বিজয়নগর (ব্রাহ্মণবাড়িয়া) প্রতিনিধি
মুদির দোকানে কিছুক্ষণ বসে থাকলে একটা অদ্ভুত গন্ধ নাকে লাগে। তেলের গন্ধ, তিসির গন্ধ, ডালের গন্ধ, বস্তার গন্ধ, মালামালভর্তি কার্টনের গন্ধ। এসব গন্ধ একদম ভালো লাগে না সিয়ামের। দোকানের ভেতরে বসলে এই গন্ধে তার মাথা ধরে আসে। আজও মাথাটা ধরেছে। কিন্তু এখন সেই গন্ধ থেকে কীভাবে মনোযোগ সরাবে, তা বসে বসে ভাবতে থাকে সে। দোকানের পেছন দিকের র্যাকের নিচে বড় একটি মাকড়সা জালে আটকা পড়েছে। তাই দেখে মজা লাগে সিয়ামের। জালে আটকানো মাকড়সার দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে, কীভাবে মাকড়সাটা জাল কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে।
চণ্ডীপুর বাজারের এই হাফিজ স্টোরে সিয়ামের বয়সী একটি ছেলেও কাজ করে। ওর নাম জাকির। বাজারের প্রায় সব দোকানেই এ রকম একটি করে ছেলে আছে। সিয়ামের সঙ্গে জাকিরের তেমন ভাব নেই। জাকিরের আদবকেতা সিয়ামের পছন্দ না। জাকির কোনো খদ্দেরকে স্যার ডাকে না। গত ঈদের ছুটিতে নাটোরে মামার বাড়িতে গিয়ে সিয়াম দেখে এসেছে, কেউ জিনিস কিনতে এলে দোকানের ছেলেরা তাদের স্যার ডাকে। ফিরে এসে সে কথা জাকিরকে বলেছে। জাকির তার কথা বিশ্বাস করেনি। উল্টো বলেছে, যারা জিনিস কিনতে আসে, তারা কি স্কুলের মাস্টার? জাকির সারা দিন দোকানের ভেতরে স্যান্ডো গেঞ্জি পরে বসে থাকে, সেটাও সিয়ামের পছন্দ না। তা ছাড়া জাকির ব্র্যাকের স্কুলে ভর্তি হয়ে পালিয়ে এসেছে। এখন সারা দিন দোকানেই কাজ করে।
সুবাস মলম কোম্পানির একজন বিক্রয় প্রতিনিধি এসেছে বাজারে। তাকে নিয়ে ব্যস্ত হাফিজ স্টোরের মালিক হাফিজ উদ্দিন। আগেরবারের পাওনা নিয়ে হিসাব-নিকাশ করছে। হাফিজের টাকা গোনা দেখে স্কুলের মজিদ স্যারের কথা মনে পড়ে সিয়ামের। স্যার একদিন ক্লাসে ‘আমি যদি কোটিপতি হতাম’ রচনা লিখতে দিয়েছিলেন সবাইকে। তাতে সবাই অকাতরে মিথ্যা কথা উগরে দিয়েছিল। সিয়ামের এক বন্ধু মজা করে বলেছিল, এক কোটি টাকা হাতে পেলে সে সব টাকা মানুষকে দান করে বান্দরবানে গুহাবাসী হবে। তাই নিয়ে ক্লাসে কত হাসাহাসি। আরেক বন্ধু স্যারকে বলেছিল, ‘আমি যদি কোটিপতি হতাম’-এর বদলে ‘কোটিপতি হওয়ার সহজ উপায়’ লিখে দিয়েছে সে। তাই শুনে স্যার খেপে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ব্যাটা, রবীন্দ্রনাথ হয়েছ, বেতায়ে পাছার ছাল তুলে দেব।’
মলম কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধির হাতে খান পাঁচেক ক্যালেন্ডার। সেগুলোর একটি হাফিজের হাতে দিয়ে চলে গেল। হাফিজ ক্যালেন্ডারটি জাকিরকে দিয়ে বলল, র্যাকে ঝুলায় দে। জাকির সেটা হাতে নিয়ে খুলে ধরে। এক পাতার বাংলা ক্যালেন্ডার। দুটি পাখি ঠোঁট ছুঁয়ে আছে, পেছনে দিগন্তবিস্তৃত ধানখেত। সিয়াম ক্যালেন্ডারটা দেখতে চায়। কিন্তু জাকির তাকে দেখতে না দিয়ে দোকানের মাঝের একটি র্যাকে ঝুলিয়ে দেয়।
হাফিজ স্টোরে সিয়ামের বসে থাকা দেড় ঘণ্টা হয়ে গেছে। আরও অনেক সময় থাকতে হবে। এতক্ষণ দোকানে বসে থাকতে তার একদম ভালো লাগে না। তবু প্রতি শনিবার তাকে এভাবে এই দোকানে বসে অপেক্ষা করতে হয়। সিয়ামের এই কাজ নিয়ে বন্ধুরা ঠাট্টা-তামাশা করে। দালালের বাচ্চা দালাল। তোর বাপ বড় দালাল আর তুই ছোট দালাল। দালাল শব্দটি শুনে খুব মন খারাপ হয় সিয়ামের।
চণ্ডীপুর বাজারে প্রতি শনিবার গরুর হাট বসে। সিয়ামের বাবা আলিম উদ্দিন সেই হাটে গরু কেনাবেচার দালাল। সিয়ামের কাজ গরু কেনাবেচায় বাবাকে সাহায্য করা। গত শনিবারও গরুর হাট বসেছিল, সিয়াম হাটে আসেনি। বাবা হাট থেকে বাড়ি ফিরে অনেক বকাঝকা করেছে। মায়ের কাছে বলেছে, সিয়াম হাটে থাকলে টাকা আরও বেশি হতো।
সিয়ামের বাবা আলিম উদ্দিন আগে পুঠিয়ার একটি সেমাই কারখানায় কাজ করত। করোনার কারণে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর দুই বছর ধরে নানা চেষ্টা-তদবির করেও কাজ জোটেনি। পরে গরু কেনাবেচাকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। গ্রামের লোকেরা তাকে গরুর দালাল বলে তামাশা করে। তাতে কোনো রা করে না আলিম উদ্দিন; বরং অন্যের মুখের ওপর শুনিয়ে দেয়, ‘কাজ করে খাই, চুরি তো করি না।’
আলিমের দুটোই ছেলে। ছোটটি কোলের। সিয়াম বড়, সে এইটে পড়ে। এমনিতে স্কুলে তার পড়াশোনায় অনেক চাপ। তার পরও প্রতি শনিবার বাবার সঙ্গে হাটে আসতে হয়। শনিবারের টিফিনের পর একটা ক্লাস থাকে। সেই ক্লাস করা হয় না সিয়ামের। প্রতিবারই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তাকে হাটে আসতে হয়।
হাটের এই মুদিদোকানি হাফিজ উদ্দিন সিয়ামের বাবার বন্ধু। ছেলে স্কুল থেকে এসে যাতে কিছু সময় অপেক্ষা করতে পারে, সে জন্য হাফিজকে বলে দিয়েছে সিয়ামের বাবা। সিয়াম এখন স্কুল থেকে সোজা হাটে এসে হাফিজের দোকানে বসে বাবার জন্য অপেক্ষা করে।
আজ সিয়ামের টিফিনের পরে অঙ্কের ক্লাস ছিল। অঙ্কের শিক্ষক শাহজাহান আলী খুবই কড়া। অঙ্ক না পারলে পরের দিন ক্লাসে দাঁড় করিয়ে রাখবেন। সিয়ামের আজ হাটে আসার কোনো ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু মা বারবার সিয়ামকে বলে দিয়েছে, তার বাবার শরীরটা খুব খারাপ। বুকে ব্যথা করছে দুদিন ধরে। সিয়াম হাটে গেলে বাবাকে সাহায্য করার পাশাপাশি দেখাশোনা করতে পারবে। বাবার শরীর খারাপের কথা সিয়ামের কাছে অঙ্কের না মেলা সূত্রের মতো বড় গোলমেলে লাগে।
সকালে স্কুলে আসার সময় বাবাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখেছে সিয়াম। বাবা এ সময় কখনো শুয়ে থাকে না। সিয়ামকে মা বলেছিল, ‘তোর বাপের শরীরডা খুব খারাপ।’ সিয়াম এ কথা শুনে প্রথমে খুশিই হয়েছিল; ভেবেছিল, আজ তাকে হাটে যেতে হবে না। হাটের এই কাজটা সিয়ামের একদম পছন্দ না। কিন্তু সেটা কখনো কারও কাছে বলেনি, মায়ের কাছেও না। বাবার কথামতো কাজটা খুব গোপনে করে সিয়াম। বাবা-ছেলের এই গোপন চুক্তি যাতে ফাঁস না হয়, সে ব্যাপারে সিয়ামও বেশ সতর্ক।
গরুর হাটের দিনে বেশির ভাগ সময় সিয়াম হাফিজের দোকানে বসে থাকে। শুধু দরকার হলেই বাবা তাকে ডেকে পাঠায়। এরপর সিয়াম হাটের ভেতরে ঢুকে যায়। হাটের ভেতরে তার কাজও খুব সামান্য। তবে কাজটা বড় অদ্ভুত। অবশ্য সব হাটবারে তাকে এ কাজ করতেও হয় না।
গরুর হাটে দুই ধরনের ক্রেতা আসে। বেশির ভাগ ক্রেতা আসে ঢাকাসহ বিভিন্ন মোকাম থেকে। তারা ট্রাক সঙ্গে নিয়ে আসে। এরা গরুর বড় ব্যাপারী। গরু কিনে তারা ট্রাকে করে ঢাকায় নিয়ে যায়। আর আসে গেরস্ত ধরনের ক্রেতা। তারা গরু কেনে কোরবানি দেওয়া বা বাড়িতে রাখার জন্য। গরুর ব্যাপারীদের চোখ থাকে সীমান্তের ওপার থেকে আসা ভারতীয় বড় আকৃতির গরুর দিকে। সরাসরি করিডর থেকে এসব গরু হাটে আসে। মাংস ব্যবসায়ীদের জন্য করিডরের গরুতে পড়তা বেশি। কিন্তু যারা কোরবানি দেওয়া বা বাড়িতে রাখার জন্য গরু কেনে, তাদের চোখ থাকে গেরস্ত বাড়ির দেশি গরুর দিকে। এসব গরুর দামও তুলনামূলক বেশি। কাজেই সীমান্তের ওপার থেকে আনা ছোট গরুকে দেশি গরু বলে চালালেই লাভ, তাতে বেশি দাম পাওয়া যাবে। গরু কেনাবেচার এই ব্যবসায় আলিম উদ্দিন এই সামান্য চালাকিটুকু করে। এতে তার বেশ লাভ হয়।
প্রথম প্রথম আলিম উদ্দিনের নিজের কাছেও কাজটা খারাপ মনে হতো। মনে মনে ভেবেছিল, এসব ছেড়ে দেবে। কিন্তু খবরের কাগজে দেখেছে, কত মানুষ ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে বিদেশে বাড়ি-গাড়ি করে আরামে আছে। অভাবের সংসারে এই সামান্য চালাকিকে বড় কোনো পাপ মনে হয়নি তার। তার চেয়ে লাভ বাড়াতে সিয়ামকেও এ কাজে নামিয়েছে। এখন বেশ ভালোই চলছে। মাসে দু-একটা হাট না করলেও দিব্যি সংসার চলে যায়। আলিমের স্ত্রী মাবিয়া খাতুনও স্বামীর এই আয়-রোজগারে বেশ খুশি।
এখন হাটের দিন করিডরের পাইকারদের কাছ থেকে বেছে বেছে ছোট আকারের গরু কেনে আলিম উদ্দিন। তার লক্ষ্য থাকে করিডরের গরুকে যেন গেরস্তের বাড়িতে পোষা গরু বলে খদ্দেরের হাতে গছিয়ে দেওয়া যায়। এই কাজ খুব সতর্কতার সঙ্গে করে আলিম, যাতে কেউ সন্দেহ না করে। আবার খুব চেনা লোক হলেও এসব কাজ করা যায় না। সে জন্য ক্রেতা এলে সব বুঝেশুনে ছেলেকে দরকারমতো কাজে লাগায় আলিম উদ্দিন। শুধু অচেনা খদ্দের হাটে এলেই এই সামান্য চালাকিটা করে সে।
গত শনিবারও হাটে এ রকম দুটি বকনা গরু বিক্রি করেছে আলিম। কপাল ভালো ছিল। দুজন খদ্দেরই অচেনা। সব বাদ দিয়েও ৪ হাজার করে লাভ হয়েছে। হাট শেষে হাফিজের দোকানে সদাই করে সিয়ামকে সঙ্গে করে বাড়ি ফিরেছে আলিম উদ্দিন।
সেদিনও সিয়াম আগের মতো হাফিজের দোকানে বসে ছিল। খদ্দেরের সঙ্গে দামদর ঠিক হওয়ার উপক্রম হতেই হাফিজের ফোনে মিসড কল দিয়েছে আলিম। হাফিজের ইশারা পেয়ে হাটের ভেতরে চলে যায় সিয়াম। সিয়ামের কাজ হলো বিক্রি হওয়ার আগেই গরুর রশি ধরে কান্নাকাটি করা। কথা যা বলার আলিমই বলে। সিয়াম শুধু গরুর রশি ধরে নীরবে কাঁদতে থাকে। আলিম খদ্দেরদের কাছে ছেলের কান্নার বিশদ বিবরণ দেয়। বলে, গেরস্তের বাড়ির গরু সন্তান ছাড়া কিছুই না। সন্তানের মতো সেই গরু বাড়িতে লালন-পালন করা হয়েছে। বাড়ির সবার মতো তার ছোট ছেলেটারও গরুর প্রতি মায়া পড়েছে। সেই গরু বিক্রি করা হচ্ছে বলে স্কুল থেকে দৌড়ে হাটে এসেছে। খদ্দেরকে দেখিয়ে বলে, দেখেন ভাই, গরুটা বেচা হচ্ছে দেখে ছেলেটা কেমন কান্নাকাটি করছে। এতে ক্রেতার মন গলতে থাকে। কেউ কেউ বলে, এত ছোট বাচ্চা ছেলেকে কষ্ট দিয়ে গরু বেচবেন কেন? বাড়ির পোষা গরু বাড়িতেই নিয়ে যান। কিন্তু আলিম উদ্দিনের সেই এক জবাব, ভাই, অভাবের সংসার। গরু না বেচলে চলবে কী করে? আলিমের আচরণ এমন যে নিতান্তই অভাবে পড়ে এই গরু হাটে তুলেছে। দরকার হলে গৃহিণীর প্রসঙ্গও টেনে আনা হয়। বউয়ের ইচ্ছা ছিল পোষা গরু নিজের হাতে কোরবানি দেবে। কিন্তু বেচতে হচ্ছে অভাবের কারণে। সিয়ামকে খুব বেশিক্ষণ কান্নাকাটির অভিনয় করতে হয় না। আলিম এই সময়ে ছেলেকে বুঝ মানানোর নানা চেষ্টার অভিনয় করে। এরপর তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে এমন ভান করে। সিয়ামকে সব আগে থেকে শেখানো আছে। সে-ও গরুর রশি ছেড়ে সহজে যেতে চায় না। কখনো কখনো গরুর গলা জড়িয়ে ধরে আদর করার ভান করে। তবে গরুর গলা জড়িয়ে ধরা সিয়ামের ভালোই লাগে। গরু বেয়াড়া হলে একটু সমস্যা হয়। একবার এক গরু তাকে শিং দিয়ে গুঁতো দিয়েছিল। পায়ের সেই দাগ এখনো মেলেনি।
এই সামান্য অভিনয় করার ক্ষেত্রেও এত দিনে বাবার সব ইশারা বুঝে গেছে সিয়াম। খদ্দেরের মন গলছে বুঝতে পারলেই ছেলেকে ইশারা করে আলিম উদ্দিন। সেই ইশারা পেয়ে বাধ্য ছেলের মতো হাটের ভেতর থেকে আস্তে করে চলে আসে সিয়াম। আলিমের কাছে ছেলের এই অভিনয়টুকুর অনেক দাম। ক্রেতারা মনে করে, এটা সত্যিই গেরস্তের বাড়ির পোষা গরু। তখন দাম নিয়ে আর কোনো সমস্যা হয় না। বাগে ফেলতে পারলে ক্রেতার কাছ থেকে বাড়তি ৪-৫ হাজার টাকাও আদায় করা যায়।
সিয়াম একবার বাবার কাছে বলেছিল, তার মনে হয়েছে, এই কাজটা ঠিক হচ্ছে না। আলিম ছেলের ওপর রাগ না করে বলেছে, বড়লোকেরা কত রকম অন্যায় করে, জানিস? সে তুলনায় এটা কোনো অন্যায়ই না। ছেলের মন রাখতে নতুন জামা কিনে দেওয়ার কথাও তুলেছিল আলিম। সিয়ামও আর কথা বাড়ায়নি।
হাটের ভেতরের এই অভিনয়টুকু শেষ হওয়ার পর সিয়ামকে আবার অপেক্ষা করতে হয় হাফিজের দোকানে। গরু কেনাবেচা শেষ হলে আলিম ফিরে আসে হাফিজের মুদিদোকানে। সংসারের জন্য সদাইপাতি নিয়ে ছেলেসমেত বাড়ি ফেরে। সিয়ামের মাঝেমধ্যে নানা জিনিসের আবদার থাকে। বাড়িতে তার ছোট ভাই আছে। দুই ভাইয়ের জন্য সবই কিনে দেয় আলিম। গেল হাটে আবুলের দোকানের গরম জিলাপি চেয়েছিল সিয়াম। বাড়িতে যাওয়ার পর মা সেই জিলাপি দেখে অনেক খুশি। হাটের গুড়ের জিলাপি তারও ভারি পছন্দের।
আজ দোকানে বসে থাকতে সিয়ামের আর ভালো লাগছে না। অনেক সময় হয়েছে, কিন্তু হাটের ভেতর থেকে কোনো ডাক আসেনি। দোকানি হাফিজের মাথায়ও বিষয়টা ঢুকেছে। হাফিজ একবার সিয়ামকে বলেছে, ‘আজ কী হইছে রে, মিস কল আসে না যে!’ সিয়াম কিছু বলেনি। তার একবার ইচ্ছে করছে হাটের ভেতরে গিয়ে দেখে আসার। কিন্তু বাবার কড়া বারণ আছে, না ডাকলে যাওয়া যাবে না।
সিয়াম অপেক্ষা করতে থাকে, কিন্তু তার মনটা ছটফট করে। মা বলেছিল, তোর বাবার শরীরটা ভালো না। বুকের বাঁ দিকে দুদিন ধরে চিনচিন করছে। মায়ের কথা খুব মনে পড়ে সিয়ামের। হাফিজ একবার সিয়ামকে বলেছে, ‘চিন্তা করিস না। পেচ্ছাব লাগলে হাটের ভেতরটাও ঘুরে আসব।’ তবু সিয়াম বাবার মিসড কলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
বেলা পড়ে গেলেই গরুর হাটের কেনাবেচা শেষ হয়। এখন প্রায় সন্ধ্যা। একটু পরে আজান হবে। তবু হাট শেষ হচ্ছে না। সিয়ামের কাছে সবকিছু বিরক্তিকর লাগে। সে দোকানের ভেতর থেকে বাইরে আসে। হাটের দিকে উঁকি দিতেই একজনকে দৌড়ে আসতে দেখে। ঝড়ের বেগে আসা লোকটা হাফিজকে বলে, ‘তোর বন্ধু হাটের মধ্যে ফিট হয়ে গ্যাছে, আমি ডাক্তার নিয়ে আসি।’ মুহূর্তে হাফিজের মুখ শুকিয়ে যায়। ‘এই সিয়াম আয় তো’—বলেই সিয়ামের হাতে জোরে টান মেরে হাটের দিকে দৌড়াতে থাকে। সিয়াম কিছু না বুঝেই হাফিজের পিছে দৌড় দেয়।
হাটের ভেতরে অনেক মানুষের ভিড়। হাটের ইজারাদার যেখানে বসে হাসিল আদায় করে, সেই চরাটের ওপরে একজনকে শোয়ানো। চারপাশে অনেক মানুষ। হাফিজ ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায়। সিয়ামকে টেনে ভেতরে নিয়ে বলে, ‘দেখ তো, বাপের কী হইছে’। সিয়াম কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। তাকিয়ে দেখে, তার বাবা নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে শুয়ে আছে। সিয়াম আব্বা আব্বা বলে ডাকে, কোনো সাড়া মেলে না।
একটু পরে ‘সরো সরো’ বলে হাটের ভেতর থেকে এগিয়ে আসেন পল্লিচিকিৎসক ফজলু মিয়া। সবাইকে সরতে বলে আলিমের বাঁ হাত একটু উঁচু করে ধরেন ফজলু। কিছুক্ষণ পালস বোঝার চেষ্টা করেন। স্টেথিস্কোপটা বুকের ওপর ঠেসে ধরেন। কয়েক মিনিট নীরব থেকে বলে ওঠেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। সঙ্গে সঙ্গে শোরগোল পড়ে যায়। ‘ও আল্লা রে...’ বলে সিয়ামকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে হাফিজ। সেই কান্না সংক্রমিত হয় হাটের লোকেদের মধ্যে। সিয়াম অবাক হয়ে হাফিজের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে কিছুই বুঝতে পারে না।
সিয়াম জানে না, এরপর কী হবে। শুয়ে থাকা লোকটি ঘিরে হাটের মানুষের ভিড় বাড়তেই থাকে। সবাই বলতে থাকে, আলিম দালাল মারা গেছে। এভাবে বেশ কিছু সময় চলে যায়। ইজারাদার আরিফ উদ্দিন একটু পরে এসে হাফিজকে ফাঁকে ডেকে নেয়। আস্তে আস্তে বলে, লাশটি বাড়ি নিয়ে যাও, হাটে বিদেশি ব্যাপারী আছে। এই বলে সে একজনকে হাঁক দিয়ে বলে, ‘এই মফিজ, একটা ভ্যান ডাক’। একটু পরে তিন চাকার একটি ভ্যান নিয়ে আসে মফিজ। সবাই ধরাধরি করে আলিমের মৃতদেহ সেই ভ্যানে তুলে দেয়। ইজারাদার হাফিজকে বলে, সে তো তোমার বন্ধু, ছেলেটাকে নিয়ে ভ্যানের সামনে বসো। এরপর সিয়ামের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বলে, ‘বাবা, এই টাকাটা মায়ের হাতে দিয়ো।’ ইজারাদার ভ্যানচালককে ধমক দিয়ে বলে, ‘লাশটায় একটু বান্ধন দাও, রাস্তা খারাপ তো।’ ইজারাদারের ধমক খেয়ে ভ্যানচালক রশির এক মাথায় একটি প্যাঁচ দিয়ে সিয়ামকে বলে, বাবা, রশির এই মাথাটা শক্ত করে ধরো।
শত শত মানুষের ভিড় ঠেলে ভরা হাটের ভেতর থেকে লাশবাহী ভ্যান বেরিয়ে যায়। হাট থেকে মূল সড়কে ওঠার মুখে সিয়াম দেখতে পায়, জাকির রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে কাঁদছে। এই প্রথম জাকিরকে তার খুব আপন মনে হয়। জাকিরকে দেখে খ্যাক করে ওঠে হাফিজ, ‘তুই এখানে, দোকানে কেউ নাই? যা যা, দোকানে যা’। ভ্যান রাস্তায় উঠে চলতে থাকে।
ভ্যানের ওপরে বাবার লাশ বাঁধা রশির একটা প্রান্ত ধরে বসে থাকে সিয়াম। প্রতি শনিবার হাটে এভাবে গরুর রশি ধরে কেঁদেছে সিয়াম, অনিচ্ছায় বহুদিন কান্নার অভিনয় করেছে। কিন্তু আজ তার সত্যিই খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে। তবু কাঁদতে পারছে না। নিজের কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারে না সে। বাড়ি গিয়ে মাকে কী বলবে, ছোট ভাইকে কী বলবে, কোনো কিছুই ঠিক করতে পারে না সিয়াম।
হাফিজ ভ্যানচালককে তাড়া দিয়ে বলে, আন্ধার হয়ে আসছে, একটু জোরে পা চালাও...। মাগরিবের নামাজ শেষ হয়েছে, চরাচরে অন্ধকার ধেয়ে আসছে। সিয়াম দেখতে থাকে, তার সামনের পথও বড় অন্ধকার, যে অন্ধকারের দিকে ক্রমশ সে তলিয়ে যাচ্ছে।
মুদির দোকানে কিছুক্ষণ বসে থাকলে একটা অদ্ভুত গন্ধ নাকে লাগে। তেলের গন্ধ, তিসির গন্ধ, ডালের গন্ধ, বস্তার গন্ধ, মালামালভর্তি কার্টনের গন্ধ। এসব গন্ধ একদম ভালো লাগে না সিয়ামের। দোকানের ভেতরে বসলে এই গন্ধে তার মাথা ধরে আসে। আজও মাথাটা ধরেছে। কিন্তু এখন সেই গন্ধ থেকে কীভাবে মনোযোগ সরাবে, তা বসে বসে ভাবতে থাকে সে। দোকানের পেছন দিকের র্যাকের নিচে বড় একটি মাকড়সা জালে আটকা পড়েছে। তাই দেখে মজা লাগে সিয়ামের। জালে আটকানো মাকড়সার দিকে তাকিয়ে দেখতে থাকে, কীভাবে মাকড়সাটা জাল কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে।
চণ্ডীপুর বাজারের এই হাফিজ স্টোরে সিয়ামের বয়সী একটি ছেলেও কাজ করে। ওর নাম জাকির। বাজারের প্রায় সব দোকানেই এ রকম একটি করে ছেলে আছে। সিয়ামের সঙ্গে জাকিরের তেমন ভাব নেই। জাকিরের আদবকেতা সিয়ামের পছন্দ না। জাকির কোনো খদ্দেরকে স্যার ডাকে না। গত ঈদের ছুটিতে নাটোরে মামার বাড়িতে গিয়ে সিয়াম দেখে এসেছে, কেউ জিনিস কিনতে এলে দোকানের ছেলেরা তাদের স্যার ডাকে। ফিরে এসে সে কথা জাকিরকে বলেছে। জাকির তার কথা বিশ্বাস করেনি। উল্টো বলেছে, যারা জিনিস কিনতে আসে, তারা কি স্কুলের মাস্টার? জাকির সারা দিন দোকানের ভেতরে স্যান্ডো গেঞ্জি পরে বসে থাকে, সেটাও সিয়ামের পছন্দ না। তা ছাড়া জাকির ব্র্যাকের স্কুলে ভর্তি হয়ে পালিয়ে এসেছে। এখন সারা দিন দোকানেই কাজ করে।
সুবাস মলম কোম্পানির একজন বিক্রয় প্রতিনিধি এসেছে বাজারে। তাকে নিয়ে ব্যস্ত হাফিজ স্টোরের মালিক হাফিজ উদ্দিন। আগেরবারের পাওনা নিয়ে হিসাব-নিকাশ করছে। হাফিজের টাকা গোনা দেখে স্কুলের মজিদ স্যারের কথা মনে পড়ে সিয়ামের। স্যার একদিন ক্লাসে ‘আমি যদি কোটিপতি হতাম’ রচনা লিখতে দিয়েছিলেন সবাইকে। তাতে সবাই অকাতরে মিথ্যা কথা উগরে দিয়েছিল। সিয়ামের এক বন্ধু মজা করে বলেছিল, এক কোটি টাকা হাতে পেলে সে সব টাকা মানুষকে দান করে বান্দরবানে গুহাবাসী হবে। তাই নিয়ে ক্লাসে কত হাসাহাসি। আরেক বন্ধু স্যারকে বলেছিল, ‘আমি যদি কোটিপতি হতাম’-এর বদলে ‘কোটিপতি হওয়ার সহজ উপায়’ লিখে দিয়েছে সে। তাই শুনে স্যার খেপে গিয়ে বলেছিলেন, ‘ব্যাটা, রবীন্দ্রনাথ হয়েছ, বেতায়ে পাছার ছাল তুলে দেব।’
মলম কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধির হাতে খান পাঁচেক ক্যালেন্ডার। সেগুলোর একটি হাফিজের হাতে দিয়ে চলে গেল। হাফিজ ক্যালেন্ডারটি জাকিরকে দিয়ে বলল, র্যাকে ঝুলায় দে। জাকির সেটা হাতে নিয়ে খুলে ধরে। এক পাতার বাংলা ক্যালেন্ডার। দুটি পাখি ঠোঁট ছুঁয়ে আছে, পেছনে দিগন্তবিস্তৃত ধানখেত। সিয়াম ক্যালেন্ডারটা দেখতে চায়। কিন্তু জাকির তাকে দেখতে না দিয়ে দোকানের মাঝের একটি র্যাকে ঝুলিয়ে দেয়।
হাফিজ স্টোরে সিয়ামের বসে থাকা দেড় ঘণ্টা হয়ে গেছে। আরও অনেক সময় থাকতে হবে। এতক্ষণ দোকানে বসে থাকতে তার একদম ভালো লাগে না। তবু প্রতি শনিবার তাকে এভাবে এই দোকানে বসে অপেক্ষা করতে হয়। সিয়ামের এই কাজ নিয়ে বন্ধুরা ঠাট্টা-তামাশা করে। দালালের বাচ্চা দালাল। তোর বাপ বড় দালাল আর তুই ছোট দালাল। দালাল শব্দটি শুনে খুব মন খারাপ হয় সিয়ামের।
চণ্ডীপুর বাজারে প্রতি শনিবার গরুর হাট বসে। সিয়ামের বাবা আলিম উদ্দিন সেই হাটে গরু কেনাবেচার দালাল। সিয়ামের কাজ গরু কেনাবেচায় বাবাকে সাহায্য করা। গত শনিবারও গরুর হাট বসেছিল, সিয়াম হাটে আসেনি। বাবা হাট থেকে বাড়ি ফিরে অনেক বকাঝকা করেছে। মায়ের কাছে বলেছে, সিয়াম হাটে থাকলে টাকা আরও বেশি হতো।
সিয়ামের বাবা আলিম উদ্দিন আগে পুঠিয়ার একটি সেমাই কারখানায় কাজ করত। করোনার কারণে কারখানাটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর দুই বছর ধরে নানা চেষ্টা-তদবির করেও কাজ জোটেনি। পরে গরু কেনাবেচাকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। গ্রামের লোকেরা তাকে গরুর দালাল বলে তামাশা করে। তাতে কোনো রা করে না আলিম উদ্দিন; বরং অন্যের মুখের ওপর শুনিয়ে দেয়, ‘কাজ করে খাই, চুরি তো করি না।’
আলিমের দুটোই ছেলে। ছোটটি কোলের। সিয়াম বড়, সে এইটে পড়ে। এমনিতে স্কুলে তার পড়াশোনায় অনেক চাপ। তার পরও প্রতি শনিবার বাবার সঙ্গে হাটে আসতে হয়। শনিবারের টিফিনের পর একটা ক্লাস থাকে। সেই ক্লাস করা হয় না সিয়ামের। প্রতিবারই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে তাকে হাটে আসতে হয়।
হাটের এই মুদিদোকানি হাফিজ উদ্দিন সিয়ামের বাবার বন্ধু। ছেলে স্কুল থেকে এসে যাতে কিছু সময় অপেক্ষা করতে পারে, সে জন্য হাফিজকে বলে দিয়েছে সিয়ামের বাবা। সিয়াম এখন স্কুল থেকে সোজা হাটে এসে হাফিজের দোকানে বসে বাবার জন্য অপেক্ষা করে।
আজ সিয়ামের টিফিনের পরে অঙ্কের ক্লাস ছিল। অঙ্কের শিক্ষক শাহজাহান আলী খুবই কড়া। অঙ্ক না পারলে পরের দিন ক্লাসে দাঁড় করিয়ে রাখবেন। সিয়ামের আজ হাটে আসার কোনো ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু মা বারবার সিয়ামকে বলে দিয়েছে, তার বাবার শরীরটা খুব খারাপ। বুকে ব্যথা করছে দুদিন ধরে। সিয়াম হাটে গেলে বাবাকে সাহায্য করার পাশাপাশি দেখাশোনা করতে পারবে। বাবার শরীর খারাপের কথা সিয়ামের কাছে অঙ্কের না মেলা সূত্রের মতো বড় গোলমেলে লাগে।
সকালে স্কুলে আসার সময় বাবাকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখেছে সিয়াম। বাবা এ সময় কখনো শুয়ে থাকে না। সিয়ামকে মা বলেছিল, ‘তোর বাপের শরীরডা খুব খারাপ।’ সিয়াম এ কথা শুনে প্রথমে খুশিই হয়েছিল; ভেবেছিল, আজ তাকে হাটে যেতে হবে না। হাটের এই কাজটা সিয়ামের একদম পছন্দ না। কিন্তু সেটা কখনো কারও কাছে বলেনি, মায়ের কাছেও না। বাবার কথামতো কাজটা খুব গোপনে করে সিয়াম। বাবা-ছেলের এই গোপন চুক্তি যাতে ফাঁস না হয়, সে ব্যাপারে সিয়ামও বেশ সতর্ক।
গরুর হাটের দিনে বেশির ভাগ সময় সিয়াম হাফিজের দোকানে বসে থাকে। শুধু দরকার হলেই বাবা তাকে ডেকে পাঠায়। এরপর সিয়াম হাটের ভেতরে ঢুকে যায়। হাটের ভেতরে তার কাজও খুব সামান্য। তবে কাজটা বড় অদ্ভুত। অবশ্য সব হাটবারে তাকে এ কাজ করতেও হয় না।
গরুর হাটে দুই ধরনের ক্রেতা আসে। বেশির ভাগ ক্রেতা আসে ঢাকাসহ বিভিন্ন মোকাম থেকে। তারা ট্রাক সঙ্গে নিয়ে আসে। এরা গরুর বড় ব্যাপারী। গরু কিনে তারা ট্রাকে করে ঢাকায় নিয়ে যায়। আর আসে গেরস্ত ধরনের ক্রেতা। তারা গরু কেনে কোরবানি দেওয়া বা বাড়িতে রাখার জন্য। গরুর ব্যাপারীদের চোখ থাকে সীমান্তের ওপার থেকে আসা ভারতীয় বড় আকৃতির গরুর দিকে। সরাসরি করিডর থেকে এসব গরু হাটে আসে। মাংস ব্যবসায়ীদের জন্য করিডরের গরুতে পড়তা বেশি। কিন্তু যারা কোরবানি দেওয়া বা বাড়িতে রাখার জন্য গরু কেনে, তাদের চোখ থাকে গেরস্ত বাড়ির দেশি গরুর দিকে। এসব গরুর দামও তুলনামূলক বেশি। কাজেই সীমান্তের ওপার থেকে আনা ছোট গরুকে দেশি গরু বলে চালালেই লাভ, তাতে বেশি দাম পাওয়া যাবে। গরু কেনাবেচার এই ব্যবসায় আলিম উদ্দিন এই সামান্য চালাকিটুকু করে। এতে তার বেশ লাভ হয়।
প্রথম প্রথম আলিম উদ্দিনের নিজের কাছেও কাজটা খারাপ মনে হতো। মনে মনে ভেবেছিল, এসব ছেড়ে দেবে। কিন্তু খবরের কাগজে দেখেছে, কত মানুষ ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়ে বিদেশে বাড়ি-গাড়ি করে আরামে আছে। অভাবের সংসারে এই সামান্য চালাকিকে বড় কোনো পাপ মনে হয়নি তার। তার চেয়ে লাভ বাড়াতে সিয়ামকেও এ কাজে নামিয়েছে। এখন বেশ ভালোই চলছে। মাসে দু-একটা হাট না করলেও দিব্যি সংসার চলে যায়। আলিমের স্ত্রী মাবিয়া খাতুনও স্বামীর এই আয়-রোজগারে বেশ খুশি।
এখন হাটের দিন করিডরের পাইকারদের কাছ থেকে বেছে বেছে ছোট আকারের গরু কেনে আলিম উদ্দিন। তার লক্ষ্য থাকে করিডরের গরুকে যেন গেরস্তের বাড়িতে পোষা গরু বলে খদ্দেরের হাতে গছিয়ে দেওয়া যায়। এই কাজ খুব সতর্কতার সঙ্গে করে আলিম, যাতে কেউ সন্দেহ না করে। আবার খুব চেনা লোক হলেও এসব কাজ করা যায় না। সে জন্য ক্রেতা এলে সব বুঝেশুনে ছেলেকে দরকারমতো কাজে লাগায় আলিম উদ্দিন। শুধু অচেনা খদ্দের হাটে এলেই এই সামান্য চালাকিটা করে সে।
গত শনিবারও হাটে এ রকম দুটি বকনা গরু বিক্রি করেছে আলিম। কপাল ভালো ছিল। দুজন খদ্দেরই অচেনা। সব বাদ দিয়েও ৪ হাজার করে লাভ হয়েছে। হাট শেষে হাফিজের দোকানে সদাই করে সিয়ামকে সঙ্গে করে বাড়ি ফিরেছে আলিম উদ্দিন।
সেদিনও সিয়াম আগের মতো হাফিজের দোকানে বসে ছিল। খদ্দেরের সঙ্গে দামদর ঠিক হওয়ার উপক্রম হতেই হাফিজের ফোনে মিসড কল দিয়েছে আলিম। হাফিজের ইশারা পেয়ে হাটের ভেতরে চলে যায় সিয়াম। সিয়ামের কাজ হলো বিক্রি হওয়ার আগেই গরুর রশি ধরে কান্নাকাটি করা। কথা যা বলার আলিমই বলে। সিয়াম শুধু গরুর রশি ধরে নীরবে কাঁদতে থাকে। আলিম খদ্দেরদের কাছে ছেলের কান্নার বিশদ বিবরণ দেয়। বলে, গেরস্তের বাড়ির গরু সন্তান ছাড়া কিছুই না। সন্তানের মতো সেই গরু বাড়িতে লালন-পালন করা হয়েছে। বাড়ির সবার মতো তার ছোট ছেলেটারও গরুর প্রতি মায়া পড়েছে। সেই গরু বিক্রি করা হচ্ছে বলে স্কুল থেকে দৌড়ে হাটে এসেছে। খদ্দেরকে দেখিয়ে বলে, দেখেন ভাই, গরুটা বেচা হচ্ছে দেখে ছেলেটা কেমন কান্নাকাটি করছে। এতে ক্রেতার মন গলতে থাকে। কেউ কেউ বলে, এত ছোট বাচ্চা ছেলেকে কষ্ট দিয়ে গরু বেচবেন কেন? বাড়ির পোষা গরু বাড়িতেই নিয়ে যান। কিন্তু আলিম উদ্দিনের সেই এক জবাব, ভাই, অভাবের সংসার। গরু না বেচলে চলবে কী করে? আলিমের আচরণ এমন যে নিতান্তই অভাবে পড়ে এই গরু হাটে তুলেছে। দরকার হলে গৃহিণীর প্রসঙ্গও টেনে আনা হয়। বউয়ের ইচ্ছা ছিল পোষা গরু নিজের হাতে কোরবানি দেবে। কিন্তু বেচতে হচ্ছে অভাবের কারণে। সিয়ামকে খুব বেশিক্ষণ কান্নাকাটির অভিনয় করতে হয় না। আলিম এই সময়ে ছেলেকে বুঝ মানানোর নানা চেষ্টার অভিনয় করে। এরপর তাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে এমন ভান করে। সিয়ামকে সব আগে থেকে শেখানো আছে। সে-ও গরুর রশি ছেড়ে সহজে যেতে চায় না। কখনো কখনো গরুর গলা জড়িয়ে ধরে আদর করার ভান করে। তবে গরুর গলা জড়িয়ে ধরা সিয়ামের ভালোই লাগে। গরু বেয়াড়া হলে একটু সমস্যা হয়। একবার এক গরু তাকে শিং দিয়ে গুঁতো দিয়েছিল। পায়ের সেই দাগ এখনো মেলেনি।
এই সামান্য অভিনয় করার ক্ষেত্রেও এত দিনে বাবার সব ইশারা বুঝে গেছে সিয়াম। খদ্দেরের মন গলছে বুঝতে পারলেই ছেলেকে ইশারা করে আলিম উদ্দিন। সেই ইশারা পেয়ে বাধ্য ছেলের মতো হাটের ভেতর থেকে আস্তে করে চলে আসে সিয়াম। আলিমের কাছে ছেলের এই অভিনয়টুকুর অনেক দাম। ক্রেতারা মনে করে, এটা সত্যিই গেরস্তের বাড়ির পোষা গরু। তখন দাম নিয়ে আর কোনো সমস্যা হয় না। বাগে ফেলতে পারলে ক্রেতার কাছ থেকে বাড়তি ৪-৫ হাজার টাকাও আদায় করা যায়।
সিয়াম একবার বাবার কাছে বলেছিল, তার মনে হয়েছে, এই কাজটা ঠিক হচ্ছে না। আলিম ছেলের ওপর রাগ না করে বলেছে, বড়লোকেরা কত রকম অন্যায় করে, জানিস? সে তুলনায় এটা কোনো অন্যায়ই না। ছেলের মন রাখতে নতুন জামা কিনে দেওয়ার কথাও তুলেছিল আলিম। সিয়ামও আর কথা বাড়ায়নি।
হাটের ভেতরের এই অভিনয়টুকু শেষ হওয়ার পর সিয়ামকে আবার অপেক্ষা করতে হয় হাফিজের দোকানে। গরু কেনাবেচা শেষ হলে আলিম ফিরে আসে হাফিজের মুদিদোকানে। সংসারের জন্য সদাইপাতি নিয়ে ছেলেসমেত বাড়ি ফেরে। সিয়ামের মাঝেমধ্যে নানা জিনিসের আবদার থাকে। বাড়িতে তার ছোট ভাই আছে। দুই ভাইয়ের জন্য সবই কিনে দেয় আলিম। গেল হাটে আবুলের দোকানের গরম জিলাপি চেয়েছিল সিয়াম। বাড়িতে যাওয়ার পর মা সেই জিলাপি দেখে অনেক খুশি। হাটের গুড়ের জিলাপি তারও ভারি পছন্দের।
আজ দোকানে বসে থাকতে সিয়ামের আর ভালো লাগছে না। অনেক সময় হয়েছে, কিন্তু হাটের ভেতর থেকে কোনো ডাক আসেনি। দোকানি হাফিজের মাথায়ও বিষয়টা ঢুকেছে। হাফিজ একবার সিয়ামকে বলেছে, ‘আজ কী হইছে রে, মিস কল আসে না যে!’ সিয়াম কিছু বলেনি। তার একবার ইচ্ছে করছে হাটের ভেতরে গিয়ে দেখে আসার। কিন্তু বাবার কড়া বারণ আছে, না ডাকলে যাওয়া যাবে না।
সিয়াম অপেক্ষা করতে থাকে, কিন্তু তার মনটা ছটফট করে। মা বলেছিল, তোর বাবার শরীরটা ভালো না। বুকের বাঁ দিকে দুদিন ধরে চিনচিন করছে। মায়ের কথা খুব মনে পড়ে সিয়ামের। হাফিজ একবার সিয়ামকে বলেছে, ‘চিন্তা করিস না। পেচ্ছাব লাগলে হাটের ভেতরটাও ঘুরে আসব।’ তবু সিয়াম বাবার মিসড কলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
বেলা পড়ে গেলেই গরুর হাটের কেনাবেচা শেষ হয়। এখন প্রায় সন্ধ্যা। একটু পরে আজান হবে। তবু হাট শেষ হচ্ছে না। সিয়ামের কাছে সবকিছু বিরক্তিকর লাগে। সে দোকানের ভেতর থেকে বাইরে আসে। হাটের দিকে উঁকি দিতেই একজনকে দৌড়ে আসতে দেখে। ঝড়ের বেগে আসা লোকটা হাফিজকে বলে, ‘তোর বন্ধু হাটের মধ্যে ফিট হয়ে গ্যাছে, আমি ডাক্তার নিয়ে আসি।’ মুহূর্তে হাফিজের মুখ শুকিয়ে যায়। ‘এই সিয়াম আয় তো’—বলেই সিয়ামের হাতে জোরে টান মেরে হাটের দিকে দৌড়াতে থাকে। সিয়াম কিছু না বুঝেই হাফিজের পিছে দৌড় দেয়।
হাটের ভেতরে অনেক মানুষের ভিড়। হাটের ইজারাদার যেখানে বসে হাসিল আদায় করে, সেই চরাটের ওপরে একজনকে শোয়ানো। চারপাশে অনেক মানুষ। হাফিজ ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায়। সিয়ামকে টেনে ভেতরে নিয়ে বলে, ‘দেখ তো, বাপের কী হইছে’। সিয়াম কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। তাকিয়ে দেখে, তার বাবা নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে শুয়ে আছে। সিয়াম আব্বা আব্বা বলে ডাকে, কোনো সাড়া মেলে না।
একটু পরে ‘সরো সরো’ বলে হাটের ভেতর থেকে এগিয়ে আসেন পল্লিচিকিৎসক ফজলু মিয়া। সবাইকে সরতে বলে আলিমের বাঁ হাত একটু উঁচু করে ধরেন ফজলু। কিছুক্ষণ পালস বোঝার চেষ্টা করেন। স্টেথিস্কোপটা বুকের ওপর ঠেসে ধরেন। কয়েক মিনিট নীরব থেকে বলে ওঠেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। সঙ্গে সঙ্গে শোরগোল পড়ে যায়। ‘ও আল্লা রে...’ বলে সিয়ামকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে হাফিজ। সেই কান্না সংক্রমিত হয় হাটের লোকেদের মধ্যে। সিয়াম অবাক হয়ে হাফিজের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে কিছুই বুঝতে পারে না।
সিয়াম জানে না, এরপর কী হবে। শুয়ে থাকা লোকটি ঘিরে হাটের মানুষের ভিড় বাড়তেই থাকে। সবাই বলতে থাকে, আলিম দালাল মারা গেছে। এভাবে বেশ কিছু সময় চলে যায়। ইজারাদার আরিফ উদ্দিন একটু পরে এসে হাফিজকে ফাঁকে ডেকে নেয়। আস্তে আস্তে বলে, লাশটি বাড়ি নিয়ে যাও, হাটে বিদেশি ব্যাপারী আছে। এই বলে সে একজনকে হাঁক দিয়ে বলে, ‘এই মফিজ, একটা ভ্যান ডাক’। একটু পরে তিন চাকার একটি ভ্যান নিয়ে আসে মফিজ। সবাই ধরাধরি করে আলিমের মৃতদেহ সেই ভ্যানে তুলে দেয়। ইজারাদার হাফিজকে বলে, সে তো তোমার বন্ধু, ছেলেটাকে নিয়ে ভ্যানের সামনে বসো। এরপর সিয়ামের হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বলে, ‘বাবা, এই টাকাটা মায়ের হাতে দিয়ো।’ ইজারাদার ভ্যানচালককে ধমক দিয়ে বলে, ‘লাশটায় একটু বান্ধন দাও, রাস্তা খারাপ তো।’ ইজারাদারের ধমক খেয়ে ভ্যানচালক রশির এক মাথায় একটি প্যাঁচ দিয়ে সিয়ামকে বলে, বাবা, রশির এই মাথাটা শক্ত করে ধরো।
শত শত মানুষের ভিড় ঠেলে ভরা হাটের ভেতর থেকে লাশবাহী ভ্যান বেরিয়ে যায়। হাট থেকে মূল সড়কে ওঠার মুখে সিয়াম দেখতে পায়, জাকির রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে কাঁদছে। এই প্রথম জাকিরকে তার খুব আপন মনে হয়। জাকিরকে দেখে খ্যাক করে ওঠে হাফিজ, ‘তুই এখানে, দোকানে কেউ নাই? যা যা, দোকানে যা’। ভ্যান রাস্তায় উঠে চলতে থাকে।
ভ্যানের ওপরে বাবার লাশ বাঁধা রশির একটা প্রান্ত ধরে বসে থাকে সিয়াম। প্রতি শনিবার হাটে এভাবে গরুর রশি ধরে কেঁদেছে সিয়াম, অনিচ্ছায় বহুদিন কান্নার অভিনয় করেছে। কিন্তু আজ তার সত্যিই খুব কাঁদতে ইচ্ছে করে। তবু কাঁদতে পারছে না। নিজের কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারে না সে। বাড়ি গিয়ে মাকে কী বলবে, ছোট ভাইকে কী বলবে, কোনো কিছুই ঠিক করতে পারে না সিয়াম।
হাফিজ ভ্যানচালককে তাড়া দিয়ে বলে, আন্ধার হয়ে আসছে, একটু জোরে পা চালাও...। মাগরিবের নামাজ শেষ হয়েছে, চরাচরে অন্ধকার ধেয়ে আসছে। সিয়াম দেখতে থাকে, তার সামনের পথও বড় অন্ধকার, যে অন্ধকারের দিকে ক্রমশ সে তলিয়ে যাচ্ছে।
চারুশিল্প হচ্ছে মানুষের অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যম। একটি ছবি একটি বিপ্লবের উন্মেষ ঘটাতে পারে। ছবি শুধু বিনোদনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি বিপ্লবের বার্তাও নিয়ে আসে।
৭ দিন আগেআপনি যে বয়সেরই হোন না কেন, এই বই পড়লে তারুণ্যশক্তিকে অনুভব করবেন, অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বইয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চার শ পৃষ্ঠার বইটির দাম
১৪ দিন আগেপ্রকাশনা সংস্থা ‘ঐতিহ্য’ তার দুই যুগের পথচলা (২০০০-২০২৪) স্মরণীয় করে রাখতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দশ দিনব্যাপী ‘ঐতিহ্য বই উৎসব ২০২৪’ আয়োজন করেছে। আজ ২ নভেম্বর শনিবার বেলা ১১টায় যৌথভাবে উৎসব উদ্বোধন করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, বিশিষ্ট লেখক-গবেষক শারমিন আহমদ এবং তরুণ
১৪ দিন আগেদ্য ভেজিটেরিয়ানের পর হান কাঙের পরের উপন্যাস ছিল ‘দ্য উইন্ড ব্লোজ, গো’। এই উপন্যাস লেখার সময়ই ঘটে বিপত্তি! হান অনুভব করেন তিনি আর লিখতে পারছেন না। গত বছর নিজের পঞ্চম উপন্যাস ‘গ্রিক লেসন’ ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হলে স্পেনের এল-পাইস পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়েছিলেন তিনি।
১০ অক্টোবর ২০২৪