অর্ণব সান্যাল
বইগুলো ছিল পেপারব্যাক। লেখার হরফ দেখা যেত কম দামি নিউজপ্রিন্টে। প্রচ্ছদে থাকত রহস্যের ইঙ্গিতবাহী সব উপকরণ। আর এক কোনায় জ্বলজ্বল করত হলুদরঙা প্রজাপতি। তার চারপাশে লাল ছিল স্বমহিমায়। আর এই লাল ও হলুদে মিশে আমাদের মনে তৈরি হতো এক নয়া রঙিন দুনিয়া!
সেই দুনিয়ায় ঢোকার টিকিটের দাম উৎসাহীদের হাতের নাগালেই থাকত। সেখানে অন্তত ছিল না ধনী-গরিবের ভেদাভেদ। প্রজাপতি তার রঙিন পাখা দেখাত যৎসামান্য দর্শনীর বিনিময়ে। পাঁচ দশকের বেশি সময় গড়ালেও জাদুকর তাঁর প্রজাপতির দর্শনী কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আকাশে চড়াননি। হয়তো প্রজাপতি দেখে দর্শনার্থীদের চোখে-মুখে ফুটে ওঠা আলোকচ্ছটা অবলোকনের এক দুর্নিবার নেশা ছিল তাঁর।
সেই জাদুকর ছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। ‘ছিলেন’ শব্দটি ব্যবহার করে অতীতচারী হতে হচ্ছে মোটে কয়েক ঘণ্টা আগে শোনা এক সংবাদের কারণে। সেই সংবাদ জানিয়েছে, সবার প্রিয় ‘কাজীদা’ নাকি চলে গেছেন! আসলেই কি গেছেন? নাকি বাহ্যিকভাবে থাকা একটা মানুষ এখন হৃদয়ের বা বিজ্ঞানের হিসাবে মস্তিষ্কের গভীরতম নিউরনে ঘাঁটি গেড়েছেন? সেখান থেকে কি আর কাজীদাকে সরানো সম্ভব!
শৈশব-কৈশোরে আমাদের রঙিন দুনিয়া দিয়েছে তিনজন গোয়েন্দা। সেই গোয়েন্দাদের গড়ে-পিটে মানুষ করেছিল কাজীদার প্রজাপতি ‘সেবা’। আমাদেরও কি গড়েনি? অন্তত দুর্ধর্ষ সব গোয়েন্দা অভিযানে বুঁদ করে কল্পনার আকাশটাকে বড় তো করতে শিখিয়েছে। হ্যাঁ, ওই বয়সটা এমন ছিল যে সচেতন অভিভাবকেরা কখনো কখনো মাসুদ রানার সঙ্গে পরিচিত হতে গেলেই সিনেমার ‘চৌধুরী সাহেব’ হয়ে যেতেন। নিষেধাজ্ঞা আসত। আর আমাদের তখন জেদ চাপত বয়সের কাঁটাকে রকেটের গতিতে ঘোরানোর! আরে, বড় না হলে ড্যাশিং স্পাইয়ের সঙ্গে হ্যান্ডশেকটা হবে কীভাবে? কেউ কেউ নিশ্চয়ই বয়সের কাঁটার নিয়মমাফিক চলাকে বরদাশত করতে না পেরে বাড়ির বা স্কুলের কোনো কোণে গোপনে দেখা করত বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের সেই দুঃসাহসী গুপ্তচরের সঙ্গে। আজ নিশ্চয়ই সেসব নির্দোষ লাগে বড়, ঠোঁটের কোণে আসে মুচকি হাসি। এই বড় বেলায় সেই প্রশান্তি এনে দেওয়া হাসিটুকুও কিন্তু কাজীদার সৌজন্যেই।
এ তো গেল রোমাঞ্চ। তার পাশেই ছিল আরও ঘন রহস্যে ঘেরা পত্রিকা। এর বাইরে সেবা আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে পুরো বিশ্বের সঙ্গে, সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় হাঁটতে শিখিয়েছে। সেখানে এই পৃথিবীর কালজয়ী প্রায় সব লেখকই আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন সাগ্রহে। সেবার কিশোর ক্ল্যাসিক আমাদের হাতে কম খরচে তুলে দিয়েছে বিশ্বসাহিত্যের মণি-মুক্তো। উদাহরণ দেওয়ার কি দরকার আছে? ছোটবেলার কিছু নাম মনে করুন না! দেখবেন, প্রজাপতি থাকবে ঠিকই।
হ্যাঁ, সমালোচনা থাকতেই পারে। মৌলিকত্ব নিয়ে প্রশ্নও তোলা যায়। তাই বলে কি যৌগিক পদার্থের গুরুত্ব ফিকে হয় একেবারে? হাইড্রোজেন, অক্সিজেন মিলে জল হয় বটে। তাই বলে জলের অপর নাম জীবন নয়! তেষ্টায় গলা ভেজাতে কিন্তু জলই লাগে হাতের কাছে। সেই তেষ্টা মেটাতে সেবার চেষ্টায় কোনো খাদ ছিল না। বরং চাইলেই অনতিদূরত্বে পাওয়া গেছে গেলাস ভরা জল। শতকের পালাবদল বা মুক্ত বাজার অর্থনীতি—কিছুই সেখানে নাক গলাতে পারেনি। বরং পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে আমাদের ‘থ্রিলড’ করে গেছে অবিচলচিত্তে।
এক সাক্ষাৎকারে বছর কয়েক আগে কাজী আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, শৈশব থেকে থ্রিলার বই তাঁকে টানত প্রবলভাবে। তা থেকেই থ্রিলারে তাঁর আগমন। আর ওই বইগুলোর কারণেই তিনি চিরকিশোর রয়ে গেছেন নিজের ভালোবাসার জগতে। সেই সঙ্গে আমাদেরও তিনি দিয়ে গেছেন এক চিরকিশোর রঙিন প্রজাপতি। সেই প্রজাপতি বুড়ো হবে না কখনো, বয়স যতই হোক! বরং পাখার রং খোলতাই হবে আরও।
আড্ডা সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
বইগুলো ছিল পেপারব্যাক। লেখার হরফ দেখা যেত কম দামি নিউজপ্রিন্টে। প্রচ্ছদে থাকত রহস্যের ইঙ্গিতবাহী সব উপকরণ। আর এক কোনায় জ্বলজ্বল করত হলুদরঙা প্রজাপতি। তার চারপাশে লাল ছিল স্বমহিমায়। আর এই লাল ও হলুদে মিশে আমাদের মনে তৈরি হতো এক নয়া রঙিন দুনিয়া!
সেই দুনিয়ায় ঢোকার টিকিটের দাম উৎসাহীদের হাতের নাগালেই থাকত। সেখানে অন্তত ছিল না ধনী-গরিবের ভেদাভেদ। প্রজাপতি তার রঙিন পাখা দেখাত যৎসামান্য দর্শনীর বিনিময়ে। পাঁচ দশকের বেশি সময় গড়ালেও জাদুকর তাঁর প্রজাপতির দর্শনী কিন্তু সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আকাশে চড়াননি। হয়তো প্রজাপতি দেখে দর্শনার্থীদের চোখে-মুখে ফুটে ওঠা আলোকচ্ছটা অবলোকনের এক দুর্নিবার নেশা ছিল তাঁর।
সেই জাদুকর ছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। ‘ছিলেন’ শব্দটি ব্যবহার করে অতীতচারী হতে হচ্ছে মোটে কয়েক ঘণ্টা আগে শোনা এক সংবাদের কারণে। সেই সংবাদ জানিয়েছে, সবার প্রিয় ‘কাজীদা’ নাকি চলে গেছেন! আসলেই কি গেছেন? নাকি বাহ্যিকভাবে থাকা একটা মানুষ এখন হৃদয়ের বা বিজ্ঞানের হিসাবে মস্তিষ্কের গভীরতম নিউরনে ঘাঁটি গেড়েছেন? সেখান থেকে কি আর কাজীদাকে সরানো সম্ভব!
শৈশব-কৈশোরে আমাদের রঙিন দুনিয়া দিয়েছে তিনজন গোয়েন্দা। সেই গোয়েন্দাদের গড়ে-পিটে মানুষ করেছিল কাজীদার প্রজাপতি ‘সেবা’। আমাদেরও কি গড়েনি? অন্তত দুর্ধর্ষ সব গোয়েন্দা অভিযানে বুঁদ করে কল্পনার আকাশটাকে বড় তো করতে শিখিয়েছে। হ্যাঁ, ওই বয়সটা এমন ছিল যে সচেতন অভিভাবকেরা কখনো কখনো মাসুদ রানার সঙ্গে পরিচিত হতে গেলেই সিনেমার ‘চৌধুরী সাহেব’ হয়ে যেতেন। নিষেধাজ্ঞা আসত। আর আমাদের তখন জেদ চাপত বয়সের কাঁটাকে রকেটের গতিতে ঘোরানোর! আরে, বড় না হলে ড্যাশিং স্পাইয়ের সঙ্গে হ্যান্ডশেকটা হবে কীভাবে? কেউ কেউ নিশ্চয়ই বয়সের কাঁটার নিয়মমাফিক চলাকে বরদাশত করতে না পেরে বাড়ির বা স্কুলের কোনো কোণে গোপনে দেখা করত বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের সেই দুঃসাহসী গুপ্তচরের সঙ্গে। আজ নিশ্চয়ই সেসব নির্দোষ লাগে বড়, ঠোঁটের কোণে আসে মুচকি হাসি। এই বড় বেলায় সেই প্রশান্তি এনে দেওয়া হাসিটুকুও কিন্তু কাজীদার সৌজন্যেই।
এ তো গেল রোমাঞ্চ। তার পাশেই ছিল আরও ঘন রহস্যে ঘেরা পত্রিকা। এর বাইরে সেবা আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছে পুরো বিশ্বের সঙ্গে, সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় হাঁটতে শিখিয়েছে। সেখানে এই পৃথিবীর কালজয়ী প্রায় সব লেখকই আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন সাগ্রহে। সেবার কিশোর ক্ল্যাসিক আমাদের হাতে কম খরচে তুলে দিয়েছে বিশ্বসাহিত্যের মণি-মুক্তো। উদাহরণ দেওয়ার কি দরকার আছে? ছোটবেলার কিছু নাম মনে করুন না! দেখবেন, প্রজাপতি থাকবে ঠিকই।
হ্যাঁ, সমালোচনা থাকতেই পারে। মৌলিকত্ব নিয়ে প্রশ্নও তোলা যায়। তাই বলে কি যৌগিক পদার্থের গুরুত্ব ফিকে হয় একেবারে? হাইড্রোজেন, অক্সিজেন মিলে জল হয় বটে। তাই বলে জলের অপর নাম জীবন নয়! তেষ্টায় গলা ভেজাতে কিন্তু জলই লাগে হাতের কাছে। সেই তেষ্টা মেটাতে সেবার চেষ্টায় কোনো খাদ ছিল না। বরং চাইলেই অনতিদূরত্বে পাওয়া গেছে গেলাস ভরা জল। শতকের পালাবদল বা মুক্ত বাজার অর্থনীতি—কিছুই সেখানে নাক গলাতে পারেনি। বরং পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে আমাদের ‘থ্রিলড’ করে গেছে অবিচলচিত্তে।
এক সাক্ষাৎকারে বছর কয়েক আগে কাজী আনোয়ার হোসেন বলেছিলেন, শৈশব থেকে থ্রিলার বই তাঁকে টানত প্রবলভাবে। তা থেকেই থ্রিলারে তাঁর আগমন। আর ওই বইগুলোর কারণেই তিনি চিরকিশোর রয়ে গেছেন নিজের ভালোবাসার জগতে। সেই সঙ্গে আমাদেরও তিনি দিয়ে গেছেন এক চিরকিশোর রঙিন প্রজাপতি। সেই প্রজাপতি বুড়ো হবে না কখনো, বয়স যতই হোক! বরং পাখার রং খোলতাই হবে আরও।
আড্ডা সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
তারাপদ রায় দুই বাংলার প্রতিষ্ঠিত কবি হলেও তাঁর জন্ম ও শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো কেটেছে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শহরে। তিনি ১৯৩৬ সালের ১৭ নভেম্বর টাঙ্গাইল শহরের পূর্ব আদালতপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন টাঙ্গাইল জজকোর্টের আইনজীবী।
৭ ঘণ্টা আগেআধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব চিনুয়া আচেবের জন্ম ১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর নাইজেরিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল ওগিদিতে। তিনি ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকদের একজন। লেখাপড়া শেষে নাইজেরিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনে রেডিও প্রযোজক ও এক্সটারনাল ব্রডকাস্টিংয়ের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
১ দিন আগেবারী সিদ্দিকী সংগীতজীবনের প্রথম দিকে বংশীবাদক হিসেবে পরিচিত পেলেও পরবর্তী সময়ে তিনি একজন লোকসংগীতশিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
২ দিন আগেতিনি ছিলেন একজন আদর্শবান শিক্ষক—অজিতকুমার গুহর এটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়। নিজের জাগতিক উন্নতিকে কখনো বড় করে দেখেননি তিনি। শিক্ষার্থীদের আদর্শ জীবন উপহার দেওয়াই ছিল তাঁর ব্রত। তিনি সক্রিয় ছিলেন ঢাকার প্রগতিশীল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিসরেও। সুবক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতির কমতি ছিল না।
৫ দিন আগে