গুঞ্জন রহমান
১৯৯৭ সালের কথা। তখন আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে প্রথম বর্ষের ছাত্র। এক বিকেলের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা, ক্যাম্পাসের পশ্চিম পাড়া দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলাম কোথাও। হঠাৎ দেখি লুঙ্গি ও স্যান্ডো গেঞ্জি পরিহিত বাবার বয়সী এক ভদ্রলোক এক হাতে হাঁসুয়া বা কাস্তে, অন্য হাতে ঘাসভর্তি বড়সড় একটা ছালার বস্তা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে আসছেন। ঘাস কাটা এবং তা নিয়ে অত জোরে হেঁটে আসার পরিশ্রমে শরীর ঘর্মাক্ত, খানিকটা হাঁপাচ্ছেনও তিনি। আমি ঝট করে সাইকেল থকে নেমে গিয়ে তাঁকে সালাম দিলাম। তিনি সালামের জবাব দিয়ে আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘ফাস্ট ইয়ার?’
আমি লাজুক ভঙ্গিতে বললাম, ‘জি স্যার।’
‘বুঝতে পারছি। ফাস্ট ইয়ার এবং গ্রাম থকে এসেছ। এজন্য এই সব নর্ম এখনো ধরে রেখেছ। আজকাল মুরব্বিদের দেখলে কেউ সাইকেল থেকে নামা তো দূররে কথা, সালামই দেয় না!’
আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। তিনি নিজে থেকেই বললেন, ‘শিক্ষকতা করে বড়জোর নিজের আর স্ত্রী-পুত্র পরিবারের পেট চলে হে ছোকরা। আর সাহিত্য করে তো গরুর রাখালের মজুরিটুকুও জোটে না। এই জন্য নিজেই ঘাস কাটতে যাই রোজ, বুঝলে?’
আমি জড়সড় হয়ে বললাম, ‘স্যার, বস্তাটা আমাকে দিন, আমি সাইকেলে করে আপনার বাসায় পৌঁছে দিই।’
‘অ! তুমি দেবে? রোজ দেবে? মানে, রোজ এই সময়ে এসে আমার ঘাসের বস্তা গোয়ালে পৌঁছে দিতে পারবে? নাকি ঘাসও কটে দেবে?’
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। বলার মতো কিছু খুঁজে পেলাম না। স্যার হাসলেন। প্রশ্রয়ের হাসি। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘যার যেটা কাজ, তাকে সেটা করতে দিতে হয়। আমার গরুর ঘাস আমাকেই কাটতে হবে, আমাকেই গোয়ালে নিতে হবে। ওসব পোশাকি ভদ্রতা করার মানে হয় না। তোমার ইনটেনশন ভালো সেটা বুঝতে পারছি, কিন্তু যার যার লড়াই তার তার লড়ে যাওয়াই উচিত। যাও যাও। সাইকেলে উঠে কেটে পড়ো।’
এই হলো উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক স্যারের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতের হুবহু বর্ণনা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথম বছর থেকেই আমি থিয়েটার করতে শুরু করি। তীর্থক নামক থিয়েটার দলের কর্মী হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আমার পদচারণা শুরু। এর আগ বাবার কর্মসূত্রে আমার নিবাস ছিল গাইবান্ধা জেলার এক পাড়াগাঁয়ের মতো জায়গায়, যার নাম মহিমাগঞ্জ। চিনিকলের কলোনিতে থাকতাম, কাছাকাছি বড় শহর বগুড়ায় যেতাম কেনাকাটা করতে। সে সময় বইপত্র যা পড়তাম, তার মধ্যে সেবা প্রকাশনী আর কিছু ক্ল্যাসিক সাহিত্যের বাইরে সমকালীন লেখক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল—এই তিন নামই আমাদের কিশোরমহলে বেশ পরিচিত ছিল।
কবিতায় শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা—এঁদের বাইরে কবি-সাহিত্যিক খুব বেশি চেনা ছিল না। তেমনই একটা সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পা রেখেই জানতে পারলাম, বাংলাদেশের তথা বাংলা ভাষারই অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হাসান আজিজুল হক এই অঙ্গনের একেবারে ঘরের মানুষ। ঠিক মুরব্বি হিসেবে দেখলেও তাঁকে কিছুটা দূরের মনে হতে পারে, কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গন তথা সবকিছুতেই তিনি এত বেশি কাছের মানুষ ছিলেন যে সামান্যতম দূরত্ব বোঝা যায় এমন কোনো বিশেষণই তাঁর জন্য প্রযোজ্য হয় না। আগেও হয়নি কোনো দিন, পরেও কখনো না। ওই যে বললাম, আটপৌরে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে ঘাস কাটা রাখালের বেশে তাঁকে আমার প্রথম দেখা; বরাবর তিনি ছিলেন এমনই একজন ঘরের মানুষ, যাঁকে দেখে শিক্ষকসুলভ সমীহ তো জাগেই, কিন্তু গুরুজনসুলভ ভীতি জাগে না। যাঁকে দেখে বাবা-চাচা-মামাদের মতো আপনজন মনে হয়, কিন্তু মাস্টারমশাইসুলভ দূরত্ব ধোপে টেকে না। সে জন্যই বুঝি ওই প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালীনই যখন আমাদের পরিবার দিনাজপুর জেলা শহরে স্থায়ী হলো, ছুটিছাঁটায় দিনাজপুরে গিয়ে সেখানকার শিল্পসাহিত্যের মানুষদের কাছে আমি রীতিমতো ঈর্ষার পাত্রে পরিণত হতাম। সেটা এই কারণে যে হাসান আজিজুল হকের মতো মহীরুহের সঙ্গে এই ছেলে চাইলে রোজ দেখা করতে পারে, কথা বলতে পারে, কোনো কারণ ছাড়াই তাঁর বাসায় পর্যন্ত চলে যেতে পারে!
ঠিক এই জায়গাতেই আপত্তি করেছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধ সহকর্মী অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম স্যার। তিনি আমাদের সুযোগ পেলেই মনে করিয়ে দিতেন, ‘বাতাসের ভেতরে থেকে তো বাতাসের অস্তিত্ব বোঝা যায় না; তাই তোমরা বুঝতে চাও না, তিনি কত বড় মানুষ। কত বড় একজন চিন্তাশীল মানুষ, সৃজনশীল মানুষ। তাঁর জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড মূল্যবান। এই যে তোমরা যখন-তখন হুট করে চলে যাও তাঁর কাছে, তিনি তখন হয় কিছু লিখছেন, নয়তো লেখার কথা ভাবছেন। তোমার কারণে সেই লেখার অপমৃত্যু হলো—এটা কি তুমি বোঝো? তাঁর সঙ্গে তোমার এক ঘণ্টা আড্ডায় তুমি সমৃদ্ধ হবে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু বঞ্চিত হবে বাংলা সাহিত্য। তিনি ভীষণ সঙ্গপ্রিয় মানুষ, তিনি তোমাদের ভালোবাসেন, প্রশ্রয় দেন—এটা তাঁর মহানুভবতা। কিন্তু তাঁকে তাঁর মতো লিখতে দিতে হবে, নিরিবিলি সময় করে দিতে হবে—এটা তোমাদের দায়িত্ব।’
শহীদুল ইসলাম স্যারের এ কথায় কেউ তেমন কান দেয়নি, সবাই স্যারকে ঘিরে থেকেছে সব সময়, কিন্তু আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে চেষ্টা করতাম। পারতপক্ষে তাঁর কাছে ঘেঁষতাম না, একা একা তো কিছুতেই না। এমনিতেই প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে তাঁকে দেখতে পেতাম, আলাদা করে একান্তে মিলিত হওয়ার দরকারই বা কী? আর আমি এত ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যে তাঁর সঙ্গে দুদণ্ড কথা বলার যোগ্যতাও আমার নেই! শুধুই শুনে যাব বলে তাঁকে তাঁর সৃষ্টিকর্ম থেকে সরিয়ে রাখার কোনো অধিকার কি আমার আছে?
রাবির ছাত্র হিসেবে অন্য সবার চেয়ে একটু হলেও আলাদা করে স্যারকে দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছিল। আমার মনে পড়ছে, সম্ভবত ১৯৯৭ কিংবা ১৯৯৮ সালের কথা। সেবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থকে সংবর্ধনা দেওয়া হলো মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় এক বীর যোদ্ধা, যিনি বন্দুক হাতে না নিয়েই এক অসম যুদ্ধ করেছিলেন মহাপরাক্রমশালী পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে এবং জয়ী হয়েছিলেন সেই যুদ্ধে—তিনি মজিবর রহমান দেবদাস স্যার। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সেনা ছাউনি করার এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে নির্বিচারে গণহত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এই অসীম সাহসী শিক্ষক। পাকিস্তান আর্মির কমান্ডার যখন যুক্তি দিয়েছিলেন—এরা বিধর্মী কাফের, তাই এদের মেরে ফেলায় অন্যায় নেই, তখন এর প্রতিবাদে তিনি নিজের মজিবর রহমান নাম পরিবর্তন করে দেবদাস রেখেছিলেন। পাকিস্তানি আর্মি তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন করে, যার কারণে তিনি একটা সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার চাকরিটি হারান এই অজুহাতে যে চাকরিতে বহাল থাকার মতো তাঁর মানসিক ভারসাম্য নেই। বঞ্চিত করা হয় তাঁর সারা জীবনের চাকরি থকে অর্জিত অর্থনৈতিক সুবিধা থেকে। প্রকৃতপক্ষে এ সবই ছিল স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের যোগসাজশ।
১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরলে স্যারকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও চাকরিজীবনের আর্থিক অর্জন ফিরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়, যার প্রথম পদক্ষেপ ছিল সেই সংবর্ধনা। সেই অনুষ্ঠানে অনিচ্ছাকৃতভাবে বারবার স্যারের নামটি ভুল বললেও আবার সংশোধন করে নিচ্ছিলেন বক্তারা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান উচ্চপদে আসীন ব্যক্তিরা দেবদাস স্যারকে “আর্থিক সহায়তার আশ্বাস” দিচ্ছিলেন। হঠাৎ অনিচ্ছাকৃতভাবে মঞ্চে উঠে হাসান স্যার ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। তীব্র ভাষায় তিনি এসব ধৃষ্টতার প্রতিবাদ করলেন। চিৎকার করে বললেন, ‘কাকে আপনারা সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছেন? তাঁর নিজের পাওনা টাকা তাঁকে বুঝিয়ে দিন! সেই টাকা আজকের বাজারদরে কত হয় হিসাব করুন। কে তাঁকে করুণা করে? কার এত বড় সাহস? করুণা পরে করবেন, আগে তো তাঁকে সম্মান দিন! তিনি নিজে তাঁর নাম রেখেছেন দেবদাস, যে নামটি প্রথম সুযোগে আপনাদের মুখে আসছে না, সংশোধন করে বলতে হচ্ছে বারবার! আপনারা কি তাঁকে সম্মান দিতে ডেকেছেন, নাকি আবারও অসম্মান করতে?.... আপনাদের প্রতি আমার আসলেই কোনো আশা নেই। আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের প্রতি বলছি। বাবা-মায়েরা, তোমরা এই লোকটিকে দেখো। এই যে ছোটখাটো মানুষটি এখানে বসে আছেন, এঁকে দেখো। কারণ হিমালয় দেখতে যাওয়ার সুযোগ তোমাদের অনেকের হবে না, আজ এই সুযোগে তোমরা স্পর্ধার হিমালয় দেখে নাও। দেখে নাও দেশপ্রেমের আটলান্টিক মহাসাগর। দেখে নাও বিদ্রোহের সাহারা মরুভূমি। দেখে নাও স্বাধীনতার ধ্রুবতারাকে। আর আমাকে একটা কথা দাও। আপস করতে হলে সব বিষয়ে আপস কোরো, কিন্তু মা আর মাতৃভূমির সঙ্গে কোরো না। ভেজাল দিতে হলে সবকিছুতে দিয়ো, কিন্তু স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে ভেজাল দিয়ো না। ভুলতে হলে সবাইকে ভুলে যেয়ো, কিন্তু এই মাটির প্রকৃত বীর এই মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো দিন ভুলে যেয়ো না।’
আজ, মাত্রই কিছুক্ষণ আগে অনুজপ্রতিম বন্ধুর কাছ থকে জানতে পারলাম, হাসান আজিজুল হক স্যার আর নেই। বাংলা সাহিত্য কাকে হারাল, সে বাংলা সাহিত্যের পাঠক আর সাহিত্যিকেরা জানেন। আমি বড়জোর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে, তাঁকে কাছে থেকে দেখতে পাওয়া সৌভাগ্যবানদের একজন হিসেবে এটুকু বলতে পারি—আপস না করা, ভেজাল না দেওয়া, শেকড়কে কিছুতেই না ভোলা এক অদম্য চেতনা আজ দেহ ত্যাগ করে অনন্তে মিলে গেলেন। এক জীবন্ত কিংবদন্তি আজ শাব্দিক অর্থেই কিংবদন্তি হয়ে গেলেন।
১৯৯৭ সালের কথা। তখন আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে প্রথম বর্ষের ছাত্র। এক বিকেলের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক এলাকা, ক্যাম্পাসের পশ্চিম পাড়া দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলাম কোথাও। হঠাৎ দেখি লুঙ্গি ও স্যান্ডো গেঞ্জি পরিহিত বাবার বয়সী এক ভদ্রলোক এক হাতে হাঁসুয়া বা কাস্তে, অন্য হাতে ঘাসভর্তি বড়সড় একটা ছালার বস্তা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে আসছেন। ঘাস কাটা এবং তা নিয়ে অত জোরে হেঁটে আসার পরিশ্রমে শরীর ঘর্মাক্ত, খানিকটা হাঁপাচ্ছেনও তিনি। আমি ঝট করে সাইকেল থকে নেমে গিয়ে তাঁকে সালাম দিলাম। তিনি সালামের জবাব দিয়ে আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘ফাস্ট ইয়ার?’
আমি লাজুক ভঙ্গিতে বললাম, ‘জি স্যার।’
‘বুঝতে পারছি। ফাস্ট ইয়ার এবং গ্রাম থকে এসেছ। এজন্য এই সব নর্ম এখনো ধরে রেখেছ। আজকাল মুরব্বিদের দেখলে কেউ সাইকেল থেকে নামা তো দূররে কথা, সালামই দেয় না!’
আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। তিনি নিজে থেকেই বললেন, ‘শিক্ষকতা করে বড়জোর নিজের আর স্ত্রী-পুত্র পরিবারের পেট চলে হে ছোকরা। আর সাহিত্য করে তো গরুর রাখালের মজুরিটুকুও জোটে না। এই জন্য নিজেই ঘাস কাটতে যাই রোজ, বুঝলে?’
আমি জড়সড় হয়ে বললাম, ‘স্যার, বস্তাটা আমাকে দিন, আমি সাইকেলে করে আপনার বাসায় পৌঁছে দিই।’
‘অ! তুমি দেবে? রোজ দেবে? মানে, রোজ এই সময়ে এসে আমার ঘাসের বস্তা গোয়ালে পৌঁছে দিতে পারবে? নাকি ঘাসও কটে দেবে?’
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। বলার মতো কিছু খুঁজে পেলাম না। স্যার হাসলেন। প্রশ্রয়ের হাসি। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘যার যেটা কাজ, তাকে সেটা করতে দিতে হয়। আমার গরুর ঘাস আমাকেই কাটতে হবে, আমাকেই গোয়ালে নিতে হবে। ওসব পোশাকি ভদ্রতা করার মানে হয় না। তোমার ইনটেনশন ভালো সেটা বুঝতে পারছি, কিন্তু যার যার লড়াই তার তার লড়ে যাওয়াই উচিত। যাও যাও। সাইকেলে উঠে কেটে পড়ো।’
এই হলো উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক স্যারের সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতের হুবহু বর্ণনা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রথম বছর থেকেই আমি থিয়েটার করতে শুরু করি। তীর্থক নামক থিয়েটার দলের কর্মী হিসেবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আমার পদচারণা শুরু। এর আগ বাবার কর্মসূত্রে আমার নিবাস ছিল গাইবান্ধা জেলার এক পাড়াগাঁয়ের মতো জায়গায়, যার নাম মহিমাগঞ্জ। চিনিকলের কলোনিতে থাকতাম, কাছাকাছি বড় শহর বগুড়ায় যেতাম কেনাকাটা করতে। সে সময় বইপত্র যা পড়তাম, তার মধ্যে সেবা প্রকাশনী আর কিছু ক্ল্যাসিক সাহিত্যের বাইরে সমকালীন লেখক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল—এই তিন নামই আমাদের কিশোরমহলে বেশ পরিচিত ছিল।
কবিতায় শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা—এঁদের বাইরে কবি-সাহিত্যিক খুব বেশি চেনা ছিল না। তেমনই একটা সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে পা রেখেই জানতে পারলাম, বাংলাদেশের তথা বাংলা ভাষারই অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হাসান আজিজুল হক এই অঙ্গনের একেবারে ঘরের মানুষ। ঠিক মুরব্বি হিসেবে দেখলেও তাঁকে কিছুটা দূরের মনে হতে পারে, কিন্তু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অঙ্গন তথা সবকিছুতেই তিনি এত বেশি কাছের মানুষ ছিলেন যে সামান্যতম দূরত্ব বোঝা যায় এমন কোনো বিশেষণই তাঁর জন্য প্রযোজ্য হয় না। আগেও হয়নি কোনো দিন, পরেও কখনো না। ওই যে বললাম, আটপৌরে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরে ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে ঘাস কাটা রাখালের বেশে তাঁকে আমার প্রথম দেখা; বরাবর তিনি ছিলেন এমনই একজন ঘরের মানুষ, যাঁকে দেখে শিক্ষকসুলভ সমীহ তো জাগেই, কিন্তু গুরুজনসুলভ ভীতি জাগে না। যাঁকে দেখে বাবা-চাচা-মামাদের মতো আপনজন মনে হয়, কিন্তু মাস্টারমশাইসুলভ দূরত্ব ধোপে টেকে না। সে জন্যই বুঝি ওই প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকাকালীনই যখন আমাদের পরিবার দিনাজপুর জেলা শহরে স্থায়ী হলো, ছুটিছাঁটায় দিনাজপুরে গিয়ে সেখানকার শিল্পসাহিত্যের মানুষদের কাছে আমি রীতিমতো ঈর্ষার পাত্রে পরিণত হতাম। সেটা এই কারণে যে হাসান আজিজুল হকের মতো মহীরুহের সঙ্গে এই ছেলে চাইলে রোজ দেখা করতে পারে, কথা বলতে পারে, কোনো কারণ ছাড়াই তাঁর বাসায় পর্যন্ত চলে যেতে পারে!
ঠিক এই জায়গাতেই আপত্তি করেছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধ সহকর্মী অধ্যাপক শহীদুল ইসলাম স্যার। তিনি আমাদের সুযোগ পেলেই মনে করিয়ে দিতেন, ‘বাতাসের ভেতরে থেকে তো বাতাসের অস্তিত্ব বোঝা যায় না; তাই তোমরা বুঝতে চাও না, তিনি কত বড় মানুষ। কত বড় একজন চিন্তাশীল মানুষ, সৃজনশীল মানুষ। তাঁর জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড মূল্যবান। এই যে তোমরা যখন-তখন হুট করে চলে যাও তাঁর কাছে, তিনি তখন হয় কিছু লিখছেন, নয়তো লেখার কথা ভাবছেন। তোমার কারণে সেই লেখার অপমৃত্যু হলো—এটা কি তুমি বোঝো? তাঁর সঙ্গে তোমার এক ঘণ্টা আড্ডায় তুমি সমৃদ্ধ হবে তাতে সন্দেহ নেই, কিন্তু বঞ্চিত হবে বাংলা সাহিত্য। তিনি ভীষণ সঙ্গপ্রিয় মানুষ, তিনি তোমাদের ভালোবাসেন, প্রশ্রয় দেন—এটা তাঁর মহানুভবতা। কিন্তু তাঁকে তাঁর মতো লিখতে দিতে হবে, নিরিবিলি সময় করে দিতে হবে—এটা তোমাদের দায়িত্ব।’
শহীদুল ইসলাম স্যারের এ কথায় কেউ তেমন কান দেয়নি, সবাই স্যারকে ঘিরে থেকেছে সব সময়, কিন্তু আমি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতে চেষ্টা করতাম। পারতপক্ষে তাঁর কাছে ঘেঁষতাম না, একা একা তো কিছুতেই না। এমনিতেই প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনোভাবে তাঁকে দেখতে পেতাম, আলাদা করে একান্তে মিলিত হওয়ার দরকারই বা কী? আর আমি এত ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র যে তাঁর সঙ্গে দুদণ্ড কথা বলার যোগ্যতাও আমার নেই! শুধুই শুনে যাব বলে তাঁকে তাঁর সৃষ্টিকর্ম থেকে সরিয়ে রাখার কোনো অধিকার কি আমার আছে?
রাবির ছাত্র হিসেবে অন্য সবার চেয়ে একটু হলেও আলাদা করে স্যারকে দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছিল। আমার মনে পড়ছে, সম্ভবত ১৯৯৭ কিংবা ১৯৯৮ সালের কথা। সেবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থকে সংবর্ধনা দেওয়া হলো মুক্তিযুদ্ধের অকুতোভয় এক বীর যোদ্ধা, যিনি বন্দুক হাতে না নিয়েই এক অসম যুদ্ধ করেছিলেন মহাপরাক্রমশালী পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে এবং জয়ী হয়েছিলেন সেই যুদ্ধে—তিনি মজিবর রহমান দেবদাস স্যার। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সেনা ছাউনি করার এবং বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশে নির্বিচারে গণহত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এই অসীম সাহসী শিক্ষক। পাকিস্তান আর্মির কমান্ডার যখন যুক্তি দিয়েছিলেন—এরা বিধর্মী কাফের, তাই এদের মেরে ফেলায় অন্যায় নেই, তখন এর প্রতিবাদে তিনি নিজের মজিবর রহমান নাম পরিবর্তন করে দেবদাস রেখেছিলেন। পাকিস্তানি আর্মি তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে অমানবিক নির্যাতন করে, যার কারণে তিনি একটা সময় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপনার চাকরিটি হারান এই অজুহাতে যে চাকরিতে বহাল থাকার মতো তাঁর মানসিক ভারসাম্য নেই। বঞ্চিত করা হয় তাঁর সারা জীবনের চাকরি থকে অর্জিত অর্থনৈতিক সুবিধা থেকে। প্রকৃতপক্ষে এ সবই ছিল স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের যোগসাজশ।
১৯৯৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি রাষ্ট্রক্ষমতায় ফিরলে স্যারকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও চাকরিজীবনের আর্থিক অর্জন ফিরিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়, যার প্রথম পদক্ষেপ ছিল সেই সংবর্ধনা। সেই অনুষ্ঠানে অনিচ্ছাকৃতভাবে বারবার স্যারের নামটি ভুল বললেও আবার সংশোধন করে নিচ্ছিলেন বক্তারা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নানান উচ্চপদে আসীন ব্যক্তিরা দেবদাস স্যারকে “আর্থিক সহায়তার আশ্বাস” দিচ্ছিলেন। হঠাৎ অনিচ্ছাকৃতভাবে মঞ্চে উঠে হাসান স্যার ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। তীব্র ভাষায় তিনি এসব ধৃষ্টতার প্রতিবাদ করলেন। চিৎকার করে বললেন, ‘কাকে আপনারা সাহায্য-সহযোগিতার আশ্বাস দিচ্ছেন? তাঁর নিজের পাওনা টাকা তাঁকে বুঝিয়ে দিন! সেই টাকা আজকের বাজারদরে কত হয় হিসাব করুন। কে তাঁকে করুণা করে? কার এত বড় সাহস? করুণা পরে করবেন, আগে তো তাঁকে সম্মান দিন! তিনি নিজে তাঁর নাম রেখেছেন দেবদাস, যে নামটি প্রথম সুযোগে আপনাদের মুখে আসছে না, সংশোধন করে বলতে হচ্ছে বারবার! আপনারা কি তাঁকে সম্মান দিতে ডেকেছেন, নাকি আবারও অসম্মান করতে?.... আপনাদের প্রতি আমার আসলেই কোনো আশা নেই। আমি আমার ছাত্রছাত্রীদের প্রতি বলছি। বাবা-মায়েরা, তোমরা এই লোকটিকে দেখো। এই যে ছোটখাটো মানুষটি এখানে বসে আছেন, এঁকে দেখো। কারণ হিমালয় দেখতে যাওয়ার সুযোগ তোমাদের অনেকের হবে না, আজ এই সুযোগে তোমরা স্পর্ধার হিমালয় দেখে নাও। দেখে নাও দেশপ্রেমের আটলান্টিক মহাসাগর। দেখে নাও বিদ্রোহের সাহারা মরুভূমি। দেখে নাও স্বাধীনতার ধ্রুবতারাকে। আর আমাকে একটা কথা দাও। আপস করতে হলে সব বিষয়ে আপস কোরো, কিন্তু মা আর মাতৃভূমির সঙ্গে কোরো না। ভেজাল দিতে হলে সবকিছুতে দিয়ো, কিন্তু স্বাধীনতার চেতনার সঙ্গে ভেজাল দিয়ো না। ভুলতে হলে সবাইকে ভুলে যেয়ো, কিন্তু এই মাটির প্রকৃত বীর এই মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো দিন ভুলে যেয়ো না।’
আজ, মাত্রই কিছুক্ষণ আগে অনুজপ্রতিম বন্ধুর কাছ থকে জানতে পারলাম, হাসান আজিজুল হক স্যার আর নেই। বাংলা সাহিত্য কাকে হারাল, সে বাংলা সাহিত্যের পাঠক আর সাহিত্যিকেরা জানেন। আমি বড়জোর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে, তাঁকে কাছে থেকে দেখতে পাওয়া সৌভাগ্যবানদের একজন হিসেবে এটুকু বলতে পারি—আপস না করা, ভেজাল না দেওয়া, শেকড়কে কিছুতেই না ভোলা এক অদম্য চেতনা আজ দেহ ত্যাগ করে অনন্তে মিলে গেলেন। এক জীবন্ত কিংবদন্তি আজ শাব্দিক অর্থেই কিংবদন্তি হয়ে গেলেন।
তারাপদ রায় দুই বাংলার প্রতিষ্ঠিত কবি হলেও তাঁর জন্ম ও শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো কেটেছে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শহরে। তিনি ১৯৩৬ সালের ১৭ নভেম্বর টাঙ্গাইল শহরের পূর্ব আদালতপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন টাঙ্গাইল জজকোর্টের আইনজীবী।
৯ ঘণ্টা আগেআধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব চিনুয়া আচেবের জন্ম ১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর নাইজেরিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল ওগিদিতে। তিনি ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকদের একজন। লেখাপড়া শেষে নাইজেরিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনে রেডিও প্রযোজক ও এক্সটারনাল ব্রডকাস্টিংয়ের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
১ দিন আগেবারী সিদ্দিকী সংগীতজীবনের প্রথম দিকে বংশীবাদক হিসেবে পরিচিত পেলেও পরবর্তী সময়ে তিনি একজন লোকসংগীতশিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
২ দিন আগেতিনি ছিলেন একজন আদর্শবান শিক্ষক—অজিতকুমার গুহর এটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়। নিজের জাগতিক উন্নতিকে কখনো বড় করে দেখেননি তিনি। শিক্ষার্থীদের আদর্শ জীবন উপহার দেওয়াই ছিল তাঁর ব্রত। তিনি সক্রিয় ছিলেন ঢাকার প্রগতিশীল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিসরেও। সুবক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতির কমতি ছিল না।
৫ দিন আগে