ইজাজুল হক
মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীর একবার কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁকে খুব বেশি মুগ্ধ করেছিল। তিনি দুই লাইনের একটি ফারসি স্তবক রচনা করেছিলেন, যা পরবর্তীতে ভূস্বর্গ কাশ্মীরের সৌন্দর্যের বিজ্ঞাপন হয়ে দাঁড়ায়। তিনি বলেছিলেন—‘গর ফেরদৌস বর রুয়ে জমিন আস্ত/হামিন আস্ত ও হামিন আস্ত ও হামিন আস্ত’ অর্থাৎ, ‘পৃথিবীর বুকে বেহেশত যদি থেকেই থাকে/তবে তা এখানেই, এখানেই এবং এখানেই’। শ্রীনগরের বর্ণিল টিউলিপ বাগান, আলপনা-রঙিন হাউসবোট, ডাল লেকের অদূরের তুষারাবৃত পর্বত, কুলকুল বয়ে চলা ঝিলম আমাদের স্বাগত জানায় কাশ্মীর উপত্যকায়। পেহেলগাম, গুলমার্গ, সোনমার্গ, আরু ভ্যালি, তুরতুক ইত্যাদি জায়গার ছবি দেখলেই ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। দেবদারু কিংবা চিনার গাছের হলুদ পাতার বসন্ত কিংবা আঙুর, আপেল ও নাশপাতির উর্বর বাগান পৃথিবীর সৌন্দর্যপিয়াসী মানুষদের ছুটিয়ে আনে এখানে। গাধার পিঠে চড়ে, পাহাড়ি ঝিরির স্বচ্ছ জলধারা পেরিয়ে, দল বেঁধে চরে বেড়ানো ভেড়াদের সরিয়ে, সবুজ চাদরে মোড়ানো মাঠ ছাড়িয়ে, সবুজের গাউনপরা উঁচু-উঁচু দেবদারু-চিনারঘেরা এই পাহাড়গুলোর কাছে যাওয়া মানুষের আজন্ম সাধ। চারপাশের উঁচু-উঁচু পাহাড়ের মাঝের আসমানি নেয়ামতে ঠাসা এই উপত্যকায় এসে নিঃসন্দেহে স্বর্গের দেখা পায় মানুষ। যেমন দেখা পেয়েছিলেন সুকান্তও। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘কাশ্মীর’ কবিতায় লিখেন—
‘সেই বিশ্রী দম-আটকানো কুয়াশা আর নেই
নেই সেই একটানা তুষার-বৃষ্টি,
হঠাৎ জেগে উঠেছে-
সূর্যের ছোঁয়ায় চমকে উঠেছে ভূস্বর্গ।
দুহাতে তুষারের পর্দা সরিয়ে ফেলে
মুঠো মুঠো হলদে পাতাকে দিয়েছে উড়িয়ে,
ডেকেছে রৌদ্রকে,
ডেকেছে তুষার-উড়িয়ে-নেওয়া বৈশাখী ঝড়কে,
পৃথিবীর নন্দন-কানন কাশ্মীর।’
(ছাড়পত্র/সুকান্ত ভট্টাচার্য)
সুকান্তের সেই ‘নন্দন-কানন’ এখন আর আগের মতো নেই। স্বতন্ত্র জাতীয়তাবাদ ও ভূখণ্ডের অধিকারী কাশ্মীর এখন তিন টুকরো। কাশ্মীরের সব সৌন্দর্য গিলে নিয়েছে এশিয়ার তিন অজগর—পাকিস্তান, ভারত ও চীন। স্বর্গীয় কাশ্মীর পরিণত হয়েছে জ্বলন্ত নরকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে যেতে থাকে কাশ্মীরি জাতিসত্তা। পাকশাসকরা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত থাকার শর্তে স্বায়ত্তশাসনের মুলো ঝুলিয়ে ‘আজাদ-কাশ্মীর ও গিলগিট-বালতিস্তান’-কে সেখানকার অঙ্গরাজ্যে পরিণত করেন। কাশ্মীরি নেতৃত্বের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাকি কাশ্মীরকে গিলতে শুরু করে ভারত। সেই গলাধঃকরণের ইতিহাস এখনো থামেনি। সুযোগ পেলেই গিলে নিচ্ছে কাশ্মীরি মানুষের অধিকার, যেন পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে না দিয়ে থামবে না তারা। এদিকে ১৯৬২ সালে ভারত থেকে কাশ্মীরের কিছু অংশ কেড়ে নিয়ে ভক্ষণ করতে থাকে চীন, সেটির নাম হয়েছে ‘আকসাই চীন’।
তিন নেকড়ের কাড়াকাড়ির পরও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতশাসিত কাশ্মীর শুরু থেকেই নিজেদের স্বকীয়তার জন্য লড়াই করে এসেছে। ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান প্রণীত হলে তাতে ‘আর্টিকেল-৩৭০’-এর অধীনে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হয়েছিল কাশ্মীর। তবে সেই কাগুজে মর্যাদা কখনোই ভোগ করতে পারেনি কাশ্মীর। শেষপর্যন্ত কয়েক বছর আগে রাতের আঁধারে তাও কেড়ে নেওয়া হয়। ষাটের দশকের গণভোটের দাবি সত্তরের দশকের শেষে এসেই ব্যর্থ আরাধনায় পরিণত হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীদের ‘ঘড়ির কাঁটা পেছনে ফেরানো যায় না’ জাতীয় মনোভাব কাশ্মীরে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম দেয়; তাতে ঘি ঢালে পাকিস্তান। শুরু হয় ত্রিমুখী সংকট—যা ভূস্বর্গ কাশ্মীরের সৌন্দর্যকে অনবরত ম্লান করছে ঝিলম নদীর জলে।
দুই.
কাশ্মীরের সাত দশকের এই রক্তক্ষয়ী সময়ের মধ্য দিয়েই বেড়ে ওঠেন কবি ফারুক নাজকি—‘ঝিলমতীরের এক দুরন্ত বালক’ শিরোনামে যার প্রথমজীবনের কথা আমরা তুলে এনেছি গত পর্বে। এবার আমরা সেই দুরন্ত বালক কীভাবে কাশ্মীরি সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে বিশাল মহিরুহে পরিণত হন, তা দেখার চেষ্টা করব।
ডেইলি মজদুরের বন্ধ হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে কবি ফারুক নাজকি প্রথমবারের মতো কাশ্মীরে চাপিয়ে দেওয়া রাজনীতির শিকারে পরিণত হয়। তবে রাজনীতিতে আগ্রহ না থাকায় নাজকি অপেক্ষাকৃত মসৃণ ও সুবিধাজনক পথ—সাহিত্য-সংস্কৃতিকেই বেছে নেন। এসপি কলেজে থাকাকালেই তিনি সাহিত্য সংগঠন ‘বজমে আদব’-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সাড়াজাগানো ‘ডেইলি মজদুর’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আর একক কাজে আগ্রহ খুঁজে পাননি। বাবা গোলাম রসুল নাজকিও সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অতো বেশি চিন্তিত ছিলেন না, বরং তিনি সন্তানদের যোগ্যতা দিয়ে পথ বের করে নেওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ফারুক নাজকি চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেন। একদিন হুট করে হাজির হন কাশ্মীর কালচারাল অ্যাকাডেমিতে। সেকালে চাকরির বাজার এত প্রতিযোগিতাপূর্ণ ছিল না। কালচারাল অ্যাকাডেমির দায়িত্বশীলরা ফারুকের যোগ্যতা নিয়ে মোটেও সন্দিহান ছিলেন না। তারা ফারুককে তৎক্ষণাৎ অ্যাকাডেমির ‘লিটারেরি অ্যাসিন্ট্যান্ট’ পদে নিয়োগ দিয়ে দেন এবং ‘ডিকশনারি ডিপার্টমেন্ট’-এর একটি ডেস্ক দেখিয়ে দেন। সেখানে বেশ কিছুদিন কাজ করেন ফারুক।
এরপর তিনি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যোগ দেন। ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’-এর অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিছুদিন পর তিনি ভারতের একটি মিডিয়া ডেলিগেশনের সদস্য হিসেবে ইংল্যান্ড সফর করার সুযোগ পান। ফারুকের ক্যারিয়ার গঠনে সেই সফর বড় তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। তিনি বলেন, ‘আমরা ইংল্যান্ডের প্রতিটি রেডিও ও টেলিভিশন স্টেশনে হাজির হই এবং তন্ন তন্ন করে দেখি তাদের সিস্টেম।’
এর কিছুদিন পর ফারুক নাজকি সরকারি ব্যবস্থাপনায় জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্নালিজমের ফেলোশিপ লাভ করেন। সেখানে নিজের সাংবাদিকতাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার সুযোগ পান তিনি। নাজকির জার্মানির দিনগুলো বড় মধুর ছিল। তিনি বলেন, ‘জার্মানির জীবন বিলাসী ছিল। সবকিছু খুব সস্তায় পাওয়া যেত। পরিবহন ভাড়া ছিল খুব কম। সপ্তাহান্তে জার্মানির বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতাম। দেশে ফেরার আগে-আগে জার্মানির প্রায় সব স্থান আমার দেখা হয়ে যায়। অবশ্য পড়ালেখাও ভালোভাবেই করি, সহপাঠীদের সবার চেয়ে ভালো রেজাল্ট করার একটি প্রচেষ্টা আমার ছিল।’
এরপর ফারুক নাজকি কাশ্মীরে ফিরে আসেন। কাশ্মীরের ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে বিশ্বমানে উন্নীত করার প্রচেষ্টা শুরু করেন। রেডিও কাশ্মীরে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শুরু করেন কাশ্মীরের প্রথম টেলিভিশন ‘দূরদর্শন কাশ্মীর’-এর কাজও। মূলত ফারুক নাজকির হাত ধরেই কাশ্মীর টেলিভিশনের জগতে প্রবেশ করে—যেমনটি তাঁর বাবার হাত ধরে কাশ্মীর প্রবেশ করেছিল রেডিও-এর যুগে।
১৯৮২ সালে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ মারা যান। পুত্র ফারুক আবদুল্লাহ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন এবং বাবার হাতেগড়া রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি)-এর সভাপতির পদও অলংকৃত করেন। নাজকি পরিবারের সঙ্গে শেখ পরিবারের আগে থেকেই হৃদ্যতার সম্পর্ক, তারওপর ফারুক নাজকি তখন কাশ্মীরের রেডিও-টেলিভিশনের নেতৃত্ব-পর্যায়ের ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। ফলে নতুন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ বন্ধুপ্রতিম কবি ফারুক নাজকিকে তাঁর ‘মিডিয়া অ্যাডভাইজর’ নিয়োগ দেন। ১৯৮৪ সালে শ্যালক গোলাম মুহাম্মদ শাহ-এর কারসাজিতে ফারুক আবদুল্লাহর সরকারের পতন হলে ফারুক নাজকির ‘মিডিয়া অ্যাডভাইজর’-এর পদও চলে যায়।
১৯৮৬ সালে ফারুক নাজকি ‘দূরদর্শন ও রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’-এর ডাইরেক্টর পদে নিয়োগ পান এবং ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১১ বছর অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেন। অবশ্য এই সময়ে রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন আসে। ১৯৮৬ সালে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আবার শপথ নেন ফারুক আবদুল্লাহ। পরের দিনগুলোতে কাশ্মীরের রাজনীতি উত্তাল হয়ে পড়ে এবং সশস্ত্র বিদ্রোহ বাড়তে থাকে। রেডিও ও টেলিভিশন কেন্দ্রগুলো দিল্লি থেকে প্রচারিত হতে থাকে। কাশ্মীরজুড়ে ব্যাপক সংঘাত ও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ পদত্যাগ করেন। কাশ্মীরে শুরু হয় কেন্দ্রশাসিত রাজ্যপালের শাসন। ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে, কাশ্মীরের অভিজাত হিন্দু সম্প্রদায় ‘পণ্ডিত’দের হত্যা ও দেশান্তর করার ঘটনা ঘটে, যা আজকাল হিন্দুত্ববাদীদের কাছে কাশ্মীরি মুসলমানদের অধিকার হরণের বৈধতার বিজ্ঞাপন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ তখন কাশ্মীর শাসন করছিলেন হিন্দু রাজ্যপাল জাগমোহন মালহোত্রা।
১৯৯৬ সালে ফারুক আবদুল্লাহ আবার মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে ২০০২ সাল পর্যন্ত কাশ্মীর শাসন করেন। এই পুরো সময়জুড়ে কবি ফারুক নাজকি ফের তাঁর ‘মিডিয়া অ্যাডভাইজর’ হিসেবে যোগ দেন। অন্যদিকে ২০০০ সালে কবি ফারুক নাজকি ডেপুটি ডাইরেক্টর জেনারেল হিসেবে ‘দূরদর্শন ও রেডিও কাশ্মীর’ অধ্যায়ের ইতি টানেন। ২০১০ সালে ফারুক আবদুল্লাহর ছেলে ওমর আবদুল্লাহ কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হলে পিতৃতুল্য কবি ফারুক নাজকিকে আবারও ‘মিডিয়া অ্যাডভাইজর’ পদে নিয়ে আসেন। কাশ্মীরি জাতিসত্তার কবি ফারুক নাজকি সব সময় শেখ পরিবারকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেন।
সম্প্রতি কাশ্মীরের বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দীর্ঘ জীবনের স্মৃতিচারণ করে কবি ফারুক নাজকি বলেন—
‘কাশ্মীরের ইতিহাসের জীবন্ত প্রত্যক্ষদর্শী আমি। কাশ্মীরি ক্ষমতার কেন্দ্রস্থলে থাকার সুবাদে সব ঘটনাবলি সরাসরি দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। রাজনীতি কখনো আমার আগ্রহের জায়গা ছিল না। তাই রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলেও আমি কখনো রাজনীতিতে জড়াইনি। গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার কারণে এবং প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার কারণে এই দীর্ঘ ইতিহাসের জ্বলন্ত সাক্ষী আমি। আমাদের চোখের সামনে কত চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ আবদুল্লাহর চুক্তি কিংবা রাজিব গান্ধী-ফারুক আবদুল্লাহর আলোচনাসহ সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আমি কভার করি। কাশ্মিরিদের ভাগ্য পরিবর্তনে কত ইস্যু সামনে এসেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে কাশ্মীর তার স্বকীয়তা হারায়। একসময়ের ‘রেডিও কাশ্মীর’ এখন ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ এবং ‘বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন’ কাশ্মীর এখন তার শেষ মর্যাদাটুকুও হারিয়ে ফেলেছে।’
তিন.
কবি ফারুক নাজকির লেখালেখি ও রচনাকর্মকে তিনি দুভাগে ভাগ করতে পছন্দ করেন। প্রবন্ধ, নাটক, গান ইত্যাদি থেকে তিনি তাঁর কবিতাচর্চাকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে দেখেন। তাঁর দাবি মতে—তিনি সম্পূর্ণ নতুন ধাঁচে কবিতাচর্চায় ব্রতী হয়েছেন। আগেই বলেছি, শৈশবেই কবি জিগর মুরাদাবাদীর হাতে তাঁর কাব্যপ্রতিভার উন্মেষ ঘটে। তাঁর বাড়ির কবিতাভরা চমৎকার পরিবেশ এবং কাশ্মীরি কবি-সাহিত্যিকদের নিত্য আনাগোনা তাঁর কবিমানস তৈরিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল। পরে এসপি কলেজ, কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়, কাশ্মীর কালচারাল অ্যাকাডেমির অনন্য পরিবেশ তাঁর কবিতাচর্চাকে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করে। দীর্ঘ মিডিয়াজীবন ও রাজনীতিঘনিষ্ঠতা এবং দেশ-বিদেশভ্রমণ তাতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।
ফারুক নাজকি কবিতায় দারুণ মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। বাবা গোলাম রসুল নাজকি সুফিধারার সংস্কারক কবি ও ফারুকের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হলেও সচেতনভাবেই তাঁর কাব্যধারা এড়িয়ে যান তিনি। নিজের মতো করে তৈরি করতে চেষ্টা করেন নিজস্ব কাব্যধারা। রোমান্টিকতা, ইতিবাচকতা, ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা ও নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বিষয়বস্তু বানিয়ে রচনা করেন আধুনিক কাশ্মীরি কবিতা, উর্দু গজল এবং আধুনিক উর্দু কবিতা। এ ছাড়া বিভিন্ন উর্দু-হিন্দি ক্ল্যাসিক্যাল কবিতার কাশ্মীরি রূপ দাঁড় করান যুগের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই। সব ক্ষেত্রেই তিনি কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন। কারণ খুব সচেতনভাবেই তিনি কবিতাচর্চায় নিজের যুগকে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। তাই কবিতার প্রশ্নে বরবারই বিরলপ্রজ তিনি; খুব কম কবিতাই লিখেন। তিনি বলেন, ‘কবিতার কোয়ান্টিটি কখনোই আমার মুখ্য ছিল না; বরং আমি কোয়ালিটিই চেয়েছি। কোয়ান্টিটির জন্য আমি সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় লেখালেখি করেছি। কবিতা আমার কাছে কবিতাই। এর সঙ্গে অন্য কোনো রচনা তুলনীয় নয়।’
ফারুক নাজকির কাশ্মীরি ভাষার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে—‘নার হায়ুতুন কাজালভানাস’ (কাজালভানাসে আগুন), ‘মেহজাবিন’ (চাঁদমুখ) ও ‘সাতবরণ’ (সাতরঙ)। এসব কাব্যগ্রন্থ কাশ্মীরি বোদ্ধাদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। তাঁর সূক্ষ্মদর্শী, মর্মস্পর্শী ও শ্লেষাত্মক কাব্যধাঁচ কাশ্মীরে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। উর্দু কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে—‘আখেরি খোয়াব সে পেহলে’ (শেষ স্বপ্নের আগে) ও ‘লফ্জ লফ্জ নোহা’ (শব্দে শব্দে বিলাপ)। এই কাব্যগুলোকে এ কালের উর্দু সাহিত্যে অবশ্যপাঠ্য গণ্য করছেন অনেক সাহিত্য সমালোচক। তাঁর হিন্দি রচনার মধ্যে ‘গেয়ি রুতিয়োঁ কে সাথি’ (বিগত রাতের সঙ্গী) ও ‘হ্যান্ডিক্রাফট অব কাশ্মীর’ (কাশ্মীরের হস্তশিল্প) উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া তিনি অসংখ্য নাটক, গান ও টেলিভিশন প্রোগ্রামের স্ক্রিপ্ট লেখেন।
১৯৯৫ সালে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘নার হায়ুতুন কাজালভানাস’ এর জন্য কাশ্মীরি ভাষা ক্যাটাগরিতে ভারতের প্রধান সাহিত্যপুরস্কার ‘সাহিত্য অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড’ পান। আবার ‘নার হায়ুতুন কাজালভানাস’ ও ‘লফ্জ লফ্জ নোহা-এর জন্য পান ‘স্টেট কালচারাল অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড’। কাশ্মীরি ভাষার রচনাবলির জন্য ‘জম্মু-কাশ্মীর অ্যাকাডেমি অব কালচার, আর্ট অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজেজ বেস্টবুক অ্যাওয়ার্ড’ পান। ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবস্থাপনায় অনন্য অবদানের জন্য পান ‘জম্মু-কাশ্মীর সরকারের স্বর্ণপদক’। অর্জনের ঝুলিতে ভরেন ‘বেস্ট মিডিয়া কন্ট্রোলার অ্যাওয়ার্ড’ও।
চার.
কাশ্মীরের কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পবোদ্ধারা কবি ফারুক নাজকির অবদানকে দারুণভাবে মূল্যায়ন করেন। কাশ্মীরের সাবেক আইনপ্রণেতা ও রাজনীতিবিদ জিএম ভবন বলেন, ‘ফারুক নাজকি কাশ্মীরি ও উর্দু ভাষার কবি। তিনি নিজেকে উর্দু সাহিত্যের প্রথমসারির কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। কবি হিসেবে তিনি সর্বাধিক পরিচিত হলেও ডেইলি মজদুর-এর সম্পাদক হিসেবে তাঁর অবদান অনেকের অজানা। তিনিই প্রথমবারের মতো কাশ্মীরের শ্রমিকশ্রেণির গুরুত্বে আলো ফেলেন।’
কাশ্মীরি চিকিৎসক ও সাহিত্য সমালোচক এ ওয়াহিদ বলেন, ‘…ফারুক নাজকি হতাশার গর্ত খুঁড়ে বের করে আনেন ইতিবাচকতা। তিনি এক অনুপম সাহিত্যিক, সমাজবিদ, কবি ও রাজনীতিবিশ্লেষক। তিনি রোমান্টিক, শতরঙা ও আধুনিক; তবে একই সঙ্গে বিশ্বাসীও। ঐতিহ্য ও রহস্যময়তা সাঙ্গ করে বিশ্বাসের পথে হেঁটে তিনি প্রতিটি ঘটনার কারণ খুঁজে ফেরেন। তাঁর কবিতা মোটেও ধারণা-কল্পনার শব্দবাজি নয়; চারপাশের ঘটনাপরম্পরারই প্রতিফলন ঘটে তাঁর লেখায়।’
এ ওয়াহিদ আরও বলেন, ‘কাশ্মীরে কয়েক দশকজুড়ে যে হতাশার রাজত্ব এবং মৃত্যুর নৃত্য তিনি প্রত্যক্ষ করেন, তা তাঁর হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। তবুও তিনি ঠোঁটের কোণে ধরে রাখেন এক চিলতে হাসি। তবে ভেতরটা তাঁর দুমড়ে-মুচড়ে যায় যখন দেখেন—এক তরুণ ক্রসফায়ারের শত বুলেটে ঝাঁজরা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে, এক মা তাঁর সদ্য বিবাহিত ছেলের রক্তমাখা শার্ট পরিষ্কার করছেন। তাঁর কবিতা আমাদের এক সময়ের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে হিন্দু-মুসলিম সকলেই সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত নেয়ামত ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। সেই জাতির এমন ভাঙন দেখে তিনি অশ্রু সংবরণ করতে পারেন না। আমাদের মাতৃভূমি কাশ্মীরের অনন্য নিদর্শন সহাবস্থান, শান্তি-সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য গভীরভাবে আকুল হন। চারপাশের বিরাজমান অন্ধকার সত্ত্বেও তাঁর কবিতা ইতিবাচকতার প্রদীপ জ্বালায়। অনেক কিছু আমরা হারিয়েছি, তবুও ফারুক নাজকি আশা ছাড়েন না; ছাড়তে পারেন না।’
অল ইন্ডিয়া রেডিও শ্রীনগরের সাবেক ডাইরেক্টর ও কবি রফিক রাজ বলেন, ‘ফারুক নাজকি সংবেদনশীল কবি, সৃজনশীল ব্রডকাস্টার এবং দক্ষ অনুবাদক। কাশ্মীরি, উর্দু, হিন্দি ও ফারসি ভাষার সাহিত্য রচনায় সিদ্ধহস্ত। দুটি কারণে তাঁর কবিতা আমাকে মুগ্ধ করে—প্রথমত স্বাতন্ত্র্য-বৈশিষ্ট্যে অনন্যতা, দ্বিতীয়ত তাঁর কল্পনার ব্যতিক্রমী আকাশ।’
রফিক রাজ আরও যুক্ত করেন, ‘তিনি শৌখিন কবি। সমসাময়িক পরিস্থিতির সঙ্গে অতীতকে দারুণভাবে যুক্ত করেন। তিনি আমাদের অপূর্ণতাগুলো পূর্ণ করেন। তাঁর পঙ্ক্তিগুলো যথাযথ এবং সহানুভূতি-জাগানিয়া। আর এটিই তো কবিতার উপাদান।’
কবি ফারুক নাজকির কবিতা ‘এবং আমি চুপ রইলাম’-এর অনুবাদ দিয়ে এই পর্বের ইতি টানছি—
এবং আমি চুপ রইলাম
আমার হাতে আমার চিতা তৈরি
আমার কাঁধে উঠল আমার লাশ
চোখের পাপড়ি দিয়ে সময়ের খাতায়
আমারই রক্তে লেখা হলো আমার নাম
এবং আমি চুপ রইলাম।
আমার বাজার-গলি-ছাদ-দরোজা
সাজানো হলো আমার অনটনে
আমার চিন্তা আমার শিল্প-সম্বল
আলোকিত হলো আমারই প্রবঞ্চনায়
এবং আমি চুপ রইলাম।
আমার ভাগ্যের যে স্কেচ আঁকা হয়েছিল
তা লেখা হলো হলদে মৌসুমের পাতায়
আমার ছবি রাখা হলো আমার আড়ালে
আমাকে দেখা গেলো অদেখা কত স্বপ্নে
এবং আমি চুপ রইলাম।
মর্ম-কৃপাণ-আঘাতে আমার শব্দ
দ্বিখণ্ডিত হয়ে গোঙাতে থাকল
ভিখিরির হাতে বণ্টিত আমার গান
জনপ্রিয়তা পেয়ে গোঙাতে থাকল
এবং আমি চুপ রইলাম।
হাত থেকে আমার আকাঙ্ক্ষা ছিনিয়ে নিয়ে
বসন্তবরণ উৎসব করলো হলদে মৌসুম
তুষারপাত হলো আমার কুঁড়েঘরে এসে
রোদ বেরিয়ে ঘরটিকে করল ভীতসন্ত্রস্ত
এবং আমি চুপ রইলাম।
আমার সবুজ মাঠ বিরান করা হলো
আমার হ্রদে পোষা হলো শত অজগর
মারান পর্বতের পবিত্রতা লুণ্ঠিত হলো
সাজানো হলো অনুভূতিহীনতার কবর
এবং আমি চুপ রইলাম।
(লফ্জ লফজ নোহা/ফারুক নাজকি)
আরও পড়ুন:
মুঘল বাদশাহ জাহাঙ্গীর একবার কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলেন। সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তাঁকে খুব বেশি মুগ্ধ করেছিল। তিনি দুই লাইনের একটি ফারসি স্তবক রচনা করেছিলেন, যা পরবর্তীতে ভূস্বর্গ কাশ্মীরের সৌন্দর্যের বিজ্ঞাপন হয়ে দাঁড়ায়। তিনি বলেছিলেন—‘গর ফেরদৌস বর রুয়ে জমিন আস্ত/হামিন আস্ত ও হামিন আস্ত ও হামিন আস্ত’ অর্থাৎ, ‘পৃথিবীর বুকে বেহেশত যদি থেকেই থাকে/তবে তা এখানেই, এখানেই এবং এখানেই’। শ্রীনগরের বর্ণিল টিউলিপ বাগান, আলপনা-রঙিন হাউসবোট, ডাল লেকের অদূরের তুষারাবৃত পর্বত, কুলকুল বয়ে চলা ঝিলম আমাদের স্বাগত জানায় কাশ্মীর উপত্যকায়। পেহেলগাম, গুলমার্গ, সোনমার্গ, আরু ভ্যালি, তুরতুক ইত্যাদি জায়গার ছবি দেখলেই ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। দেবদারু কিংবা চিনার গাছের হলুদ পাতার বসন্ত কিংবা আঙুর, আপেল ও নাশপাতির উর্বর বাগান পৃথিবীর সৌন্দর্যপিয়াসী মানুষদের ছুটিয়ে আনে এখানে। গাধার পিঠে চড়ে, পাহাড়ি ঝিরির স্বচ্ছ জলধারা পেরিয়ে, দল বেঁধে চরে বেড়ানো ভেড়াদের সরিয়ে, সবুজ চাদরে মোড়ানো মাঠ ছাড়িয়ে, সবুজের গাউনপরা উঁচু-উঁচু দেবদারু-চিনারঘেরা এই পাহাড়গুলোর কাছে যাওয়া মানুষের আজন্ম সাধ। চারপাশের উঁচু-উঁচু পাহাড়ের মাঝের আসমানি নেয়ামতে ঠাসা এই উপত্যকায় এসে নিঃসন্দেহে স্বর্গের দেখা পায় মানুষ। যেমন দেখা পেয়েছিলেন সুকান্তও। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘কাশ্মীর’ কবিতায় লিখেন—
‘সেই বিশ্রী দম-আটকানো কুয়াশা আর নেই
নেই সেই একটানা তুষার-বৃষ্টি,
হঠাৎ জেগে উঠেছে-
সূর্যের ছোঁয়ায় চমকে উঠেছে ভূস্বর্গ।
দুহাতে তুষারের পর্দা সরিয়ে ফেলে
মুঠো মুঠো হলদে পাতাকে দিয়েছে উড়িয়ে,
ডেকেছে রৌদ্রকে,
ডেকেছে তুষার-উড়িয়ে-নেওয়া বৈশাখী ঝড়কে,
পৃথিবীর নন্দন-কানন কাশ্মীর।’
(ছাড়পত্র/সুকান্ত ভট্টাচার্য)
সুকান্তের সেই ‘নন্দন-কানন’ এখন আর আগের মতো নেই। স্বতন্ত্র জাতীয়তাবাদ ও ভূখণ্ডের অধিকারী কাশ্মীর এখন তিন টুকরো। কাশ্মীরের সব সৌন্দর্য গিলে নিয়েছে এশিয়ার তিন অজগর—পাকিস্তান, ভারত ও চীন। স্বর্গীয় কাশ্মীর পরিণত হয়েছে জ্বলন্ত নরকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে যেতে থাকে কাশ্মীরি জাতিসত্তা। পাকশাসকরা পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত থাকার শর্তে স্বায়ত্তশাসনের মুলো ঝুলিয়ে ‘আজাদ-কাশ্মীর ও গিলগিট-বালতিস্তান’-কে সেখানকার অঙ্গরাজ্যে পরিণত করেন। কাশ্মীরি নেতৃত্বের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাকি কাশ্মীরকে গিলতে শুরু করে ভারত। সেই গলাধঃকরণের ইতিহাস এখনো থামেনি। সুযোগ পেলেই গিলে নিচ্ছে কাশ্মীরি মানুষের অধিকার, যেন পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে না দিয়ে থামবে না তারা। এদিকে ১৯৬২ সালে ভারত থেকে কাশ্মীরের কিছু অংশ কেড়ে নিয়ে ভক্ষণ করতে থাকে চীন, সেটির নাম হয়েছে ‘আকসাই চীন’।
তিন নেকড়ের কাড়াকাড়ির পরও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভারতশাসিত কাশ্মীর শুরু থেকেই নিজেদের স্বকীয়তার জন্য লড়াই করে এসেছে। ১৯৫০ সালে ভারতের সংবিধান প্রণীত হলে তাতে ‘আর্টিকেল-৩৭০’-এর অধীনে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী হয়েছিল কাশ্মীর। তবে সেই কাগুজে মর্যাদা কখনোই ভোগ করতে পারেনি কাশ্মীর। শেষপর্যন্ত কয়েক বছর আগে রাতের আঁধারে তাও কেড়ে নেওয়া হয়। ষাটের দশকের গণভোটের দাবি সত্তরের দশকের শেষে এসেই ব্যর্থ আরাধনায় পরিণত হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীদের ‘ঘড়ির কাঁটা পেছনে ফেরানো যায় না’ জাতীয় মনোভাব কাশ্মীরে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম দেয়; তাতে ঘি ঢালে পাকিস্তান। শুরু হয় ত্রিমুখী সংকট—যা ভূস্বর্গ কাশ্মীরের সৌন্দর্যকে অনবরত ম্লান করছে ঝিলম নদীর জলে।
দুই.
কাশ্মীরের সাত দশকের এই রক্তক্ষয়ী সময়ের মধ্য দিয়েই বেড়ে ওঠেন কবি ফারুক নাজকি—‘ঝিলমতীরের এক দুরন্ত বালক’ শিরোনামে যার প্রথমজীবনের কথা আমরা তুলে এনেছি গত পর্বে। এবার আমরা সেই দুরন্ত বালক কীভাবে কাশ্মীরি সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনে বিশাল মহিরুহে পরিণত হন, তা দেখার চেষ্টা করব।
ডেইলি মজদুরের বন্ধ হয়ে যাওয়ার মাধ্যমে কবি ফারুক নাজকি প্রথমবারের মতো কাশ্মীরে চাপিয়ে দেওয়া রাজনীতির শিকারে পরিণত হয়। তবে রাজনীতিতে আগ্রহ না থাকায় নাজকি অপেক্ষাকৃত মসৃণ ও সুবিধাজনক পথ—সাহিত্য-সংস্কৃতিকেই বেছে নেন। এসপি কলেজে থাকাকালেই তিনি সাহিত্য সংগঠন ‘বজমে আদব’-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন। সাড়াজাগানো ‘ডেইলি মজদুর’ পত্রিকা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর আর একক কাজে আগ্রহ খুঁজে পাননি। বাবা গোলাম রসুল নাজকিও সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে অতো বেশি চিন্তিত ছিলেন না, বরং তিনি সন্তানদের যোগ্যতা দিয়ে পথ বের করে নেওয়ার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ফারুক নাজকি চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেন। একদিন হুট করে হাজির হন কাশ্মীর কালচারাল অ্যাকাডেমিতে। সেকালে চাকরির বাজার এত প্রতিযোগিতাপূর্ণ ছিল না। কালচারাল অ্যাকাডেমির দায়িত্বশীলরা ফারুকের যোগ্যতা নিয়ে মোটেও সন্দিহান ছিলেন না। তারা ফারুককে তৎক্ষণাৎ অ্যাকাডেমির ‘লিটারেরি অ্যাসিন্ট্যান্ট’ পদে নিয়োগ দিয়ে দেন এবং ‘ডিকশনারি ডিপার্টমেন্ট’-এর একটি ডেস্ক দেখিয়ে দেন। সেখানে বেশ কিছুদিন কাজ করেন ফারুক।
এরপর তিনি ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যোগ দেন। ‘রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’-এর অফিসার হিসেবে কাজ শুরু করেন। কিছুদিন পর তিনি ভারতের একটি মিডিয়া ডেলিগেশনের সদস্য হিসেবে ইংল্যান্ড সফর করার সুযোগ পান। ফারুকের ক্যারিয়ার গঠনে সেই সফর বড় তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। তিনি বলেন, ‘আমরা ইংল্যান্ডের প্রতিটি রেডিও ও টেলিভিশন স্টেশনে হাজির হই এবং তন্ন তন্ন করে দেখি তাদের সিস্টেম।’
এর কিছুদিন পর ফারুক নাজকি সরকারি ব্যবস্থাপনায় জার্মানির বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্নালিজমের ফেলোশিপ লাভ করেন। সেখানে নিজের সাংবাদিকতাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার সুযোগ পান তিনি। নাজকির জার্মানির দিনগুলো বড় মধুর ছিল। তিনি বলেন, ‘জার্মানির জীবন বিলাসী ছিল। সবকিছু খুব সস্তায় পাওয়া যেত। পরিবহন ভাড়া ছিল খুব কম। সপ্তাহান্তে জার্মানির বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াতাম। দেশে ফেরার আগে-আগে জার্মানির প্রায় সব স্থান আমার দেখা হয়ে যায়। অবশ্য পড়ালেখাও ভালোভাবেই করি, সহপাঠীদের সবার চেয়ে ভালো রেজাল্ট করার একটি প্রচেষ্টা আমার ছিল।’
এরপর ফারুক নাজকি কাশ্মীরে ফিরে আসেন। কাশ্মীরের ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে বিশ্বমানে উন্নীত করার প্রচেষ্টা শুরু করেন। রেডিও কাশ্মীরে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি শুরু করেন কাশ্মীরের প্রথম টেলিভিশন ‘দূরদর্শন কাশ্মীর’-এর কাজও। মূলত ফারুক নাজকির হাত ধরেই কাশ্মীর টেলিভিশনের জগতে প্রবেশ করে—যেমনটি তাঁর বাবার হাত ধরে কাশ্মীর প্রবেশ করেছিল রেডিও-এর যুগে।
১৯৮২ সালে কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাহ মারা যান। পুত্র ফারুক আবদুল্লাহ তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন এবং বাবার হাতেগড়া রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি)-এর সভাপতির পদও অলংকৃত করেন। নাজকি পরিবারের সঙ্গে শেখ পরিবারের আগে থেকেই হৃদ্যতার সম্পর্ক, তারওপর ফারুক নাজকি তখন কাশ্মীরের রেডিও-টেলিভিশনের নেতৃত্ব-পর্যায়ের ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। ফলে নতুন মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ বন্ধুপ্রতিম কবি ফারুক নাজকিকে তাঁর ‘মিডিয়া অ্যাডভাইজর’ নিয়োগ দেন। ১৯৮৪ সালে শ্যালক গোলাম মুহাম্মদ শাহ-এর কারসাজিতে ফারুক আবদুল্লাহর সরকারের পতন হলে ফারুক নাজকির ‘মিডিয়া অ্যাডভাইজর’-এর পদও চলে যায়।
১৯৮৬ সালে ফারুক নাজকি ‘দূরদর্শন ও রেডিও কাশ্মীর শ্রীনগর’-এর ডাইরেক্টর পদে নিয়োগ পান এবং ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ১১ বছর অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে এই দায়িত্ব পালন করেন। অবশ্য এই সময়ে রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন আসে। ১৯৮৬ সালে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে আবার শপথ নেন ফারুক আবদুল্লাহ। পরের দিনগুলোতে কাশ্মীরের রাজনীতি উত্তাল হয়ে পড়ে এবং সশস্ত্র বিদ্রোহ বাড়তে থাকে। রেডিও ও টেলিভিশন কেন্দ্রগুলো দিল্লি থেকে প্রচারিত হতে থাকে। কাশ্মীরজুড়ে ব্যাপক সংঘাত ও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লাহ পদত্যাগ করেন। কাশ্মীরে শুরু হয় কেন্দ্রশাসিত রাজ্যপালের শাসন। ১৯৯০ সালের জানুয়ারিতে, কাশ্মীরের অভিজাত হিন্দু সম্প্রদায় ‘পণ্ডিত’দের হত্যা ও দেশান্তর করার ঘটনা ঘটে, যা আজকাল হিন্দুত্ববাদীদের কাছে কাশ্মীরি মুসলমানদের অধিকার হরণের বৈধতার বিজ্ঞাপন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ তখন কাশ্মীর শাসন করছিলেন হিন্দু রাজ্যপাল জাগমোহন মালহোত্রা।
১৯৯৬ সালে ফারুক আবদুল্লাহ আবার মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে ২০০২ সাল পর্যন্ত কাশ্মীর শাসন করেন। এই পুরো সময়জুড়ে কবি ফারুক নাজকি ফের তাঁর ‘মিডিয়া অ্যাডভাইজর’ হিসেবে যোগ দেন। অন্যদিকে ২০০০ সালে কবি ফারুক নাজকি ডেপুটি ডাইরেক্টর জেনারেল হিসেবে ‘দূরদর্শন ও রেডিও কাশ্মীর’ অধ্যায়ের ইতি টানেন। ২০১০ সালে ফারুক আবদুল্লাহর ছেলে ওমর আবদুল্লাহ কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হলে পিতৃতুল্য কবি ফারুক নাজকিকে আবারও ‘মিডিয়া অ্যাডভাইজর’ পদে নিয়ে আসেন। কাশ্মীরি জাতিসত্তার কবি ফারুক নাজকি সব সময় শেখ পরিবারকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেন।
সম্প্রতি কাশ্মীরের বেসরকারি টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দীর্ঘ জীবনের স্মৃতিচারণ করে কবি ফারুক নাজকি বলেন—
‘কাশ্মীরের ইতিহাসের জীবন্ত প্রত্যক্ষদর্শী আমি। কাশ্মীরি ক্ষমতার কেন্দ্রস্থলে থাকার সুবাদে সব ঘটনাবলি সরাসরি দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। রাজনীতি কখনো আমার আগ্রহের জায়গা ছিল না। তাই রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকলেও আমি কখনো রাজনীতিতে জড়াইনি। গণমাধ্যমের সঙ্গে জড়িয়ে থাকার কারণে এবং প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকার কারণে এই দীর্ঘ ইতিহাসের জ্বলন্ত সাক্ষী আমি। আমাদের চোখের সামনে কত চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী ও শেখ আবদুল্লাহর চুক্তি কিংবা রাজিব গান্ধী-ফারুক আবদুল্লাহর আলোচনাসহ সব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা আমি কভার করি। কাশ্মিরিদের ভাগ্য পরিবর্তনে কত ইস্যু সামনে এসেছে। কিন্তু ধীরে ধীরে কাশ্মীর তার স্বকীয়তা হারায়। একসময়ের ‘রেডিও কাশ্মীর’ এখন ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ এবং ‘বিশেষ মর্যাদাসম্পন্ন’ কাশ্মীর এখন তার শেষ মর্যাদাটুকুও হারিয়ে ফেলেছে।’
তিন.
কবি ফারুক নাজকির লেখালেখি ও রচনাকর্মকে তিনি দুভাগে ভাগ করতে পছন্দ করেন। প্রবন্ধ, নাটক, গান ইত্যাদি থেকে তিনি তাঁর কবিতাচর্চাকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে দেখেন। তাঁর দাবি মতে—তিনি সম্পূর্ণ নতুন ধাঁচে কবিতাচর্চায় ব্রতী হয়েছেন। আগেই বলেছি, শৈশবেই কবি জিগর মুরাদাবাদীর হাতে তাঁর কাব্যপ্রতিভার উন্মেষ ঘটে। তাঁর বাড়ির কবিতাভরা চমৎকার পরিবেশ এবং কাশ্মীরি কবি-সাহিত্যিকদের নিত্য আনাগোনা তাঁর কবিমানস তৈরিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল। পরে এসপি কলেজ, কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়, কাশ্মীর কালচারাল অ্যাকাডেমির অনন্য পরিবেশ তাঁর কবিতাচর্চাকে দারুণভাবে সমৃদ্ধ করে। দীর্ঘ মিডিয়াজীবন ও রাজনীতিঘনিষ্ঠতা এবং দেশ-বিদেশভ্রমণ তাতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা।
ফারুক নাজকি কবিতায় দারুণ মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। বাবা গোলাম রসুল নাজকি সুফিধারার সংস্কারক কবি ও ফারুকের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা হলেও সচেতনভাবেই তাঁর কাব্যধারা এড়িয়ে যান তিনি। নিজের মতো করে তৈরি করতে চেষ্টা করেন নিজস্ব কাব্যধারা। রোমান্টিকতা, ইতিবাচকতা, ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা ও নিজের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বিষয়বস্তু বানিয়ে রচনা করেন আধুনিক কাশ্মীরি কবিতা, উর্দু গজল এবং আধুনিক উর্দু কবিতা। এ ছাড়া বিভিন্ন উর্দু-হিন্দি ক্ল্যাসিক্যাল কবিতার কাশ্মীরি রূপ দাঁড় করান যুগের সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই। সব ক্ষেত্রেই তিনি কৃতিত্বের সাক্ষর রাখেন। কারণ খুব সচেতনভাবেই তিনি কবিতাচর্চায় নিজের যুগকে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। তাই কবিতার প্রশ্নে বরবারই বিরলপ্রজ তিনি; খুব কম কবিতাই লিখেন। তিনি বলেন, ‘কবিতার কোয়ান্টিটি কখনোই আমার মুখ্য ছিল না; বরং আমি কোয়ালিটিই চেয়েছি। কোয়ান্টিটির জন্য আমি সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় লেখালেখি করেছি। কবিতা আমার কাছে কবিতাই। এর সঙ্গে অন্য কোনো রচনা তুলনীয় নয়।’
ফারুক নাজকির কাশ্মীরি ভাষার কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে—‘নার হায়ুতুন কাজালভানাস’ (কাজালভানাসে আগুন), ‘মেহজাবিন’ (চাঁদমুখ) ও ‘সাতবরণ’ (সাতরঙ)। এসব কাব্যগ্রন্থ কাশ্মীরি বোদ্ধাদের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়। তাঁর সূক্ষ্মদর্শী, মর্মস্পর্শী ও শ্লেষাত্মক কাব্যধাঁচ কাশ্মীরে ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। উর্দু কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে—‘আখেরি খোয়াব সে পেহলে’ (শেষ স্বপ্নের আগে) ও ‘লফ্জ লফ্জ নোহা’ (শব্দে শব্দে বিলাপ)। এই কাব্যগুলোকে এ কালের উর্দু সাহিত্যে অবশ্যপাঠ্য গণ্য করছেন অনেক সাহিত্য সমালোচক। তাঁর হিন্দি রচনার মধ্যে ‘গেয়ি রুতিয়োঁ কে সাথি’ (বিগত রাতের সঙ্গী) ও ‘হ্যান্ডিক্রাফট অব কাশ্মীর’ (কাশ্মীরের হস্তশিল্প) উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া তিনি অসংখ্য নাটক, গান ও টেলিভিশন প্রোগ্রামের স্ক্রিপ্ট লেখেন।
১৯৯৫ সালে তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘নার হায়ুতুন কাজালভানাস’ এর জন্য কাশ্মীরি ভাষা ক্যাটাগরিতে ভারতের প্রধান সাহিত্যপুরস্কার ‘সাহিত্য অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড’ পান। আবার ‘নার হায়ুতুন কাজালভানাস’ ও ‘লফ্জ লফ্জ নোহা-এর জন্য পান ‘স্টেট কালচারাল অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড’। কাশ্মীরি ভাষার রচনাবলির জন্য ‘জম্মু-কাশ্মীর অ্যাকাডেমি অব কালচার, আর্ট অ্যান্ড ল্যাঙ্গুয়েজেজ বেস্টবুক অ্যাওয়ার্ড’ পান। ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবস্থাপনায় অনন্য অবদানের জন্য পান ‘জম্মু-কাশ্মীর সরকারের স্বর্ণপদক’। অর্জনের ঝুলিতে ভরেন ‘বেস্ট মিডিয়া কন্ট্রোলার অ্যাওয়ার্ড’ও।
চার.
কাশ্মীরের কবি-সাহিত্যিক ও শিল্পবোদ্ধারা কবি ফারুক নাজকির অবদানকে দারুণভাবে মূল্যায়ন করেন। কাশ্মীরের সাবেক আইনপ্রণেতা ও রাজনীতিবিদ জিএম ভবন বলেন, ‘ফারুক নাজকি কাশ্মীরি ও উর্দু ভাষার কবি। তিনি নিজেকে উর্দু সাহিত্যের প্রথমসারির কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। কবি হিসেবে তিনি সর্বাধিক পরিচিত হলেও ডেইলি মজদুর-এর সম্পাদক হিসেবে তাঁর অবদান অনেকের অজানা। তিনিই প্রথমবারের মতো কাশ্মীরের শ্রমিকশ্রেণির গুরুত্বে আলো ফেলেন।’
কাশ্মীরি চিকিৎসক ও সাহিত্য সমালোচক এ ওয়াহিদ বলেন, ‘…ফারুক নাজকি হতাশার গর্ত খুঁড়ে বের করে আনেন ইতিবাচকতা। তিনি এক অনুপম সাহিত্যিক, সমাজবিদ, কবি ও রাজনীতিবিশ্লেষক। তিনি রোমান্টিক, শতরঙা ও আধুনিক; তবে একই সঙ্গে বিশ্বাসীও। ঐতিহ্য ও রহস্যময়তা সাঙ্গ করে বিশ্বাসের পথে হেঁটে তিনি প্রতিটি ঘটনার কারণ খুঁজে ফেরেন। তাঁর কবিতা মোটেও ধারণা-কল্পনার শব্দবাজি নয়; চারপাশের ঘটনাপরম্পরারই প্রতিফলন ঘটে তাঁর লেখায়।’
এ ওয়াহিদ আরও বলেন, ‘কাশ্মীরে কয়েক দশকজুড়ে যে হতাশার রাজত্ব এবং মৃত্যুর নৃত্য তিনি প্রত্যক্ষ করেন, তা তাঁর হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। তবুও তিনি ঠোঁটের কোণে ধরে রাখেন এক চিলতে হাসি। তবে ভেতরটা তাঁর দুমড়ে-মুচড়ে যায় যখন দেখেন—এক তরুণ ক্রসফায়ারের শত বুলেটে ঝাঁজরা হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে, এক মা তাঁর সদ্য বিবাহিত ছেলের রক্তমাখা শার্ট পরিষ্কার করছেন। তাঁর কবিতা আমাদের এক সময়ের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে হিন্দু-মুসলিম সকলেই সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত নেয়ামত ভাগাভাগি করে নিয়েছিল। সেই জাতির এমন ভাঙন দেখে তিনি অশ্রু সংবরণ করতে পারেন না। আমাদের মাতৃভূমি কাশ্মীরের অনন্য নিদর্শন সহাবস্থান, শান্তি-সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য গভীরভাবে আকুল হন। চারপাশের বিরাজমান অন্ধকার সত্ত্বেও তাঁর কবিতা ইতিবাচকতার প্রদীপ জ্বালায়। অনেক কিছু আমরা হারিয়েছি, তবুও ফারুক নাজকি আশা ছাড়েন না; ছাড়তে পারেন না।’
অল ইন্ডিয়া রেডিও শ্রীনগরের সাবেক ডাইরেক্টর ও কবি রফিক রাজ বলেন, ‘ফারুক নাজকি সংবেদনশীল কবি, সৃজনশীল ব্রডকাস্টার এবং দক্ষ অনুবাদক। কাশ্মীরি, উর্দু, হিন্দি ও ফারসি ভাষার সাহিত্য রচনায় সিদ্ধহস্ত। দুটি কারণে তাঁর কবিতা আমাকে মুগ্ধ করে—প্রথমত স্বাতন্ত্র্য-বৈশিষ্ট্যে অনন্যতা, দ্বিতীয়ত তাঁর কল্পনার ব্যতিক্রমী আকাশ।’
রফিক রাজ আরও যুক্ত করেন, ‘তিনি শৌখিন কবি। সমসাময়িক পরিস্থিতির সঙ্গে অতীতকে দারুণভাবে যুক্ত করেন। তিনি আমাদের অপূর্ণতাগুলো পূর্ণ করেন। তাঁর পঙ্ক্তিগুলো যথাযথ এবং সহানুভূতি-জাগানিয়া। আর এটিই তো কবিতার উপাদান।’
কবি ফারুক নাজকির কবিতা ‘এবং আমি চুপ রইলাম’-এর অনুবাদ দিয়ে এই পর্বের ইতি টানছি—
এবং আমি চুপ রইলাম
আমার হাতে আমার চিতা তৈরি
আমার কাঁধে উঠল আমার লাশ
চোখের পাপড়ি দিয়ে সময়ের খাতায়
আমারই রক্তে লেখা হলো আমার নাম
এবং আমি চুপ রইলাম।
আমার বাজার-গলি-ছাদ-দরোজা
সাজানো হলো আমার অনটনে
আমার চিন্তা আমার শিল্প-সম্বল
আলোকিত হলো আমারই প্রবঞ্চনায়
এবং আমি চুপ রইলাম।
আমার ভাগ্যের যে স্কেচ আঁকা হয়েছিল
তা লেখা হলো হলদে মৌসুমের পাতায়
আমার ছবি রাখা হলো আমার আড়ালে
আমাকে দেখা গেলো অদেখা কত স্বপ্নে
এবং আমি চুপ রইলাম।
মর্ম-কৃপাণ-আঘাতে আমার শব্দ
দ্বিখণ্ডিত হয়ে গোঙাতে থাকল
ভিখিরির হাতে বণ্টিত আমার গান
জনপ্রিয়তা পেয়ে গোঙাতে থাকল
এবং আমি চুপ রইলাম।
হাত থেকে আমার আকাঙ্ক্ষা ছিনিয়ে নিয়ে
বসন্তবরণ উৎসব করলো হলদে মৌসুম
তুষারপাত হলো আমার কুঁড়েঘরে এসে
রোদ বেরিয়ে ঘরটিকে করল ভীতসন্ত্রস্ত
এবং আমি চুপ রইলাম।
আমার সবুজ মাঠ বিরান করা হলো
আমার হ্রদে পোষা হলো শত অজগর
মারান পর্বতের পবিত্রতা লুণ্ঠিত হলো
সাজানো হলো অনুভূতিহীনতার কবর
এবং আমি চুপ রইলাম।
(লফ্জ লফজ নোহা/ফারুক নাজকি)
আরও পড়ুন:
আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব চিনুয়া আচেবের জন্ম ১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর নাইজেরিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল ওগিদিতে। তিনি ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকদের একজন। লেখাপড়া শেষে নাইজেরিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনে রেডিও প্রযোজক ও এক্সটারনাল ব্রডকাস্টিংয়ের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
২০ ঘণ্টা আগেবারী সিদ্দিকী সংগীতজীবনের প্রথম দিকে বংশীবাদক হিসেবে পরিচিত পেলেও পরবর্তী সময়ে তিনি একজন লোকসংগীতশিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
২ দিন আগেতিনি ছিলেন একজন আদর্শবান শিক্ষক—অজিতকুমার গুহর এটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়। নিজের জাগতিক উন্নতিকে কখনো বড় করে দেখেননি তিনি। শিক্ষার্থীদের আদর্শ জীবন উপহার দেওয়াই ছিল তাঁর ব্রত। তিনি সক্রিয় ছিলেন ঢাকার প্রগতিশীল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিসরেও। সুবক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতির কমতি ছিল না।
৫ দিন আগেআব্দুল করিম খাঁ ছিলেন হিন্দুস্তানি ধ্রুপদি সংগীতের অন্যতম কিংবদন্তি। কিরানা ঘরানারও তিনি কিংবদন্তি ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত—তিনি গান গাওয়ার সময় এমনভাবে ধ্যানমগ্ন হয়ে যেতেন যে, শ্রোতারাও সেই সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন।
৬ দিন আগে