ইজাজুল হক
আগের পর্বেই বলা হয়েছে, গাসসান সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ফিলিস্তিনি-জর্ডানি কবি মুহাম্মাদ আজ-জাহিরের (১৯৫২-২০২০) সঙ্গে যৌথকাব্য রচনার মাধ্যমে তাঁর কবিতাজীবন শুরু করেন। ‘দেশের হালচাল’ নামের কাব্যগ্রন্থটি ১৯৭৭ সালে ‘জর্ডানিয়ান রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন’ প্রকাশ করে। সেই সংকলনে আমরা তাঁদের যৌথ কর্মপ্রয়াস, কাছাকাছি সুর-ছন্দ, একই ধরনের কাব্যছাপ এবং ফিলিস্তিনি সাহিত্যের থিমের সঙ্গে পরিচিত হই—যেমনটি আধুনিক ফিলিস্তিনি কবিতার উৎকর্ষের সময়টিতে বিপুলসংখ্যক কবিদের দেখতে পাই।
এসব থিম, ছন্দ, ছাপ ও কবিতার শরীর নির্মাণের পদ্ধতি ভালোভাবেই উপস্থিত রয়েছে তাঁর পরবর্তী কাব্য সংকলন ‘প্রত্যুষ’-এ। বইটি সত্তরের দশকের শেষদিকে জর্ডান থেকে প্রকাশিত হয়। ফলে এটিও একই সময়ের একই চিত্র ফুটিয়ে তোলে। শরণার্থীশিবির, পরদেশি জীবন, দেশান্তর, মৃত্যু, গেরিলা যুদ্ধ ও প্রতিরোধ, যা ১৯৬৭ সালের পরাজয়ের পর প্রায় দুই দশক ধরে চলা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যুদ্ধের তীব্রতার সময় ফিলিস্তিনি সাহিত্যের মূল প্রতিপাদ্য ছিল। গাসসান সে কথাই বলেছেন এভাবে—
‘গেরিলারা আমাকে ক্যাম্পের চায়ের গল্প বলে
এবং স্বপ্ন বিস্ফোরণের...
আমি নিজেকে আবিষ্কার করিনি
ক্যাম্পই আমাকে কবি বানিয়ে ছাড়ে...
ফিলিস্তিনিদের পরিচয়-তিলক তো এই ক্যাম্পই
কত কিছু ঘটে চলে, তাই আমি শুরু করি।’
গাসসানের কবিতায় মাহমুদ দারবিশের ভাষাশৈলীর স্পষ্ট ছাপ আমরা দেখতে পাই। কবিতার ভিত, বাক্যশৈলী, ছন্দ ও অলংকার—সব দিক থেকেই। ফিলিস্তিনি মানসের উর্বরতা, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, আত্মোৎসর্গের প্রেরণা এবং বীরত্বের সংজ্ঞায় টইটম্বুর সেই পদ্যগুলো। দারবিশের মতো গীত-নাটকীয়তার সঙ্গে দুঃখগাথার অপূর্ব মিথস্ক্রিয়ায় নির্মিত হতে থাকে গাসসানের কবিতার ভুবন। গাসসান বলেন—
‘এবং সে সাগরে আসে—আরিহায় কলা চাষ করবে বলে
এ মাটি তো ফলায় কেবল
কবিতা ও রক্তের ফসল
এ মাটি প্রত্যুষে জন্ম দেয় ফুটফুটে এক বাচ্চা
এবং সন্ধ্যায় সে ঘরে ফেরে শহীদ হয়ে।’
এ কবিতা দারবিশের দুই কাব্যগ্রন্থ ‘ভালোবাসি তোমাকে অথবা ভালোবাসি না’ এবং ‘প্রয়াস নম্বর ৭ ’-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। নির্দিষ্ট করে বললে ‘ক্যাফেটেরিয়ায় কফি খায় সিরহান’ কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়, যা দারবিশের কবিতা এবং গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের ফিলিস্তিনি কবিতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট ছিল। গাসসানের ‘পুরোনো কারণ’ কাব্যেও এই ছাপ অনেকটা পাওয়া যায়। এই পর্যায়ে এসে তিনি দারবিশের বাক্যেরই প্রতিধ্বনি করেন—
‘মা গো
শহরগুলো আমাকে তাড়াতে পারেনি
বরং আমি আমার শিরায়-শিরায় শহরগুলোকে ছড়িয়ে দিই।’
চির নির্বাসিত ফিলিস্তিনিদের ভবঘুরে জীবনের কাতর অভিব্যক্তি প্রকাশ করেই গাসসান এ কথা বলেন।
দুই.
দারবিশের প্রভাব এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সাহিত্যের স্পষ্ট ছাপ থাকা সত্ত্বেও গাসসানের কবিতায় আমরা ‘পুরোনো কারণ’ কাব্য থেকে শুরু করে পরবর্তী কবিতাগুলোতে আরবি ও বিশ্বসাহিত্যের নানা স্বাদের কবিতাশৈলীর নতুন ছাপ প্রত্যক্ষ করি। গদ্য কবিতার প্রভাব, এর ভাষাকাঠামো, আকস্মিক সূচনা, বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব, সাধারণ চালচিত্র, বর্ণনামূলক উপস্থাপনা, দৈনন্দিন জীবনের হালচাল, অন্তরঙ্গতা, ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, অদ্ভুত ও আনকোরা বিষয়ের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার যে প্রবণতা আধুনিক কবিতায় দেখা যায়, তা গাসসানের কবিতায়ও অবাধে প্রবেশ করে। গাসসানের কবিতার রং যেভাবেই বদলাক না কেন, কিংবা গদ্যের কথাই বলুন, তিনি এ ধাঁচের গভীরে ঢুকে পড়েন। তিনি বলেন—
‘এটি গির্জার ঘণ্টা নয় যে বাজবে...
এটি সেই তামা
পুরুষের শিরা থেকে বেরিয়ে
যা মিলিত হয়
খনিজ পদার্থদের মিছিলে।’
অথবা বলেন—
‘আমাদের নিগ্রো প্রতিবেশী টাঙিয়েছে
ভারী পর্দা
ফলে আমরা আর দেখতে পাই না
কাপড়ের থান থেকে
কীভাবে বেরোয় আবলুস কাঠ।’
এসব প্রভাব গাসসান জাকতানের কবিতাকে আরও পরিণত-মার্জিত করে তোলে; কবিতার বিষয়বস্তুকে করে আরও সুনির্দিষ্ট-মূর্ত এবং অনুভবের কাছাকাছি।
তিন.
এখান থেকেই, ‘বস্তুর বীরত্বগাথা’ কাব্যের মাধ্যমে গাসসানের স্পষ্ট বাঁক প্রতিভাত হয়। ১৯৮২ সালে পিএলওর বৈরুত ছেড়ে যাওয়ার পর, কবি নিজের ও ফিলিস্তিনিদের ক্ষতি ও বিপর্যয় বিষয়ে কবিতা রচনায় আরও পরিপক্ব হয়ে ওঠেন। ‘বস্তুর বীরত্বগাথা’ কাব্যের যে শিরোনাম কবি দিয়েছেন, তা হয়তো তাঁর পাঠকের সেই কবিতাশৈলীতে প্রবেশের একটি প্রান্ত, যা প্রকৃতির উপাদান, যুদ্ধের স্মৃতি, রণাঙ্গনের বীরপুরুষ, পরাজয় ও ক্ষতির জন্য বিলাপ করে। কবি বলেন—
‘আঙুল তুলে দেখায় সে আমাদের…
এই যে, এখান থেকে…
পরক্ষণেই সে বাড়ি ও বিস্ফোরণের ধ্বংসস্তূপে অদৃশ্য হয়
আঙুল রাখে দেয়ালের শূন্যে
আমাদের দেখায়
এই যে, এখান থেকে
এখান থেকে।’
অন্য স্থানে গাসসান বলেন—
‘সবকিছু আগের মতোই আছে
যখন থেকে আমরা যুদ্ধে গিয়েছি
সেই শৈশব থেকে…
সবকিছু আগের মতোই আছে
পাল্টায়নি মোটেও,
শুধু আমরাই
আমরাই ঝাঁপিয়ে পড়েছি যুদ্ধে
ইশকুলের ঘণ্টাধ্বনি শুনে...
এর পর কোনো দিন ফিরে আসিনি…’
এটি তাঁর কবিতাকে প্রকৃতির উপাদান ও বিশ্ববাস্তবতার সঙ্গে দৃঢ়ভাবে যুক্ত করে একটি দৃঢ়, স্বচ্ছ ও গভীর কাব্যিক রূপ দেয়।
চার.
গাসসানের পরবর্তী কাব্যগ্রন্থের বিষয়বস্তুতে প্রথম পর্যায়ের থেকে কিছুটা বিষণ্নতা দেখা যায়। আগে তিনি অন্যদের জীবন ও অভিজ্ঞতার ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন, ব্যক্তির বীরত্বগাথা চিত্রিত করেছিলেন এবং ব্যক্তিজীবনের বাইরের বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে এসে কবি নিজের অভিজ্ঞতার উৎকর্ষ সাধনে সচেষ্ট হন। নিজের গভীরে ডুব দিয়ে আত্মানুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন। একান্ত ব্যক্তিগত অতীতে ফিরতে চেয়েছেন। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সেসব স্মৃতিকে পাঠকের সামনে পরিবেশন করেছেন। এই পর্যায় থেকে জাকতানের কাব্যিক অভিযাত্রা ব্যক্তিগত স্মৃতিকে ঘিরে নতুন মাত্রা পায়। জন্ম, শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলোর কথা তিনি স্মরণ করেছেন।
জন্মের পর থেকে যেসব স্থানে পাড়ি দিয়েছেন এবং যেসব স্থান থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, তাঁর সেই জন্মস্থান—বেইত জালা, ১৯৪৮ সালে নাকাবার (ইহুদিদের দ্বারা বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে সেই সময় থেকে ফিলিস্তিনিরা নাকাবা দিবস পালন করে) পর তাঁর পরিবার যেখানে আশ্রয় নিয়েছিল—প্রথমে ফিলিস্তিনের জেরিকো শহরের পাশের শরণার্থীশিবির, এর পর জর্ডানের আল-কারামাহ শরণার্থীশিবির, এর পর দামেস্ক, বৈরুত ও তিউনিসিয়ার দিনগুলোর কথা বিশেষভাবে স্মরণ করেছেন কবিতায়। প্রথম নাকাবার পর থেকে, লাগাতার ছুটে চলা একজন ফিলিস্তিনি মুসাফিরের সংগ্রামের বিভিন্ন দিক ফুটে ওঠে তাঁর কবিতায়। একসময় তা আজকের ধূসর অজানার পথে অবিরাম ছুটতে থাকা বর্তমানের বিন্দুও স্পর্শ করে নেয়। তিনি বলেন—
‘যেন আমিই এটি প্রস্তুত করেছি
এবং আগেও, কোনো এক সময় এই স্থান আমি স্পর্শ করেছি
এবং স্পর্শ করেছি এই প্রতিধ্বনি
যেন সতত দেখছি আমি, ফেলে আসা দিনগুলো…’
এভাবেই কবি ‘আমার কারণে নয়’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় ফেলে আসা অতীতের স্মৃতিচারণ করেছেন। এই বিলাপধ্বনিতে পরিবর্তন আসে ‘ভাইদের ডাকে পথচারীরা’ কাব্যগ্রন্থে, যা ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর শোনা সেই প্রতিধ্বনি বাঁক নেয় মৃত্যু উপত্যকা ভ্রমণে, মৃতদেহগুলোর আর্তনাদ পুনরুদ্ধার করতে।
‘ভাইদের ডাকে পথচারীরা’ কাব্যে মৃতদের মধ্যস্থতায় স্মৃতির জগতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন গাসসান। তিনি লিখেছেন—
‘নরোম খেজুরের শরীর থেকে
বীজ বের করার মতো করে
তারা হৃদয়ের ভাঁজ খুলে
স্মৃতি বের করে।’
…
আঁধারের চাদরে ঢাকা কোনা থেকে
ময়লা সরাতে তারা শুরু করে স্মৃতিযাপন…।’
গাসসান এখানে ক্লান্ত হন। নিঃশেষ হয়ে আসা স্বপ্ন ও ইচ্ছেগুলো আঁকতে শুরু করেন এবার। মৃতদের স্থান-কালকে চিত্রিত করেন। স্মৃতির বিবর্ণ জগৎকে স্মরণ করেন। শুরুর সঙ্গে শেষকে মিলিয়ে নেন। এখানে নির্বাসন ও দেশান্তরের প্রতিধ্বনি শোনা যায় অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীনভাবে। এ কাব্যগ্রন্থের ‘কল্পনার বিবর্তন’ কিংবা ‘ঈষৎ পরিবর্তন’-এর মতো কবিতাগুলো সাধারণভাবে মৃতদের অতীত জীবনের স্মৃতিচারণ জাতীয় কবিতার অন্তর্ভুক্ত। আমরা কবির সঙ্গেই আছি—এমন আবহ এনে তিনি প্রাত্যহিক জীবনের কোলাহলে ডুব দিয়ে এবং মৌলিক ও সর্বজনীন সমস্যাগুলোর পেছনে সময় কাটিয়ে, অতীতের অবহেলা ও বৈষম্যগুলো জানতে পথে পথে ঘোরেন। অতীতের ধূসর স্মৃতি এবং অস্পষ্ট ঘটনায় ফিরে যান তিনি। সেসবকে সাগরসেঁচা মুক্তোর মতো করে তুলে আনেন, এবং ইচ্ছেমতো সাজান কবিতার পরতে পরতে। তাতে তাঁর কবিতার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য প্রতিভাত হয়; প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যপ্রতিভার হাড়-মাংস।
পাঁচ.
২০১৯ সালে প্রকাশিত গাসসানের কবিতার বই ‘কথা বলো হে পথিক কথা বলো’-তেও তিনি অতীতের স্মৃতিযাপন অব্যাহত রাখেন। ব্যক্তিগত জীবন, ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর হালচাল এবং আরবদের উত্থান-পতনের আলাপ করেছেন অত্যন্ত নির্মোহভাবে। এ কাব্যগ্রন্থে যে পথিককে সম্বোধন করেছেন তিনি, তা গাসসানের ভিন্ন একটি রূপ। সেই পথিক নিজের পরিচয় হারিয়ে ভবঘুরের মতো ঘুরতে থাকে মরুর বালুকাবেলায়। কবি নিজেকে কাছে ডাকেন এবং জেগে ওঠার আহ্বান জানান। তিনি বলেন—
‘এখানে একটু থামো
হে পথিক
মোটেও জানতে চাইব না কী নাম তোমার
কিংবা কোথায় তোমার গন্তব্য।
শুধু একবার এ মোমের আলোয় বসো
তোমার জন্যই জ্বালিয়েছি তা
তোমার হারানো অতীত স্মরণ করিয়ে দিতে।
কথা বলো, কথা বলো
কথা বলো হে পথিক, কথা বলো
ফিরে পেতে চাই আমি
ধুলোওড়া মরুঝড়ে ছিনতাই হওয়া
আমার দরাজ কণ্ঠস্বর।’
এ গ্রন্থে জেগে ওঠার প্রেরণার পাশাপাশি তাঁর কণ্ঠে হতাশার ছাপও আমরা দেখতে পাই। শেষে এসে পথিক তথা নিজেকে গাসসান এমন এক প্রশ্ন করে বসেন, যার উত্তর সম্ভবত এই পৃথিবীর কারও জানা নেই; কিংবা সবার জানা। তিনি বলেন—
‘কীভাবে তোমাকে পথ দেখাব, হে পথিক?
তোমার গন্তব্য যে অনেক দূরে
এবং তোমার পথ বেশ বন্ধুর!’
আগের পর্বেই বলা হয়েছে, গাসসান সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে ফিলিস্তিনি-জর্ডানি কবি মুহাম্মাদ আজ-জাহিরের (১৯৫২-২০২০) সঙ্গে যৌথকাব্য রচনার মাধ্যমে তাঁর কবিতাজীবন শুরু করেন। ‘দেশের হালচাল’ নামের কাব্যগ্রন্থটি ১৯৭৭ সালে ‘জর্ডানিয়ান রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন’ প্রকাশ করে। সেই সংকলনে আমরা তাঁদের যৌথ কর্মপ্রয়াস, কাছাকাছি সুর-ছন্দ, একই ধরনের কাব্যছাপ এবং ফিলিস্তিনি সাহিত্যের থিমের সঙ্গে পরিচিত হই—যেমনটি আধুনিক ফিলিস্তিনি কবিতার উৎকর্ষের সময়টিতে বিপুলসংখ্যক কবিদের দেখতে পাই।
এসব থিম, ছন্দ, ছাপ ও কবিতার শরীর নির্মাণের পদ্ধতি ভালোভাবেই উপস্থিত রয়েছে তাঁর পরবর্তী কাব্য সংকলন ‘প্রত্যুষ’-এ। বইটি সত্তরের দশকের শেষদিকে জর্ডান থেকে প্রকাশিত হয়। ফলে এটিও একই সময়ের একই চিত্র ফুটিয়ে তোলে। শরণার্থীশিবির, পরদেশি জীবন, দেশান্তর, মৃত্যু, গেরিলা যুদ্ধ ও প্রতিরোধ, যা ১৯৬৭ সালের পরাজয়ের পর প্রায় দুই দশক ধরে চলা ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যুদ্ধের তীব্রতার সময় ফিলিস্তিনি সাহিত্যের মূল প্রতিপাদ্য ছিল। গাসসান সে কথাই বলেছেন এভাবে—
‘গেরিলারা আমাকে ক্যাম্পের চায়ের গল্প বলে
এবং স্বপ্ন বিস্ফোরণের...
আমি নিজেকে আবিষ্কার করিনি
ক্যাম্পই আমাকে কবি বানিয়ে ছাড়ে...
ফিলিস্তিনিদের পরিচয়-তিলক তো এই ক্যাম্পই
কত কিছু ঘটে চলে, তাই আমি শুরু করি।’
গাসসানের কবিতায় মাহমুদ দারবিশের ভাষাশৈলীর স্পষ্ট ছাপ আমরা দেখতে পাই। কবিতার ভিত, বাক্যশৈলী, ছন্দ ও অলংকার—সব দিক থেকেই। ফিলিস্তিনি মানসের উর্বরতা, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, আত্মোৎসর্গের প্রেরণা এবং বীরত্বের সংজ্ঞায় টইটম্বুর সেই পদ্যগুলো। দারবিশের মতো গীত-নাটকীয়তার সঙ্গে দুঃখগাথার অপূর্ব মিথস্ক্রিয়ায় নির্মিত হতে থাকে গাসসানের কবিতার ভুবন। গাসসান বলেন—
‘এবং সে সাগরে আসে—আরিহায় কলা চাষ করবে বলে
এ মাটি তো ফলায় কেবল
কবিতা ও রক্তের ফসল
এ মাটি প্রত্যুষে জন্ম দেয় ফুটফুটে এক বাচ্চা
এবং সন্ধ্যায় সে ঘরে ফেরে শহীদ হয়ে।’
এ কবিতা দারবিশের দুই কাব্যগ্রন্থ ‘ভালোবাসি তোমাকে অথবা ভালোবাসি না’ এবং ‘প্রয়াস নম্বর ৭ ’-এর কথা মনে করিয়ে দেয়। নির্দিষ্ট করে বললে ‘ক্যাফেটেরিয়ায় কফি খায় সিরহান’ কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়, যা দারবিশের কবিতা এবং গত শতাব্দীর সত্তরের দশকের ফিলিস্তিনি কবিতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট ছিল। গাসসানের ‘পুরোনো কারণ’ কাব্যেও এই ছাপ অনেকটা পাওয়া যায়। এই পর্যায়ে এসে তিনি দারবিশের বাক্যেরই প্রতিধ্বনি করেন—
‘মা গো
শহরগুলো আমাকে তাড়াতে পারেনি
বরং আমি আমার শিরায়-শিরায় শহরগুলোকে ছড়িয়ে দিই।’
চির নির্বাসিত ফিলিস্তিনিদের ভবঘুরে জীবনের কাতর অভিব্যক্তি প্রকাশ করেই গাসসান এ কথা বলেন।
দুই.
দারবিশের প্রভাব এবং ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সাহিত্যের স্পষ্ট ছাপ থাকা সত্ত্বেও গাসসানের কবিতায় আমরা ‘পুরোনো কারণ’ কাব্য থেকে শুরু করে পরবর্তী কবিতাগুলোতে আরবি ও বিশ্বসাহিত্যের নানা স্বাদের কবিতাশৈলীর নতুন ছাপ প্রত্যক্ষ করি। গদ্য কবিতার প্রভাব, এর ভাষাকাঠামো, আকস্মিক সূচনা, বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব, সাধারণ চালচিত্র, বর্ণনামূলক উপস্থাপনা, দৈনন্দিন জীবনের হালচাল, অন্তরঙ্গতা, ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ, অদ্ভুত ও আনকোরা বিষয়ের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার যে প্রবণতা আধুনিক কবিতায় দেখা যায়, তা গাসসানের কবিতায়ও অবাধে প্রবেশ করে। গাসসানের কবিতার রং যেভাবেই বদলাক না কেন, কিংবা গদ্যের কথাই বলুন, তিনি এ ধাঁচের গভীরে ঢুকে পড়েন। তিনি বলেন—
‘এটি গির্জার ঘণ্টা নয় যে বাজবে...
এটি সেই তামা
পুরুষের শিরা থেকে বেরিয়ে
যা মিলিত হয়
খনিজ পদার্থদের মিছিলে।’
অথবা বলেন—
‘আমাদের নিগ্রো প্রতিবেশী টাঙিয়েছে
ভারী পর্দা
ফলে আমরা আর দেখতে পাই না
কাপড়ের থান থেকে
কীভাবে বেরোয় আবলুস কাঠ।’
এসব প্রভাব গাসসান জাকতানের কবিতাকে আরও পরিণত-মার্জিত করে তোলে; কবিতার বিষয়বস্তুকে করে আরও সুনির্দিষ্ট-মূর্ত এবং অনুভবের কাছাকাছি।
তিন.
এখান থেকেই, ‘বস্তুর বীরত্বগাথা’ কাব্যের মাধ্যমে গাসসানের স্পষ্ট বাঁক প্রতিভাত হয়। ১৯৮২ সালে পিএলওর বৈরুত ছেড়ে যাওয়ার পর, কবি নিজের ও ফিলিস্তিনিদের ক্ষতি ও বিপর্যয় বিষয়ে কবিতা রচনায় আরও পরিপক্ব হয়ে ওঠেন। ‘বস্তুর বীরত্বগাথা’ কাব্যের যে শিরোনাম কবি দিয়েছেন, তা হয়তো তাঁর পাঠকের সেই কবিতাশৈলীতে প্রবেশের একটি প্রান্ত, যা প্রকৃতির উপাদান, যুদ্ধের স্মৃতি, রণাঙ্গনের বীরপুরুষ, পরাজয় ও ক্ষতির জন্য বিলাপ করে। কবি বলেন—
‘আঙুল তুলে দেখায় সে আমাদের…
এই যে, এখান থেকে…
পরক্ষণেই সে বাড়ি ও বিস্ফোরণের ধ্বংসস্তূপে অদৃশ্য হয়
আঙুল রাখে দেয়ালের শূন্যে
আমাদের দেখায়
এই যে, এখান থেকে
এখান থেকে।’
অন্য স্থানে গাসসান বলেন—
‘সবকিছু আগের মতোই আছে
যখন থেকে আমরা যুদ্ধে গিয়েছি
সেই শৈশব থেকে…
সবকিছু আগের মতোই আছে
পাল্টায়নি মোটেও,
শুধু আমরাই
আমরাই ঝাঁপিয়ে পড়েছি যুদ্ধে
ইশকুলের ঘণ্টাধ্বনি শুনে...
এর পর কোনো দিন ফিরে আসিনি…’
এটি তাঁর কবিতাকে প্রকৃতির উপাদান ও বিশ্ববাস্তবতার সঙ্গে দৃঢ়ভাবে যুক্ত করে একটি দৃঢ়, স্বচ্ছ ও গভীর কাব্যিক রূপ দেয়।
চার.
গাসসানের পরবর্তী কাব্যগ্রন্থের বিষয়বস্তুতে প্রথম পর্যায়ের থেকে কিছুটা বিষণ্নতা দেখা যায়। আগে তিনি অন্যদের জীবন ও অভিজ্ঞতার ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন, ব্যক্তির বীরত্বগাথা চিত্রিত করেছিলেন এবং ব্যক্তিজীবনের বাইরের বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে এসে কবি নিজের অভিজ্ঞতার উৎকর্ষ সাধনে সচেষ্ট হন। নিজের গভীরে ডুব দিয়ে আত্মানুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন। একান্ত ব্যক্তিগত অতীতে ফিরতে চেয়েছেন। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সেসব স্মৃতিকে পাঠকের সামনে পরিবেশন করেছেন। এই পর্যায় থেকে জাকতানের কাব্যিক অভিযাত্রা ব্যক্তিগত স্মৃতিকে ঘিরে নতুন মাত্রা পায়। জন্ম, শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলোর কথা তিনি স্মরণ করেছেন।
জন্মের পর থেকে যেসব স্থানে পাড়ি দিয়েছেন এবং যেসব স্থান থেকে বিতাড়িত হয়েছেন, তাঁর সেই জন্মস্থান—বেইত জালা, ১৯৪৮ সালে নাকাবার (ইহুদিদের দ্বারা বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে সেই সময় থেকে ফিলিস্তিনিরা নাকাবা দিবস পালন করে) পর তাঁর পরিবার যেখানে আশ্রয় নিয়েছিল—প্রথমে ফিলিস্তিনের জেরিকো শহরের পাশের শরণার্থীশিবির, এর পর জর্ডানের আল-কারামাহ শরণার্থীশিবির, এর পর দামেস্ক, বৈরুত ও তিউনিসিয়ার দিনগুলোর কথা বিশেষভাবে স্মরণ করেছেন কবিতায়। প্রথম নাকাবার পর থেকে, লাগাতার ছুটে চলা একজন ফিলিস্তিনি মুসাফিরের সংগ্রামের বিভিন্ন দিক ফুটে ওঠে তাঁর কবিতায়। একসময় তা আজকের ধূসর অজানার পথে অবিরাম ছুটতে থাকা বর্তমানের বিন্দুও স্পর্শ করে নেয়। তিনি বলেন—
‘যেন আমিই এটি প্রস্তুত করেছি
এবং আগেও, কোনো এক সময় এই স্থান আমি স্পর্শ করেছি
এবং স্পর্শ করেছি এই প্রতিধ্বনি
যেন সতত দেখছি আমি, ফেলে আসা দিনগুলো…’
এভাবেই কবি ‘আমার কারণে নয়’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতায় ফেলে আসা অতীতের স্মৃতিচারণ করেছেন। এই বিলাপধ্বনিতে পরিবর্তন আসে ‘ভাইদের ডাকে পথচারীরা’ কাব্যগ্রন্থে, যা ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর শোনা সেই প্রতিধ্বনি বাঁক নেয় মৃত্যু উপত্যকা ভ্রমণে, মৃতদেহগুলোর আর্তনাদ পুনরুদ্ধার করতে।
‘ভাইদের ডাকে পথচারীরা’ কাব্যে মৃতদের মধ্যস্থতায় স্মৃতির জগতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হন গাসসান। তিনি লিখেছেন—
‘নরোম খেজুরের শরীর থেকে
বীজ বের করার মতো করে
তারা হৃদয়ের ভাঁজ খুলে
স্মৃতি বের করে।’
…
আঁধারের চাদরে ঢাকা কোনা থেকে
ময়লা সরাতে তারা শুরু করে স্মৃতিযাপন…।’
গাসসান এখানে ক্লান্ত হন। নিঃশেষ হয়ে আসা স্বপ্ন ও ইচ্ছেগুলো আঁকতে শুরু করেন এবার। মৃতদের স্থান-কালকে চিত্রিত করেন। স্মৃতির বিবর্ণ জগৎকে স্মরণ করেন। শুরুর সঙ্গে শেষকে মিলিয়ে নেন। এখানে নির্বাসন ও দেশান্তরের প্রতিধ্বনি শোনা যায় অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীনভাবে। এ কাব্যগ্রন্থের ‘কল্পনার বিবর্তন’ কিংবা ‘ঈষৎ পরিবর্তন’-এর মতো কবিতাগুলো সাধারণভাবে মৃতদের অতীত জীবনের স্মৃতিচারণ জাতীয় কবিতার অন্তর্ভুক্ত। আমরা কবির সঙ্গেই আছি—এমন আবহ এনে তিনি প্রাত্যহিক জীবনের কোলাহলে ডুব দিয়ে এবং মৌলিক ও সর্বজনীন সমস্যাগুলোর পেছনে সময় কাটিয়ে, অতীতের অবহেলা ও বৈষম্যগুলো জানতে পথে পথে ঘোরেন। অতীতের ধূসর স্মৃতি এবং অস্পষ্ট ঘটনায় ফিরে যান তিনি। সেসবকে সাগরসেঁচা মুক্তোর মতো করে তুলে আনেন, এবং ইচ্ছেমতো সাজান কবিতার পরতে পরতে। তাতে তাঁর কবিতার চূড়ান্ত উদ্দেশ্য প্রতিভাত হয়; প্রকাশিত হয় তাঁর কাব্যপ্রতিভার হাড়-মাংস।
পাঁচ.
২০১৯ সালে প্রকাশিত গাসসানের কবিতার বই ‘কথা বলো হে পথিক কথা বলো’-তেও তিনি অতীতের স্মৃতিযাপন অব্যাহত রাখেন। ব্যক্তিগত জীবন, ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর হালচাল এবং আরবদের উত্থান-পতনের আলাপ করেছেন অত্যন্ত নির্মোহভাবে। এ কাব্যগ্রন্থে যে পথিককে সম্বোধন করেছেন তিনি, তা গাসসানের ভিন্ন একটি রূপ। সেই পথিক নিজের পরিচয় হারিয়ে ভবঘুরের মতো ঘুরতে থাকে মরুর বালুকাবেলায়। কবি নিজেকে কাছে ডাকেন এবং জেগে ওঠার আহ্বান জানান। তিনি বলেন—
‘এখানে একটু থামো
হে পথিক
মোটেও জানতে চাইব না কী নাম তোমার
কিংবা কোথায় তোমার গন্তব্য।
শুধু একবার এ মোমের আলোয় বসো
তোমার জন্যই জ্বালিয়েছি তা
তোমার হারানো অতীত স্মরণ করিয়ে দিতে।
কথা বলো, কথা বলো
কথা বলো হে পথিক, কথা বলো
ফিরে পেতে চাই আমি
ধুলোওড়া মরুঝড়ে ছিনতাই হওয়া
আমার দরাজ কণ্ঠস্বর।’
এ গ্রন্থে জেগে ওঠার প্রেরণার পাশাপাশি তাঁর কণ্ঠে হতাশার ছাপও আমরা দেখতে পাই। শেষে এসে পথিক তথা নিজেকে গাসসান এমন এক প্রশ্ন করে বসেন, যার উত্তর সম্ভবত এই পৃথিবীর কারও জানা নেই; কিংবা সবার জানা। তিনি বলেন—
‘কীভাবে তোমাকে পথ দেখাব, হে পথিক?
তোমার গন্তব্য যে অনেক দূরে
এবং তোমার পথ বেশ বন্ধুর!’
আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব চিনুয়া আচেবের জন্ম ১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর নাইজেরিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল ওগিদিতে। তিনি ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকদের একজন। লেখাপড়া শেষে নাইজেরিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনে রেডিও প্রযোজক ও এক্সটারনাল ব্রডকাস্টিংয়ের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
১ দিন আগেবারী সিদ্দিকী সংগীতজীবনের প্রথম দিকে বংশীবাদক হিসেবে পরিচিত পেলেও পরবর্তী সময়ে তিনি একজন লোকসংগীতশিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
২ দিন আগেতিনি ছিলেন একজন আদর্শবান শিক্ষক—অজিতকুমার গুহর এটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়। নিজের জাগতিক উন্নতিকে কখনো বড় করে দেখেননি তিনি। শিক্ষার্থীদের আদর্শ জীবন উপহার দেওয়াই ছিল তাঁর ব্রত। তিনি সক্রিয় ছিলেন ঢাকার প্রগতিশীল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিসরেও। সুবক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতির কমতি ছিল না।
৫ দিন আগেআব্দুল করিম খাঁ ছিলেন হিন্দুস্তানি ধ্রুপদি সংগীতের অন্যতম কিংবদন্তি। কিরানা ঘরানারও তিনি কিংবদন্তি ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত—তিনি গান গাওয়ার সময় এমনভাবে ধ্যানমগ্ন হয়ে যেতেন যে, শ্রোতারাও সেই সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন।
৬ দিন আগে