ইজাজুল হক
‘নার হেয়ুতুন কাজালভানাস’ (কাজালভানাসে আগুন) ফারুক নাজকির সেরা কীর্তি। কাশ্মীরী ভাষার এই কাব্যগ্রন্থ তাঁকে ১৯৯৫ সালে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার ‘সাহিত্য অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড’ এনে দেয়। কাশ্মীরি সাহিত্যে মৌলিক কবিতা রচনার পাশাপাশি উর্দু-হিন্দি সাহিত্যের বেশ কিছু ধ্রুপদি কবিতার অনুবাদও তিনি করেছেন, যেখানে তিনি নিজস্বতা ধরে রাখার প্রয়াস চালান। কাশ্মীরি সাহিত্যে ইতিবাচকতা, আধুনিকতা ও রোমান্টিকতার নতুন মাইলফলক হয়ে থাকবে নাজকির এসব কবিতা।
‘নার হেয়ুতুন কাজালভানাস’ নামটি চয়ন করেন বিখ্যাত কাশ্মীরি সাহিত্যিক মাস্টার জিন্দা কৌলের ‘নার হা!’ (সাবধান! আগুন!) কবিতা থেকে। বইয়ের সূচনাপাতায় মাস্টারজির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতাও নিবেদন করেন। এই কাব্য দশকের পর দশক জ্বলতে থাকা নাজকির জন্মভূমি কাশ্মীরের দুঃখ, বেদনা, অস্থিরতা, ভয়, ক্ষোভ, অসহিষ্ণুতা, আশা ও হতাশার কথা বলে। বইয়ের নাম থেকে সেই তীব্র আগুনের আঁচ আমরা অনুভব করতে পারি। নাজকি লিখছেন—
‘কাজালভানাস জ্বলছে!
এবং এখানে রয়েছে বসন্তের আগমনী হাহাকারও।
জ্বলছে আগুন এ হৃদয়েও—
‘আগুন’-এর সঙ্গে; কান্না সর্বাঙ্গে।’
কাশ্মীরে বিরাজমান এই আগুন-আগুন খেলার সামনে নিদারুণ অসহায় নাজকি। দরজার ফাঁক গলে বাতাসের ডানায় ভর করে বসতঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ছে সংঘাত-অস্থিরতা। ইট দিয়ে সেই দরজা এঁটে দিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং অনেক মানুষের মতো কবি নাজকিও দরজা-বাতাসের ইঁদুর-বিড়াল খেলার এই উপদ্রব থেকে বাঁচতে ভিন্ন পথে ঘরে প্রবেশ করছেন। মানুষজন আজকাল জানালা দিয়ে চলাচল শুরু করেছে। এমন অভিনব উপমায় কবি সময়ের সংকটকে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে তোলেন। পড়ুন—
‘আবার বাতাস আসে, দরজা ঠেলে করে আধখোলা
ওঠো, রেখে এসো দরজার পেছনে ইটটি আরেকবার
আজকাল জানালা দিয়েই ঢুকে পড়ছে লোকজন
দরজাগুলো এক সময় কত শ্রদ্ধাই না ভোগ করত।’
১৯৯০ সাল থেকে চলে আসা কাশ্মীরের ত্রাসের জগৎকে খুল্লম খোলা বয়ান করেন নাজকি। এ ক্ষেত্রে কোনো রাখঢাক করার প্রয়োজন মনে করেন না। আতঙ্কের মুহূর্ত বয়ানে কবি অত্যন্ত স্পষ্টবাদী, দ্ব্যর্থহীন। তবে কবির সব দুঃখের আশ্রয় কাশ্মীরের প্রকৃতি, ফুল ও তুষার এবং অরণ্য। পড়ুন—
‘দরজা-জানালায় ঝুলে থাকে আতঙ্ক
উঠোনে অপেক্ষা করে মুখোশপরা শয়তান
চিনার গাছের খোঁড়ল থেকে মিউমিউ ডাকে বিড়াল
শব্দের জন্য তোতলাই আমরা—কী করে কাঁদব
যৌবনোচ্ছল আইরিশ লুটিয়ে পড়ে ধুলোয়,
মাটির তৈরি ছাদে বন্য হয়ে ওঠে টিউলিপেরা
এবং মারমুখী বাতাস ওড়ে—যেভাবে ক্ষুধার্ত সিংহ
মধ্য জানুয়ারিতে নেমে আসে লোকালয়ে
অরণ্য ছেড়ে, শীতের তুষারপাতের পর
এবং হিংস্র হয়ে ওঠে আরও, প্রতিটি শিকারের পর।’
দুই.
সাধারণ মানুষের জীবনে অকথ্য ভোগান্তি নিয়ে আসা ধ্বংসের নতুন আড়তদারদের অপকর্ম অত্যন্ত নির্মোহ ভঙ্গিতে তুলে আনেন। বিদ্রূপ, কটাক্ষ কিংবা শ্লেষ মেশাতেও যেন কবির আত্মমর্যাদায় লাগে। কতটা নির্লজ্জ হলে খুনের পর খুন করেও ঘাতকেরা নিজেদের কাশ্মীরি পরিচয় দিতে পারে—নাজকি অবাক হন। তিনি লিখেন—
‘এখানে, নদীতীরে
(সদ্যবিবাহিত) ছেলেদের রক্তমাখা কাপড় ধুতে আসেন মায়েরা
আগুনে ভস্ম হয় নববধুদের দামি পোশাকও
এবং দেখো—স্তন্যদায়ী মায়েরা মরছে অনাহারে
অথচ ঝিলম বয়ে চলে আপন মনে
সরাইখানায় তালা লাগিয়ে দেয় তারা
নজরদারির আওতায় আনে মাজার ও সৌন্দর্য
গুন্ডারা তছনছ করে পুরো শহর
ঝকঝকে দিন বাঁক নেয় বিমর্ষ সন্ধ্যায়
জাফরানের খেতে
লজ্জা দিতে খুনিরা রাখে ফুল—হিমলের দেহের মতো
এবং দেখো—কী করে ঘাতকেরা উচ্চস্বরে গাইছে লালভাখ
এবং আবৃত্তি করছে রেশিনামা থেকেও…।’
সশস্ত্র তৎপরতার মাতাল হাওয়া কাশ্মীরে হিংসা-অসহিষ্ণুতার উন্মত্ত ঢেউ তোলে। একজন খাঁটি কাশ্মীরি হিসেবে কবির আত্মা বেদনায় পুড়ে ছারখার হয়; ভেঙে খানখান হয় নির্মল কাচের হৃদয়। উপত্যকা থেকে হিন্দু অভিজাত শ্রেণির পণ্ডিতদের নির্বাসন, খুন ও তাদের ওপর চলা ধ্বংসযজ্ঞ তাঁকে অত্যন্ত ব্যথিত করে। তিনি উপলব্ধি করেন, হিংসার বিষাক্ত বায়ু কাশ্মীরের বহুদিনের পুরোনো বহুরৈখিক সাংস্কৃতিক চাদরকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল কাশ্মীরিকেই এই মাতাল হাওয়া বিভাজন, দুঃখ ও হতাশার রাজ্যে হারিয়ে দিচ্ছে। কাশ্মীরের মানুষের শরণার্থীশিবিরে দেখার দুঃখ ভুলতে পারেন না তিনি। তিনি লিখেন—
‘চোখের আড়ালে স্বপ্ন লুকিয়ে
তাঁবুর ছায়ায় দিন কাটায় তারা
দিনের সূর্যে দেহ মুড়িয়ে এবং
রাতের বালিশে গোলাপ রেখে
আশা করেছিল এক সাধারণ ঘুমের।
অথচ সাপগুলো ক্রমেই তাঁবুর কাছে আসে
পৃথিবী পরিণত হয় জ্বলন্ত হাপরে
আকাশ থেকে ঝরে পড়ে আগুনের গোলা
আমরা কোনো গান শুনি না—
নাম ধরে কেউই ডাকে না তাদের
ফুলের পাপড়ি হাতে দেবী পুজো করে না কেউ
অংশ নেয় না কেউ চারার-ই-শরিফের ওরসে
আমাকে রুখো না—
অনুভূতিগুলো ঢেলে দিতে হবে আমার।’
সংঘাত-সহিংসতায় ধীরে-ধীরে ম্লান হতে থাকে কাশ্মীরের ধর্মপ্রাণ মানুষের আরাধনার স্বর্গীয় সুর। রক্তের নেশায় মাতাল ঘাতকেরা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাপক বাধাগ্রস্ত করে। ঘর থেকে বেরোনোর জো নেই মানুষের। উপত্যকা যেন অমাবস্যার রাতের সুনসান ভুতুড়ে কবরস্থান! নাজকির ভাষায়—
‘ছাদের ওপর জ্বলজ্বল করছে টকটকে লাল পপি
তবে আফসোস! বাতাসে বলছে ভীতিকর তরঙ্গ
শীতের রাতে, ক্ষুধায় মাতাল এক সিংহ
শিকারের খোঁজে হামলে পড়ে লোকালয়ে
ভারী করে তোলে নিশ্বাস অসুস্থ আকাঙ্ক্ষারা
এবং ধেয়ে আসে দরজা-জানালা অভিমুখে
সেঁটে রাখা মেহেদির কৌটাটি খেয়াল করে না কেউ
জিন-তাড়ানো ভেষজের ধোঁয়াও কেউ শুঁকে না
রক্ত ও কাদা মিলেমিশে একাকার ভেজা পিণ্ডে…
শুকনো নদী বানের অপেক্ষায়, শিরায় ফুটছে কালো রক্ত
এবং সিঁদুর মাখা সাদা পাথর…
শহরের উপকণ্ঠে ওঠে দূষিত বর্জ্য
এবং বাতাসেরা হাহাকার করে সুনসান কবরস্থানে।’
তিন.
১৯৯০-২০০০ সময়ের অশান্তিঘেরা কালো দশকে, যখন কাশ্মীর মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়, তখনো নাজকি শান্তির আশায় বুক বাঁধেন। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রচনা করতে থাকেন কবিতা। দুঃখ, হতাশার নর্দমা মাড়িয়ে কবি উঠে আসেন গভীর নীল ও নির্মল আকাশে। সেখান থেকে প্রভাতের নতুন আলো, হলুদ পাতাঝরা বসন্ত এবং মানবকল্যাণের গান গেয়ে যান। তিনি মনে করেন, এসব দাঙ্গা, হাঙ্গামা, খুনোখুনির রাজনীতি কাশ্মীরের ঐতিহ্য নয়। বরং রক্তের এই জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে ভেসে গেছে এই স্বর্গীয় উপত্যকার ৫ হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহিষ্ণু ঐতিহ্যের সৌধ। নাজকি বলেন—
‘আমাকে রুখো না—হৃদয়টা বের করে আনতে হবে আমার
এই বিজন মরুর বুকে ফুটবে গোলাপ
কাল ফুল ফুটবে এ পরিত্যক্ত বাগানেও
সেই ফুলের সঙ্গে আমাকে কথা বলতে হবে নির্জনে
চোখজোড়া আমার উলার হ্রদের পানির মতো উতলা
তাদের জানাতে হবে আমাদের সরল আর্তনাদ
জানাতে হবে—বসন্তের বুলবুলি গাইছে এখনো সুরেলা গান
নৌকাকে নিরাপদ কূলে নিয়ে যাবে এই মাতাল ঝড়
তাদের জানাতে হবে
এই দেহের গভীরে
স্ফুরণ ঘটতে চলেছে একটি আগ্নেয়গিরির
আমাকে রুখো না—
ভেতরের সবকিছু আমাকে ঢেলে দিতে হবে।’
নাজকি বুঝতে পারেন না, কেন হলুদ পাতাঝরা বসন্ত তাঁর পণ্ডিত বন্ধুদের উপত্যকায় ফিরিয়ে আনতে পারে না। কাশ্মীরের মানুষ কেন এই স্বর্গ ছেড়ে সমতলের অসমতল জীবনযাপন করবে? তাদের অনুপস্থিতি কবিকে পোড়ায়। কাশ্মীরের তুষারাবৃত শীত কিংবা সোনালি পাতামোড়ানো বসন্তও কবির এই দুঃখ ভোলাতে পারে না। তাঁর ভাষায়—
‘আবার আমাদের ফিরে তাকাতে হবে দূর অতীতে?
বসন্ত আমাদের আসবে আগের মতো
আগের মতোই উল্লাস করবে ফুরফুরে হাওয়া
ফুলের প্রস্ফুটিত কলি বুকে নিয়ে
এবং শরৎ আস্থার বসন্তকে বিদ্রূপ করে বলবে—
‘পৃথিবী পোশাক পরে না—তুলো উৎপাদন করে কী হবে!’
ঘ্রাণ-সৌরভে অবগাহন করে
আবারও এই পথে আসবে বসন্ত
কয়েকটি সুখবর নিয়ে
আহা! ঘর থেকে বেরোনো মানুষগুলো
আর কখনো ফিরে আসেনি
অথবা এই বসন্ত পায়নি তাদের কোনো খোঁজ।’
চার.
ভূস্বর্গ কাশ্মীরকে এই দুর্দশা থেকে মুক্ত করার জন্য এক মহামানবের পথ চেয়ে দিন গোনেন নাজকি। কাশ্মীরের আকাশ, মেঘ, পাহাড় ও প্রকৃতির মাঝে তাঁকে খুঁজে ফেরেন। রাতের ঘুমোনোর সময় খোলা রাখেন দরজা-জানালা—পাছে তিনি এসে পড়েন! কবিতার ভাষায় পড়ুন—
‘খুঁজে ফিরি তাঁকে প্রখর সূর্যের নিচে
তুষারবাহী বাতাসে; তাঁকে খুঁজতে ছুঁই আকাশ
খোলা রাখি ঘরের দরজা-জানালা
আমাকে বলো—কখন তিনি এসেছিলেন এবং কোন গন্তব্যে করেছেন যাত্রা।’
কিন্তু মহামানব আসে না; শেষ হয় না অপেক্ষার প্রহর। অসহায় নাজকি আপসের পথে হাঁটেন। অসহায়-নিঃস্ব কাশ্মীরি মানুষের মুখ নাজকি ক্ষমতার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হতে চান না। ক্ষমতা ক্ষমতাবানদের হাতেই থাকুক—তবে আমাদের, সাধারণ কাশ্মীরিদের শান্তিতে থাকে দাও। তিনি লেখেন—
‘তোমার সঙ্গে কী করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি—সেই যোগ্যতা কি আমার আছে?
ঘোড়ার পিঠে তুমিই নাহয় চড়ো
আমাকে তোমার ওড়ানো ধুলো মেখেই সুখী থাকতে দাও।’
কবি দুই পক্ষকে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করেন। অতীতের দুঃখ ভুলে সবার সঙ্গে মিলেমিশে সুখে দিন কাটাতে চান। উদার বক্ষ খুলে ঘোষণা দেন ক্ষমার। তিনি বলেন—
‘চলো ফের নতুন করে দিল খুলে হাসার ওয়াদা করি
তোমরাও মনে রাখবে না বিভীষিকার দিনগুলো
আমিও গোপন জখম বলে বেড়াব না যুগ-যুগান্তরে।’
তবে কে শোনে কার কথা! নাজকি রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং হতাশার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যান। অসহিষ্ণুতার আড়তদারদের গলা ফাটিয়ে বলেন—
‘আমাকে শূলে চড়াও
ভস্ম করো আমাকে
উদীয়মান সূর্যের পুজো আমি করেছি
ছিটকে পড়া থেকে উদ্ধার করেছি অস্তগামী চাঁদকেও।’
আরও পড়ুন:
‘নার হেয়ুতুন কাজালভানাস’ (কাজালভানাসে আগুন) ফারুক নাজকির সেরা কীর্তি। কাশ্মীরী ভাষার এই কাব্যগ্রন্থ তাঁকে ১৯৯৫ সালে ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার ‘সাহিত্য অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড’ এনে দেয়। কাশ্মীরি সাহিত্যে মৌলিক কবিতা রচনার পাশাপাশি উর্দু-হিন্দি সাহিত্যের বেশ কিছু ধ্রুপদি কবিতার অনুবাদও তিনি করেছেন, যেখানে তিনি নিজস্বতা ধরে রাখার প্রয়াস চালান। কাশ্মীরি সাহিত্যে ইতিবাচকতা, আধুনিকতা ও রোমান্টিকতার নতুন মাইলফলক হয়ে থাকবে নাজকির এসব কবিতা।
‘নার হেয়ুতুন কাজালভানাস’ নামটি চয়ন করেন বিখ্যাত কাশ্মীরি সাহিত্যিক মাস্টার জিন্দা কৌলের ‘নার হা!’ (সাবধান! আগুন!) কবিতা থেকে। বইয়ের সূচনাপাতায় মাস্টারজির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতাও নিবেদন করেন। এই কাব্য দশকের পর দশক জ্বলতে থাকা নাজকির জন্মভূমি কাশ্মীরের দুঃখ, বেদনা, অস্থিরতা, ভয়, ক্ষোভ, অসহিষ্ণুতা, আশা ও হতাশার কথা বলে। বইয়ের নাম থেকে সেই তীব্র আগুনের আঁচ আমরা অনুভব করতে পারি। নাজকি লিখছেন—
‘কাজালভানাস জ্বলছে!
এবং এখানে রয়েছে বসন্তের আগমনী হাহাকারও।
জ্বলছে আগুন এ হৃদয়েও—
‘আগুন’-এর সঙ্গে; কান্না সর্বাঙ্গে।’
কাশ্মীরে বিরাজমান এই আগুন-আগুন খেলার সামনে নিদারুণ অসহায় নাজকি। দরজার ফাঁক গলে বাতাসের ডানায় ভর করে বসতঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ছে সংঘাত-অস্থিরতা। ইট দিয়ে সেই দরজা এঁটে দিয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং অনেক মানুষের মতো কবি নাজকিও দরজা-বাতাসের ইঁদুর-বিড়াল খেলার এই উপদ্রব থেকে বাঁচতে ভিন্ন পথে ঘরে প্রবেশ করছেন। মানুষজন আজকাল জানালা দিয়ে চলাচল শুরু করেছে। এমন অভিনব উপমায় কবি সময়ের সংকটকে আমাদের সামনে স্পষ্ট করে তোলেন। পড়ুন—
‘আবার বাতাস আসে, দরজা ঠেলে করে আধখোলা
ওঠো, রেখে এসো দরজার পেছনে ইটটি আরেকবার
আজকাল জানালা দিয়েই ঢুকে পড়ছে লোকজন
দরজাগুলো এক সময় কত শ্রদ্ধাই না ভোগ করত।’
১৯৯০ সাল থেকে চলে আসা কাশ্মীরের ত্রাসের জগৎকে খুল্লম খোলা বয়ান করেন নাজকি। এ ক্ষেত্রে কোনো রাখঢাক করার প্রয়োজন মনে করেন না। আতঙ্কের মুহূর্ত বয়ানে কবি অত্যন্ত স্পষ্টবাদী, দ্ব্যর্থহীন। তবে কবির সব দুঃখের আশ্রয় কাশ্মীরের প্রকৃতি, ফুল ও তুষার এবং অরণ্য। পড়ুন—
‘দরজা-জানালায় ঝুলে থাকে আতঙ্ক
উঠোনে অপেক্ষা করে মুখোশপরা শয়তান
চিনার গাছের খোঁড়ল থেকে মিউমিউ ডাকে বিড়াল
শব্দের জন্য তোতলাই আমরা—কী করে কাঁদব
যৌবনোচ্ছল আইরিশ লুটিয়ে পড়ে ধুলোয়,
মাটির তৈরি ছাদে বন্য হয়ে ওঠে টিউলিপেরা
এবং মারমুখী বাতাস ওড়ে—যেভাবে ক্ষুধার্ত সিংহ
মধ্য জানুয়ারিতে নেমে আসে লোকালয়ে
অরণ্য ছেড়ে, শীতের তুষারপাতের পর
এবং হিংস্র হয়ে ওঠে আরও, প্রতিটি শিকারের পর।’
দুই.
সাধারণ মানুষের জীবনে অকথ্য ভোগান্তি নিয়ে আসা ধ্বংসের নতুন আড়তদারদের অপকর্ম অত্যন্ত নির্মোহ ভঙ্গিতে তুলে আনেন। বিদ্রূপ, কটাক্ষ কিংবা শ্লেষ মেশাতেও যেন কবির আত্মমর্যাদায় লাগে। কতটা নির্লজ্জ হলে খুনের পর খুন করেও ঘাতকেরা নিজেদের কাশ্মীরি পরিচয় দিতে পারে—নাজকি অবাক হন। তিনি লিখেন—
‘এখানে, নদীতীরে
(সদ্যবিবাহিত) ছেলেদের রক্তমাখা কাপড় ধুতে আসেন মায়েরা
আগুনে ভস্ম হয় নববধুদের দামি পোশাকও
এবং দেখো—স্তন্যদায়ী মায়েরা মরছে অনাহারে
অথচ ঝিলম বয়ে চলে আপন মনে
সরাইখানায় তালা লাগিয়ে দেয় তারা
নজরদারির আওতায় আনে মাজার ও সৌন্দর্য
গুন্ডারা তছনছ করে পুরো শহর
ঝকঝকে দিন বাঁক নেয় বিমর্ষ সন্ধ্যায়
জাফরানের খেতে
লজ্জা দিতে খুনিরা রাখে ফুল—হিমলের দেহের মতো
এবং দেখো—কী করে ঘাতকেরা উচ্চস্বরে গাইছে লালভাখ
এবং আবৃত্তি করছে রেশিনামা থেকেও…।’
সশস্ত্র তৎপরতার মাতাল হাওয়া কাশ্মীরে হিংসা-অসহিষ্ণুতার উন্মত্ত ঢেউ তোলে। একজন খাঁটি কাশ্মীরি হিসেবে কবির আত্মা বেদনায় পুড়ে ছারখার হয়; ভেঙে খানখান হয় নির্মল কাচের হৃদয়। উপত্যকা থেকে হিন্দু অভিজাত শ্রেণির পণ্ডিতদের নির্বাসন, খুন ও তাদের ওপর চলা ধ্বংসযজ্ঞ তাঁকে অত্যন্ত ব্যথিত করে। তিনি উপলব্ধি করেন, হিংসার বিষাক্ত বায়ু কাশ্মীরের বহুদিনের পুরোনো বহুরৈখিক সাংস্কৃতিক চাদরকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল কাশ্মীরিকেই এই মাতাল হাওয়া বিভাজন, দুঃখ ও হতাশার রাজ্যে হারিয়ে দিচ্ছে। কাশ্মীরের মানুষের শরণার্থীশিবিরে দেখার দুঃখ ভুলতে পারেন না তিনি। তিনি লিখেন—
‘চোখের আড়ালে স্বপ্ন লুকিয়ে
তাঁবুর ছায়ায় দিন কাটায় তারা
দিনের সূর্যে দেহ মুড়িয়ে এবং
রাতের বালিশে গোলাপ রেখে
আশা করেছিল এক সাধারণ ঘুমের।
অথচ সাপগুলো ক্রমেই তাঁবুর কাছে আসে
পৃথিবী পরিণত হয় জ্বলন্ত হাপরে
আকাশ থেকে ঝরে পড়ে আগুনের গোলা
আমরা কোনো গান শুনি না—
নাম ধরে কেউই ডাকে না তাদের
ফুলের পাপড়ি হাতে দেবী পুজো করে না কেউ
অংশ নেয় না কেউ চারার-ই-শরিফের ওরসে
আমাকে রুখো না—
অনুভূতিগুলো ঢেলে দিতে হবে আমার।’
সংঘাত-সহিংসতায় ধীরে-ধীরে ম্লান হতে থাকে কাশ্মীরের ধর্মপ্রাণ মানুষের আরাধনার স্বর্গীয় সুর। রক্তের নেশায় মাতাল ঘাতকেরা মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন ব্যাপক বাধাগ্রস্ত করে। ঘর থেকে বেরোনোর জো নেই মানুষের। উপত্যকা যেন অমাবস্যার রাতের সুনসান ভুতুড়ে কবরস্থান! নাজকির ভাষায়—
‘ছাদের ওপর জ্বলজ্বল করছে টকটকে লাল পপি
তবে আফসোস! বাতাসে বলছে ভীতিকর তরঙ্গ
শীতের রাতে, ক্ষুধায় মাতাল এক সিংহ
শিকারের খোঁজে হামলে পড়ে লোকালয়ে
ভারী করে তোলে নিশ্বাস অসুস্থ আকাঙ্ক্ষারা
এবং ধেয়ে আসে দরজা-জানালা অভিমুখে
সেঁটে রাখা মেহেদির কৌটাটি খেয়াল করে না কেউ
জিন-তাড়ানো ভেষজের ধোঁয়াও কেউ শুঁকে না
রক্ত ও কাদা মিলেমিশে একাকার ভেজা পিণ্ডে…
শুকনো নদী বানের অপেক্ষায়, শিরায় ফুটছে কালো রক্ত
এবং সিঁদুর মাখা সাদা পাথর…
শহরের উপকণ্ঠে ওঠে দূষিত বর্জ্য
এবং বাতাসেরা হাহাকার করে সুনসান কবরস্থানে।’
তিন.
১৯৯০-২০০০ সময়ের অশান্তিঘেরা কালো দশকে, যখন কাশ্মীর মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত হয়, তখনো নাজকি শান্তির আশায় বুক বাঁধেন। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে রচনা করতে থাকেন কবিতা। দুঃখ, হতাশার নর্দমা মাড়িয়ে কবি উঠে আসেন গভীর নীল ও নির্মল আকাশে। সেখান থেকে প্রভাতের নতুন আলো, হলুদ পাতাঝরা বসন্ত এবং মানবকল্যাণের গান গেয়ে যান। তিনি মনে করেন, এসব দাঙ্গা, হাঙ্গামা, খুনোখুনির রাজনীতি কাশ্মীরের ঐতিহ্য নয়। বরং রক্তের এই জলোচ্ছ্বাসের তোড়ে ভেসে গেছে এই স্বর্গীয় উপত্যকার ৫ হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহিষ্ণু ঐতিহ্যের সৌধ। নাজকি বলেন—
‘আমাকে রুখো না—হৃদয়টা বের করে আনতে হবে আমার
এই বিজন মরুর বুকে ফুটবে গোলাপ
কাল ফুল ফুটবে এ পরিত্যক্ত বাগানেও
সেই ফুলের সঙ্গে আমাকে কথা বলতে হবে নির্জনে
চোখজোড়া আমার উলার হ্রদের পানির মতো উতলা
তাদের জানাতে হবে আমাদের সরল আর্তনাদ
জানাতে হবে—বসন্তের বুলবুলি গাইছে এখনো সুরেলা গান
নৌকাকে নিরাপদ কূলে নিয়ে যাবে এই মাতাল ঝড়
তাদের জানাতে হবে
এই দেহের গভীরে
স্ফুরণ ঘটতে চলেছে একটি আগ্নেয়গিরির
আমাকে রুখো না—
ভেতরের সবকিছু আমাকে ঢেলে দিতে হবে।’
নাজকি বুঝতে পারেন না, কেন হলুদ পাতাঝরা বসন্ত তাঁর পণ্ডিত বন্ধুদের উপত্যকায় ফিরিয়ে আনতে পারে না। কাশ্মীরের মানুষ কেন এই স্বর্গ ছেড়ে সমতলের অসমতল জীবনযাপন করবে? তাদের অনুপস্থিতি কবিকে পোড়ায়। কাশ্মীরের তুষারাবৃত শীত কিংবা সোনালি পাতামোড়ানো বসন্তও কবির এই দুঃখ ভোলাতে পারে না। তাঁর ভাষায়—
‘আবার আমাদের ফিরে তাকাতে হবে দূর অতীতে?
বসন্ত আমাদের আসবে আগের মতো
আগের মতোই উল্লাস করবে ফুরফুরে হাওয়া
ফুলের প্রস্ফুটিত কলি বুকে নিয়ে
এবং শরৎ আস্থার বসন্তকে বিদ্রূপ করে বলবে—
‘পৃথিবী পোশাক পরে না—তুলো উৎপাদন করে কী হবে!’
ঘ্রাণ-সৌরভে অবগাহন করে
আবারও এই পথে আসবে বসন্ত
কয়েকটি সুখবর নিয়ে
আহা! ঘর থেকে বেরোনো মানুষগুলো
আর কখনো ফিরে আসেনি
অথবা এই বসন্ত পায়নি তাদের কোনো খোঁজ।’
চার.
ভূস্বর্গ কাশ্মীরকে এই দুর্দশা থেকে মুক্ত করার জন্য এক মহামানবের পথ চেয়ে দিন গোনেন নাজকি। কাশ্মীরের আকাশ, মেঘ, পাহাড় ও প্রকৃতির মাঝে তাঁকে খুঁজে ফেরেন। রাতের ঘুমোনোর সময় খোলা রাখেন দরজা-জানালা—পাছে তিনি এসে পড়েন! কবিতার ভাষায় পড়ুন—
‘খুঁজে ফিরি তাঁকে প্রখর সূর্যের নিচে
তুষারবাহী বাতাসে; তাঁকে খুঁজতে ছুঁই আকাশ
খোলা রাখি ঘরের দরজা-জানালা
আমাকে বলো—কখন তিনি এসেছিলেন এবং কোন গন্তব্যে করেছেন যাত্রা।’
কিন্তু মহামানব আসে না; শেষ হয় না অপেক্ষার প্রহর। অসহায় নাজকি আপসের পথে হাঁটেন। অসহায়-নিঃস্ব কাশ্মীরি মানুষের মুখ নাজকি ক্ষমতার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হতে চান না। ক্ষমতা ক্ষমতাবানদের হাতেই থাকুক—তবে আমাদের, সাধারণ কাশ্মীরিদের শান্তিতে থাকে দাও। তিনি লেখেন—
‘তোমার সঙ্গে কী করে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি—সেই যোগ্যতা কি আমার আছে?
ঘোড়ার পিঠে তুমিই নাহয় চড়ো
আমাকে তোমার ওড়ানো ধুলো মেখেই সুখী থাকতে দাও।’
কবি দুই পক্ষকে মিলিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করেন। অতীতের দুঃখ ভুলে সবার সঙ্গে মিলেমিশে সুখে দিন কাটাতে চান। উদার বক্ষ খুলে ঘোষণা দেন ক্ষমার। তিনি বলেন—
‘চলো ফের নতুন করে দিল খুলে হাসার ওয়াদা করি
তোমরাও মনে রাখবে না বিভীষিকার দিনগুলো
আমিও গোপন জখম বলে বেড়াব না যুগ-যুগান্তরে।’
তবে কে শোনে কার কথা! নাজকি রাগে-ক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং হতাশার চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যান। অসহিষ্ণুতার আড়তদারদের গলা ফাটিয়ে বলেন—
‘আমাকে শূলে চড়াও
ভস্ম করো আমাকে
উদীয়মান সূর্যের পুজো আমি করেছি
ছিটকে পড়া থেকে উদ্ধার করেছি অস্তগামী চাঁদকেও।’
আরও পড়ুন:
আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব চিনুয়া আচেবের জন্ম ১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর নাইজেরিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল ওগিদিতে। তিনি ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকদের একজন। লেখাপড়া শেষে নাইজেরিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনে রেডিও প্রযোজক ও এক্সটারনাল ব্রডকাস্টিংয়ের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
২০ ঘণ্টা আগেবারী সিদ্দিকী সংগীতজীবনের প্রথম দিকে বংশীবাদক হিসেবে পরিচিত পেলেও পরবর্তী সময়ে তিনি একজন লোকসংগীতশিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
২ দিন আগেতিনি ছিলেন একজন আদর্শবান শিক্ষক—অজিতকুমার গুহর এটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়। নিজের জাগতিক উন্নতিকে কখনো বড় করে দেখেননি তিনি। শিক্ষার্থীদের আদর্শ জীবন উপহার দেওয়াই ছিল তাঁর ব্রত। তিনি সক্রিয় ছিলেন ঢাকার প্রগতিশীল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিসরেও। সুবক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতির কমতি ছিল না।
৫ দিন আগেআব্দুল করিম খাঁ ছিলেন হিন্দুস্তানি ধ্রুপদি সংগীতের অন্যতম কিংবদন্তি। কিরানা ঘরানারও তিনি কিংবদন্তি ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত—তিনি গান গাওয়ার সময় এমনভাবে ধ্যানমগ্ন হয়ে যেতেন যে, শ্রোতারাও সেই সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন।
৬ দিন আগে