ইজাজুল হক
[বেইত জালা—জেরুসালেম থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণের ছোট এক শহর। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান বেথলেহেমের বিপরীতে এবং হেরবন রোডের পশ্চিমে হাজার বছরের পুরোনো এক জনপদ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮২৫ মিটার উঁচু বেইত জালার ৮০ শতাংশ বাসিন্দা খ্রিষ্টান; বাকি ২০ শতাংশ মুসলমান। জায়নবাদী ইসরায়েলের দখলদারির আগে এটি ফিলিস্তিনের আল-জাকারিয়া জনপদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর পুরো আল-জাকারিয়াই জনশূন্য হয়ে পড়ে। সেই যুদ্ধে আল-জাকারিয়ার অন্যান্য অংশ ইসরায়েলের হাতে চলে গেলেও সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যক্রমে বেইত জালা চলে আসে জর্ডানের হাতে। পরে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে তা ফের ইসরায়েল দখল করে নেয় এবং ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির পর এই শহরের কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের হাতে ছেড়ে দেয়। তখন থেকে পশ্চিম তীরের অন্য এলাকার মতো বেইত জালাও ইসরায়েলি আধিপত্য ও দখলদারির ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে আজ পর্যন্ত।
১৯৫৩ সালে, এই বেইত জালারই বাসিন্দা কবি খলিল জাকতান ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে কবিতা লিখে আরবদের মধ্য তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ‘ক্ষুধার্তের কণ্ঠস্বর’ নামের সেই কাব্যগ্রন্থকে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ কাব্য বিবেচনা করা হয়। এমন অর্জন নিঃসন্দেহে কবির জীবনের বড় ঘটনা। তবে সেই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের ঠিক এক বছর পর, ১৯৫৪ সালে, কবি খলিল জাকতানের জীবনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে—তাঁর ঘর আলো করে জন্ম নেয় এক ফুটফুটে ছেলে; আজকের পৃথিবী যাঁকে গাসসান জাকতান নামে চেনে। গাসসান আজ ফিলিস্তিনি কবিতার আধুনিকতম বিজ্ঞাপন হয়ে উঠেছেন। দারবিশ-আদোনিসদের ছাড়িয়ে যাওয়া গাসসান এরই মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছেন। কয়েক কিস্তির এ প্রবন্ধে আমরা কবি গাসসান জাকতানের জীবন ও তাঁর কবিতার সুলুক সন্ধানের প্রয়াস চালাব। ]
এক.
গাসসান জাকতানের এক ভবঘুরে-মুসাফিরি জীবন। হতাভাগা ফিলিস্তিনিদের জন্য এমন জীবন এখন আর কারও কাছেই অস্বাভাবিক কিংবা অপ্রত্যাশিত মনে হয় না। যেন এটিই তাদের নিয়তি! অন্য দশজন ফিলিস্তিনির মতো গাসসানও শিবির থেকে শিবিরে, এক অনাহূত অভিশাপের ঘানি টানতে টানতে কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের সোনালি সময়। সেই শৈশবেই, ১৯৬০ সালে, মাত্র ছয় বছর বয়সের নিষ্পাপ গাসসানকে প্রিয় জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করা হয়। জন্মমাটির মায়া ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে তিনি পাড়ি জমান সীমান্তের ওপারে, জর্ডানের আল-কারামাহ শরণার্থীশিবিরে। এক টুকরো মুক্ত আকাশের নিচে মাটির শীতল পাটি ও পাথরের বালিশে মাথা ঠেকানোর জায়গা খুঁজতে তখন ফিলিস্তিনিরা দলে দলে ছুটছে অজানার পথে।
শরণার্থীশিবিরের ধুলোবালি, পাথুরে উপত্যকা ও জয়তুন গাছের সঙ্গে হেসে-খেলে গাসসান পার করেন পরের সাত বছর। এই সময়ে ক্যাম্পের স্কুল থেকে সম্পন্ন করেন প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ। ১৯৬৭ সালে গাসসানের পরিবার আম্মানের রুসেইফায় চলে যায়। ফলে তাঁর মাধ্যমিক শিক্ষাও সেখানে শেষ করতে হয়। এর পর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি জর্ডানের নাউরে পাড়ি জমান এবং রিফিউজি রিলিফ এজেন্সি পরিচালিত টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে ১৯৭৩ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। শরণার্থী জীবন ও ত্রাণের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে তিনি রোজগারের পথ ধরেন। জর্ডানের এক স্কুলে শরীরবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন।
তবে কবিতা ও বিপ্লব যাঁর শিরায় প্রবাহিত, তিনি নিশ্চয়ই জর্ডানের কোনো অখ্যাত বিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে বন্দী থাকতে পছন্দ করবেন না। কবি খলিল জিবরানের স্মৃতিধন্য বৈরুত তখন শিল্পী, সাহিত্যিক ও কবিদের বিকল্প ‘প্যারিস’ হয়ে উঠেছিল। তা ছাড়া বৈরুত তখন ইসরায়েলবিরোধী ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরও প্রধান আশ্রয় হয়ে ওঠে। ফলে কবিদের দলে যুক্ত হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং বিপন্ন ফিলিস্তিনের পক্ষে অস্ত্র ধরার জন্য তরুণ গাসসানের হৃদয় হাহাকার করে ওঠে। তাঁর ভেতরের আন্দোলিত কবিতারা পরিণত হয় ফুটন্ত বারুদে। এক বুক স্বপ্ন, বেদনা ও ক্রোধ সঙ্গে নিয়ে ১৯৭৯ সালে গাসসান ছুটে যান বৈরুতে। নাম লেখান বৈরুতের কবি দলে। যোগ দেন ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যুদ্ধেও।
তখনকার বৈরুতের স্মৃতিচারণ করে সম্প্রতি আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গাসসান বলেন, ‘সত্তরের দশকের শেষের দিকে, আমরা যখন বৈরুতে পৌঁছাই, তখন তা এক উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক মোহনায় পরিণত হয়। এ অঞ্চলের শিল্প-সাহিত্যের সকল স্রোত এখানে এসে মিলিত হতে থাকে—কে আরব, কে কুর্দি কিংবা কে নৈরাজ্যবাদী—সে পার্থক্য করেনি এই শহর। ফলে বৈরুতে সবাই কবি হয়ে ওঠেন—আর এ বৈশিষ্ট্যই শহরটিকে অনন্য করে তোলে। ফিলিস্তিন-লেবাননের জোট, উত্তর সিরিয়ার দিক হয়ে দামেস্ক যাওয়ার উন্মুক্ত করিডোর এবং ইরাকিদের অবাক-করা চরমপন্থার অভিজ্ঞতার স্পর্শে বৈরুত হয়ে ওঠে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার বাস্তব ল্যাবরেটরি।’
বৈরুতের সাহিত্যসমাজ, সেনা ছাউনি, বাংকার ও রণাঙ্গনে তিন বছর কাটানোর পর ১৯৮২ সালে বিপুল অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে গাসসান এই মায়ার শহর ত্যাগ করে দামেস্ক চলে যান এবং সাহিত্য-সাংবাদিকতায় পুরোদমে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
দুই.
কবির ঘরে যাঁর জন্ম, কবিতার মাঝে যাঁর বসবাস এবং পুরো জীবনটাই যাঁর কবিতার উপাদানে ঠাসা, তিনি কবিতা লিখবেন না, তা কী করে হয়? গাসসান বাবার উত্তরাধিকার-চিন্তা, পড়াশোনা ও লড়াই-সংগ্রামের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পুরোদস্তুর কবি হয়ে ওঠেন। তা ছিল ফিলিস্তিনি কবিতার নবজাগরণের সময়। প্রতিরোধ সাহিত্যই তখন গাসসানদের অন্যতম অস্ত্র হয়ে ওঠে। ফিলিস্তিনি গদ্য সাহিত্যিক গাসসান কানাফানির হাতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এ ধাঁচের সাহিত্য তখন বিশ্বজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়। মাহমুদ দারবিশ, সামিহ আল-কাসিম ও তাওফিক আল-জায়াদরা দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কবিতার শব্দে শব্দে তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তখন। জাকতানও তাঁদের পিছু নেন; রচনা করেন নতুন ধাঁচের কবিতা।
বৈরুতে থাকাকালেই, ১৯৭৭ সালে গাসসানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ‘দেশের হালচাল’ নামের সেই কাব্যগ্রন্থ যৌথকাব্য হলেও প্রকাশের পরপরই তাঁর কবিতা সাহিত্যবোদ্ধাদের নজর কাড়ে। ওই বছরই কবিতার জন্য তিনি জর্ডানিয়ান রাইটার্স সোসাইটির কবিতা পুরস্কার পান। দুই বছর পর, ১৯৭৯ সালে তাঁর একক কাব্যগ্রন্থ ‘প্রত্যুষে’ প্রকাশিত হয়। ১৯৮২ সালে তিনি প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) সংস্কৃতি দপ্তর থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা আল-বাদায়ির-এর সম্পাদক নিযুক্ত হন।
১৯৯৩ সালে সম্পাদিত অসলো চুক্তির ফলে নিজের দেশ ফিলিস্তিনের রামাল্লায় ফেরার সুযোগ পান গাসসান। এর আগে সিরিয়া ও তিউনিসিয়ায় কিছুদিন বসবাস করেন। রামাল্লায় ফিরে তিনি ফিলিস্তিনি সাহিত্য সমৃদ্ধ করার মিশন অব্যাহত রাখেন। যুক্ত হন ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। কবিতার পাশাপাশি হাত দেন গদ্যসাহিত্যেও। এরই মধ্যে ফিলিস্তিন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সাহিত্য ও প্রকাশনা বিভাগের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন কিছুকাল।
২০০৩ সালে প্রকাশিত ‘কয়লার আত্মকাহিনি’ কাব্যের মাধ্যমে কবিতায় তাঁর অবস্থান আরও পোক্ত হয়। ২০০০-২০০৪ সালে ফিলিস্তিনের হাউস অব পোয়েট্রি প্রকাশিত আশ-শোআরা পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। হাউস অব পোয়েট্রির পরিচালক হিসেবেও কাজ করেন কিছুকাল। ফিলিস্তিনি দৈনিক আল-আইয়াম-এর সাহিত্য-সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেন। দাতব্য সংস্থা আত-তাআউন-এর সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা এবং মাহমুদ দারবিশ ফাউন্ডেশনের পরিচালনা কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন কবি গাসসান।
তিন.
২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘খড়ের পাখির মতো তা আমার পিছু নেয়’ কাব্যগ্রন্থ তাঁর কবিতা জীবনের গতিপথ ঘুরিয়ে দেয়। ‘লাইক আ স্ট্র বার্ড ইট ফলোস মি: অ্যান্ড আদার পোয়েমস’ নামে বইটির ইংরেজি অনুবাদ করে তাঁকে বৈশ্বিক স্বীকৃতি এনে দেন ফিলিস্তিনি-আমেরিকান কবি ফেদি জওদাহ। ২০১৩ সালে তিনি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত কানাডার শ্রেষ্ঠতম কবিতা পুরস্কার ‘দ্য গ্রিফিন পোয়েট্রি প্রাইজ’-এর আন্তর্জাতিক কবিতা ক্যাটাগরিতে পুরস্কার জেতেন। একই বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের প্রাথমিক তালিকায়ও স্থান পান তিনি। এর পর যুক্তরাষ্ট্রের নোবেলখ্যাত ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিউস্টাড ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর লিটারেচার’-এর জন্যও দুবার মনোনয়ন পান।
এভাবেই, ভাষা ও সীমানার কাঁটাতার পেরিয়ে, বেইত জালা ছেড়ে আসা সেই ছোট্ট গাসসান আজকের পৃথিবীর সব মানুষের কবি হয়ে ওঠেন। তাঁর রচনা অনূদিত হতে থাকে ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান, নরওয়েজীয়, তুর্কি, জার্মানসহ অসংখ্য ভাষায়। আরবি ও ফিলিস্তিনি সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি লাভ করেন ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্টের দেওয়া ‘দ্য ন্যাশনাল মেডেল অব অনার’, ‘মাহমুদ দারবিশ অ্যাক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড’, ‘লেবানিজ পোয়েট আনওয়ার সালমানস পোয়েট্রি অ্যাওয়ার্ড’সহ অসংখ্য সম্মাননা।
এ পর্যন্ত তাঁর ১৩টি কাব্যগ্রন্থ, ৪টি উপন্যাস, ২টি সম্পাদিত কাব্য সংকলন এবং ১টি নাটক প্রকাশিত হয়েছে:
কাব্যগ্রন্থ—‘দেশের হালচাল’ (মুহাম্মদ আজ-জাহিরের সঙ্গে যৌথকাব্য; ১৯৭৭), ‘প্রত্যুষে’ (১৯৭৯), ‘পুরোনো কারণ’ (১৯৮২), ‘পতাকা’ (১৯৮৪), ‘বস্তুর বীরত্বগাথা’ (১৯৮৮), ‘আমার কারণে নয়’ (১৯৯২), ‘পর্বতের আকর্ষণ’ (১৯৯৯), ‘কয়লার আত্মকাহিনি’ (২০০৩), ‘খড়ের পাখির মতো তা আমার পিছু নেয়’ (২০০৮), ‘পথচারীরা ভাইদের ডাকে’ (২০১৫), ‘থেকে যায় যে নীরবতা’ (২০১৭), ‘কথা বলো হে পথিক কথা বলো’ (২০১৯) এবং ‘পাতলা স্যুটপরা কয়েকজন আগন্তুক’ (২০২১)।
উপন্যাস—‘হালকা আকাশ’ (১৯৯৩), ‘অতীতের বিবরণ’ (১৯৯৪), ‘পর্দাবৃত পুরোনো ওয়াগন’ (২০১১) এবং ‘যেখানে মাথা গোঁজে পাখি’ (২০১৫)।
কবিতা সংকলন—‘বর্ণনার পুনর্বিন্যাস’ (১৯৯৮) ও ‘নরকের স্থায়ী অতিথিরা’ (১৯৯৯)।
নাটক—‘উজ্জ্বল আকাশ’ (২০০৫)।
পরের পর্ব পড়ুন আগামীকাল: ফিলিস্তিনি কবি গাসসান জাকতানের কবিতাশৈলী
[বেইত জালা—জেরুসালেম থেকে ১০ কিলোমিটার দক্ষিণের ছোট এক শহর। খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান বেথলেহেমের বিপরীতে এবং হেরবন রোডের পশ্চিমে হাজার বছরের পুরোনো এক জনপদ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮২৫ মিটার উঁচু বেইত জালার ৮০ শতাংশ বাসিন্দা খ্রিষ্টান; বাকি ২০ শতাংশ মুসলমান। জায়নবাদী ইসরায়েলের দখলদারির আগে এটি ফিলিস্তিনের আল-জাকারিয়া জনপদের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৪৮ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর পুরো আল-জাকারিয়াই জনশূন্য হয়ে পড়ে। সেই যুদ্ধে আল-জাকারিয়ার অন্যান্য অংশ ইসরায়েলের হাতে চলে গেলেও সৌভাগ্য কিংবা দুর্ভাগ্যক্রমে বেইত জালা চলে আসে জর্ডানের হাতে। পরে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে তা ফের ইসরায়েল দখল করে নেয় এবং ১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তির পর এই শহরের কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের হাতে ছেড়ে দেয়। তখন থেকে পশ্চিম তীরের অন্য এলাকার মতো বেইত জালাও ইসরায়েলি আধিপত্য ও দখলদারির ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে আজ পর্যন্ত।
১৯৫৩ সালে, এই বেইত জালারই বাসিন্দা কবি খলিল জাকতান ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে কবিতা লিখে আরবদের মধ্য তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করেন। ‘ক্ষুধার্তের কণ্ঠস্বর’ নামের সেই কাব্যগ্রন্থকে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ কাব্য বিবেচনা করা হয়। এমন অর্জন নিঃসন্দেহে কবির জীবনের বড় ঘটনা। তবে সেই কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের ঠিক এক বছর পর, ১৯৫৪ সালে, কবি খলিল জাকতানের জীবনে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে—তাঁর ঘর আলো করে জন্ম নেয় এক ফুটফুটে ছেলে; আজকের পৃথিবী যাঁকে গাসসান জাকতান নামে চেনে। গাসসান আজ ফিলিস্তিনি কবিতার আধুনিকতম বিজ্ঞাপন হয়ে উঠেছেন। দারবিশ-আদোনিসদের ছাড়িয়ে যাওয়া গাসসান এরই মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছেন। কয়েক কিস্তির এ প্রবন্ধে আমরা কবি গাসসান জাকতানের জীবন ও তাঁর কবিতার সুলুক সন্ধানের প্রয়াস চালাব। ]
এক.
গাসসান জাকতানের এক ভবঘুরে-মুসাফিরি জীবন। হতাভাগা ফিলিস্তিনিদের জন্য এমন জীবন এখন আর কারও কাছেই অস্বাভাবিক কিংবা অপ্রত্যাশিত মনে হয় না। যেন এটিই তাদের নিয়তি! অন্য দশজন ফিলিস্তিনির মতো গাসসানও শিবির থেকে শিবিরে, এক অনাহূত অভিশাপের ঘানি টানতে টানতে কাটিয়ে দিয়েছেন জীবনের সোনালি সময়। সেই শৈশবেই, ১৯৬০ সালে, মাত্র ছয় বছর বয়সের নিষ্পাপ গাসসানকে প্রিয় জন্মভূমি থেকে বিতাড়িত করা হয়। জন্মমাটির মায়া ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে তিনি পাড়ি জমান সীমান্তের ওপারে, জর্ডানের আল-কারামাহ শরণার্থীশিবিরে। এক টুকরো মুক্ত আকাশের নিচে মাটির শীতল পাটি ও পাথরের বালিশে মাথা ঠেকানোর জায়গা খুঁজতে তখন ফিলিস্তিনিরা দলে দলে ছুটছে অজানার পথে।
শরণার্থীশিবিরের ধুলোবালি, পাথুরে উপত্যকা ও জয়তুন গাছের সঙ্গে হেসে-খেলে গাসসান পার করেন পরের সাত বছর। এই সময়ে ক্যাম্পের স্কুল থেকে সম্পন্ন করেন প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ। ১৯৬৭ সালে গাসসানের পরিবার আম্মানের রুসেইফায় চলে যায়। ফলে তাঁর মাধ্যমিক শিক্ষাও সেখানে শেষ করতে হয়। এর পর উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি জর্ডানের নাউরে পাড়ি জমান এবং রিফিউজি রিলিফ এজেন্সি পরিচালিত টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে ১৯৭৩ সালে স্নাতক সম্পন্ন করেন। শরণার্থী জীবন ও ত্রাণের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে তিনি রোজগারের পথ ধরেন। জর্ডানের এক স্কুলে শরীরবিদ্যার শিক্ষক হিসেবে দুই বছর দায়িত্ব পালন করেন।
তবে কবিতা ও বিপ্লব যাঁর শিরায় প্রবাহিত, তিনি নিশ্চয়ই জর্ডানের কোনো অখ্যাত বিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে বন্দী থাকতে পছন্দ করবেন না। কবি খলিল জিবরানের স্মৃতিধন্য বৈরুত তখন শিল্পী, সাহিত্যিক ও কবিদের বিকল্প ‘প্যারিস’ হয়ে উঠেছিল। তা ছাড়া বৈরুত তখন ইসরায়েলবিরোধী ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধাদেরও প্রধান আশ্রয় হয়ে ওঠে। ফলে কবিদের দলে যুক্ত হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা এবং বিপন্ন ফিলিস্তিনের পক্ষে অস্ত্র ধরার জন্য তরুণ গাসসানের হৃদয় হাহাকার করে ওঠে। তাঁর ভেতরের আন্দোলিত কবিতারা পরিণত হয় ফুটন্ত বারুদে। এক বুক স্বপ্ন, বেদনা ও ক্রোধ সঙ্গে নিয়ে ১৯৭৯ সালে গাসসান ছুটে যান বৈরুতে। নাম লেখান বৈরুতের কবি দলে। যোগ দেন ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যুদ্ধেও।
তখনকার বৈরুতের স্মৃতিচারণ করে সম্প্রতি আল-জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে গাসসান বলেন, ‘সত্তরের দশকের শেষের দিকে, আমরা যখন বৈরুতে পৌঁছাই, তখন তা এক উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক মোহনায় পরিণত হয়। এ অঞ্চলের শিল্প-সাহিত্যের সকল স্রোত এখানে এসে মিলিত হতে থাকে—কে আরব, কে কুর্দি কিংবা কে নৈরাজ্যবাদী—সে পার্থক্য করেনি এই শহর। ফলে বৈরুতে সবাই কবি হয়ে ওঠেন—আর এ বৈশিষ্ট্যই শহরটিকে অনন্য করে তোলে। ফিলিস্তিন-লেবাননের জোট, উত্তর সিরিয়ার দিক হয়ে দামেস্ক যাওয়ার উন্মুক্ত করিডোর এবং ইরাকিদের অবাক-করা চরমপন্থার অভিজ্ঞতার স্পর্শে বৈরুত হয়ে ওঠে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সৃজনশীলতার বাস্তব ল্যাবরেটরি।’
বৈরুতের সাহিত্যসমাজ, সেনা ছাউনি, বাংকার ও রণাঙ্গনে তিন বছর কাটানোর পর ১৯৮২ সালে বিপুল অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে গাসসান এই মায়ার শহর ত্যাগ করে দামেস্ক চলে যান এবং সাহিত্য-সাংবাদিকতায় পুরোদমে নিজেকে নিয়োজিত করেন।
দুই.
কবির ঘরে যাঁর জন্ম, কবিতার মাঝে যাঁর বসবাস এবং পুরো জীবনটাই যাঁর কবিতার উপাদানে ঠাসা, তিনি কবিতা লিখবেন না, তা কী করে হয়? গাসসান বাবার উত্তরাধিকার-চিন্তা, পড়াশোনা ও লড়াই-সংগ্রামের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পুরোদস্তুর কবি হয়ে ওঠেন। তা ছিল ফিলিস্তিনি কবিতার নবজাগরণের সময়। প্রতিরোধ সাহিত্যই তখন গাসসানদের অন্যতম অস্ত্র হয়ে ওঠে। ফিলিস্তিনি গদ্য সাহিত্যিক গাসসান কানাফানির হাতে প্রতিষ্ঠা পাওয়া এ ধাঁচের সাহিত্য তখন বিশ্বজুড়ে তুমুল জনপ্রিয়। মাহমুদ দারবিশ, সামিহ আল-কাসিম ও তাওফিক আল-জায়াদরা দখলদার ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কবিতার শব্দে শব্দে তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তখন। জাকতানও তাঁদের পিছু নেন; রচনা করেন নতুন ধাঁচের কবিতা।
বৈরুতে থাকাকালেই, ১৯৭৭ সালে গাসসানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। ‘দেশের হালচাল’ নামের সেই কাব্যগ্রন্থ যৌথকাব্য হলেও প্রকাশের পরপরই তাঁর কবিতা সাহিত্যবোদ্ধাদের নজর কাড়ে। ওই বছরই কবিতার জন্য তিনি জর্ডানিয়ান রাইটার্স সোসাইটির কবিতা পুরস্কার পান। দুই বছর পর, ১৯৭৯ সালে তাঁর একক কাব্যগ্রন্থ ‘প্রত্যুষে’ প্রকাশিত হয়। ১৯৮২ সালে তিনি প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) সংস্কৃতি দপ্তর থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা আল-বাদায়ির-এর সম্পাদক নিযুক্ত হন।
১৯৯৩ সালে সম্পাদিত অসলো চুক্তির ফলে নিজের দেশ ফিলিস্তিনের রামাল্লায় ফেরার সুযোগ পান গাসসান। এর আগে সিরিয়া ও তিউনিসিয়ায় কিছুদিন বসবাস করেন। রামাল্লায় ফিরে তিনি ফিলিস্তিনি সাহিত্য সমৃদ্ধ করার মিশন অব্যাহত রাখেন। যুক্ত হন ফিলিস্তিনিদের অধিকার আদায়ের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। কবিতার পাশাপাশি হাত দেন গদ্যসাহিত্যেও। এরই মধ্যে ফিলিস্তিন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সাহিত্য ও প্রকাশনা বিভাগের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন কিছুকাল।
২০০৩ সালে প্রকাশিত ‘কয়লার আত্মকাহিনি’ কাব্যের মাধ্যমে কবিতায় তাঁর অবস্থান আরও পোক্ত হয়। ২০০০-২০০৪ সালে ফিলিস্তিনের হাউস অব পোয়েট্রি প্রকাশিত আশ-শোআরা পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। হাউস অব পোয়েট্রির পরিচালক হিসেবেও কাজ করেন কিছুকাল। ফিলিস্তিনি দৈনিক আল-আইয়াম-এর সাহিত্য-সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেন। দাতব্য সংস্থা আত-তাআউন-এর সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা এবং মাহমুদ দারবিশ ফাউন্ডেশনের পরিচালনা কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন কবি গাসসান।
তিন.
২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘খড়ের পাখির মতো তা আমার পিছু নেয়’ কাব্যগ্রন্থ তাঁর কবিতা জীবনের গতিপথ ঘুরিয়ে দেয়। ‘লাইক আ স্ট্র বার্ড ইট ফলোস মি: অ্যান্ড আদার পোয়েমস’ নামে বইটির ইংরেজি অনুবাদ করে তাঁকে বৈশ্বিক স্বীকৃতি এনে দেন ফিলিস্তিনি-আমেরিকান কবি ফেদি জওদাহ। ২০১৩ সালে তিনি বিশ্বব্যাপী সমাদৃত কানাডার শ্রেষ্ঠতম কবিতা পুরস্কার ‘দ্য গ্রিফিন পোয়েট্রি প্রাইজ’-এর আন্তর্জাতিক কবিতা ক্যাটাগরিতে পুরস্কার জেতেন। একই বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের প্রাথমিক তালিকায়ও স্থান পান তিনি। এর পর যুক্তরাষ্ট্রের নোবেলখ্যাত ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নিউস্টাড ইন্টারন্যাশনাল প্রাইজ ফর লিটারেচার’-এর জন্যও দুবার মনোনয়ন পান।
এভাবেই, ভাষা ও সীমানার কাঁটাতার পেরিয়ে, বেইত জালা ছেড়ে আসা সেই ছোট্ট গাসসান আজকের পৃথিবীর সব মানুষের কবি হয়ে ওঠেন। তাঁর রচনা অনূদিত হতে থাকে ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান, নরওয়েজীয়, তুর্কি, জার্মানসহ অসংখ্য ভাষায়। আরবি ও ফিলিস্তিনি সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি লাভ করেন ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্টের দেওয়া ‘দ্য ন্যাশনাল মেডেল অব অনার’, ‘মাহমুদ দারবিশ অ্যাক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড’, ‘লেবানিজ পোয়েট আনওয়ার সালমানস পোয়েট্রি অ্যাওয়ার্ড’সহ অসংখ্য সম্মাননা।
এ পর্যন্ত তাঁর ১৩টি কাব্যগ্রন্থ, ৪টি উপন্যাস, ২টি সম্পাদিত কাব্য সংকলন এবং ১টি নাটক প্রকাশিত হয়েছে:
কাব্যগ্রন্থ—‘দেশের হালচাল’ (মুহাম্মদ আজ-জাহিরের সঙ্গে যৌথকাব্য; ১৯৭৭), ‘প্রত্যুষে’ (১৯৭৯), ‘পুরোনো কারণ’ (১৯৮২), ‘পতাকা’ (১৯৮৪), ‘বস্তুর বীরত্বগাথা’ (১৯৮৮), ‘আমার কারণে নয়’ (১৯৯২), ‘পর্বতের আকর্ষণ’ (১৯৯৯), ‘কয়লার আত্মকাহিনি’ (২০০৩), ‘খড়ের পাখির মতো তা আমার পিছু নেয়’ (২০০৮), ‘পথচারীরা ভাইদের ডাকে’ (২০১৫), ‘থেকে যায় যে নীরবতা’ (২০১৭), ‘কথা বলো হে পথিক কথা বলো’ (২০১৯) এবং ‘পাতলা স্যুটপরা কয়েকজন আগন্তুক’ (২০২১)।
উপন্যাস—‘হালকা আকাশ’ (১৯৯৩), ‘অতীতের বিবরণ’ (১৯৯৪), ‘পর্দাবৃত পুরোনো ওয়াগন’ (২০১১) এবং ‘যেখানে মাথা গোঁজে পাখি’ (২০১৫)।
কবিতা সংকলন—‘বর্ণনার পুনর্বিন্যাস’ (১৯৯৮) ও ‘নরকের স্থায়ী অতিথিরা’ (১৯৯৯)।
নাটক—‘উজ্জ্বল আকাশ’ (২০০৫)।
পরের পর্ব পড়ুন আগামীকাল: ফিলিস্তিনি কবি গাসসান জাকতানের কবিতাশৈলী
আধুনিক আফ্রিকান সাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব চিনুয়া আচেবের জন্ম ১৯৩০ সালের ১৬ নভেম্বর নাইজেরিয়ার দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল ওগিদিতে। তিনি ইবাদান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্নাতকদের একজন। লেখাপড়া শেষে নাইজেরিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশনে রেডিও প্রযোজক ও এক্সটারনাল ব্রডকাস্টিংয়ের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
১ দিন আগেবারী সিদ্দিকী সংগীতজীবনের প্রথম দিকে বংশীবাদক হিসেবে পরিচিত পেলেও পরবর্তী সময়ে তিনি একজন লোকসংগীতশিল্পী হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন।
২ দিন আগেতিনি ছিলেন একজন আদর্শবান শিক্ষক—অজিতকুমার গুহর এটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়। নিজের জাগতিক উন্নতিকে কখনো বড় করে দেখেননি তিনি। শিক্ষার্থীদের আদর্শ জীবন উপহার দেওয়াই ছিল তাঁর ব্রত। তিনি সক্রিয় ছিলেন ঢাকার প্রগতিশীল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক পরিসরেও। সুবক্তা হিসেবে তাঁর খ্যাতির কমতি ছিল না।
৫ দিন আগেআব্দুল করিম খাঁ ছিলেন হিন্দুস্তানি ধ্রুপদি সংগীতের অন্যতম কিংবদন্তি। কিরানা ঘরানারও তিনি কিংবদন্তি ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত—তিনি গান গাওয়ার সময় এমনভাবে ধ্যানমগ্ন হয়ে যেতেন যে, শ্রোতারাও সেই সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তেন।
৬ দিন আগে