ষ্য করে বিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। ওদিকে কোন দূর দেশে যুদ্ধ হচ্ছে আর এদিকে দেশে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে লিটারে ৫০ টাকা। শুধু কি তেলের দাম বেড়েছে? আজ হামিদ পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে মাসকাবারি বাজার করতে গিয়েছিল। শুকনো সদাইয়ে ব্যাগের অর্ধেকটা ভরতে না ভরতেই পকেটের টাকা ফুরিয়ে গেছে। সামনে রোজা, কী করে যে চারদিক সামাল দেবে, সেসব ভাবার ফুরসতও দিচ্ছে না কুকুরগুলো।
সারা জীবন শুনে এসেছে, কুকুর ডাকে ঘেউঘেউ। আর এই বজ্জাত কুকুরের দল ওউওওও ওউওওও শব্দে অবিরাম ডেকে চলে। এবার খিস্তি করতে ছাড়ে না হামিদ। ‘ওই শালা...’ বাবার কণ্ঠস্বর শুনে ছেলে চটজলদি অদৃশ্য হয়ে যায়। ওদিকে নতুন সঙ্গী পেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে চিৎকার করতে থাকে কুকুরের দল। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত আসতেই কুকুরের দলের কোরাস আরও উচ্চকিত হতে থাকে। পথচারীরা আড়ে আড়ে তাকাতে তাকাতে রাস্তা পার হয়। চেনা মানুষগুলোকে ছাড় দেয় ওরা, পাড়ায় ঢোকা আগন্তুক রিকশা থেকে নামতেই তাকে ঘিরে ধরে ‘ওউওওওও’ স্বরে চেঁচিয়ে ওঠে।
সেদিন রাতে মুষলধারে বৃষ্টি পড়ে, আকাশে মুহুর্মুহু বিদ্যুৎ চমকায়। আচমকা পুরো পাড়া অন্ধকারে ঢেকে যায়। কুকুরগুলো অন্ধকারের ভেতরে কিসের আভাস পায় কে জানে, মুহূর্তের জন্যও বিরাম দেয় না। রাতভর ডেকে ডেকে পাড়া মাথায় তুলে রাখে।
অস্থির হামিদের মনে হতে থাকে পাশে শুয়ে থাকা আল্পনা বিদ্রুপের হাসি হাসছে। অন্ধকারের ভেতরেই সে আল্পনার ঠোঁটে লেগে থাকা হাসির বিচ্ছুরণটুকু দেখতে পায়। যদিও অন্ধকারের সান্নিধ্যে হাসির সমান্তরালে থাকা বিদ্রুপের অভিব্যক্তি হামিদের পরিষ্কারভাবে দেখতে পাওয়ার কথা নয়; তবু সে স্পষ্টভাবেই কিছু একটা দেখতে পায়। হামিদের ইচ্ছে করে এখনই আল্পনাকে টেনে আনে, তারপর কুকুরের মতো ওর গালে-ঠোঁটে কামড়ে দেয়। স্বামীর ভাবভঙ্গি দেখে সন্ত্রস্ত আল্পনা পিঠ ফিরে শুয়ে সে যাত্রা রক্ষা পেলেও হামিদ ওউওওও ডাক থেকে সহজে রক্ষা পায় না।
পরের দিন বিপত্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়। এমনিতেই ওর মনমেজাজ বিশেষ ভালো ছিল না। অফিসে কুকুরের ওউওওও ডাক কানে না এলেও বসের অবিশ্রান্ত হাঁকডাক লেগেই থাকে। ‘বিমার টার্গেট পূরণ করতে না পারলে সামনের মাস থেকে অফিসে আসার দরকার নেই’ বলে বুড়ো ভামটা আজ এক বিঘত দীর্ঘ জিব বের করে হাঁপাতে শুরু করল। দেখে হামিদের মুখ ফসকে বেরিয়ে এল, ‘ক-তে কুকুর।’
ভাগ্যিস, বুড়োটার কান অবধি পৌঁছায়নি কথাটা। ওদিকে অফিস থেকে বের হয়ে বাসা পর্যন্ত পৌঁছাতে পৌঁছাতে বসের অশালীন কথাগুলো হামিদের কানের কাছে পুনরাবৃত্তি হচ্ছিল। খানিকটা আনমনা, বেখেয়াল হয়ে উঠেছিল সে। তখনই মোটা লেজের দামড়া একটা কালো কুকুর এসে ওর প্যান্ট খামচে ধরল। নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে হামিদের পা গিয়ে পড়ল খোলা ড্রেনের একেবারে ভেতরে।
পোড় খাওয়া মনে বাসায় ফিরে বাথরুমে ঢোকে হামিদ। পানির স্পর্শ পেতেই শরীর-মনে বেশ একটা ফুরফুরে ভাব হয়। হামিদের এই ভাব বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। মুরাদ দরজার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে ভীতসন্ত্রস্ত কণ্ঠে বলে, ‘একটা নতুন স্কুলড্রেস লাগবে...।’
ছেলের কথা শেষ করতে দেয় না হামিদ। ছুটে এসে ছেলেকে চড়-থাপ্পড় মারতে থাকে। বাবার মার খেয়ে তাল সামলাতে পারে না মুরাদ, মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে অনুচ্চ স্বরে কুঁই কুঁই করে। কচিকণ্ঠের কান্নার সুর বিকৃত করে বাইরে একটা কুকুর ডেকে ওঠে, ওওওউউউ...।
হামিদ হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘কেমনে ছিঁড়ল হ্যাঁ...বাপের টাকার গাছ আছে না?’
আল্পনার শরীর থরথর কাঁপছে।
‘ক্লাস ফাইভে পড়া ছেলেরে লাথি-ঘুষি মারতেছেন? আপনি কি মানুষ?’
‘না, আমি মানুষ না...’
হামিদের কণ্ঠ ছাপিয়ে বাইরে কারও প্রবল চিৎকার শোনা যায়। পাশের বাসা থেকে হইচই ভেসে আসছে। ডোর ভিউতে চোখ রেখে হামিদ দেখার চেষ্টা করে কী নিয়ে এত হইচই। পাশের বাসার রন্টুর মা ছেলেকে মারছে। হামিদ দরজার কাছ থেকে সরে আসে। যার বাচ্চা সে মারবে, আদর করবে, তাতে কার কী? হামিদও তার বাচ্চাকে মারবে, সে নিজেও তো কত মার খেয়েছে।
হেফজখানা থেকে প্রথম যেবার পালায়, সেবার বাবা ওকে টেনেহিঁচড়ে ওস্তাদজির কাছে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, ‘হুজুর মাংসগুলা আপনার, হাড্ডিগুলা আমার।’ ওস্তাদজিও ওর মাংস খেয়েছিল একটু একটু করে। হামিদ তাই দ্বিতীয়বারের মতো হেফজখানা থেকে পালিয়েছিল।
হাফেজ হওয়া হয়নি ওর। বাবার বেহেশতে যাওয়ার পথও মসৃণ হয়নি। সেই দুঃখে বাবা হামিদকে প্রতিদিন রুটিন করে পেটাত।
হামিদের মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করে আল্পনা বলে, ‘বাচ্চাটারে একটু ছুটাই?’
আল্পনার আবদার শুনে খেঁকিয়ে ওঠে হামিদ। ‘নিজের কাজে যাও’ বলে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। সিঁড়িঘরে নিরবচ্ছিন্ন শব্দ হচ্ছে। হামিদ গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে শব্দের উৎস খোঁজার চেষ্টা করে। তখনই দৃশ্যটা চোখে পড়ে ওর। হেফজখানার ওস্তাদজি যেভাবে ওর দেহে নিজেকে ঢোকাত, সেভাবে একটা মদ্দা কুকুর মাদি কুকুরের ভেতরে ঢুকছে। সঙ্গমরত প্রাণী দুটোকে দেখে শৈশবের আতঙ্ক জেগে ওঠার বদলে হামিদের দেহে কাম জেগে ওঠে। ঘরে ঢুকে হতবিহ্বল আল্পনাকে টানতে টানতে ও বিছানায় নিয়ে যায়। আল্পনার অনিচ্ছুক দেহকে বাগে আনতে হামিদকে বাড়তি পরিশ্রম করতে হয়। রতিক্লান্ত হামিদ ঘুমে চোখ বন্ধ করার মুহূর্তে ফের কুকুরের কোরাস শুরু হয়। নিজের মাথায় বালিশ চাপা দিয়ে কানে শব্দ প্রবেশের পথ বন্ধ করতে চায় হামিদ। ব্যর্থ হয়ে বিছানা ছেড়ে ঘরময় পায়চারি করে আর সিগারেটে আগুন ধরায়।
দিন দুয়েকের মধ্যে স্বস্তি মেলে।
বাজারের ফর্দ নিয়ে আল্পনার সঙ্গে অনর্থক বাদানুবাদ শেষে হামিদ সকাল সকাল বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে টের পায় কিছু একটা নেই।
এই সময়টায় বাড়ির উল্টো দিকের ফাঁকা জায়গার পুব পাশের আবর্জনার স্তূপের পাশে এক বা একাধিক কুকুর মুখ গুঁজে থাকে। বাসি-পচা ময়লা ঘেঁটে দুর্গন্ধ ছড়াতে ছড়াতে এরা হাড়ের বখরা নিয়ে বচসা করে। অনর্গল ডাকচিৎকারে পাড়া মাথায় তোলে। আজ এসবের কিছুই নেই।
হামিদ অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে দেখে স্তূপীকৃত আবর্জনার ধারে একটা বাদামি কুকুর শুয়ে আছে। পাশে আরেকটা, এর পাশে আরেকটা, আরও একটা। ওদের শরীর নিশ্চল।
দেখতে দেখতে হামিদের আশপাশে কয়েকজন দর্শনার্থী এসে দাঁড়ায়। তাদের কথোপকথন থেকে জানা যায়, সকাল থেকে পাড়ার গলিতে গলিতে পনেরোটি কুকুরের মৃতদেহ দেখা গেছে। এ পাড়ারই একজন এদের খাবারের সঙ্গে বিষ খাইয়ে মেরেছে। দর্শনার্থী একজন
বলে, ‘উচিত কাজ।’
ঠিক এই কাজটিই হোক—মনেপ্রাণে সেটিই তো চাইছিল হামিদ। তবে কেন দৃশ্যটা দেখে ওর সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে উঠছে? হামিদ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই টের পায় ওর শিরদাঁড়া শিরশির করে ওঠে। শরীরের শিরা-উপশিরার পাতলা পর্দা ছিন্ন করে রক্তের স্রোত বেরিয়ে আসতে চায়। বুকের ভেতরে বাতাস নিতে গিয়ে মুখ হাঁ হয়ে যায় হামিদের। চোখের ঝলসানো মণি দুটো প্রসারিত করে সে দেখে দর্শনার্থীরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ওর দিকেই এগিয়ে আসছে সবাই। এদের প্রত্যেকের হাতে খাবার। পাউরুটি, মাংস, হাড়...।
চারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
৭ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
১৪ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
১৪ দিন আগেদ্য ভেজিটেরিয়ানের পর হান কাঙের পরের উপন্যাস ছিল ‘দ্য উইন্ড ব্লোজ, গো’। এই উপন্যাস লেখার সময়ই ঘটে বিপত্তি! হান অনুভব করেন তিনি আর লিখতে পারছেন না। গত বছর নিজের পঞ্চম উপন্যাস ‘গ্রিক লেসন’ ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হলে স্পেনের এল-পাইস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি।
১০ অক্টোবর ২০২৪