জাহীদ রেজা নূর
মুক্তিযুদ্ধের একপর্যায়ে যে স্বাধীনতা এল, তারই প্রশস্ত পথ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল আমাদের শৈশব। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশকে এখনকার তরুণ চিনবে না। সেই সরু সরু রাস্তা, ছোট ছোট বাড়ি, বাড়ির সামনে লন, বড় বড় গাছ—এগুলো কি এখন আর প্রাসঙ্গিক? সে সময়ের ঢাকা শহরকে চিনতে হলে যেতে হবে মফস্বলের কোনো শহরে, কিংবা ভারতের আগরতলায়। বেশ ক’বছর আগে আগরতলায় গিয়ে মনে হয়েছিল, আরে! আমার ছেলেবেলায় দেখা ঢাকার সঙ্গে এই শহরের কত মিল!
সে সময় শহুরে তারুণ্যকে গ্রাস করেছিলেন আজম খান। তাঁর ‘রেল লাইনের ওই বস্তিতে’, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘হাইকোর্টের মাজারে’ শুনতে শুনতে মাতাল হয়ে যেত তরুণেরা। মাতাল হতো আমাদের মতো শিশুরাও। পপ সংগীত যেন আমাদের নিয়ে যেত মোক্ষধামে। বাকি সব এই ঘোরের মধ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল।
এরই মধ্য থেকে কখনো ঝলক দিয়ে উঠত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কোনো গান। ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবরে’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি।’
আর সেই গানগুলোর মধ্য থেকে ঝলক দিয়ে ওঠে, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।’ আমাদের জাতীয় সংগীত।
বাহাত্তরে বয়স যখন ছয়, তখন আমরা চিৎকার করে জাতীয় সংগীত গাইতে থাকি। ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়নজলে ভাসি’ বলতে গিয়ে দেশের চেহারা নয়, আমার চোখে ফুটে উঠত আমার মায়ের চেহারা। রাষ্ট্রপতি আবু সায়ীদ চৌধুরী আমাদের ৫ নং চামেলিবাগের ভাড়া বাড়িতে এসে মাকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে যাওয়ার পর যে ছবিতে আমরা আট ভাই মায়ের সঙ্গে বসে আছি, সে ছবিটাই ভেসে উঠত চোখে।
‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না মা’, কিংবা ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ গানটি বেসুরো কণ্ঠে গাইতে গিয়ে কখন নিজেরই অলক্ষ্যে মাটির সঙ্গে মাথার মোলাকাত হয়েছে, টেরই পাইনি।
হ্যাঁ, তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গাওয়া গানগুলোর কিছু কিছু আমরা মুখস্থ করে নিয়েছিলাম। নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহকপাট’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’, অতুল প্রসাদ সেনের ‘মোদের গরব মোদের আশা’, মুকুন্দ দাসের ‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে’, গুরুসদয় দত্তের ‘মানুষ হ মানুষ হ আবার তোরা মানুষ হ’ গানগুলো আমাদের মোহিত করে তুলত। সলিল চৌধুরীর দুটো গান ‘মানব না এ বন্ধনে না, মানব না এ শৃঙ্খলে’, কিংবা ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা’ শুনলে শরীরে অদ্ভুত শক্তি আসত। আর ছিল মোহিনী সেনের ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’। এই গানটি নাচের সঙ্গে দেখতে ভালো লাগত বেশি।
এভাবেই আজম খানের প্রবল প্রমত্ত ঝড়ের মাঝে দেশের গানেরা শান্ত হয়ে মনের মাঝে বসত। কী করে সেগুলোই একসময় হয়ে উঠল তৃষ্ণার জল, সে কথাই তো বলার জন্য এই আয়োজন।
হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ
আমাদের একটা টেলিভিশন ছিল। ফিলিপস। দেশে যখন প্রথম টেলিভিশন এসেছে, তখন তার একটি এসেছিল আমাদের বাড়িতে। পাড়ার লোকেরা বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান হলে চলে আসত আমাদের বাড়িতে। তখন বারান্দায় রাখা হতো টেলিভিশন। বাড়ির সামনের লনে দাঁড়িয়ে-বসে পাড়ার মানুষেরা টিভি দেখত।
সেই টিভিতে হতো গানের অনুষ্ঠান। সম্ভবত রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠানটির নাম ছিল গীতবিতান। রাত ৮টার খবরের আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বোধ হয় ছিল সে অনুষ্ঠান। সারা দিন কাজের পর আমাদের মা সে সময় একটু বসতেন টেলিভিশনের সামনে। তিনিই বলতেন সন্জীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, কলিম শরাফীর কথা। জাহেদুর রহিমের কথা। স্বীকার করে নেওয়া ভালো, সে সময় রবীন্দ্রসংগীতে মোটেই আনন্দ পেতাম না। মনে হতো, একঘেয়ে সুরে কী হচ্ছে এটা? কোথাও কোনো চমক নেই, চিৎকার নেই। একটানা কী সব কথা বলে যাওয়া হচ্ছে!
সে বয়সেই হঠাৎ করে কানে এল কয়েকটি গান। আমূল পাল্টে গেল রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ভাবনা। গানগুলোর কয়েকটির উল্লেখ না করলে এই পাল্টে যাওয়ার ঘটনাটি বোঝা যাবে না। বলে রাখি, তখনো টেপ রেকর্ডার বা স্টেরিও সেট নেই আমাদের বাড়িতে। সম্বল এক ব্যান্ডের একটা রেডিও, আর টেলিভিশন। রেডিওটা থাকে আমাদের পঞ্চম ভ্রাতার শাসনে, ফলে সেটার কাছাকাছি হওয়া যেত শুধু সে বাড়িতে না থাকলেই।
শিশুদেরই কোনো অনুষ্ঠানে যখন শুনলাম, ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’, তখন সে গানের কথাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে মনে হলো, আরে! এ দেখি আমার কথাই বলা হচ্ছে। আমাদের সবার কথাই বলা হচ্ছে। রাজা বলে আলাদা কেউ নেই। এ রাজা তো আমি, এ রাজা তো তুমি, এ রাজা তো সে! এ যে কী এক অনবদ্য আবিষ্কার, সেটা অনুভব না করলে বলে লাভ নেই।
তারপর ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলোরে!’ এই গান শুনতে গিয়ে একটা খটকা আসত মনে। এখানে তুমি, আর তুইয়ের ব্যবহার একই সঙ্গে করলেন কেন রবীন্দ্রনাথ, সেটা বুঝতে পারতাম না। খুদে এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করায় সে বিজ্ঞের মতো উত্তর দিয়েছিল, ‘রবীন্দ্রনাথ তো কবি, ব্যাকরণ জানে না। বড়ুয়া স্যারের ক্লাসে গেলে রবীন্দ্রনাথ বুঝত কত ধানে কত চাল!’ উত্তরটা অবশ্য আজও পাইনি।
এবার কয়েকটি গানের কথা এক নিশ্বাসে বলে যাই, তাতে বোঝা যাবে, কেন রবীন্দ্রসংগীতকে আর প্যানপ্যানানি বলে মনে হতো না। যদিও অনেক পরে এসে বুঝতে শুরু করেছি, যাকে প্যানপ্যানানি ভেবেছি সেই ছেলেবেলায়, তা ছিল দুঃখ নামক রোগের প্রতিষেধক, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার ওষুধ। কিন্তু সে বয়সে কে আর তা ভাবে?
‘বাঁধ ভেঙে দাও বাঁধ ভেঙে দাও।’
‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক।’
‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে।’
‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজের অপমান।’
‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো।’
‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে জয় মা বলে ভাসা তরী।’
অন্যরকম হলেও অনেক পরে আরেকটি গান খুব ভালো লেগেছিল, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’। সে কথাও বলব যথাসময়ে।
এই যে হঠাৎ করে রবীন্দ্রনাথ ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন, তা কিন্তু ‘মনে মনেই’। হারিয়ে গেছি মনে মনে। এবং হ্যাঁ, নিজের কণ্ঠে সে গান করার চেষ্টা করিনি মোটেও, নিজে বেসুরো বলে। অন্যের কণ্ঠে শুনেই প্রাণের আশ মিটিয়েছি।
কৈশোরে রবীন্দ্রনাথ
স্বাধীন দেশের প্রাথমিক চলার পথে ছিল অনেক খানা-খন্দ। রাজনীতির মাঠে যে খেলা চলছিল, তাতে রেফারির বাঁশি হয়ে গিয়েছিল গৌণ। এর পর তো উদ্ভট উটের পিঠে চড়ে বসল দেশ। সে যে কোনদিকে যাচ্ছে, তা বুঝবে সাধ্য কার?
সেই অরাজকতায় ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ বাক্যটি হয়ে উঠল কারও কারও জন্য হীরন্ময়। রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি জটিল করে দেওয়ার খেলা শুরু হলো। মরুভূমির লু হাওয়া বইতে লাগল বাংলাদেশজুড়ে।
তখন রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলেন কী করে, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। দেখা গেল, হারমোনিয়ামের রিডে আঙুল বুলিয়ে তুলছে রবীন্দ্রনাথের সুর। পাড়ায়-মহল্লায় সকালের দিকে তখনো শোনা যেত গলা সাধার আওয়াজ। ভোরবেলাটায় রাঙিয়ে যেত মন, ‘যাবার আগে নয়’, দিনের শুরুতেই।
সে সময় বইয়ের পাতায় আসতেন রবীন্দ্রনাথ। ‘বলাই’ কিংবা ‘ছুটি’ গল্পের মাধ্যমে তিনি ঢুকে যেতেন মনের ভিতর। গানে গানে রবীন্দ্রনাথকে পেতাম না তখন।
এর মাঝে বাড়িতে ঘটে গেল এক পরিবর্তন। মেজ ভাই মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন। ফেরার পথে সেখান থেকে নিয়ে এসেছেন একটা স্টেরিও সেট। সেখানে ক্যাসেট দিলেই শোনা যাবে গান। যখন ইচ্ছে, তখন শোনা যাবে। যখন ইচ্ছে, তা বন্ধ করে অন্য একটি গান দেওয়া যাবে। গানের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য।
সে সময় যে ক্যাসেটগুলো এল, তার একটি ছিল ‘শ্যামা’, একটি ‘চিত্রাঙ্গদা’, একটি ‘মায়ার খেলা’, একটি ‘চণ্ডালিকা’। হতে পারে দুই পিঠে দুটো গীতিনাট্য।
আলাদাভাবে এল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্র সংগীতের ক্যাসেট। যে ক্যাসেট থেকে সবার আগে মুখস্থ হয়ে গেল ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় ফাগুন মাসের কী উচ্ছ্বাসে’।
শ্যামার মধ্যেই দেখি হেমন্ত! বজ্রসেন হয়ে মঞ্চ কাঁপাচ্ছেন! এই প্রথম রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে একটু স্থিত হই। শ্যামাকে বোঝার চেষ্টা করি। বজ্রসেন আর শ্যামার মধ্যে কে বেশি আপন, তা ঠিক করে নিতে দ্বিধান্বিত হয়ে ওঠে মন। উত্তীয়কে বিপদে ফেলার পরও শ্যামাকে একমাত্র অপরাধী বলে ভাবতে ভাল্লাগে না। বজ্রসেনের জন্যই তো এত ত্যাগ, তাহলে বজ্রসেন কেন ক্ষমা করতে পারবে না শ্যামাকে! শেষে এসে বলছে ‘যাও যাও যাও, যাও ফিরে যাও।’ তারপর বলছে, ‘ক্ষম হে মম দীনতা, পাপীজন স্মরণ প্রভু।’ ‘ক্ষমিবে না আমার ক্ষমাহীনতা’—কী মারাত্মক কথা!
এইচএসসি দিলাম ১৯৮৪ সালে। এর পর ‘কণ্ঠশীলন’ নামে একটি আবৃত্তি সংগঠনে যোগ দিলাম। সেখানে কবিতার পাশাপাশি বিশ্ববীক্ষার সুযোগ হলো। রবীন্দ্রনাথের গানের পথে হাঁটার সুযোগ হলো একেবারে ভিন্ন একটি মাধ্যমে।
কণ্ঠশীলনে আবৃত্তি করতেন ফওজিয়া মান্নান। আমি তাঁকে মিলি আপা বলে ডাকি। মহড়া শেষ হলে আমরা কয়েকজন তাঁকে আর ছন্দা আপাকে তাঁদের বাড়ি পৌঁছে দিতাম। টিএসসি থেকে নীলক্ষেত হয়ে আজিমপুর কলোনিতে মিলি আপা, আর কবরস্থান ছাড়িয়ে নতুন পল্টনে ছন্দা আপাকে পৌঁছে দিতাম। ওয়াহিদুল হক সে সময় মিলি আপাদের বাড়িতে গিয়ে আটকে যেতেন। সেখানে ছিল ক্লাস নাইন পড়ুয়া তানিয়া মান্নান, মিলি আপার ছোট বোন। আমরাও কখনো কখনো বসতাম সে বাড়িতে। তানিয়া নিয়ে আসত হারমোনিয়াম। তারপর গাইত গান।
এখনো তানিয়ার রেওয়াজ করা কয়েকটি গান মনে আছে। রবীন্দ্রনাথের দিকে এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে এ গানগুলো ছিল দিশারি। একটি গান হলো, ‘আকাশ আমায় ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে।’ গানটা শুনি আর ভাবি, এ কি অসাধারণ কথা! বিনে পয়সার বিনিময়! আকাশ মানে সূর্য, নিশ্চয়ই আলো দিচ্ছে পৃথিবীকে, আর তাতে পৃথিবী মানে পৃথিবীর মানুষের কত আনন্দ! সে গান দিয়ে সে পুরস্কারের মূল্য দিচ্ছে!
সে সময় আরও দুটো গানের সুধা এসে মিশে যায় মনে।
‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই’
‘অল্প লইয়া থাকি তাই মোর যাহা যায়, তাহা যায়।’
গান দুটি শুনি সুবিনয় রায়ের ক্যাসেটে। রাশিয়ার দশ বছর কেটেছে এই দুই গানের ওমে। সে আরও পরের ব্যাপার।
এ ছাড়া আরও দুটি গান হলো, ‘জাগো পূরবাসী, ভগবৎ প্রেমপিয়াসি।’ অন্যটা ‘ধীরে ধীরে মোরে টেনে লহ তোমা পানে।’ পরের দুটি গান রবীন্দ্রসংগীত নয়, কিন্তু একই সঙ্গে গান তিনটি শুনতাম, এবং অবাক হয়ে খেয়াল করে দেখতাম, গান তিনটি আমাদের মুখস্থ হয়ে গেছে। আর এ সময় পেয়ে যাই এক অমোঘ বার্তা: রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল সময় হলো ১৮৯১ থেকে ১৯০০ সাল। এ সময়টিতে তিনি কাটিয়েছেন পূর্ববঙ্গে!
‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’
এক নতুন জগতের ঠিকানা লিখে দিল সে কালের পূর্ববঙ্গ। শাহজাদপুর, শিলাইদহ, আর পতিসর। বোটটা যেন আমি নিজের চোখে দেখি। ছিন্নপত্রগুলো ভেসে ওঠে চোখে। রবীন্দ্রনাথ নিজের চোখে মানুষ দেখছেন। তিনি সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে পৌঁছাচ্ছেন। এতকাল যে বদ্ধ জলাশয়ে ছিল বসবাস, সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এ যেন মহাসাগর!
গানের কথা বলছি। তাই আগে শোনা একটি গানকে এই সময়ের গায়ে লেপ্টে দিলাম:
‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকল খানে।’
‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে’ গানটির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ওয়াহিদুল হক বলেন, ‘এ সময় বাউল সংগীতের সঙ্গে একাত্ম হচ্ছেন কবি। এই যে গানটা, সেটাও লেখা হয়েছে বাউল সুরে। একটা গান আছে, “হরিনাম দিয়ে জগৎ মাতালে, আমার একলা নিতাই!” সেই সুরেই তো গানটা!’
গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানটির সুরে হলো ‘আমার সোনার বাংলা’, এখন যা আমাদের জাতীয় সংগীত। এর পর থেকে নানাভাবেই তো রবীন্দ্রনাথ এসেছেন আমার কাছে। এসেছেন তাঁর প্রবন্ধের মাধ্যমে, কবিতায়। এসেছেন অন্যদের হাত ধরে। সে রকমই কিছু কথা শোনানো জরুরি।
বিচ্ছিন্ন কিছু কথা
আমার গালে একটা চটকানা দিলেন বিষ্ণু দে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখলেন:
‘তুমি কি কেবল-ই স্মৃতি, শুধু এক উপলক্ষ, কবি?
হরেক উৎসবে হৈ হৈ
মঞ্চে মঞ্চে কেবল-ই কি ছবি?
তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ
আর বাইশে শ্রাবণ?’
তারপর বললেন—
‘তোমার আকাশ দাও, কবি, দাও
দীর্ঘ আশি বছরের
আমাদের ক্ষীয়মাণ মানসে ছড়াও
সূর্যোদয় সূর্যাস্তের আশি বছরের আলো,
বহুধা কীর্তিতে শত শিল্পকর্মে উন্মুক্ত উধাও
তোমার কীর্তিতে আর তোমাতে যা দিকে দিকে
একাগ্র মহৎ,
সে কঠিন ব্রতের গৌরবে,
আমাদের বিকারের গড্ডল ধুলার দিনগত অন্যায়ের কুৎসিতে
শুনি যেন সুন্দরের গান’
ওলোট পালট হয়ে গেল ভাবনার জগৎ। মেকি মনে হলো অনেক কিছুই। আসলেই কি উপলক্ষ তৈরি করে হইহই করলে রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া যায়? ওই জন্ম-মৃত্যুর দুটি দিন, আর নববর্ষে ‘এসো হে বৈশাখ’ গাইলেই কর্তব্য শেষ? তাঁর গান কবিতাটিতে এসে ‘এ পরবাসে রবে কে এ পরবাসে’ পঙ্ক্তিটিতে এসে থমকে দাঁড়াই। মালতী ঘোষালকে চিনি না। কিন্তু তিনি যেন এসে গানটি শুনিয়ে যান। সে কবিতায় দেবব্রত বিশ্বাসের উদাত্ত কণ্ঠের বর্ণনা শুনে ক্যাসেটে তাঁর গান শোনার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম!
‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধ সংগীত’ বইটি পড়ে আহত হয়েছিলাম।
শামসুর রাহমান তাঁর ঋণী কবিতায় লেখেন ফাহমিদা খাতুনের রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে:
‘ফাহমিদা সুর ভাঁজে, এ-ও এক বৃষ্টি অপরূপ
অস্তিত্ব ডুবিয়ে নামে, গীতবিতানের কিছু নিভৃত নিশ্চুপ
পাতা ওড়ে অলৌকিক কলরবে, গাংচিলের মতো ওড়ে
ঘোরে সারা ঘরে
প্রাণের ঊর্মিল জল ছুঁয়ে যায় কত ছল ভরে।’
আরেকটা কথা বলি ফাহমিদা খাতুনকে নিয়ে। এটা অবশ্য গান। আমাদের গর্বের ইতিহাস। ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ গানটি নিয়েই কথা।
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে পাকিস্তান টেলিভিশনে গান গাইছিলেন ফাহমিদা খাতুন। স্বাধিকার আন্দোলনের সেই তুঙ্গ মুহূর্তে টেলিভিশনের বাঙালি কর্মকর্তারা চাইছিলেন না টেলিভিশনে পাকিস্তানি পতাকা দেখিয়ে অধিবেশন শেষ করতে। তাই ফাহমিদা খাতুনকে নির্দেশ দেওয়া হলো গান গেয়ে মাঝ রাত পার করে দিতে। ফাহমিদা খাতুন গাইতে থাকলেন, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি, তুমি কী অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।’ এবং সত্যিই রাত ১২টা পেরিয়ে গেলে অধিবেশন শেষ হলো। ২৩ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান টেলিভিশনে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের একপর্যায়ে যে স্বাধীনতা এল, তারই প্রশস্ত পথ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল আমাদের শৈশব। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশকে এখনকার তরুণ চিনবে না। সেই সরু সরু রাস্তা, ছোট ছোট বাড়ি, বাড়ির সামনে লন, বড় বড় গাছ—এগুলো কি এখন আর প্রাসঙ্গিক? সে সময়ের ঢাকা শহরকে চিনতে হলে যেতে হবে মফস্বলের কোনো শহরে, কিংবা ভারতের আগরতলায়। বেশ ক’বছর আগে আগরতলায় গিয়ে মনে হয়েছিল, আরে! আমার ছেলেবেলায় দেখা ঢাকার সঙ্গে এই শহরের কত মিল!
সে সময় শহুরে তারুণ্যকে গ্রাস করেছিলেন আজম খান। তাঁর ‘রেল লাইনের ওই বস্তিতে’, ‘ওরে সালেকা ওরে মালেকা’, ‘হাইকোর্টের মাজারে’ শুনতে শুনতে মাতাল হয়ে যেত তরুণেরা। মাতাল হতো আমাদের মতো শিশুরাও। পপ সংগীত যেন আমাদের নিয়ে যেত মোক্ষধামে। বাকি সব এই ঘোরের মধ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছিল।
এরই মধ্য থেকে কখনো ঝলক দিয়ে উঠত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কোনো গান। ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবরে’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’, ‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি।’
আর সেই গানগুলোর মধ্য থেকে ঝলক দিয়ে ওঠে, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।’ আমাদের জাতীয় সংগীত।
বাহাত্তরে বয়স যখন ছয়, তখন আমরা চিৎকার করে জাতীয় সংগীত গাইতে থাকি। ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়নজলে ভাসি’ বলতে গিয়ে দেশের চেহারা নয়, আমার চোখে ফুটে উঠত আমার মায়ের চেহারা। রাষ্ট্রপতি আবু সায়ীদ চৌধুরী আমাদের ৫ নং চামেলিবাগের ভাড়া বাড়িতে এসে মাকে সান্ত্বনা দিয়ে চলে যাওয়ার পর যে ছবিতে আমরা আট ভাই মায়ের সঙ্গে বসে আছি, সে ছবিটাই ভেসে উঠত চোখে।
‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক আমি তোমায় ছাড়ব না মা’, কিংবা ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ গানটি বেসুরো কণ্ঠে গাইতে গিয়ে কখন নিজেরই অলক্ষ্যে মাটির সঙ্গে মাথার মোলাকাত হয়েছে, টেরই পাইনি।
হ্যাঁ, তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গাওয়া গানগুলোর কিছু কিছু আমরা মুখস্থ করে নিয়েছিলাম। নজরুলের ‘কারার ঐ লৌহকপাট’, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্যে পুষ্পে ভরা’, অতুল প্রসাদ সেনের ‘মোদের গরব মোদের আশা’, মুকুন্দ দাসের ‘ভয় কি মরণে রাখিতে সন্তানে’, গুরুসদয় দত্তের ‘মানুষ হ মানুষ হ আবার তোরা মানুষ হ’ গানগুলো আমাদের মোহিত করে তুলত। সলিল চৌধুরীর দুটো গান ‘মানব না এ বন্ধনে না, মানব না এ শৃঙ্খলে’, কিংবা ‘বিচারপতি তোমার বিচার করবে যারা’ শুনলে শরীরে অদ্ভুত শক্তি আসত। আর ছিল মোহিনী সেনের ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে’। এই গানটি নাচের সঙ্গে দেখতে ভালো লাগত বেশি।
এভাবেই আজম খানের প্রবল প্রমত্ত ঝড়ের মাঝে দেশের গানেরা শান্ত হয়ে মনের মাঝে বসত। কী করে সেগুলোই একসময় হয়ে উঠল তৃষ্ণার জল, সে কথাই তো বলার জন্য এই আয়োজন।
হঠাৎ রবীন্দ্রনাথ
আমাদের একটা টেলিভিশন ছিল। ফিলিপস। দেশে যখন প্রথম টেলিভিশন এসেছে, তখন তার একটি এসেছিল আমাদের বাড়িতে। পাড়ার লোকেরা বিশেষ কোনো অনুষ্ঠান হলে চলে আসত আমাদের বাড়িতে। তখন বারান্দায় রাখা হতো টেলিভিশন। বাড়ির সামনের লনে দাঁড়িয়ে-বসে পাড়ার মানুষেরা টিভি দেখত।
সেই টিভিতে হতো গানের অনুষ্ঠান। সম্ভবত রবীন্দ্রসংগীতের অনুষ্ঠানটির নাম ছিল গীতবিতান। রাত ৮টার খবরের আগে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বোধ হয় ছিল সে অনুষ্ঠান। সারা দিন কাজের পর আমাদের মা সে সময় একটু বসতেন টেলিভিশনের সামনে। তিনিই বলতেন সন্জীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন, কলিম শরাফীর কথা। জাহেদুর রহিমের কথা। স্বীকার করে নেওয়া ভালো, সে সময় রবীন্দ্রসংগীতে মোটেই আনন্দ পেতাম না। মনে হতো, একঘেয়ে সুরে কী হচ্ছে এটা? কোথাও কোনো চমক নেই, চিৎকার নেই। একটানা কী সব কথা বলে যাওয়া হচ্ছে!
সে বয়সেই হঠাৎ করে কানে এল কয়েকটি গান। আমূল পাল্টে গেল রবীন্দ্রনাথ নিয়ে ভাবনা। গানগুলোর কয়েকটির উল্লেখ না করলে এই পাল্টে যাওয়ার ঘটনাটি বোঝা যাবে না। বলে রাখি, তখনো টেপ রেকর্ডার বা স্টেরিও সেট নেই আমাদের বাড়িতে। সম্বল এক ব্যান্ডের একটা রেডিও, আর টেলিভিশন। রেডিওটা থাকে আমাদের পঞ্চম ভ্রাতার শাসনে, ফলে সেটার কাছাকাছি হওয়া যেত শুধু সে বাড়িতে না থাকলেই।
শিশুদেরই কোনো অনুষ্ঠানে যখন শুনলাম, ‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’, তখন সে গানের কথাগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে মনে হলো, আরে! এ দেখি আমার কথাই বলা হচ্ছে। আমাদের সবার কথাই বলা হচ্ছে। রাজা বলে আলাদা কেউ নেই। এ রাজা তো আমি, এ রাজা তো তুমি, এ রাজা তো সে! এ যে কী এক অনবদ্য আবিষ্কার, সেটা অনুভব না করলে বলে লাভ নেই।
তারপর ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলোরে!’ এই গান শুনতে গিয়ে একটা খটকা আসত মনে। এখানে তুমি, আর তুইয়ের ব্যবহার একই সঙ্গে করলেন কেন রবীন্দ্রনাথ, সেটা বুঝতে পারতাম না। খুদে এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করায় সে বিজ্ঞের মতো উত্তর দিয়েছিল, ‘রবীন্দ্রনাথ তো কবি, ব্যাকরণ জানে না। বড়ুয়া স্যারের ক্লাসে গেলে রবীন্দ্রনাথ বুঝত কত ধানে কত চাল!’ উত্তরটা অবশ্য আজও পাইনি।
এবার কয়েকটি গানের কথা এক নিশ্বাসে বলে যাই, তাতে বোঝা যাবে, কেন রবীন্দ্রসংগীতকে আর প্যানপ্যানানি বলে মনে হতো না। যদিও অনেক পরে এসে বুঝতে শুরু করেছি, যাকে প্যানপ্যানানি ভেবেছি সেই ছেলেবেলায়, তা ছিল দুঃখ নামক রোগের প্রতিষেধক, নিজেকে খুঁজে পাওয়ার ওষুধ। কিন্তু সে বয়সে কে আর তা ভাবে?
‘বাঁধ ভেঙে দাও বাঁধ ভেঙে দাও।’
‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়ুক।’
‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে।’
‘সংকোচের বিহ্বলতা নিজের অপমান।’
‘ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো।’
‘এবার তোর মরা গাঙে বান এসেছে জয় মা বলে ভাসা তরী।’
অন্যরকম হলেও অনেক পরে আরেকটি গান খুব ভালো লেগেছিল, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’। সে কথাও বলব যথাসময়ে।
এই যে হঠাৎ করে রবীন্দ্রনাথ ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন, তা কিন্তু ‘মনে মনেই’। হারিয়ে গেছি মনে মনে। এবং হ্যাঁ, নিজের কণ্ঠে সে গান করার চেষ্টা করিনি মোটেও, নিজে বেসুরো বলে। অন্যের কণ্ঠে শুনেই প্রাণের আশ মিটিয়েছি।
কৈশোরে রবীন্দ্রনাথ
স্বাধীন দেশের প্রাথমিক চলার পথে ছিল অনেক খানা-খন্দ। রাজনীতির মাঠে যে খেলা চলছিল, তাতে রেফারির বাঁশি হয়ে গিয়েছিল গৌণ। এর পর তো উদ্ভট উটের পিঠে চড়ে বসল দেশ। সে যে কোনদিকে যাচ্ছে, তা বুঝবে সাধ্য কার?
সেই অরাজকতায় ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ বাক্যটি হয়ে উঠল কারও কারও জন্য হীরন্ময়। রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি জটিল করে দেওয়ার খেলা শুরু হলো। মরুভূমির লু হাওয়া বইতে লাগল বাংলাদেশজুড়ে।
তখন রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলেন কী করে, সেটা একটা প্রশ্ন বটে। দেখা গেল, হারমোনিয়ামের রিডে আঙুল বুলিয়ে তুলছে রবীন্দ্রনাথের সুর। পাড়ায়-মহল্লায় সকালের দিকে তখনো শোনা যেত গলা সাধার আওয়াজ। ভোরবেলাটায় রাঙিয়ে যেত মন, ‘যাবার আগে নয়’, দিনের শুরুতেই।
সে সময় বইয়ের পাতায় আসতেন রবীন্দ্রনাথ। ‘বলাই’ কিংবা ‘ছুটি’ গল্পের মাধ্যমে তিনি ঢুকে যেতেন মনের ভিতর। গানে গানে রবীন্দ্রনাথকে পেতাম না তখন।
এর মাঝে বাড়িতে ঘটে গেল এক পরিবর্তন। মেজ ভাই মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন। ফেরার পথে সেখান থেকে নিয়ে এসেছেন একটা স্টেরিও সেট। সেখানে ক্যাসেট দিলেই শোনা যাবে গান। যখন ইচ্ছে, তখন শোনা যাবে। যখন ইচ্ছে, তা বন্ধ করে অন্য একটি গান দেওয়া যাবে। গানের ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য।
সে সময় যে ক্যাসেটগুলো এল, তার একটি ছিল ‘শ্যামা’, একটি ‘চিত্রাঙ্গদা’, একটি ‘মায়ার খেলা’, একটি ‘চণ্ডালিকা’। হতে পারে দুই পিঠে দুটো গীতিনাট্য।
আলাদাভাবে এল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রবীন্দ্র সংগীতের ক্যাসেট। যে ক্যাসেট থেকে সবার আগে মুখস্থ হয়ে গেল ‘প্রাঙ্গণে মোর শিরীষ শাখায় ফাগুন মাসের কী উচ্ছ্বাসে’।
শ্যামার মধ্যেই দেখি হেমন্ত! বজ্রসেন হয়ে মঞ্চ কাঁপাচ্ছেন! এই প্রথম রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে একটু স্থিত হই। শ্যামাকে বোঝার চেষ্টা করি। বজ্রসেন আর শ্যামার মধ্যে কে বেশি আপন, তা ঠিক করে নিতে দ্বিধান্বিত হয়ে ওঠে মন। উত্তীয়কে বিপদে ফেলার পরও শ্যামাকে একমাত্র অপরাধী বলে ভাবতে ভাল্লাগে না। বজ্রসেনের জন্যই তো এত ত্যাগ, তাহলে বজ্রসেন কেন ক্ষমা করতে পারবে না শ্যামাকে! শেষে এসে বলছে ‘যাও যাও যাও, যাও ফিরে যাও।’ তারপর বলছে, ‘ক্ষম হে মম দীনতা, পাপীজন স্মরণ প্রভু।’ ‘ক্ষমিবে না আমার ক্ষমাহীনতা’—কী মারাত্মক কথা!
এইচএসসি দিলাম ১৯৮৪ সালে। এর পর ‘কণ্ঠশীলন’ নামে একটি আবৃত্তি সংগঠনে যোগ দিলাম। সেখানে কবিতার পাশাপাশি বিশ্ববীক্ষার সুযোগ হলো। রবীন্দ্রনাথের গানের পথে হাঁটার সুযোগ হলো একেবারে ভিন্ন একটি মাধ্যমে।
কণ্ঠশীলনে আবৃত্তি করতেন ফওজিয়া মান্নান। আমি তাঁকে মিলি আপা বলে ডাকি। মহড়া শেষ হলে আমরা কয়েকজন তাঁকে আর ছন্দা আপাকে তাঁদের বাড়ি পৌঁছে দিতাম। টিএসসি থেকে নীলক্ষেত হয়ে আজিমপুর কলোনিতে মিলি আপা, আর কবরস্থান ছাড়িয়ে নতুন পল্টনে ছন্দা আপাকে পৌঁছে দিতাম। ওয়াহিদুল হক সে সময় মিলি আপাদের বাড়িতে গিয়ে আটকে যেতেন। সেখানে ছিল ক্লাস নাইন পড়ুয়া তানিয়া মান্নান, মিলি আপার ছোট বোন। আমরাও কখনো কখনো বসতাম সে বাড়িতে। তানিয়া নিয়ে আসত হারমোনিয়াম। তারপর গাইত গান।
এখনো তানিয়ার রেওয়াজ করা কয়েকটি গান মনে আছে। রবীন্দ্রনাথের দিকে এগিয়ে আসার ক্ষেত্রে এ গানগুলো ছিল দিশারি। একটি গান হলো, ‘আকাশ আমায় ভরল আলোয়, আকাশ আমি ভরব গানে।’ গানটা শুনি আর ভাবি, এ কি অসাধারণ কথা! বিনে পয়সার বিনিময়! আকাশ মানে সূর্য, নিশ্চয়ই আলো দিচ্ছে পৃথিবীকে, আর তাতে পৃথিবী মানে পৃথিবীর মানুষের কত আনন্দ! সে গান দিয়ে সে পুরস্কারের মূল্য দিচ্ছে!
সে সময় আরও দুটো গানের সুধা এসে মিশে যায় মনে।
‘তোমার অসীমে প্রাণমন লয়ে যত দূরে আমি ধাই’
‘অল্প লইয়া থাকি তাই মোর যাহা যায়, তাহা যায়।’
গান দুটি শুনি সুবিনয় রায়ের ক্যাসেটে। রাশিয়ার দশ বছর কেটেছে এই দুই গানের ওমে। সে আরও পরের ব্যাপার।
এ ছাড়া আরও দুটি গান হলো, ‘জাগো পূরবাসী, ভগবৎ প্রেমপিয়াসি।’ অন্যটা ‘ধীরে ধীরে মোরে টেনে লহ তোমা পানে।’ পরের দুটি গান রবীন্দ্রসংগীত নয়, কিন্তু একই সঙ্গে গান তিনটি শুনতাম, এবং অবাক হয়ে খেয়াল করে দেখতাম, গান তিনটি আমাদের মুখস্থ হয়ে গেছে। আর এ সময় পেয়ে যাই এক অমোঘ বার্তা: রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে সৃষ্টিশীল সময় হলো ১৮৯১ থেকে ১৯০০ সাল। এ সময়টিতে তিনি কাটিয়েছেন পূর্ববঙ্গে!
‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে’
এক নতুন জগতের ঠিকানা লিখে দিল সে কালের পূর্ববঙ্গ। শাহজাদপুর, শিলাইদহ, আর পতিসর। বোটটা যেন আমি নিজের চোখে দেখি। ছিন্নপত্রগুলো ভেসে ওঠে চোখে। রবীন্দ্রনাথ নিজের চোখে মানুষ দেখছেন। তিনি সাধারণ মানুষের কাছে গিয়ে পৌঁছাচ্ছেন। এতকাল যে বদ্ধ জলাশয়ে ছিল বসবাস, সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এ যেন মহাসাগর!
গানের কথা বলছি। তাই আগে শোনা একটি গানকে এই সময়ের গায়ে লেপ্টে দিলাম:
‘আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তায় সকল খানে।’
‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে’ গানটির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে ওয়াহিদুল হক বলেন, ‘এ সময় বাউল সংগীতের সঙ্গে একাত্ম হচ্ছেন কবি। এই যে গানটা, সেটাও লেখা হয়েছে বাউল সুরে। একটা গান আছে, “হরিনাম দিয়ে জগৎ মাতালে, আমার একলা নিতাই!” সেই সুরেই তো গানটা!’
গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাব তারে’ গানটির সুরে হলো ‘আমার সোনার বাংলা’, এখন যা আমাদের জাতীয় সংগীত। এর পর থেকে নানাভাবেই তো রবীন্দ্রনাথ এসেছেন আমার কাছে। এসেছেন তাঁর প্রবন্ধের মাধ্যমে, কবিতায়। এসেছেন অন্যদের হাত ধরে। সে রকমই কিছু কথা শোনানো জরুরি।
বিচ্ছিন্ন কিছু কথা
আমার গালে একটা চটকানা দিলেন বিষ্ণু দে। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লিখলেন:
‘তুমি কি কেবল-ই স্মৃতি, শুধু এক উপলক্ষ, কবি?
হরেক উৎসবে হৈ হৈ
মঞ্চে মঞ্চে কেবল-ই কি ছবি?
তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ
আর বাইশে শ্রাবণ?’
তারপর বললেন—
‘তোমার আকাশ দাও, কবি, দাও
দীর্ঘ আশি বছরের
আমাদের ক্ষীয়মাণ মানসে ছড়াও
সূর্যোদয় সূর্যাস্তের আশি বছরের আলো,
বহুধা কীর্তিতে শত শিল্পকর্মে উন্মুক্ত উধাও
তোমার কীর্তিতে আর তোমাতে যা দিকে দিকে
একাগ্র মহৎ,
সে কঠিন ব্রতের গৌরবে,
আমাদের বিকারের গড্ডল ধুলার দিনগত অন্যায়ের কুৎসিতে
শুনি যেন সুন্দরের গান’
ওলোট পালট হয়ে গেল ভাবনার জগৎ। মেকি মনে হলো অনেক কিছুই। আসলেই কি উপলক্ষ তৈরি করে হইহই করলে রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া যায়? ওই জন্ম-মৃত্যুর দুটি দিন, আর নববর্ষে ‘এসো হে বৈশাখ’ গাইলেই কর্তব্য শেষ? তাঁর গান কবিতাটিতে এসে ‘এ পরবাসে রবে কে এ পরবাসে’ পঙ্ক্তিটিতে এসে থমকে দাঁড়াই। মালতী ঘোষালকে চিনি না। কিন্তু তিনি যেন এসে গানটি শুনিয়ে যান। সে কবিতায় দেবব্রত বিশ্বাসের উদাত্ত কণ্ঠের বর্ণনা শুনে ক্যাসেটে তাঁর গান শোনার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছিলাম!
‘ব্রাত্যজনের রুদ্ধ সংগীত’ বইটি পড়ে আহত হয়েছিলাম।
শামসুর রাহমান তাঁর ঋণী কবিতায় লেখেন ফাহমিদা খাতুনের রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে:
‘ফাহমিদা সুর ভাঁজে, এ-ও এক বৃষ্টি অপরূপ
অস্তিত্ব ডুবিয়ে নামে, গীতবিতানের কিছু নিভৃত নিশ্চুপ
পাতা ওড়ে অলৌকিক কলরবে, গাংচিলের মতো ওড়ে
ঘোরে সারা ঘরে
প্রাণের ঊর্মিল জল ছুঁয়ে যায় কত ছল ভরে।’
আরেকটা কথা বলি ফাহমিদা খাতুনকে নিয়ে। এটা অবশ্য গান। আমাদের গর্বের ইতিহাস। ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ গানটি নিয়েই কথা।
১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে পাকিস্তান টেলিভিশনে গান গাইছিলেন ফাহমিদা খাতুন। স্বাধিকার আন্দোলনের সেই তুঙ্গ মুহূর্তে টেলিভিশনের বাঙালি কর্মকর্তারা চাইছিলেন না টেলিভিশনে পাকিস্তানি পতাকা দেখিয়ে অধিবেশন শেষ করতে। তাই ফাহমিদা খাতুনকে নির্দেশ দেওয়া হলো গান গেয়ে মাঝ রাত পার করে দিতে। ফাহমিদা খাতুন গাইতে থাকলেন, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি, তুমি কী অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।’ এবং সত্যিই রাত ১২টা পেরিয়ে গেলে অধিবেশন শেষ হলো। ২৩ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান টেলিভিশনে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়নি।
তারাপদ রায় দুই বাংলার প্রতিষ্ঠিত কবি হলেও তাঁর জন্ম ও শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো কেটেছে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শহরে। তিনি ১৯৩৬ সালের ১৭ নভেম্বর টাঙ্গাইল শহরের পূর্ব আদালতপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন টাঙ্গাইল জজকোর্টের আইনজীবী।
২২ মিনিট আগেআধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব চিনুয়া আচেবের জন্ম ১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর নাইজেরিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল ওগিদিতে। তিনি ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকদের একজন। লেখাপড়া শেষে নাইজেরিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনে রেডিও প্রযোজক ও এক্সটারনাল ব্রডকাস্টিংয়ের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
১ দিন আগেবারী সিদ্দিকী সংগীতজীবনের প্রথম দিকে বংশীবাদক হিসেবে পরিচিত পেলেও পরবর্তী সময়ে তিনি একজন লোকসংগীতশিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
২ দিন আগেতিনি ছিলেন একজন আদর্শবান শিক্ষক—অজিতকুমার গুহর এটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়। নিজের জাগতিক উন্নতিকে কখনো বড় করে দেখেননি তিনি। শিক্ষার্থীদের আদর্শ জীবন উপহার দেওয়াই ছিল তাঁর ব্রত। তিনি সক্রিয় ছিলেন ঢাকার প্রগতিশীল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিসরেও। সুবক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতির কমতি ছিল না।
৫ দিন আগে