জাহীদ রেজা নূর
গতকাল অভয় দিয়ে বলেছিলেন, জন্মদিনের সকালে তাঁর বাড়িতে যাওয়া যাবে। দরজার বাইরে থেকে তাঁকে দেখে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো যাবে। তাতেই আমি অনেকক্ষণ উড়ছিলাম কল্পনার আকাশে।
আজ, ৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৮টার আগেই পৌঁছে গেলাম তাঁর বাড়িতে। আজ তাঁর ৯০তম জন্মদিন। ৮৯তম জন্মবার্ষিকী।
করোনা তার হাত প্রসারিত করছিল যখন, তখন থেকেই সন্জীদা খাতুনের বাড়িতে যাওয়া নিষেধ হয়ে গিয়েছিল সবার জন্য। সে সময় মাঝে মাঝেই তিনি ফোন করতেন আমাকে। ২০২০ সালে করোনার বিভীষিকার মধ্যে নববর্ষের অনুষ্ঠান কীভাবে করবেন, তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। এতগুলো মানুষকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর মত ছিল না। যখন কথাগুলো বলছিলেন আমাকে, বোঝা যাচ্ছিল, তিনি চাইছেন তাঁর এই ভাবনাকে যেন আমি সমর্থন করি। আমিও নির্দ্বিধায় বলেছি, যেভাবে রোগটা ছড়াচ্ছে তাতে এত দিন একসঙ্গে এত মানুষের রিহার্সাল করা ঠিক হবে না। সেবার রমনার বটমূলে অনুষ্ঠান হয়নি। ভার্চুয়ালি হয়েছিল।
তখন সারা বিশ্বেই কেমন সময় আমরা সবাই মিলে কাটিয়েছি, সেটা কাউকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে না। প্রত্যেকেই ভুক্তভোগী। কাউকে বলে দিতে হবে না, তখন থেকে একের পর এক মানুষ মুড়ি-মুড়কির মতো মারা যেতে থাকলেন। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, মৃত্যুতালিকায় যোগ হতে থাকলেন কাছের মানুষেরা। মনে হচ্ছিল, এভাবেই ভয়াল রোগটা তার থাবা বাড়িয়ে দিয়েছে সবাইকে গ্রাস করবে বলে। কেউ একজন মারা গেছেন, সে কথা জানাতে ফোন করেছি যাঁকে, তিনিও তার কিছুদিন পর এই একই অতিমারিতে ভুগে মারা গেছেন।
তখন মাঝে মাঝেই কথা বলতেন তিনি। এক একটা মৃত্যু তাঁকে বিমর্ষ করে দিচ্ছিল। সে বছর তাঁর যে দুটো বই বের হয়েছিল, সে দুটো আমাকে উপহার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাইরের মানুষের সামনে দরজা খোলা মানা। তাই ফোনে বলেছিলেন, ‘বাড়ির দারোয়ানের কাছে বই দেওয়া থাকবে, সেখান থেকে নিয়ে যাবি।’
আমি নিয়ে এসেছিলাম।
এরপর ২০২১ সালে একেবারে নিকটাত্মীয়দের হারাতে শুরু করলাম যখন, তখন থেকে আমার নিজেরও কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলতে ইচ্ছে হতো না। সন্জীদা খাতুনও আর খুব বেশি ফোন করতেন না। এ সময় তিনি জানতে পারলেন, তাঁর চোখে এই বয়সে আর অপারেশন করা সম্ভব নয়। অপারেশন করার পর যা যা মানতে হবে, শরীর তাতে সায় দেবে না। তাই পড়ার ক্ষেত্রে সংকট সৃষ্টি হলো। হাঁটতে সমস্যা হতে শুরু করল। প্রচণ্ডরকমভাবে জীবনের সঙ্গে মিশে থাকা মানুষটি নিজের ওপর বিরক্ত হলেন।
সেই মানুষটি আমাকে অনুমতি দিয়েছেন, তাঁর বাড়িতে গিয়ে একবার তাঁকে চোখে দেখা সম্ভব।
২.
সেই পরিচিত বাড়ি! যখন বলেছেন, তখনই এই বাড়িতে এসে হাজির হয়েছি। কখনো কখনো তাঁর কথা রেকর্ড করেছি মোবাইল ফোনে। জন্মদিনগুলোতে তিনি যদি কথা বলতে রাজি হতেন, তাহলে কী যে আনন্দে ভরে যেত মন! আমরা সতীর্থ অনেকেই একসঙ্গে গিয়ে হাজির হতাম তাঁর বাড়িতে। লুচি আর তরকারি ছাড়াও আরও অনেক খাবারে ভরা থাকত টেবিল। কারও ইচ্ছে হলে খেয়ে নিত। কেউ তাঁকে শোনাত গান, কেউ করত আবৃত্তি। এবার সে সুযোগ ছিল না।
আমি যখন পৌঁছলাম, তখন নিচ থেকে বোঝা যাচ্ছিল না, লিফটের সাতে আসলে কী হচ্ছে। বাড়ির দারোয়ানদের বললাম, ‘কেউ কি এসেছে?’
তাঁরা বললেন, ‘একজন ওপরে গেছেন।’
আমি আগের দিনের কথামতো ঠিক করে রেখেছি, দরজা খোলা হলে কেকটা বাড়ির ভেতর রেখে তাঁকে একবার দূর থেকে দেখে ফিরে আসব।
সেভাবেই দরজায় দোরঘণ্টি বাজালাম। দরজা খুলে গেল। দেখলাম, আপা বসে আছেন। সামনে বসে আছেন ওয়াদুদ ভাই।
আমি দরজায় দাঁড়িয়েই বললাম, ‘শুভ জন্মদিন। বহুদিন পর দেখা হলো আপনার সঙ্গে!’
কোমল স্বরে তিনি বললেন, ‘ভেতরে আয়।’
আগের দিন বলেছিলেন, করোনা ধীরে ধীরে কমে যাওয়ায় এখন আগের মতো সতর্কতা অবলম্বন করেন না।
ঘরে ঢুকেই বুঝলাম একটু বেশি সকালে চলে এসেছি। তিনি তখনো শাড়ি বদলে পরিপাটি হয়ে বসেননি।
চোখে চশমা নেই।
আমি আমার অধিকার খাটিয়ে বললাম, ‘চশমা কোথায়?’
দেখিয়ে দিলেন সামনেই রয়েছে চশমার বাক্সটা।
বললাম, ‘আপনাকে চশমা ছাড়া ভালো লাগে না।’
এবার চশমা দিলেন চোখে। বললেন, ‘কাল রুচিরা শাড়ি বের করে দিয়ে গেছে। এখনো পরতে পারিনি।’
‘ছায়ানটের কর্মীরা কখন আসবে?’
‘নটার পর। বোধ হয়, সাড়ে নটার দিকে। পার্থ এসে ঘরদোর সব ঠিকঠাক করে গেছে। সে সময় পার্থ আবার আসবে। লিসার নাকি খুব জরুরি কাজ আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ও সকালে সেখানে গেছে।’
৩.
ওয়াদুদ ভাইয়ের সঙ্গে সংগীত নিয়ে কিছু কথা বললেন তিনি। তার একটা হলো, স্বাভাবিকভাবে যারা গান শুরু করেছে, তাদের মধ্যে উচ্চাঙ্গসংগীতের জুজু ঢুকিয়ে না দেওয়াই ভালো। কিন্তু এখনকার শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সহজাত ভঙ্গির মধ্যে জোর করে উচ্চাঙ্গসংগীত ঢুকিয়ে দিতে চান বলে অনেক নতুন শিল্পীই গানের ওপর উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।
গান হতে হবে স্বতঃস্ফূর্ত।
কথার ফাঁকে ফাঁকে টেলিফোন আসতে থাকে। তিনি আজ সবগুলো ফোন ধরবেন। যাঁরা ফোন করছেন, তাঁরা গভীর ভালোবাসা থেকেই আজকের দিনটিতে তাঁকে স্মরণ করছেন। তিনি সবার সঙ্গেই একটু একটু করে কথা বলছেন।
গতকাল বলেছিলেন, পড়তে অসুবিধা হয়, হাঁটতে অসুবিধা হয়। আজ দেখলাম, কে ফোন করছে সেটাও টেলিফোনের দিকে তাকিয়ে পড়ে ফেলতে পারছেন। বললেন, বেশিক্ষণ কোনো দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। ছোট মেয়ে রুচিরা একটা জিনিস কিনে দিয়েছেন, যা দিয়ে দেখলে অক্ষরগুলো বড় দেখা যায়। আশাপূর্ণা দেবীর ‘৫০টি গল্প’ নামে একটি বই মাঝে মাঝে পড়ছেন এখন। গল্পগুলোর কোনো কোনোটি ভালো হলেও কোনো কোনোটি ভালো লাগেনি তাঁর, সে কথাও বললেন।
৪.
এ সময় একেবারেই যুক্তিহীনভাবে আমি তাঁকে বললাম, ‘একটা গান করেন।’
চোখেমুখে রাগ ফুটিয়ে তুলে বললেন, ‘না।’
বললাম, ‘আমার জন্য দুটো লাইন গান। ভালো লাগবে।’
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। গান করবেন কি করবেন না, সেটা বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু যখন গানের কয়েকটি লাইন তুলে আনলেন কণ্ঠে, তখন বুঝলাম, এদিনের সঙ্গে যায়, এমন একটি গানই খুঁজছিলেন এই মৌনতার সময়।
গাইলেন:
‘কী গাব আমি, কী শোনাব আজি আনন্দধামে’।
৫.
তাঁর দুটো ফোনে একের পর এক শুভেচ্ছাবার্তা আসতে শুরু করল।
এর মধ্যে কানাডা থেকে ফোন করলেন পার্থ সারথি শিকদার। মস্কোতে পার্থদার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। চিঠি চালাচালি হতো। এরপর ফোন করলেন মাছওয়ালা। বাড়ির কাজের সহযোগী মেয়েটা কড়া ভাষায় জানাল, এখন মাছ কেনার দরকার নেই।
মাছওয়ালা লোভ দেখাচ্ছিল বড় মাছের। কিন্তু এর আগে সম্ভবত মাছ বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো অসততা করায় সে কথা মনে করিয়ে দিলেন তিনি। একটু পরে মনে হলো মনটা নরম হয়েছে, বাড়ির সহযোগীকে বললেন, ‘গুলশা মাছ দিতে চাইছে, নেব?’
ওয়াদুদ ভাইয়ের আনা ফুল গোছাতে গোছাতে এবার সেই রাগত মেয়েটাও নরম সুরে বলল, ‘দিতে বলেন।’
একটু পরেই ছায়ানটের কর্মীরা আসবে। তাই আমি বললাম, ‘আজ আসি!’
তারপর বললাম, ‘আপনি তো জানেন আমি প্রণাম, সালাম কিছুই করি না। কিন্তু মন থেকে যাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা এমনিতেই আসে, তাঁদের পা ছুঁই!’
‘না না’ করলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, ‘আমার হাতটা ধর তাহলে!’
তাঁর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ গালের সঙ্গে ধরে রাখলাম। তারপর বললাম, ‘কাল টেলিফোনে যা যা বললেন, তা আমার ভালো লাগেনি। আপনাকে বাঁচতে হবে। অনেক দিন বাঁচতে হবে। মৃত্যুর কথা বলা চলবে না।’
হেসে বললেন, ‘আবার আসিস!’
গতকাল অভয় দিয়ে বলেছিলেন, জন্মদিনের সকালে তাঁর বাড়িতে যাওয়া যাবে। দরজার বাইরে থেকে তাঁকে দেখে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো যাবে। তাতেই আমি অনেকক্ষণ উড়ছিলাম কল্পনার আকাশে।
আজ, ৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৮টার আগেই পৌঁছে গেলাম তাঁর বাড়িতে। আজ তাঁর ৯০তম জন্মদিন। ৮৯তম জন্মবার্ষিকী।
করোনা তার হাত প্রসারিত করছিল যখন, তখন থেকেই সন্জীদা খাতুনের বাড়িতে যাওয়া নিষেধ হয়ে গিয়েছিল সবার জন্য। সে সময় মাঝে মাঝেই তিনি ফোন করতেন আমাকে। ২০২০ সালে করোনার বিভীষিকার মধ্যে নববর্ষের অনুষ্ঠান কীভাবে করবেন, তা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন। এতগুলো মানুষকে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর মত ছিল না। যখন কথাগুলো বলছিলেন আমাকে, বোঝা যাচ্ছিল, তিনি চাইছেন তাঁর এই ভাবনাকে যেন আমি সমর্থন করি। আমিও নির্দ্বিধায় বলেছি, যেভাবে রোগটা ছড়াচ্ছে তাতে এত দিন একসঙ্গে এত মানুষের রিহার্সাল করা ঠিক হবে না। সেবার রমনার বটমূলে অনুষ্ঠান হয়নি। ভার্চুয়ালি হয়েছিল।
তখন সারা বিশ্বেই কেমন সময় আমরা সবাই মিলে কাটিয়েছি, সেটা কাউকে ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে না। প্রত্যেকেই ভুক্তভোগী। কাউকে বলে দিতে হবে না, তখন থেকে একের পর এক মানুষ মুড়ি-মুড়কির মতো মারা যেতে থাকলেন। ভয়ংকর ব্যাপার হলো, মৃত্যুতালিকায় যোগ হতে থাকলেন কাছের মানুষেরা। মনে হচ্ছিল, এভাবেই ভয়াল রোগটা তার থাবা বাড়িয়ে দিয়েছে সবাইকে গ্রাস করবে বলে। কেউ একজন মারা গেছেন, সে কথা জানাতে ফোন করেছি যাঁকে, তিনিও তার কিছুদিন পর এই একই অতিমারিতে ভুগে মারা গেছেন।
তখন মাঝে মাঝেই কথা বলতেন তিনি। এক একটা মৃত্যু তাঁকে বিমর্ষ করে দিচ্ছিল। সে বছর তাঁর যে দুটো বই বের হয়েছিল, সে দুটো আমাকে উপহার দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাইরের মানুষের সামনে দরজা খোলা মানা। তাই ফোনে বলেছিলেন, ‘বাড়ির দারোয়ানের কাছে বই দেওয়া থাকবে, সেখান থেকে নিয়ে যাবি।’
আমি নিয়ে এসেছিলাম।
এরপর ২০২১ সালে একেবারে নিকটাত্মীয়দের হারাতে শুরু করলাম যখন, তখন থেকে আমার নিজেরও কারও সঙ্গে ফোনে কথা বলতে ইচ্ছে হতো না। সন্জীদা খাতুনও আর খুব বেশি ফোন করতেন না। এ সময় তিনি জানতে পারলেন, তাঁর চোখে এই বয়সে আর অপারেশন করা সম্ভব নয়। অপারেশন করার পর যা যা মানতে হবে, শরীর তাতে সায় দেবে না। তাই পড়ার ক্ষেত্রে সংকট সৃষ্টি হলো। হাঁটতে সমস্যা হতে শুরু করল। প্রচণ্ডরকমভাবে জীবনের সঙ্গে মিশে থাকা মানুষটি নিজের ওপর বিরক্ত হলেন।
সেই মানুষটি আমাকে অনুমতি দিয়েছেন, তাঁর বাড়িতে গিয়ে একবার তাঁকে চোখে দেখা সম্ভব।
২.
সেই পরিচিত বাড়ি! যখন বলেছেন, তখনই এই বাড়িতে এসে হাজির হয়েছি। কখনো কখনো তাঁর কথা রেকর্ড করেছি মোবাইল ফোনে। জন্মদিনগুলোতে তিনি যদি কথা বলতে রাজি হতেন, তাহলে কী যে আনন্দে ভরে যেত মন! আমরা সতীর্থ অনেকেই একসঙ্গে গিয়ে হাজির হতাম তাঁর বাড়িতে। লুচি আর তরকারি ছাড়াও আরও অনেক খাবারে ভরা থাকত টেবিল। কারও ইচ্ছে হলে খেয়ে নিত। কেউ তাঁকে শোনাত গান, কেউ করত আবৃত্তি। এবার সে সুযোগ ছিল না।
আমি যখন পৌঁছলাম, তখন নিচ থেকে বোঝা যাচ্ছিল না, লিফটের সাতে আসলে কী হচ্ছে। বাড়ির দারোয়ানদের বললাম, ‘কেউ কি এসেছে?’
তাঁরা বললেন, ‘একজন ওপরে গেছেন।’
আমি আগের দিনের কথামতো ঠিক করে রেখেছি, দরজা খোলা হলে কেকটা বাড়ির ভেতর রেখে তাঁকে একবার দূর থেকে দেখে ফিরে আসব।
সেভাবেই দরজায় দোরঘণ্টি বাজালাম। দরজা খুলে গেল। দেখলাম, আপা বসে আছেন। সামনে বসে আছেন ওয়াদুদ ভাই।
আমি দরজায় দাঁড়িয়েই বললাম, ‘শুভ জন্মদিন। বহুদিন পর দেখা হলো আপনার সঙ্গে!’
কোমল স্বরে তিনি বললেন, ‘ভেতরে আয়।’
আগের দিন বলেছিলেন, করোনা ধীরে ধীরে কমে যাওয়ায় এখন আগের মতো সতর্কতা অবলম্বন করেন না।
ঘরে ঢুকেই বুঝলাম একটু বেশি সকালে চলে এসেছি। তিনি তখনো শাড়ি বদলে পরিপাটি হয়ে বসেননি।
চোখে চশমা নেই।
আমি আমার অধিকার খাটিয়ে বললাম, ‘চশমা কোথায়?’
দেখিয়ে দিলেন সামনেই রয়েছে চশমার বাক্সটা।
বললাম, ‘আপনাকে চশমা ছাড়া ভালো লাগে না।’
এবার চশমা দিলেন চোখে। বললেন, ‘কাল রুচিরা শাড়ি বের করে দিয়ে গেছে। এখনো পরতে পারিনি।’
‘ছায়ানটের কর্মীরা কখন আসবে?’
‘নটার পর। বোধ হয়, সাড়ে নটার দিকে। পার্থ এসে ঘরদোর সব ঠিকঠাক করে গেছে। সে সময় পার্থ আবার আসবে। লিসার নাকি খুব জরুরি কাজ আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। ও সকালে সেখানে গেছে।’
৩.
ওয়াদুদ ভাইয়ের সঙ্গে সংগীত নিয়ে কিছু কথা বললেন তিনি। তার একটা হলো, স্বাভাবিকভাবে যারা গান শুরু করেছে, তাদের মধ্যে উচ্চাঙ্গসংগীতের জুজু ঢুকিয়ে না দেওয়াই ভালো। কিন্তু এখনকার শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সহজাত ভঙ্গির মধ্যে জোর করে উচ্চাঙ্গসংগীত ঢুকিয়ে দিতে চান বলে অনেক নতুন শিল্পীই গানের ওপর উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।
গান হতে হবে স্বতঃস্ফূর্ত।
কথার ফাঁকে ফাঁকে টেলিফোন আসতে থাকে। তিনি আজ সবগুলো ফোন ধরবেন। যাঁরা ফোন করছেন, তাঁরা গভীর ভালোবাসা থেকেই আজকের দিনটিতে তাঁকে স্মরণ করছেন। তিনি সবার সঙ্গেই একটু একটু করে কথা বলছেন।
গতকাল বলেছিলেন, পড়তে অসুবিধা হয়, হাঁটতে অসুবিধা হয়। আজ দেখলাম, কে ফোন করছে সেটাও টেলিফোনের দিকে তাকিয়ে পড়ে ফেলতে পারছেন। বললেন, বেশিক্ষণ কোনো দিকে তাকিয়ে থাকা যায় না। ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। ছোট মেয়ে রুচিরা একটা জিনিস কিনে দিয়েছেন, যা দিয়ে দেখলে অক্ষরগুলো বড় দেখা যায়। আশাপূর্ণা দেবীর ‘৫০টি গল্প’ নামে একটি বই মাঝে মাঝে পড়ছেন এখন। গল্পগুলোর কোনো কোনোটি ভালো হলেও কোনো কোনোটি ভালো লাগেনি তাঁর, সে কথাও বললেন।
৪.
এ সময় একেবারেই যুক্তিহীনভাবে আমি তাঁকে বললাম, ‘একটা গান করেন।’
চোখেমুখে রাগ ফুটিয়ে তুলে বললেন, ‘না।’
বললাম, ‘আমার জন্য দুটো লাইন গান। ভালো লাগবে।’
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। গান করবেন কি করবেন না, সেটা বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু যখন গানের কয়েকটি লাইন তুলে আনলেন কণ্ঠে, তখন বুঝলাম, এদিনের সঙ্গে যায়, এমন একটি গানই খুঁজছিলেন এই মৌনতার সময়।
গাইলেন:
‘কী গাব আমি, কী শোনাব আজি আনন্দধামে’।
৫.
তাঁর দুটো ফোনে একের পর এক শুভেচ্ছাবার্তা আসতে শুরু করল।
এর মধ্যে কানাডা থেকে ফোন করলেন পার্থ সারথি শিকদার। মস্কোতে পার্থদার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। চিঠি চালাচালি হতো। এরপর ফোন করলেন মাছওয়ালা। বাড়ির কাজের সহযোগী মেয়েটা কড়া ভাষায় জানাল, এখন মাছ কেনার দরকার নেই।
মাছওয়ালা লোভ দেখাচ্ছিল বড় মাছের। কিন্তু এর আগে সম্ভবত মাছ বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো অসততা করায় সে কথা মনে করিয়ে দিলেন তিনি। একটু পরে মনে হলো মনটা নরম হয়েছে, বাড়ির সহযোগীকে বললেন, ‘গুলশা মাছ দিতে চাইছে, নেব?’
ওয়াদুদ ভাইয়ের আনা ফুল গোছাতে গোছাতে এবার সেই রাগত মেয়েটাও নরম সুরে বলল, ‘দিতে বলেন।’
একটু পরেই ছায়ানটের কর্মীরা আসবে। তাই আমি বললাম, ‘আজ আসি!’
তারপর বললাম, ‘আপনি তো জানেন আমি প্রণাম, সালাম কিছুই করি না। কিন্তু মন থেকে যাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা এমনিতেই আসে, তাঁদের পা ছুঁই!’
‘না না’ করলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, ‘আমার হাতটা ধর তাহলে!’
তাঁর হাতটা নিজের হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ গালের সঙ্গে ধরে রাখলাম। তারপর বললাম, ‘কাল টেলিফোনে যা যা বললেন, তা আমার ভালো লাগেনি। আপনাকে বাঁচতে হবে। অনেক দিন বাঁচতে হবে। মৃত্যুর কথা বলা চলবে না।’
হেসে বললেন, ‘আবার আসিস!’
তারাপদ রায় দুই বাংলার প্রতিষ্ঠিত কবি হলেও তাঁর জন্ম ও শৈশব-কৈশোরের দিনগুলো কেটেছে বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শহরে। তিনি ১৯৩৬ সালের ১৭ নভেম্বর টাঙ্গাইল শহরের পূর্ব আদালতপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন টাঙ্গাইল জজকোর্টের আইনজীবী।
৫ ঘণ্টা আগেআধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব চিনুয়া আচেবের জন্ম ১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর নাইজেরিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল ওগিদিতে। তিনি ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকদের একজন। লেখাপড়া শেষে নাইজেরিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনে রেডিও প্রযোজক ও এক্সটারনাল ব্রডকাস্টিংয়ের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
১ দিন আগেবারী সিদ্দিকী সংগীতজীবনের প্রথম দিকে বংশীবাদক হিসেবে পরিচিত পেলেও পরবর্তী সময়ে তিনি একজন লোকসংগীতশিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
২ দিন আগেতিনি ছিলেন একজন আদর্শবান শিক্ষক—অজিতকুমার গুহর এটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়। নিজের জাগতিক উন্নতিকে কখনো বড় করে দেখেননি তিনি। শিক্ষার্থীদের আদর্শ জীবন উপহার দেওয়াই ছিল তাঁর ব্রত। তিনি সক্রিয় ছিলেন ঢাকার প্রগতিশীল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিসরেও। সুবক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতির কমতি ছিল না।
৫ দিন আগে